ত্রিপুরাসুন্দরী, রবিঠাকুর এবং…
(Tripura Travelogue) ডিসেম্বরে ত্রিপুরার জলবায়ু অত্যন্ত মনোরম। কলকাতার মতোই। এক সকালে আমাদের গন্তব্য ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে মায়ের বাড়ি। স্থানীয় ভাষায় মাতাবাড়ি। মানে সেই মা, যার নামে এ রাজ্যের নাম ত্রিপুরা। এটি ভারতবর্ষের অন্যতম শক্তিপীঠ এবং পীঠনির্ণয়তন্ত্র অনুসারে ৫১ সতীপীঠের পঞ্চদশ পীঠ হল ত্রিপুরায়।
“ত্রিপুরায়াং দক্ষপাদো দেবী ত্রিপুরসুন্দরী ভৈরবস্ত্রিপুরেশ সর্বাভীষ্টপ্রদায়কঃ॥”
ত্রিপুরায় দেবীর দক্ষিণ চরণ পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম ত্রিপুরসুন্দরী বা ত্রিপুরেশ্বরী। তাঁর ভৈরব ত্রিপুরেশ। পীঠনির্ণয়তন্ত্র অনুযায়ী এই তথ্য স্বীকৃত হলেও, ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গলে ভিন্ন মত পোষণ করে লিখেছেন,
“দক্ষিণচরণখানি পড়ে ত্রিপুরায় নল নামে ভৈরব ত্রিপুরা দেবী তায়॥”
অর্থাৎ ভারতচন্দ্রের বর্ণনায় দেবী ‘ত্রিপুরা’র ডান পা এখানে পড়লেও তাঁর ভৈরব হলেন নল। উদয়পুরের ত্রিপুরসুন্দরী মন্দিরের আলোচনায় পীঠনির্ণয়ের মূল পাণ্ডুলিপির মধ্যেই বর্ণনার ভিন্নতা। একটিতে রয়েছে ‘দেবতা ত্রিপুরা মাতা’।
আগের পর্ব পড়ুন: ত্রিপুরার ৭ কাহন – [১], [২], [৩]
তবে সে যাই হোক, সনাতন ধর্মে দেবী নিরাকার আদ্যাশক্তি পার্বতীর সাকার দশটি বিশেষ রূপের সমষ্টিগত নাম দশমহাবিদ্যা। দক্ষযজ্ঞের সময় মহাশক্তিস্বরূপা দাক্ষায়ণী সতী তাঁর দশটি রূপ দেখিয়েছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। সর্বগুণবতী এবং সর্ব অর্থে সততার প্রতিমা দক্ষকন্যা ভগবতী সতীর এই দশটি রূপের ভয়ানকতা দেখে শিব যেদিকে পালাতে গেলেন, দেবী সেইদিকেই আবির্ভূতা হলেন। এইভাবে দশ দিকে আবির্ভূতা দেবীর ভিন্ন ভিন্ন রূপ দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত। সেই দশ রূপের কোনোটি ভয়াল, কোনোটি স্নিগ্ধ। তবে প্রতিটি রূপই তাৎপর্যপূর্ণ, সর্বগুণাণ্বিতা, তত্ত্বজ্ঞানময়ী।
‘এত রক্ত কেন?’-রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষির এই প্রশ্নটির সঙ্গে প্রায় সব বাঙালিই পরিচিত। যে মাতৃমন্দিরের রক্তস্রোত দেখে বিশ্বকবি এই কাতর প্রশ্নটি চরিত্রের মুখ দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন, সেই মাতৃমন্দিরে হাজির হওয়ার আগে আবারও ঝালিয়ে নিলাম হাসি ও তাতার সেই গল্প।
দশমহাবিদ্যার চতুর্থ রূপ ষোড়শীই হলেন ত্রিপুরাসুন্দরী বা ত্রিপুরেশ্বরী। প্রধানত কালীকে কেন্দ্র করেই এই দশমহাবিদ্যা। তাই কালীমূর্তির ভিন্ন তত্ত্বজ্ঞান সম্পন্ন রূপ এই ত্রিপুরাসুন্দরী। তারা রূপ ত্যাগ করে মহাদেবের সামনে দেবী আবির্ভূতা হলেন ষোড়শী রূপে। দুর্গার অন্য রূপ শতাক্ষীর দেহ হতে আবির্ভূতা এই ষোড়শীর অপর নাম স্ত্রী বিদ্যা, ত্রিপুরাসুন্দরী, রাজ রাজেশ্বরী।
ত্রিপুর শব্দের অর্থ বলা হয়েছে যিনি ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষম্নাতে অথবা মন, চিত্ত ও বুদ্ধিতে অবস্থিত। দেবীর চার হাত, গায়ের রং জবাকুসুমের মতো (ভোরের সূর্যের মতো), হাতে নানাবিধ অস্ত্র। মহাদেবের নাভি পদ্মের উপর দেবী আসীন। নীচে দেবগণ স্তব করছেন। শঙ্করাচার্য কর্তৃক এই দেবী পূজিতা হয়েছিলেন ললিতা রূপে। ললিতা সহস্রনাম ও সৌন্দর্যলহরী স্তোত্রে ত্রিপুরসুন্দরীরূপী পার্বতীর রূপ বর্ণনা করেছেন আদি শঙ্করাচার্য। ত্রিপুরসুন্দরী অষ্টকম্ স্তোত্রে ত্রিপুরসুন্দরীকে বিশ্বজননী বলা হয়েছে, যার মধ্যে কালীর শক্তি এবং দুর্গার সৌন্দর্য ও মহত্ব একই সঙ্গে বর্ণিত। (Tripura Travelogue)

সত্বগুণী, অসম্ভব সুন্দরী এই দেবী ত্রিপুরা। কালিকাপুরাণ অনুসারে ত্রিকোণাং মণ্ডলাং অর্থাৎ ত্রিপুরা সুন্দরীর যন্ত্রে আঁকা হয় ত্রিকোণ। জ্যামিতিক রেখায় ত্রিরেখায় তার প্রকাশ, ত্রক্ষ্য হল বীজ মন্ত্র। ত্রিবিধ শক্তি…ইচ্ছা, জ্ঞান ও ক্রিয়ার আধার তিনি। কালীতত্ত্বের সঙ্গে তার কোনও তফাৎ নেই।
মাঘমাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় ললিতা জয়ন্তী। মা ললিতাকে উৎসর্গ করে এইদিন ব্রত পালন করে থাকেন ভক্তরা।
বাংলার চালা স্টাইলে নির্মিত সব মন্দির। সেই মন্দিরময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পথ চলি আমরা। এখানেই নিত্য পুজো হত তবে রাজবাড়ির কুল দেবতার? অলিগলি এঁকেবেঁকে নিয়ে চলে রাজবাড়ির প্রধান ফটকে। এই কি সেই শাক্ত রাজা যিনি মায়ের পুজোয় বলিদান করতেন? এই কি সেই রাজা যিনি ঋষি হয়ে উঠেছিলেন আর বলি প্রথা সমূলে বন্ধ করেছিলেন?
সফরসঙ্গী মৌসুমীর সঙ্গে এবার রবিঠাকুরের রাজর্ষি, বিসর্জন খুলে হাতেনাতে, ছত্রে ছত্রে ত্রিপুরার রাজারাজড়ার গল্পময়তায় আবিষ্ট হই। মৌসুমী বলে ওঠে এক, আমি বলি আরেক… এভাবেই আমরা চলি উদয়পুরের সব্বোমাটি মাড়িয়ে।
‘এত রক্ত কেন?’-রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষির এই প্রশ্নটির সঙ্গে প্রায় সব বাঙালিই পরিচিত। যে মাতৃমন্দিরের রক্তস্রোত দেখে বিশ্বকবি এই কাতর প্রশ্নটি চরিত্রের মুখ দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন, সেই মাতৃমন্দিরে হাজির হওয়ার আগে আবারও ঝালিয়ে নিলাম হাসি ও তাতার সেই গল্প। (Tripura Travelogue)

১৫০১ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা ধন্যমাণিক্য প্রতিষ্ঠা করেন ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দিরটি। মাতাবাড়ি নামেই ডাকে সবাই মায়ের এই থানকে। কচ্ছপ আকৃতির এক অনুচ্চ টিলার উপরে অবস্থান এই মন্দিরের। আটচালা আকৃতির লালরঙা মন্দিরটির শীর্ষে রয়েছে স্তূপ, আর তারও উপরে রয়েছে কলস। কথিত আছে, সতীর ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পড়েছিল এখানে। কষ্ঠিপাথরের মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী মূলত কালীমূর্ত। (Tripura Travelogue)
ধন্যমাণিক্যর পরবর্তীকালে রাজা কল্যাণমাণিক্য মন্দিরের পিছনে একটি দিঘি খনন করান, যা তাঁর নামেই কল্যাণসাগর নামে আজও বিদ্যমান। দিঘি খননের সময় মাটির ভিতর থেকে আরও একটি ছোটো মাতৃমূর্তি পাওয়া যায় যেটি রাজা কল্যাণমাণিক্য এই মন্দিরেই প্রতিষ্ঠা করেন ত্রিপুরাসুন্দরীর মূর্তির পাশেই, যিনি ‘ছোটো মা’ রূপে পূজিতা। মন্দিরের সামনে রয়েছে বড় এক নাটমন্দির। আর পিছনে সেই কল্যাণসাগর নামের টলটলে দিঘি, যেখানে অগণিত মাছ ও কচ্ছপের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বিভিন্ন পুজো-পার্বণে বলিপ্রথাও চালু আছে এখানে। কল্যাণসাগরের সামনে গিয়ে কুন্ডের জল মাথায় ছোঁয়ালাম। এখানে ডালা কিনে পুজো দেওয়া হল, তবে পাণ্ডাদের সাহায্য ছাড়াই দর্শন হল। (Tripura Travelogue)

এবার ভুবনেশ্বরী মন্দির। গোমতী নদী বয়ে চলত এককালে এর ভিতর দিয়েই। এখন মজে গেছে শহরায়নের দৌলতে। আর রাজাদের আবাস বলে এই স্থানের নাম রাজনগর রয়েই গেছে সময়ের দলিলে। রবিঠাকুর স্বয়ং পা দিয়েছিলেন এখানে, সেই ভেবেই শিহরিত হই আমরা।
দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল যেন শক্তিপীঠের মাহাত্ম্যে যুগ যুগ ধরে ভরপুর হয়ে রয়েছে। ৫১ সতীপিঠের কামাখ্যা, ত্রিপুরেশ্বরী নাহয় পৌরাণিক কাহিনির অবতারণায় জনপ্রিয়। তাই বলে কালীর দশমহাবিদ্যার স্নিগ্ধ রূপ ভুবনেশ্বরীর কী সম্পর্ক ছিল এই ত্রিপুরার সঙ্গে? নাকি শুধুই পৌরাণিক বিশ্বাসের ভেলায় চড়েই সেই প্রাচীন যুগে ত্রিপুরার রাজারা গোমতি নদীর পাশেই গড়ে তুলেছিলেন এক মন্দিরময় নগর, যার নাম রাজনগর। আর যেখানে ভুবনেশ্বরী দেবীর মন্দিরটি আজও নজর কাড়ে। শক্তির উপাসক এই রাজার নির্মিত মন্দির কিন্তু পোড়া মাটি বা টেরাকোটার নয়। পোড়া ইটের। আর আর্কিওলজিকাল সোশ্যাইটির তত্ত্বাবধানে তা আজও অমলিন। (Tripura Travelogue)

বাংলার চালা স্টাইলে নির্মিত সব মন্দির। সেই মন্দিরময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পথ চলি আমরা। এখানেই নিত্য পুজো হত তবে রাজবাড়ির কুল দেবতার? অলিগলি এঁকেবেঁকে নিয়ে চলে রাজবাড়ির প্রধান ফটকে। এই কি সেই শাক্ত রাজা যিনি মায়ের পুজোয় বলিদান করতেন? এই কি সেই রাজা যিনি ঋষি হয়ে উঠেছিলেন আর বলি প্রথা সমূলে বন্ধ করেছিলেন? সেই ছোট্ট মেয়েটি হাসি যার নাম, বলির রক্ত দেখেই প্রাণ হারিয়েছিল… সে ঘটনার প্রেক্ষাপট তো এই ত্রিপুরাই। রাজর্ষি প্রসঙ্গ মনে পড়লেই উথালপাথাল আমার মন তখন। (Tripura Travelogue)

সেই ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পাথরের ঘাট গোমতী নদীতে গিয়ে পড়ত সেকালে। আর ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য একদিন গ্রীষ্মকালের প্রভাতে স্নান করতে এসেই সেই ছোটো মেয়েকে প্রথম বার দেখেছিলেন। রবিঠাকুরের বর্ণনায় সেই মন্দিরের আশেপাশেই গোমতী নদীর জলে এবং গোমতী নদীর উভয়পারের অরণ্যে অন্ধকার আকাশের ছায়া পড়ত যখন, তখনই অমাবস্যার ঘোর আঁধারে ভুবনেশ্বরীর পুজো চলত সাড়ম্বরে। (Tripura Travelogue)

রবিঠাকুরের “রাজর্ষি” গল্পে সেই মন্দিরের রাজপুরোহিতের নাম ছিল রঘুপতি। “এ দেশে পুরোহিতকে চোন্তাই বলিয়া থাকে। ভুবনেশ্বরী দেবীর পূজার চৌদ্দ দিন পরে গভীর রাত্রে চতুর্দশ দেবতার এক পূজা হয়। এই পূজার সময় এক দিন দুই রাত্রি কেহ ঘরের বাহির হইতে পারে না, রাজাও না। রাজা যদি বাহির হন, তবে চোন্তাইয়ের নিকটে তাঁহাকে অর্থদণ্ড দিতে হয়। প্রবাদ আছে, এই পূজার রাত্রে মন্দিরে নরবলি হয়। এই পূজা উপলক্ষে সর্বপ্রথমে যে-সকল পশুবলি হয়, তাহা রাজবাড়ির দান বলিয়া গৃহীত হয়।” অতএব রবিঠাকুর যে এখানে থেকে সেসব ঘটনাবলী, তথ্য জোগাড় করেছিলেন তা বুঝতে ভুল হয়না। (Tripura Travelogue)
কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণ মাণিক্য দেববর্মা যখন তার মূল রাজধানী উদয়পুরকে পিছনে ফেলে আগরতলায় একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন, তখন দেব-দেবীরাও এই স্থানটি ছেড়ে তার সঙ্গে নতুন স্থানে পাড়ি দেন। রাজা আগরতলায় এসে নবনির্মিত মন্দিরে স্থাপন করেন।
বলির রক্ত দেখে ছোট্ট মেয়েটির মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল রাজা কে। রাজা বলিলেন, “এ বৎসর হইতে মন্দিরে জীববলি আর হইবে না।” রাজা যেন হাসির মধ্যে জীবন্ত ভুবনেশ্বরীকে দেখতে পেয়েছিলেন। এই উপন্যাসে সম্রাট শাহজাহানের শাসনকাল উল্লেখ আছে। অর্থাৎ রাজা গোবিন্দমাণিক্য সেই ষোড়শ শতাব্দী বা তার আশেপাশেই সেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তার সত্যতা যাচাই হল মন্দিরের পাশে ফলক দেখে। (Tripura Travelogue)
দ্বিতীয়বার সিংহাসন আরোহণ করে ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য ১৬৬৭-১৬৭৬ সালে ভুবনেশ্বরী মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। বাংলার চারচালা স্টাইলে নির্মিত মূল মন্দিরটি প্রায় ৩ ফুট উঁচু স্তম্ভের ওপর স্থাপিত আর মন্দিরের চুড়ো স্তম্ভের আকৃতির। (Tripura Travelogue)

কাছেই রাধাকিশোরপুর জেলার অন্তর্গত গুণবতী মন্দির। মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যর স্ত্রী গুণবতী এই মন্দিরগুলি উৎসর্গ করেছিলেন বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে। মানে শক্তির উপাসক ছিলেন রাজা স্বয়ং আর রাজমহিষী হয়তোবা পরম বৈষ্ণব ছিলেন। তাই শাক্ত বৈষ্ণব উভয় ধারার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান?
সাময়িকভাবে আবিষ্ট এবং আছন্ন হতে হয় এই মন্দিরময় জনপদে এসে দাঁড়ালে। এই গুণবতী মন্দিরগুলির ভেতরের ঘরগুলি অর্ধ চন্দ্রাকৃতি এবং মন্দিরের সামনের আয়তকার চাঁদনীর দ্বারা মন্দিরটি বেষ্টিত। ইন্ডিয়ান আরকিওলজিকাল সোশ্যাইটি ভাগ্যিস দেখভাল করে অগণিত এইসব মন্দিরগুলির, নয়তো কালের স্রোতে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যেত ত্রিপুরার এই মন্দিরময়তা। (Tripura Travelogue)

সত্যিই তো, সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে চতুর্দশ দেবতার পুজো হয়ে আসছে বলেই ত্রিপুরার নাম “দ্যা ল্যান্ড অফ ফর্টিন গডস”। মন্দির নগরী ত্রিপুরার মহারাজা নাম দিয়েছিলেন। এটি হল ত্রিপুরার রাজাদের এক ঐতিহ্য। চোদ্দ দেবদেবীর পুজো করতেন তাঁরা। আর এই চতুর্দশ দেবতা হলেন ত্রিপুরাবাসীর আরাধ্য হারা (শিব), উমা (দুর্গা), হরি (বিষ্ণু), লক্ষ্মী, বাণী (সরস্বতী), কুমার (কার্তিক), গণপা (গণেশ), বিধু (চাঁদ), কা (ব্রহ্মা), অভি (সমুদ্র), গঙ্গা, সেখী (অগ্নি), কাম (কামদেব), হিমাদ্রি (হিমালয়)। চতুর্দশ দেবতার মন্দির বানিয়ে ফেলতেন রাজারা নিজের প্রাসাদের কাছেই। (Tripura Travelogue)
ইউরোপীয় শৈলীর ছোঁয়া প্রাসাদে। বাগান দ্বারা বেষ্টিত দুটি হ্রদের তীরে অবস্থিত। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে ভারতে ত্রিপুরার একীভূত হওয়ার আগে অবধি এটি শাসক মাণিক্য রাজবংশের বসতবাড়ি ছিল। তারপর ত্রিপুরা সরকার রাজপরিবারের কাছ থেকে তা কিনে নেয়।
প্রাচীন ইতিহাস ও কিংবদন্তী বলে, রাজা ত্রিপুর তার ধর্মহীন কাজ এবং আচরণের জন্য ভগবান শিব কর্তৃক নিহত হন। তার বিধবা স্ত্রী হরবতী নদীতে স্নান করতে গিয়ে দেখেন চৌদ্দ দেবতাকে একটি বন্য মহিষ তাড়া করেছে আর যার ফলে তাঁরা একটি তুলা গাছে আশ্রয় নিচ্ছেন। হরবতী সাহসের সঙ্গে সেই মহিষকে মেরে নিজেও বাঁচেন ও দেবতাদেরও বাঁচান। চোদ্দ দেবদেবী হরাবতীর প্রতি এতটাই প্রসন্ন হয়েছিলেন যে, তাঁরা উদয়পুরের রাজপ্রাসাদে থাকতে আসেন এবং সেখানে পুজো শুরু হয়। খারচি উৎসবে বুনো মহিষ বলিদানের প্রথাও তখন থেকেই চলে আসছে। (Tripura Travelogue)
উদয়পুর শহর একদা সামসের গাজীর নেতৃত্বে মুসলিম আক্রমণকারীদের কবলে পড়ে। তারা শহরটি দখল করলে, ত্রিপুরী রাজাকে তার রাজধানী নদীর তীরে আগরতলায় স্থানান্তর করতে হয়। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণ মাণিক্য দেববর্মা যখন তার মূল রাজধানী উদয়পুরকে পিছনে ফেলে আগরতলায় একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন, তখন দেব-দেবীরাও এই স্থানটি ছেড়ে তার সঙ্গে নতুন স্থানে পাড়ি দেন। রাজা আগরতলায় এসে নবনির্মিত মন্দিরে স্থাপন করেন। (Tripura Travelogue)

উজ্জয়ন্ত প্যালেস ছিল ত্রিপুরার সফরসূচীর সর্বশেষ পয়েন্ট। রাজা ঈশান চন্দ্র মাণিক্য ১৮৬২ সালে আগরতলা থেকে কিছুদূরে প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। বিধ্বংসী ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হওয়ার পর মহারাজা রাধা কিশোর মাণিক্য ১৮৯৯-১৯০১ সালে আগরতলা শহরের কেন্দ্রস্থলে বর্তমান প্রাসাদটির পুনর্নির্মাণ করেন। (Tripura Travelogue)
ইউরোপীয় শৈলীর ছোঁয়া প্রাসাদে। বাগান দ্বারা বেষ্টিত দুটি হ্রদের তীরে অবস্থিত। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে ভারতে ত্রিপুরার একীভূত হওয়ার আগে অবধি এটি শাসক মাণিক্য রাজবংশের বসতবাড়ি ছিল। তারপর ত্রিপুরা সরকার রাজপরিবারের কাছ থেকে তা কিনে নেয়। (Tripura Travelogue)
২০১১ পর্যন্ত এটি রাজ্য বিধানসভার দপ্তর ছিল। দৃষ্টিনন্দন উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ এখন রাজ্য যাদুঘর আর একইসঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতে বসবাসকারী নানান সম্প্রদায়ের জীবনধারা, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং উপযোগী কারুশিল্প প্রদর্শন কেন্দ্র। সেইসঙ্গে আছে প্রচুর ভাস্কর্য, মানিক্য রাজবংশের মুদ্রা এবং আরও কিছু নজরকাড়া নিদর্শন।
এবার কলকাতার পথে। হয়ত আরও কিছু বাকি থেকে গেল ত্রিপুরা নিয়ে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ৭টি জায়গা নিয়ে আলোকপাত করে এহেন ভ্রমণপিপাসুও ঋদ্ধ। তবে ৭কাহনের পরেও কিছু বাকি থেকেই যায়। (Tripura Travelogue)
(শেষ)
তথ্যসূত্র
http://www.tripura.org.in
https://tbse.tripura.gov.in/
https://tripuratourism.gov.in/
https://unakoti.nic.in/
একান্নপীঠ – পূর্বা সেনগুপ্ত
রাজর্ষি, বিসর্জন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সুকান্ত চক্রবর্তী, রিটায়ার্ড PGT – শিশুবিহার হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল
দ্যা ওয়াল, আনন্দবাজার পত্রিকা
ছবি সৌজন্য: লেখক
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।