(Bengali Novel)
চারমাস কেটে গেছে।
রোদের উত্তাপ কমেছে সামান্য, রাতের দিকে হাওয়াতে মৃদু শিরশিরানি। আজ সকাল সকালই পৌঁছে গেছেন সোমদত্তা। রান্নাঘরের মাটিতে মাদুর পেতে বসে মলয়ের ঠাকুরদা,বাবা, মা, কাকা, কাকিমা, ভাইয়েরা, পিসি, পিসতুতো বোন, মামা- কে নেই! একটু আগে নিজের ল্যাপটপে ঠাকুমার পান্তাভাতের এপিসোডটা দেখলেন। এপিসোডের ভিউ তিরিশ হাজারের ওপর। আজ চারপাশে উৎসব উৎসব ভাব। সবাই হৈ-চৈ করছে, সবার মুখে হাসি। সোমদত্তার সম্মানে আজ ইলিশ উৎসব।ইলিশের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, ভাজা, সর্ষে ভাপা ইলিশ, চালতার চাটনি, রসগোল্লা কিছু বাদ যায়নি। বহুকাল বাদে এরকম রাজকীয় খাওয়া খেয়ে সোমদত্তার স্যালাড, দই, বেকড ফিশ খাওয়া হজমশক্তি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। ঠাকুমা ঝুঁকে সোমদত্তার হাত ধরে একটু টানলেন। (Bengali Novel)
ওটা খেয়ে নিজের বোতল থেকে এক চুমুক জল খেয়ে একটু স্বস্তি পেলেন। সকাল থেকে ভীষণ কম জল খেয়ে আছেন, বাথরুম যাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই, অথচ অনেকখানি সময়।
‘মুখটা কাঁচুমাচু কেন?’
‘বড্ড খেয়ে ফেলেছি! এত ইলিশ মাছ, অভ্যেস নেই তো।’ হাসিমুখ ঠাকুমাকে বললেন ফিসফিস করে।
‘কিছু হবে না।’ তিনি একমুখ হেসে নিজের পানের বাটা থেকে জোয়ান দিয়ে বললেন-
‘খেয়ে নাও। এর মধ্যে লেবু মেশানো আছে।’
ওটা খেয়ে নিজের বোতল থেকে এক চুমুক জল খেয়ে একটু স্বস্তি পেলেন। সকাল থেকে ভীষণ কম জল খেয়ে আছেন, বাথরুম যাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই, অথচ অনেকখানি সময়।
মলয়ের বাবা, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন-
‘বিয়ের সময়টা নিয়ে কিছু ভাবলেন?’ (Bengali Novel)

মলয়ের বাবা সুবোধের মুখে ভালোমানুষি আর সম্ভ্রম মেশানো হাসি, তিনি মুখ খোলার আগেই সোমদত্তা হাতটা একটু তুলে বললেন –
‘আগে বলুন সোনালীকে আপনাদের সবাইয়ের কেমন লাগল? তবে ও যে আপনাদের বাড়িতে একদম মানিয়ে যাবে সে কথা আমি আগেই বুঝেছি।’ (Bengali Novel)
এক মুহূর্তের মধ্যে মলয়ের মা শিবানী চকিত দৃষ্টিতে তাকালেন মলয়ের দিকে। খুব সূক্ষ্ম একটা তরঙ্গ খেলে গেল সোমদত্তার মনে। শিবানী জানেন। লালীর কথা। মলয় তার মাকে বলেছে। তিনি আড়চোখেও মলয়ের কালো হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকালেন না। লালীর কথাটা তিনি প্রথম থেকেই জানতেন। লালীকে তার ছবিতেই অপছন্দ হয়েছিল-চুলে স্টেপ কাট, রং, প্লাক করা ভুরু, এক হাতে বড় বড় রং করা নখ, ক্যাপ্রি প্যান্ট, টকটকে লিপস্টিক, সিনেমা, মল, ফুচকা, সিরিয়ালময় জীবনের জন্য বুভুক্ষ মরীয়া ভাব- এসব দিয়ে চলবে না। লালীকে তার স্ক্রিপ্টে মানাবে না। লালীর কথা জানার পর থেকেই তিনি একটি অল্পবয়সী মেয়ের খোঁজ করছিলেন যাকে মলয়ের বৌ হিসাবে ওই পরিবারে মানায়। (Bengali Novel)
শ্যামলা রং, রোগা,একমাথা কোঁকড়ানো চুল, ঢলঢলে মুখে প্রাণচঞ্চল ছেলেমানুষী, আদরে মানুষ কিন্তু ঘরের কাজকর্ম জানে, এখনও সরল-এখনও বাইরের জগৎ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।
তিনি মলয়ের এবং আশেপাশের গ্রাম থেকে খোঁজ করার জন্য লোক লাগিয়ে ছিলেন। তারপর পাঁচ ছটি মেয়ের মধ্যে সোনালীকে তার টিম পছন্দ করেছে, বয়স বেশ কম। শ্যামলা রং, রোগা,একমাথা কোঁকড়ানো চুল, ঢলঢলে মুখে প্রাণচঞ্চল ছেলেমানুষী, আদরে মানুষ কিন্তু ঘরের কাজকর্ম জানে, এখনও সরল-এখনও বাইরের জগৎ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। সোনালী ওর বাবা বাসুদেবের দ্বিতীয় সন্তান, পরে আর একটি মেয়ে আছে, তিনি প্রস্তাবটি গিলে নিয়েছেন। (Bengali Novel)
তাদের দিক থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, মলয়কে তিনি যখন সোনালীর কথাটা বলেছিলেন, তাকে ডেকেছিলেন নিউটাউনের মিটিউবের ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ব্রাঞ্চের অফিসের কাছে একটি ফাইভস্টার হোটেলের রেস্টুরেন্টে। মলয় দৃশ্যতঃ অস্বস্তিতে। এরকম কোনও হোটেলে ঢোকার কথা তার চিন্তার বাইরে। সে জড়োসড়ো হয়ে বসে পায়ের সস্তা, পুরোনো স্নিকার জোড়া লুকোনোর চেষ্টা করছে। যা তিনি আশা করছিলেন। তাঁর সামনে ল্যাপটপ খোলা। তিনি মলয়ের দিকে বিশেষ দৃকপাত করেননি। (Bengali Novel)
কফি অর্ডার করেছেন, অন্য কি করবে বুঝতে না পেরে মলয়ও কফিই চাইল। কফি দিয়ে গেল।তিনি একটা ইমেইল লিখে চলেছেন, কফি তখনও মুখে তোলেননি। না তাকিয়েও বোঝে মলয়, তাই কী করবে বুঝতে না পেরে একবার কফির দিকে হাত বাড়িয়ে সে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তার আত্মবিশ্বাস তলানিতে।
সোনালীর ছবি সমেত ল্যাপটপটা ওর দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। (Bengali Novel)
‘দেখতো কেমন লাগছে ওকে?’
একটু অবাক হলেও মলয় দেখল তারপর বলল-
‘ভালই তো।’
‘আরে সময় নিয়ে ভাল করে দেখো? তোমার ভাবী বৌ।’
হঠাৎ করে একদম জমে গেল মলয়। মুখটাই পুরো প্রশ্নচিহ্ন
‘তোমার ভাবী বৌ।’ কেটে কেটে বললেন সোমদত্তা। ‘মানে আগামী ফাল্গুন মাস নাগাদ তোমার এই সোনালী পালের সাথে বিয়ে।’ কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা। মলয় মুখ খোলার আগেই সোমদত্তা বললেন-
‘অবশ্যই তোমার গুরুজনরা দিন স্থির করবেন।’
এবার সোমদত্তা একটু চুপ করে গেলেন। আজ তাঁর পরণে একটা মোছা মোছা শ্লেট রঙের টপ, ফর্মাল স্কার্ট, গলায় স্কার্ফ, চুলটা শক্ত করে বাঁধা। সম্পূর্ণ পেশাদার এক্সিকিউটিভ।
মলয়ের মুখ লাল।
‘আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। আমি তো এখন বিয়ে… কে ঠিক করেছে বিয়ে? আমি…’
এবার সোমদত্তা একটু চুপ করে গেলেন। আজ তাঁর পরণে একটা মোছা মোছা শ্লেট রঙের টপ, ফর্মাল স্কার্ট, গলায় স্কার্ফ, চুলটা শক্ত করে বাঁধা। সম্পূর্ণ পেশাদার এক্সিকিউটিভ। উনি ল্যাপটপটা বন্ধ করে, চেয়ার টেবিলের কাছে টেনে সোজা হয়ে বসলেন।‘মলয় আমি লালীর কথা জানি। তুমি না বললেও।আমার রিসার্চ করা হয়ে গেছে।’
মলয় মুখ খোলার আগেই,তাকে হাত তুলে থামতে বললেন। (Bengali Novel)
‘আগে আমার পুরো কথাটা শোনো। তোমার পরিবার একটা রোজকার লাইফ ভ্লগ করার জন্য তৈরি। একমাত্র অভাব, একটি অল্পবয়সী মেয়ে। তোমার বৌ। সে আনবে… কী যেন বলে? হুম, লাবণ্য। শুধু ভাল রান্নাই ডেইলি ভ্লগের সাকসেস বাড়ায় না! তার জন্য পারিবারিক সম্পর্ক, তারপর তোমাদের মতো পরিবার যেখানে মাল্টি জেনারেশন একসাথে থাকে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক এসব খুব ম্যাটার করে। দর্শকরা এসব খুব পছন্দ করে। কমন সেন্স তাই বলে না মলয়? আমাদের রিসার্চও।’
একটু দম নিলেন। (Bengali Novel)

‘ভেবে দ্যাখো তোমার মা, কাকীমা, ঠাকুমার সাথে ওই ঘরে রান্না করবে তোমার বৌ, তিন জেনারেশন একসাথে। বাগান থেকে সবজি তুলবে। তোমার বাবা কাকার আদরের বৌমা। ভাই-বোনদের সাথে বৌদির খুনসুটি। সবাইকে নিয়ে, সবার আদরের মানুষ। কী সুন্দর একটা পরিবার।’ (Bengali Novel)
এরপর তিনি ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কালো কফিতে একটা দীর্ঘ চুমুক দিলেন, অবিকৃত মুখে।
মলয় স্তব্ধ। (Bengali Novel)
‘সোনালীকে তো দেখলে, কী সুন্দর ঘরোয়া, স্নিগ্ধ, সরল। তোমাদের ডেইলি ভ্লগের মূল আকর্ষণ হবে, ভিউ বাড়বে চড়চড় করে। এবার ভেবে দেখো মলয়, তোমার এই জার্নিতে লালী কীভাবে ফিট করবে। লালীকে তো তুমি আমার থেকে অনেক ভালো চেনো।’ (Bengali Novel)
সেদিনের মতো আজও মলয় বোধহীন, নিষ্কম্প। আজও আবার মলয়ের মাথার মধ্যে বিদ্যুত্স্ফুরণ হচ্ছে। ‘কীভাবে জানে এত কিছু? কীভাবে?’ মলয় বর্তমানে ফিরে এল।
সেদিনের মতো আজও মলয় বোধহীন, নিষ্কম্প।
আজও আবার মলয়ের মাথার মধ্যে বিদ্যুত্স্ফুরণ হচ্ছে।
‘কীভাবে জানে এত কিছু? কীভাবে?’ মলয় বর্তমানে ফিরে এল।
মলয়ের কাকা বলে উঠলেন
‘মেয়ে আমাদের দিব্যি লেগেছে। পাল্টি ঘর, পাশের গ্রাম, আর সবচেয়ে বড় আপনার মতো মানুষ সম্বন্ধ এনেছেন।’
‘তাহলে আর কী? ফাল্গুনে দিন দেখুন? কি ঠাকুমা খুশি, নাতবৌ আসবে ঘরে?’
ঠাকুমা পান খাওয়া দাগ ধরা এবড়ো খেবড়ো দাঁতে হেসে উঠলেন। ঘরে মলয়ের কাকীমা, কাকা, খুড়তোতো ভাই, পিসিরা একসাথে কথা বলছে। (Bengali Novel)
‘হাসলে হবে? আশীর্বাদের দিন দেখুন একটা?’
মলয় আস্তে আস্তে উঠে বাইরের দাওয়ায় চলে গেল। না তাকিয়েও বুঝতে পারলেন তিনি।
(ক্রমশ)
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় বস্টন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মূলতঃ ছোট গল্প এবং আর্টিকেল লেখেন। ছোট গল্প সংকলন ক্যালাইডোস্কোপ এবং অপরাজিতা প্রকাশিত হয়েছে, কমলিনী,দেজ পাবলিকেশন থেকে।একটি ছোট গল্পের অনুবাদ শর্টলিস্টেড হয়েছে, ‘Armory Square Prize for women writers in South Asian literature’ এ। অনুদিত গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত Words Without Borders এর পাতায় ।আনন্দবাজারের বিদেশ পাতার নিয়মিত লেখেন তাছাড়া রোববার-সংবাদ প্রতিদিন, বাংলা লাইভ, গুরুচণ্ডালী এবং আরো কিছু ম্যাগাজিনে গল্প এবং ছোট বড় প্রবন্ধ নিয়মিত লেখেন।