(Motherland)
‘মাতৃভূমি’ আসলে কী? যে আলো-হাওয়ার মধ্যে জন্ম নিয়েছিলাম, যে ধুলোর মধ্যে, পথের মধ্যে, নদীর ধারে, চেনা মাঠের মধ্যে সকাল-দুপুর হয়ে ছুটে বেড়াত আমাদের শিশুবয়স, সেটুকুই কি কেবল আমাদের মাতৃভূমি? (Motherland)
অবৈধ বলে কিছু নেই: অভিরূপ মুখোপাধ্যায়
মা মানে, জন্ম। মা মানে, দান। মাতৃভূমি অর্থাৎ আমার মায়ের ভূমি! যে-ভূমিতে আমি জন্মেছি! এখানে ‘ভূমি’ কথাটির অর্থটির দিকে আরও গভীরে নেমে তাকালে দেখতে পাব, এক জন্মপাত্র সেখানে ভাসমান রয়েছে। যার নাম জরায়ু। এই পাত্রেই, একদিন আমার মা আমাকে ধারণ করেছিলেন। সেই মাতৃগর্ভ-ও তো আমার মাতৃভূমি! এমন এক আদিদেশ, যেখানে আমার প্রাণের জেগে-ওঠা ও তাকে ঘিরে আমার মা— এছাড়া আর কেউ নেই! (Motherland)
…এতদিন ধরে ছিল সে আমার শবের রক্ষক।
আজ তার ছুটি হল। এ-দুর্গে থাকে না কেউ, তবু এর পাথুরে দেওয়ালে
মশাল অর্ধেক গাঁথা। লম্বা ছায়া দুলে যায় লোহার টেবিল।
এজন্যই বোধহয় ‘মা’ শব্দটির মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আমরা অনুভব করি এক দয়াময়ী আশ্রয়কে। ঘরকে। কারণ, আমাদের অবচেতন ‘মা’র কাছে গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকেই এক সুরক্ষিত ও গোপন আশ্রয়বাসের ধারণা পেয়ে এসেছে! ‘শবের রক্ষক’ নামের একটি কবিতায় জয় গোস্বামী লিখেছিলেন:
…এতদিন ধরে ছিল সে আমার শবের রক্ষক।
আজ তার ছুটি হল। এ-দুর্গে থাকে না কেউ, তবু এর পাথুরে দেওয়ালে
মশাল অর্ধেক গাঁথা। লম্বা ছায়া দুলে যায় লোহার টেবিল। পোড়ানো
মাটির পাত্রে পড়ে আছে শুকনো খেজুর। তোমরা কি ফিরে এলে? বলো,
বলো মৃতগণ, বলো এ-দুর্গের জন্য কী এনেছ তোমরা প্রত্যেকে? —‘আমি
সাগরের থেকে নুন।’ —‘আমি দূর দ্বীপ থেকে এনেছি প্রাচীন ফল।’— ‘আমি
তেল।’ —‘আমি হাড়।’ — ‘আর আমি মশলা ও পানীয়।’— তবে তুই? হাড়ের
মুকুট পরা মেয়ে, তুই কিছু আনিসনি? —‘আমার জরায়ু আমি মাথায় কলস
করে আনলাম, এ-দুর্গের সমস্ত মৃতকে আবার জন্মাতে দেব বলে।’

আমি লক্ষ করতে অনুরোধ করব শেষ দুটি লাইনের দিকে, ‘হাড়ের/মুকুট পরা মেয়ে, তুই কিছু আনিসনি? —‘আমার জরায়ু আমি মাথায় কলস/করে আনলাম, এ-দুর্গের সমস্ত মৃতকে আবার জন্মাতে দেব বলে।’ মৃতদের দুর্গ। সেখানে একজন নারী তাঁর জরায়ুকে মাথায় কলস করে নিয়ে এসেছেন, সেই সমস্ত মৃতকে পুনরায় জন্ম দেবেন বলে। দৃশ্যটি আরও একবার ভাবা যাক! নিজের জরায়ু, নিজেরই মাথার ওপর সজ্জিত, কলসরূপে। যখনই এ-লাইনগুলি পড়ি, এক আশ্চর্য শৃঙ্গারময়ী নারীকে দেখতে পাই, যে জন্মদাত্রী হয়ে উঠতে চায় এক রহস্যময় কর্তব্যে। অথচ সে নারী তো জন্ম দেওয়ার কথা বলছে? বলছে জরায়ুর কথা? সেখানে শৃঙ্গার আসে কী করে? আসলে সমস্ত প্রেমে— কামেও জেগে থাকে এক অপূর্ব মাতৃত্ব। (Motherland)
সামাজিকভাবে ‘মা’ কথাটির মধ্যে যে আলংকারিক শ্রদ্ধাবিধি আমরা চাপিয়ে রেখেছি, প্রাকৃতিকভাবে মনের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় সেসবের তো কোনও স্থান নেই!
সামাজিকভাবে ‘মা’ কথাটির মধ্যে যে আলংকারিক শ্রদ্ধাবিধি আমরা চাপিয়ে রেখেছি, প্রাকৃতিকভাবে মনের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় সেসবের তো কোনও স্থান নেই! (Motherland)
জয় গোস্বামীর এই কবিতাটি প্রধানত দৃশ্য নির্ভর। ‘প্রত্নজীব’, ‘আলেয়া হ্রদ’ লেখার সময়পর্বে কবিতাটি লিখেছিলেন জয়, যা তাঁর ‘কবিতাসংগ্রহ’ প্রথম খণ্ডের ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ অংশে খুঁজে পাওয়া যায়। এই কবিতাটি থেকে আরও পেছনে যেতে চাইব এবার। ১৯৫৬ সালে ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘জরাসন্ধ’ কবিতাটি। শক্তি লিখেছিলেন:
আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।
যে-মুখ অন্ধকারের মতো শীতল, চোখ দুটি রিক্ত হ্রদের মতো কৃপণ করুণ, তাকে
তোর মায়ের হাতে ছুঁয়ে ফিরিয়ে নিতে বলি। এ-মাঠ আর নয়, ধানের নাড়ায়
বিঁধে কাতর হল পা। সেবন্নে শাকের শরীর মাড়িয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমাকে
তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।
পচা ধানের গন্ধ, শ্যাওলার গন্ধ, ডুবো জলে তেচোখা মাছের আঁশ গন্ধ সব
আমার অন্ধকার অনুভবের ঘরে সারি সারি তোর ভাঁড়ারের নুন মশলার পাত্র
হল, মা। আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না, তখন
তোর জরায় ভর করে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি। আমি কখনও অনঙ্গ
অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না।
কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র। তুই তোর জরার হাতে কঠিন
বাঁধন দিস। অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে
নামলে সমুদ্র সরে যাবে শীতল সরে যাবে মৃত্যু সরে যাবে।
তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে। অন্ধকার আছি, অন্ধকার
থাকব, বা অন্ধকার হব।
আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।।

কয়েকটি কথা আগে এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন। সকলেই জানেন, জরাসন্ধ ছিলেন এক প্রবল প্রতাপসম্পন্ন রাজা ও যোদ্ধা। জরাসন্ধের বাবা রাজা বৃহদ্রথের বিবাহ হয়েছিল কাশীরাজের দুই রাজকুমারীর সঙ্গে। দুই রানির থেকে বৃহদ্রথ অর্ধ-অর্ধ সন্তান লাভ করেন। এ-অবস্থায় বৃহদ্রথ ক্রধিত হয়ে দুই রানির সেই অর্ধ-খণ্ড সন্তানকে বনে ফেলে আসার নির্দেশ দেন। সেই বনে ছিল জরা নামের এক রাক্ষসী। সেই রাক্ষসী, দুই খণ্ড-অংশকে যুক্ত করে মনুষ্যরূপ দেয়। আমরা জানি, ‘সন্ধ’ মানে যুক্ত করা। আর, এও পূর্বে বলেছি সেই রাক্ষসীর নাম ছিল জরা। ফলে, একত্রে সে-সন্তানটির নাম হয় জরাসন্ধ। (Motherland)
‘জরাসন্ধ’-তে এক সন্তান কথা বলছে তার মায়ের সঙ্গে। বলছে, নিজের গর্ভের ভেতর তাকে পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়ার কথা! ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।’
এবার আমরা ফিরে তাকাব কবিতাটির দিকে। জয় গোস্বামীর ‘শবের রক্ষক’-এ আমরা দেখতে পেয়েছিলাম একজন নারী তার জরায়ু মাথায় কলসি করে নিয়ে এসেছে, মৃতদের আবার জন্ম দেবে বলে। আর, ‘জরাসন্ধ’-তে এক সন্তান কথা বলছে তার মায়ের সঙ্গে। বলছে, নিজের গর্ভের ভেতর তাকে পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়ার কথা! ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।’ (Motherland)
কেন বলছে এমন কথা? কবিতাটি জানায়: ‘আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে/নামলে সমুদ্র সরে যাবে শীতল সরে যাবে মৃত্যু সরে যাবে।’ জীবনকে যখন অস্পৃশ্য মনে হয়, বেঁচে থাকাকে মনে হয় ঘৃণাসমতুল, তখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকেই মনে হয় জাগ্রত মৃত্যু। এমন অনুভব বিভিন্ন সময়ে অনেকেরই হয়েছে নিশ্চয়ই। জরাসন্ধ তাই তার মা-কে বলছে: ‘মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে’। (Motherland)
এই হল কবিত্ব! জরাসন্ধ, তার নিজেকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা শুধুমাত্র তার মা জরাকেই বলছে না, মায়ের জরায়ুকেও বলছে!
কিন্তু এখানে আশ্চর্য কী জানেন? শক্তি লিখছেন: ‘আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না, তখন
তোর জরায় ভর করে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি’। জরা, জরাসন্ধের মায়ের নাম। এখানে নিজের মায়ের সঙ্গেই জরাসন্ধ কথা বলছে। বলছে, তাকে গর্ভে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। এসবই আমরা জানি। কিন্তু ‘জরায় ভর করে’ এই লাইনটিতে এসে শক্তি ‘জরায়’ শব্দটি থেকে জরায়ুর প্রতিচ্ছবিকে যেন এক মুহূর্তের জন্য সামনে আনতে চাইলেন! এই হল কবিত্ব! জরাসন্ধ, তার নিজেকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা শুধুমাত্র তার মা জরাকেই বলছে না, মায়ের জরায়ুকেও বলছে! (Motherland)
রংয়ের কবিতাগুচ্ছ: অভিরূপ মুখোপাধ্যায়
একদিকে নিজের অভিশপ্ত জীবন ও অন্যদিকে মায়ের গর্ভপাত্রের দিকে ফিরে তাকানো, এই চিন্তা আমাকে মনে করিয়ে দেয় ৪৫৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এসকাইলাসের লেখা ‘ইউমেনেডাইস’-এর এই বাক্য: ‘Here me, oh brooding night, my mother, from whose womb I came for punishment.’ বারংবার নিজের শাস্তিভাগ্যের ওপরদিকে দাঁড়িয়ে থাকা শান্তিময় মাতৃগর্ভের দিকে ফিরতে চাওয়া যাঁদের একান্ত নিয়তি, তাঁরা নিশ্চয় জানেন এসকাইলাসের লেখা বাক্যটির অর্থ কত সুদূর! শক্তি-র একাধিক কবিতায় মায়ের কথা খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু জীবনের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ্য’-র এই কবিতাটির মধ্যেকার অন্ধকার স্নায়ু তেমনভাবে খুব কমই দেখতে পেয়েছি। (Motherland)

অবশ্য একেবারে যে পাইনি তা তো নয়। ‘কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছ’ বইয়ের ‘রক্ত পড়ে’ নামক কবিতায় স্বল্পভাবে হলেও খুঁজে পেয়েছিলাম সেই একটি ডার্কনেস। শক্তি লিখেছিলেন: ‘জননীর কাঠের ভিতরে/রক্ত পড়ে’। এখানে ‘কাঠ’ শব্দটিকে শক্তি ব্যবহার করেছিলেন শরীরের সমার্থক হিসেবে। শরীর পুড়ে ছাই হয়। কাঠ-ও তাই। সেই কাঠের ভেতর রক্ত। মানে প্রাণ। কোথাও একটা জন্মের চিহ্ন যেন দেখা যায় এখানে। (Motherland)
বালির স্বভাবে ঝরে গেছে
মায়ের শরীর
ওই কাঠামোর মধ্যে একদিন অজ্ঞান ছিলাম?
‘কাঠ’ কথাটি এসে পড়ল বলে মনে পড়ছে কাঠামো-র কথা। শরীরী কাঠামো। এই সূত্রে আরেকটি কবিতার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাইব। কবিতাটি লিখেছেন আমাদের সময়ের একজন কবি, তুষার বিশ্বাস। কবিতাটি এমন:
টাইম কলের জল আসামাত্র
বালতি ভরতে ছুটে যায় আমাদের মা
বাড়িতে তো নদী নেই, তবু কেন
সে-মুহূর্তে মায়ের দু-পাশে
আমি দেখি, নদী আর গ্রাম!
দেখি আর ভাবি—
নদী থেকে জল তুলছে
চেনা কোনও মেয়ে?
বালির স্বভাবে ঝরে গেছে
মায়ের শরীর
ওই কাঠামোর মধ্যে একদিন অজ্ঞান ছিলাম?
এখানেও একজন সন্তান। এখানেও, একজন মা। এতক্ষণ যে-কবিতাগুলি নিয়ে কথা বললাম, তার থেকে কিছু-বা পরিচিত পরিবেশের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এই কবিতাটি। টাইম কলে জল এলেই দৌড়ে যায় মা। জল ভরে। ভরতে থাকে। আর তখন তার সন্তানের মনে হয়, মায়ের দুপাশে শুধু নদী আর গ্রাম। তার মা যেন তারই অপরিচিত কোনও মেয়ে, যে নদী থেকে জল তুলতে এসেছে। (Motherland)
সেই আদিজন্মপাত্র। মাতৃগর্ভ। আমাদের সকলের সঙ্গে জেগে আছে সেই নির্জন নিঃস্বার্থ মাতৃভূমির আশ্রয় ও শান্তি!
এই পর্যন্ত আমার পরিচিত আয়ত্তের মধ্যে থাকে। কিন্তু লেখাটির শেষ তিনটি লাইন সেই পরিচিতিকে ভেঙে বেরিয়ে যায়। ‘বালির স্বভাবে ঝরে গেছে/মায়ের শরীর/ওই কাঠামোর মধ্যে একদিন অজ্ঞান ছিলাম?’ মধ্যবয়সে পৌঁছতে-পৌঁছতে ভেঙে গেছে মায়ের শরীর। মা যখন জল ভরছে, সেই ভগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে সন্তানের কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে, ‘ওই কাঠামোর মধ্যে একদিন অজ্ঞান ছিলাম?’ (Motherland)
সেই আদিজন্মপাত্র। মাতৃগর্ভ। আমাদের সকলের সঙ্গে জেগে আছে সেই নির্জন নিঃস্বার্থ মাতৃভূমির আশ্রয় ও শান্তি!
ছবি সৌজন্য- ক্যানভা ডট কম-এর কপিরাইট ফ্রি ছবি
অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৯৩ সালে, নদিয়ার কৃষ্ণনগগরে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্বভারতী থেকে এম.ফিল। বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি-র গবেষণা-প্রকল্পে যুক্ত। ২০২০ সালের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে অভিরূপের প্রথম কবিতার বই ‘এই মন রঙের কৌতুক’, সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে।