(Bismillah Khan) ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সাধারণত যে যন্ত্রগুলি কোনোকালেই তেমন সম্মানজনক অবস্থান পায়নি, তার মধ্যে অন্যতম হল সানাই। একটা সময়ে মানুষের মনে এই ধারণাই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সানাই মানে যা বাজানো হয় শাদী-বাড়িতে। তথাকথিত মূলস্রোতের শাস্ত্রীয় যন্ত্রগুলির সঙ্গে সানাই যে এক আসনে বসতে পারে, তা কেউ মনেই করতেন না। শাদী-বাড়িতে যাঁরা সানাই বাজাতেন, তাঁদের অধিকার ছিল না অন্যান্য আমন্ত্রিতদের সঙ্গে মেলামেশা করার। সানাই বস্তুত কঠিন একটি বাদ্যযন্ত্র। ফুঁয়ের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে তার সুর। শাদী-বাড়িতে অতিথিদের শব্দে অসুবিধে হতে পারে বলে সানাই বাদকদের স্থান হত দরজার মাথায়, নহবতে।
কিন্তু একদিন জাদু হল। হঠাৎ একজন এসে যন্ত্রটির ভোল পাল্টে দিলেন; সানাইকে দিলেন তার যোগ্য মর্যাদা। তাঁরই কল্যাণে সেতার, সরোদ, বেহালার সঙ্গে এক আসনে জায়গা পেলো সানাই। যিনি এই কাণ্ডটি ঘটালেন, তিনি আর কেউ নন; স্বয়ং বিসমিল্লা খাঁ। রবিশঙ্কর তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘ভগবানদত্ত ওই যে একটা ফুঁ – একটা অন্য স্তর সৃষ্টি করে গেল লোকটা।’
বিসমিল্লা খাঁ-র জন্ম ২১শে মার্চ, ১৯১৬ সালে, বিহারের ডুমরাওঁতে। জন্মকালে তাঁর নাম ছিল কামরুদ্দিন। শোনা যায়, তাঁকে দেখে তাঁর পিতামহ রসুল বকশ খাঁ বলেন, ‘বিসমিল্লা’, যার পর থেকে তাঁর পরিচয় গড়ে ওঠে বিসমিল্লা নামে। বিসমিল্লার পিতা ছিলেন পয়গম্বর বকশ খাঁ, মাতা মিঠঠনবাঈ। ডুমরাওঁরাজের মহারাজা কেশব প্রসাদ সিংহের দরবারে পয়গম্বর বকশ সানাই বাজাতেন। তিন বছর বয়সে বিসমিল্লা খাঁ চলে আসেন বারাণসীতে, পরবর্তীকালে যে জায়গার সঙ্গে তাঁর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর বারাণসী আসা প্রধানত শিক্ষার কারণেই। মামা, আলী বকশ কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিসমিল্লাও তাঁর রেওয়াজ করতেন ওই মন্দিরে বসেই। তাঁর প্রথম আসরে বাজানোও মামার হাত ধরেই।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে মামার সঙ্গে তিনি বাজাতে যান এলাহাবাদ মিউজিক কনফারেন্সে। একুশ বছর বয়সে ১৯৩৭ সালে কলকাতার অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে বাজানোর পর বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি, এবং অচিরেই বেরিয়ে পড়েন বিশ্বজয়ের পথে। এলাহাবাদ দিয়ে শুরু। ধীরে ধীরে তাঁর প্রচার ছড়িয়ে পরে সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা, চায়না, এমনকি আফ্রিকাতেও।
সদা হাস্যময় এই মানুষটিকে সবাই ভালোবাসতেন। তিনিও মানুষকে কিছু কম ভালোবাসতেন না। এর বৃহত্তম প্রমাণ, তিনি অকপটে, প্রকাশ্যে ধর্মের নিরিখে ভেদাভেদের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, সকলেরই ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক পক্ষ অন্য পক্ষের রাস্তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। অথচ, সা রে গা মা পা ধা নি, এই সাত স্বর পৃথিবীর কারুর মতেই আট হতে পারে না। (Bismillah Khan)
তিনি নিজে ছিলেন পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়া মুসলমান, অথচ তাঁর রেওয়াজের জায়গা ছিল কাশী বিশ্বনাথের মন্দির, অধিকাংশ অনুষ্ঠানেই তিনি গাইতেন ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’– খেয়াল রাখতেন না কোনও বিশেষ ধর্মীয় রীতির কথা। সঙ্গীতই ছিল তাঁর ধর্ম। এ প্রসঙ্গে আমজাদ আলি খাঁ বলেন, তাঁর কোনও একটি অনুষ্ঠানে বিসমিল্লা খাঁ উপস্থিত ছিলেন। তাঁর নমাজ পড়ার সময় হয়ে গেলেও তিনি নবীন আমজাদের বাজনা ছেড়ে ওঠেননি। পরে আমজাদ আলি খাঁকে বলেন, তিনি নিজেকে বসিয়ে রাখেন এই কথা বলে, ‘সঙ্গীত তো প্রার্থনাই।’ (Bismillah Khan)
ভিডিও: পণ্ডিত যশরাজ— আধুনিক ভারতের তানসেন
সিনেদুনিয়াতেও বিসমিল্লা খাঁর বিচরণ নেহাতই কম ছিল না। বিজয় রেড্ডির কন্নড় ছবি, ‘সনাদি আপ্পান্না’তে রাজকুমারের চরিত্রের জন্য তিনি সানাই বাজান। বিজয় ভাটের ‘গুঞ্জ উঠি সেহনাই’তেও তাঁর অসামান্য সানাই-বাদন শুনি আমরা। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গীত-নির্ভর ছবি, ‘জলসাঘরে’ আমরা তাঁকে পর্দাতেও দেখি। পর্দাতে আবারও দেখি যখন গৌতম ঘোষ তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র বানান ‘মিটিং আ মাইলস্টোন’ নামে। (Bismillah Khan)
বিসমিল্লা খাঁর মৃত্যু হয় নব্বই বছর বয়সে, ২১শে আগস্ট, ২০০৬ সালে। তাঁর দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল, ইন্ডিয়া গেটের সামনে বাজানো। তা পূরণ হয়নি। যদিও তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও আশা রেখেছিলেন, প্রাণের বিনিময়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে তিনি একবার বাজাবেন। প্রয়াণের পর তাঁর বিশ্রামস্থান হয় পুরোনো বারাণসীর ফতেমান কবরস্থানে ভারত সেনার একুশটি গান-স্যালুটের সঙ্গে। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী একটি সানাইও তাঁর সঙ্গে সেখানে রেখে দেওয়া হয়। (Bismillah Khan)
বিসমিল্লা খাঁ সারাজীবনে সম্মান কুড়িয়েছিলেন প্রচুর। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৫৬ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার। ১৯৬১ সালে তাঁকে ভারত সরকার পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে, এবং ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ ও ১৯৮০ সালে পদ্মবিভূষণ উপাধিতে। ২০০১ সালে ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত হন। রবিশঙ্কর ও এম.এস.শুভলক্ষ্মী ছাড়া তিনিই একমাত্র ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী, যিনি ভারতরত্ন পান। (Bismillah Khan)
আজ তাঁর জন্মদিনে বাংলালাইভের শ্রদ্ধার্ঘ্য… (Bismillah Khan)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।