(Little Magazine)
“Write as you will
In whatever style you like…”
‘তরুণ কবি’দের উদ্দেশ্যে লেখা নিকানোর পাররার এই পঙক্তি দুটি বাস্তবেই বিপথে চালিত করতে পারে যেকোনো নতুন লিখতে আসা কবিকে, কেননা কবিতাটির শেষ পঙক্তি, যেটা আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (শুধু এই কবিতাটির নয় হয়তো সারা পৃথিবীর কবিতাবলি থেকে বেছে নেওয়া যেতে পারে কোনো কবির করা মহার্ঘ্য অমোঘ এক উক্তি হিসেবে) তো সেটাই যদি লক্ষ না করে কেউ! কী আছে সেখানে?- কবি বলছেন, তোমাকে খালি পৃষ্ঠাকে ইম্প্রভ করতে হবে। অর্থাৎ একটা সাদা শূন্য পৃষ্ঠার চেয়ে যেন গভীর হয় তোমার লেখা। যেকোনো চিন্তা যেকোনো সূত্র থেকেই আমরা লিখতে শুরু করতে পারি, যেভাবে খুশি লিখতে পারি যেকোনো গুরুবাদী নির্দেশকে উড়িয়ে দিয়ে আমরা তো লিখতে চাই। প্রতিটি দেশকালে বারবার এটা ঘটেছে। আর তরুণ কবিরাই সবার আগে ছিঁড়ে ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন প্রচলিত ধারার জগদ্দল পাথর সরিয়ে- এই নয় যে কেবল এটাই নির্দিষ্ট এটাই একমাত্র পথ! (Little Magazine)
নতুন কবিতা কি নিজের খেয়ালখুশি লেখা কবিতা? না, ঐ যে পাররা সাবধান করতে ভোলেননি, একটা বর্ণও নেই যে শূন্য পৃষ্ঠায়, তাকে উন্নত অর্থাৎ গভীর অর্থময় করে তোলার দায়িত্ব কবির।
কবিতাকে হতেই হবে “revolution of Ideas’, যদি তা না হয়, যদি কবিতা লিখতে এসে এতদিন ধরে যা-সব চিবিয়ে আসছি অতীতের ছন্দোবদ্ধ গীতিময় কাব্যিক সব কবিতা, যা পৌনঃপুনিকতায় আমাদের বৈচিত্রহীন জীবন ও জীবনের আশপাশকে নিপুণ কৌশলে ধরে রেখেছে কেবল, তারই উত্তরাধিকার বহন করবার নামে যদি আরো ভুলভুলাইয়ার ভেতরে নিয়ে যাই আমারও কবিতাকে তবে সে-কবিতা নতুন কবিতা নয়। নতুন কবিতা কি নিজের খেয়ালখুশি লেখা কবিতা? না, ঐ যে পাররা সাবধান করতে ভোলেননি, একটা বর্ণও নেই যে শূন্য পৃষ্ঠায়, তাকে উন্নত অর্থাৎ গভীর অর্থময় করে তোলার দায়িত্ব কবির। শূন্যতার চেয়ে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিই হয়তো কবিতা রচনার প্রধান শর্ত। (Little Magazine)
আরও পড়ুন: ‘জলটুঙ্গি পত্রিকার পেটার হাকে সংখ্যা নিয়ে দু’চার কথা: পত্রিকা সম্পাদকের কলমে
২
কীভাবে অর্থপূর্ণ বা কাদের কাছে কেন অর্থপূর্ণ? যা লেখা হচ্ছে তা যে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার বিচারই বা হবে কোন মূল্যে? এখানে কবির এবং সংশ্লিষ্ট পাঠকের দাঁড়াবার জায়গা ও চিন্তার ধরন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সংকট এবং ঘনীভূত সংকটের থেকে বেরিয়ে কবি পাঠকেরা যখন আরো গভীরতর সংকটের মধ্যে চলে আসেন; যখন নিরিবিলি অধ্যাত্মবোধের চেয়ে গুরুতর হয়ে ওঠে প্রখর রাজনৈতিক বোধ, তখন কবিতার অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠার প্রকৃতিটাই কি বদলে যায় না? অবশ্যই এমন উদাহরণও দেওয়া যায় যে, সংকটকালেও রাষ্ট্রীয় কোনো চেতনা ছাড়াই কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতিকে আশ্রয় করেও কত গভীর কবিতা রচিত হয়েছে, হয়ে চলেছে। এখানে আলোচনাটা আরো বড়ো হয়ে পড়তে চায়। সমস্যাটা কেবল আর তরুণ কবির সমস্যা হয়ে থাকে না। যুগে যুগে সময়ের নানা বাঁকে কবিতা কীভাবে বদলে নিচ্ছে তার ধরন, সেটাও খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। (Little Magazine)
ধরুন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখে ফেলা কবিদের কবিতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেশভাগ দাঙ্গার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থাকা কবিদের কবিতা, দেশ থেকে নির্বাসিত কবির কবিতা। তাঁরা তো কবিতাই লিখেছেন, এখানেই মিল তাঁদের কিন্তু তাঁরা কি একইভাবে সময়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন নাকি সমকালকে এড়িয়ে নিভৃতে থেকে মানুষের শাশ্বত ক্রন্দনকে লিখবার চেষ্টা করেছেন? পাঠকও তো একটা সময়কে চিহ্নিত করতে চান নাকি তাঁরও এই দ্বন্দু যে, ব্যক্তি মানুষ না নির্যাতিত বহু মানুষ? তখন কি পাঠকের মধ্যেও বিভাজন তৈরি হয়ে যায়। তাঁদের চিন্তা চেতনা অনুসারে শিবির ভাগ করে নিতে থাকেন? তবে পুরো বিষয়টা আরো গুলিয়ে ওঠে- কোনো পাঠকের চেশোয়াভ মিউশের কবিতা পড়ে মনে হয় যদি যে এ সাদা পৃষ্ঠার চেয়ে উন্নত নয়! কিংবা হোলুবের কবিতায় যিনি এই অমানবিক রিক্ত পৃথিবীটাকে খুঁজে পান, তিনি যদি ট্রান্সট্রোমারের কবিতায় তা না পান? কে কোন কবিতায় নিজেকে খুঁজে পাবেন তার ওপরই তো নির্ভর করবে সাদা পৃষ্ঠার চেয়ে কবিতার গভীর হয়ে ওঠার বিষয়টি।
(Little Magazine)
ব্রেখট হেরবের্টদের কবিতায় যে পাঠক এই দুঃসহ সময়টাকে জ্যান্ত দেখতে পান, তাঁরা রিলকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন।
রিলকে জীবনানন্দ মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা একজন পাঠক কিন্তু পাররার কবিতাকে অস্বীকার করতেই পারেন। আবার উল্টোটাও ঘটতে পারে, ব্রেখট হেরবের্টদের কবিতায় যে পাঠক এই দুঃসহ সময়টাকে জ্যান্ত দেখতে পান, তাঁরা রিলকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। রিলকে বা ট্রান্সট্রোমারের কবিতার উদাহরণ এখানে টানা যেতে পারে।
মনে করুন রিলকের ‘The Blindman’s Song’ কবিতাটি-
I alone
live and suffer and howl.
In me there is an endless outcry
and I can’t tell what’s crying, whether it’s my broken heart or my bowels.”
কিংবা ট্রান্সট্রোমারের এই পঙক্তিগুলি-
“A man feels the world with his work like a glove.
He rests for a while at midday having laid aside the gloves on the shelf.”
(‘Open and Closed Spaces’)
দেখুন দুটি কবিতায় কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি কোন গভীর স্তরে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। ব্যক্তি মানুষের ভেতরে যে অশেষ ক্রন্দন বুক ভাঙা আর্তনাদ অথচ তা ব্যক্ত করা যায় না, সেই একার চিৎকারই তো লিখতে চেয়েছেন কবি। আবার দ্বিতীয়টিতে একজন মানুষ দস্তানার মতো পৃথিবীকে ছুঁয়ে থাকে তার কাজের ভেতর দিয়ে। কিন্তু এমন অনুভূতি তা যতই গভীরতাকে ছুঁয়ে থাকুক, তা একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতিনির্ভর। দেশকাল, হত্যা, নিপীড়নের সঙ্গে এই অনুভূতির কোনো যোগ তৈরি হয় না। (Little Magazine)
অথচ এঁদের কবিতার অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠা নিয়ে কারো মনে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল- যদি অন্যভাবে পৃথিবীটাকে দেখা হয়? যদি রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ বা ‘সংগত ঘৃণা’ই কবিতার ভেতরে ঢুকে আসতে চায়? তখন পাঠক যদি সেই প্লাটফর্মে গিয়ে না দাঁড়ান তখন তাঁর কাছে সেইসব কবিতা অর্থপূর্ণ মনে নাও হতে পারে। মনে হতে পারে কবিতা নয়, বরং এ তিরের ফলার মতো কিছু পঙক্তি মাত্র। আমার বক্তব্য বোঝাতে উদাহরণ দেব ট্রান্সট্রোমারের প্রায় সমসাময়িক আরেকজন কবির। অন্য দুজনের মতো ইনিও বিশ শতকের যাবতীয় অত্যাচার অনাচারের সাক্ষী। (Little Magazine)
I want to be buried
with a sackful of nuts
and brand new teeth.
Whenever a crunching sound
is heard where I lie
it can be assumed
it’s him,
still him.
(‘Provision For The Journey’)
যে লোকটা জীবনের অনেকটা সময় জুড়ে স্বৈরতন্ত্রকে আক্রমণ শানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় পীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, সেই লোকটা মৃত্যুর পরেও মাটির নিচ থেকে গরগর করেই চলেছে।
(Little Magazine)
গু্যুন্টার গ্রাসের এই কবিতাটি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের অনুবাদে পড়ি আসুন:
এক বস্তা বাদাম
আর আমার বাঁধানো নতুন দাঁতের পাটি নিয়ে
আমায় যেন গোর দেওয়া হয়।
যেখানটায় শুয়ে থাকব
কুড়মুড় মড়মড় শব্দ উঠলেই
অনুমান করা যাবে;
এই সে-ই,
এখনও সেই লোকটাই।
(‘পথের টিফিন’)
এই কবিতায় কোনো আচ্ছন্নতা বা ভাবাবেগ তৈরির প্রয়াস নেই। আছে সপাটে উচ্চারণ। যে লোকটা জীবনের অনেকটা সময় জুড়ে স্বৈরতন্ত্রকে আক্রমণ শানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় পীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, সেই লোকটা মৃত্যুর পরেও মাটির নিচ থেকে গরগর করেই চলেছে।
এই কবিতা তখনই অর্থময় হয়ে উঠবে যখন পাঠক তৈরি থাকবেন কবিতার ভিন্ন ধরনকে স্বীকৃতি দিতে। নিশ্চয়ই একই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রান্সট্রোমার ও
এনৎসেনসবারগারের কবিতা পড়া যায় না।
(Little Magazine)
‘মধ্যবিত্তের বিষাদগীতি’ কবিতায় ভয়ানক এক ঠাট্টার ছলে কবি এএনৎসেনসবারগার মধ্যবিত্তের বয়ানে লেখেন, আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, আমাদের কোনো অতীত নেই, যুদ্ধও ঘোষণা হয়নি, সাইরেনগুলো চুপচাপ। এখানে শব্দের ভেতর খুঁড়ে অর্থে পৌঁছোনো যাবে না, যদি না পাঠকের রাজনৈতিক চেতনা থাকে, সমকালের মানুষের যন্ত্রণা হতাশা এবং সেই প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্তের ভীরু সুখীসুখী জীবনের বিড়ম্বনা বিষয়ে ধারণা না থাকে। (Little Magazine)
“…We eat the past.
We have nothing to conceal.
We have nothing to miss.
We have nothing to say.
…
We are not complaining.
What are we waiting for?”
(Little Magazine)
পৃথিবীর যেকোনো সংকটকালে সে বিশ্বযুদ্ধ দেশভাগ দাঙ্গার মতো ভয়াবহ সময়েও এই যাবতীয় বিক্ষোভ বিপ্লবকে এড়িয়ে শান্ত গভীর অনুভূতির কবিতা লেখা হয়েছে।
৩
ধারাবাহিক ভাবে যদি সারা পৃথিবীর কবিতা পড়তে থাকি, তবে এ ধারণা স্বাভাবিক ভাবেই জন্মাবে যে, কত ভাষায় কত কত ধরনেই না কবিরা তাঁদের সময়ের কথাগুলো বলেছেন। যেখানে কবি ধ্যানের মতো শান্ত গভীর দৃষ্টি দিয়ে জগৎকে দেখেছেন সেখানেও দূরাগত ধ্বনির মতো ক্ষীণ হলেও সময় উপস্থিত, আবার কোথাও সময় তার রক্তারক্তি বিক্ষোভ ঘৃণাসমেত এসে উপস্থিত। প্রশ্ন ওঠে, পাঠকও কি যে-যার রুচিমতো এখানে বিভক্ত হয়ে পড়বেন? একইভাবে সমস্ত পাঠকই তো আর কবিতার ভেতর ভাঙচুর রক্তক্ষরণ দেখতে চান না। এমন উদাহরণ তো দেওয়া অসম্ভব নয় যে, পৃথিবীর যেকোনো সংকটকালে সে বিশ্বযুদ্ধ দেশভাগ দাঙ্গার মতো ভয়াবহ সময়েও এই যাবতীয় বিক্ষোভ বিপ্লবকে এড়িয়ে শান্ত গভীর অনুভূতির কবিতা লেখা হয়েছে। সে তো হতেই পারে। আবার সংকটকালে ‘কী হবে কবিতা’ বলে নিদারুণ চিৎকারও করেছেন কেউ কেউ। (Little Magazine)
এর মানে দাঁড়ায়-যাই ঘটুক, যতবড় ক্রাইসিস আসুক, কবিতা তাকে এড়িয়ে না গিয়ে তাকেই কবিতার মাঝখানে স্থান দিতে পারে। কবিতাই তখন হয়ে উঠতে পারে সময়ের স্বীকারোক্তি। কবিতার পঙক্তি তখন হয়ে উঠতে বাধ্য তিরের ফলার মতো তীক্ষ্ণ, যা সরাসরি পাঠককে আহত করে। আর বিপত্তি দেখা দেয় তখনই। শান্ত শুদ্ধ নিরুপদ্রব কবিতা লিখতে পড়তে ভালোবাসেন যাঁরা, তাঁদের মনে হতেই পারে- এখানে কবিতা কোথায়। কেননা কবিতায় ভারতী খোঁজার প্রকৃতিটাই তখন প্রশ্নের মুখে পড়ে- সমাধির ভেতরে শুয়েও কুড়মুড় শব্দ করার মধ্যে কবিতা আছে নাকি “I felt the deadmell reading my thoughts better than I could.” এখানে কবিতা আছে কিংবা ভিন্ন ধরনের হলেও দুটিই দুভাবে সময়কে মানুষের অনুভবকে ধরতে পেরেছে- তার বিচার কঠিন হয়ে পড়ে। আসুন না একটু পড়ে বিচার করে দেখি ইরাকের নির্বাসিত কবি আদনান আল-শায়েখের ‘Passage to Exile’ কবিতাটি কবিতা হয়ে উঠেছে কিনা-
“পা তুলে পথচারীদের দেখাব স্কুলের বেত্রাঘাতের দাগ, জেলের বেড়ির দাগ,
আমার পকেটে যা আছে তা পাসপোর্ট নয়
তা এক অত্যাচারের ইতিহাস
যেখানে পঞ্চাশ বছর আমাদের কপালে জুটেছে কেবল পশুর আহার
আর বক্তৃতার পর বক্তৃতা
নিজের হাতে বানিয়ে নেওয়া চুরুট
ফাঁসিকাঠের সামনে গেলে
নিজেদেরই ঝুলন্ত শব দেখতে পাই
আর প্রেসিডেন্টের জন্য জোরে জোরে করতালি দিতে থাকি..
যেখানে নিজের মাতৃভূমি শুরু হয় প্রেসিডেন্টের ভাষণ দিয়ে এবং শেষও হয় প্রেসিডেন্টের ভাষণ দিয়ে
আর মাঝখানে থাকে
প্রেসিডেন্টের পথ, প্রেসিডেন্টের সঙ্গীত, প্রেসিডেন্টের জাদুঘর, প্রেসিডেন্টের সংবাদপত্র, প্রেসিডেন্টের আস্তাবল, প্রেসিডেন্টের মেঘ, প্রেসিডেন্টের বুট-ক্যাম্প, প্রেসিডেন্টের মূর্তি, প্রেসিডেন্টের স্কুল, প্রেসিডেন্টের জলবায়ু, প্রেসিডেন্টের আদেশাবলি…”
(অনুবাদ- শ্রী পর্যটক)
(Little Magazine)
পাঠক, এই কবিতার ভেতর দিয়ে কি দেখা যাচ্ছে না নিজের দেশেই নির্যাতিত এবং নির্বাসিত একজন কবির অসহায় ক্ষোভ? একজন নির্বাসিতের ভাষা তবে কেমন হবে? মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর দেশ থেকে দেশে লুকিয়ে বেড়াতে হবে যাঁকে, হয়তো অন্যদেশের কোনো নারী তাঁর আর্দ্র চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করবে একদিন- “তুমি কোন দেশ থেকে আসছ?” কবিতা আর কী তবে, যদি তা নির্বাসিতের পীড়িতের ভাষায় কথা বলে উঠতে না পারে। যদি না সে ক্ষোভের ঘৃণার ভাষাকে ধারণ করতে পারে।
এখানেও কিন্তু পরম্পরা ও মূল স্রোতের আধিপত্যের সুর ধরা পড়ছে, যেন নতুন ঢঙে যিনি লিখতে চাইছেন, তাঁকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে, যেন তাঁর কবিতা পড়ে কারুর মনে না হয়, সাদা পৃষ্ঠা নষ্ট হল।
(Little Magazine)
8
আমরা আবার শুরুর আলোচনাতে ফিরে আসি- সাদা পৃষ্ঠাকে ইম্প্রভ করা। খেয়াল করতে হবে, এই যে সাদা পৃষ্ঠার চেয়ে গভীর হতে হবে আমার লেখাকে, এই প্রসঙ্গ তখনই উঠছে, যখন আমি ভাঙচুর চালাতে যাচ্ছি। নতুনভাবে কিছু লিখতে চাইছি। এখানেও কিন্তু পরম্পরা ও মূল স্রোতের আধিপত্যের সুর ধরা পড়ছে, যেন নতুন ঢঙে যিনি লিখতে চাইছেন, তাঁকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে, যেন তাঁর কবিতা পড়ে কারুর মনে না হয়, সাদা পৃষ্ঠা নষ্ট হল। তাহোক, এই করেই তো পৃথিবীর কত কত নদী দিয়ে কত জল বয়ে গেল কিন্তু মনোভাব বদলাল না এতদিনেও। অথচ শত শত বছর ধরে কতভাবেই না কবিতা রচিত হয়ে চলেছে। আমরা তার কতটুকুই বা খবর রাখতে পারি। অথচ নিদান দিতে এক পায়ে খাড়া। (Little Magazine)
(Little Magazine) ওপরে জান্টার গ্রাস এনৎসেনসবারগারদের উদাহরণ দিয়েছি এজন্যই যে, আমাদের পাঠকের পাঠপ্রস্তুতি যদি ঠিকঠাক না থাকে তো এঁদের কবিতাকেও সাদা পৃষ্ঠার চেয়ে উন্নত মনে নাও হতে পারে। কেননা অধিকাংশ পাঠকেরই থাকে নির্দিষ্ট ধারার এক চিন্তনক্ষমতা ও গোঁড়ামি আর সেইমতোই তিনি কবিতার বিচার করতে থাকেন। তাঁর জায়গা থেকে সরে দাঁড়িয়ে অন্য ধরনের অন্য ভঙ্গির কবিতাকে তিনি বিচার করতে অক্ষম হন। এতে কী হয় নিরাপদ কবিতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। পাঠকের কথা ভেবেই কবি, এমনকি নতুন কবিরাও ‘অনুমোদিত স্বাধীনতার গণ্ডির বাইরে’ আসতে চান না। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সাহিত্যের মুক্তি আসে না, এক বদ্ধ জলায় আটকে যেতে থাকে আমাদের লেখালেখি। মনে পড়ছে ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসের ‘রচনাপাঠের সঙ্কেত’ অংশে লেখা দেবেশ রায়ের কথাগুলি:
“উপন্যাস সত্যি করেই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে চাইবে না কেন? তার অনুমোদিত স্বাধীনতার গণ্ডির বাইরে উপন্যাস চলে আসতে চাইবে না কেন? উপন্যাস তার ব্যবহারযোগ্যতার বাধ্যতা তছনছ করে দিতে চাইবে না কেন?… উপন্যাসকে যারা নিরাপদ করে ফেলেছে তাদের প্রতি বশ্যতা থেকে উপন্যাস মুক্তি পাক-“। (Little Magazine)
আসুন পাঠক, আমরাও আরেকটু মুক্ত হই, নিজেদের জায়গা থেকে একটু সরে দাঁড়াই, ভিন্নভাবে জীবনকে দেখতে শিখি।
আমার এই ছোট প্রবন্ধটি যাঁরা পড়ছেন তাঁদের অনুরোধ এখানে উপন্যাস শব্দটির জায়গায় কবিতা শব্দ বসিয়ে পড়ুন। ভাবুন, কী বলতে চাইছেন উনি। আসুন পাঠক, আমরাও আরেকটু মুক্ত হই, নিজেদের জায়গা থেকে একটু সরে দাঁড়াই, ভিন্নভাবে জীবনকে দেখতে শিখি। বিপজ্জনক সময়ে এসে যাঁরা যেকোনো নিরাপদ পথকে ভেঙে বিপজ্জনক কবিতা লিখতে চাইছেন, তাঁদের চিহ্নিত করি। নাহলে আমরা কীসের জন্য অপেক্ষা করছি আর?
(Little Magazine)
(Little Magazine)
(বানান অপরিবর্তিত)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।