(Black Pagoda)
হেঁটে দেখতে শেখার অভ্যাস, আমাদের তেমন করে আজও হল না। তাই কি এ কলকাতার ভেতরের আর একটা কলকাতা ক্রমে হারিয়ে যেতেই বসল চোখের আড়ালে?
প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা জানা নয়। শহরের ইতিহাস যখন একের পরে এক নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে বিপুল বণিকবৃত্তির এক সমাজ, তখনও কেউ কেউ চেষ্টা করছেন যা হারিয়ে যায় অন্তত তার ইতিহাসটা আগলে রাখার। সেইটুকুই আশার আলো। যে-আলো জ্বালিয়ে রাখছিলেন পি থঙ্কপ্পন নায়ার, তারাপদ সাঁতরার মতো ইতিহাসবিদ। তাঁদের প্রয়াণের পরেও যে তার সবটা নিভে যায়নি সেটা বোঝা গেল সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আয়োজিত বিশেষ বক্তৃতায়, যার শিরোনাম ছিল ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা, দি আর্লি ক্যালকাটা ল্যান্ডমার্ক’। বললেন টেগোর ন্যাশনাল রিসার্চ স্কলার ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী। (Black Pagoda)
আরও পড়ুন: গামানুষের গল্প আর অন্য রাজশেখর
কোনারকের সূর্যমন্দিরকে একসময় বিদেশিরা বলত ব্ল্যাক প্যাগোডা। জাহাজে আসত তারা। সমুদ্রের দিক থেকে মন্দিরকে মনে হত কালো। কিন্তু আঠারো শতকে উত্তর কলকাতার জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের এই প্যাগোডা তথাকথিত ব্ল্যাক, কারণ গোবিন্দরামকে ইংরেজরা বলতো ব্ল্যাক জমিনদার। ১৭৩০-এ গোবিন্দরাম এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। (Black Pagoda)
মন্দির না বলে অবশ্য মন্দিরগুচ্ছ বলাই ভাল। কারণ এই চত্বরে একটি নয়, ছিল বেশ কয়েকটি মন্দির। মূল মন্দিরটি ছিল পঞ্চরত্ন, তাকে ঘিরে ছিল নবরত্ন মন্দির।
মন্দির না বলে অবশ্য মন্দিরগুচ্ছ বলাই ভাল। কারণ এই চত্বরে একটি নয়, ছিল বেশ কয়েকটি মন্দির। মূল মন্দিরটি ছিল পঞ্চরত্ন, তাকে ঘিরে ছিল নবরত্ন মন্দির। তবু বার বার নানা লেখায় মন্দিরটিকে নবরত্ন বলা হয়েছে। গোলমালের সূত্রপাতটা অবশ্য করেছিলেন গোবিন্দরামের এক বংশধরই। বিষয়টা আর একটু খুলে বলা প্রয়োজন। কলকাতায় রত্নরীতির মন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ‘নবরত্ন’ শৈলী। আর তার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হিসেবে চলে আসে গোবিন্দরাম মিত্রের ব্ল্যাক প্যাগোডার কথা। কিন্তু আদি ব্ল্যাক প্যাগোডা মোটেই নবরত্ন ছিল না, ছিল পঞ্চরত্ন। (Black Pagoda)

বিশিষ্ট ঐতিহাসিক তারাপদ সাঁতরা লিখছেন, ‘গোবিন্দরাম জাঁকালো এক প্রকাণ্ড পঞ্চরত্ন মন্দিরের সঙ্গে স্থাপন করেছিলেন তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রাকার দুটি নবরত্ন। বর্তমানে তাঁর সেই অভ্রভেদী পঞ্চরত্ন মন্দিরের কীর্তি, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার প্রতিকৃতি আজও বেঁচে রয়েছে, বিদেশি চিত্রকরদের আঁকা ছবির মধ্যে। সেই ছবিগুলি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, গোবিন্দরামের বিখ্যাত ‘প্যাগোডা’ ছিল ‘পঞ্চরত্ন’, প্রচলিত ধারণা মতো ‘নবরত্ন’ নয়।’ কিন্তু ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী তারাপদ সাঁতরার এই অনুমানের সঙ্গে সহমত নন। তাঁর যুক্তিসিদ্ধ অনুমান, নবরত্ন মন্দির দু’টি নয়, ছিল চারটি। তার একটা কারণ স্থাপত্য-গত সমতা, আর একটা কারণ দৃশ্যগুণ। নইলে গঙ্গার দিক থেকে যাঁরা দেখবেন তাঁদের কাছে দৃশ্যটা খাপছাড়া লাগবে। (Black Pagoda)
আরও পড়ুন: সন্জীদা খাতুন (১৯৩৩-২০২৫): সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে
আসলে ইউরোপীয় চিত্রকরদের তুলিতে পুরনো কলকাতার পটে এই দৃশ্যগুণটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক একটি জায়গার এক একটি স্থাপত্য যেন এই দৃশ্যপটে প্রতীকের মতো হয়ে ওঠে। কোনার্কে যেমন সূর্যমন্দির, কাশীর পঞ্চগঙ্গা ঘাট থেকে দেখা যেমন আলমগীর মসজিদের গম্বুজ, দিল্লির কুতব মিনার, তেমনি নেটিভ কলকাতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল গোবিন্দরাম মিত্রের ব্ল্যাক প্যাগোডা। ইউরোপীয় চিত্রকররা ছবি এঁকে বিক্রি করতে চাইতেন। তাই খুব পরিচিত কোনও স্থাপত্য তাঁদের প্রায় সকলের ছবিতেই থাকত। (Black Pagoda)
এই রত্ন-মন্দির স্থাপত্যের ধারণাটা ক্রমে বিবর্তিত হয় শ্রীচৈতন্যোত্তর যুগে। তার পরে রীতি-বিবর্তনের ধারায় অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত তার প্রবল প্রচলন ছিল। গোবিন্দরামের এই মন্দির-চত্বর অনেকগুলি রীতিকেই ধরে রেখেছিল। যেমন দোচালা, পঞ্চরত্ন, নবরত্ন ইত্যাদি। স্থাপত্যের ইতিহাসে গোবিন্দরাম মিত্রের ব্ল্যাক প্যাগোডার এই গুরুত্ব বারবার ধরা পড়ল ইন্দ্রজিৎ চৌধুরীর কথায়। (Black Pagoda)
গোবিন্দরামের মৃত্যু হয় ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে। বিধ্বংসী এক ঝড়ে যখন তাঁর তৈরি সুউচ্চ পঞ্চরত্নটি ভেঙে পড়ে তখনও তিনি জীবিত। তবে মন্দিরটির সারাই ও সংস্কার হল না কেন? বিধ্বস্ত প্যাগোডার ছবিও এঁকেছিলেন ড্যানিয়েলরা।
গোবিন্দরামের মৃত্যু হয় ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে। বিধ্বংসী এক ঝড়ে যখন তাঁর তৈরি সুউচ্চ পঞ্চরত্নটি ভেঙে পড়ে তখনও তিনি জীবিত। তবে মন্দিরটির সারাই ও সংস্কার হল না কেন? বিধ্বস্ত প্যাগোডার ছবিও এঁকেছিলেন ড্যানিয়েলরা। তারাপদ সাঁতরা অনুমান করেছেন, পঞ্চরত্নটি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা ছিল সংস্কারের অযোগ্য; সেজন্য এটি অনাদৃত ও অসংস্কৃত অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকে। ১৮২০ নাগাদ সেটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। থেকে যায় নবরত্ন ও তার দক্ষিণপাশ সংলগ্ন পুবমুখী ক্ষুদ্রাকার দোচালা স্থাপত্যটি। (Black Pagoda)

এর পরেও গোবিন্দরামের ‘প্যাগোডা’ ইউরোপীয় চিত্রকরদের চোখ টেনেছে। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে টমাস প্রিন্সেপ ‘Chitpore Road and the Black Pagoda’ নামে যে রঙিন ছবিটি এঁকেছিলেন তাতে পঞ্চরত্ন নেই, আছে শুধু নবরত্ন এবং তার ডান পাশে দোচালার ভাঙা দেওয়াল। ড’য়লি ১৯৩৫-এ যখন কালি-কলমে স্কেচ করছেন, নেটিভ টাউন চিতপুর বাজারের, তারও মুখ্য বিষয় গোবিন্দরামের প্যাগোডা। শুধু আঁকা ছবিই নয়, ১৮৫১-এ, এদেশে ফোটোগ্রাফির আদি যুগেও একটি আলোকচিত্রে মন্দিরটির দেখা মেলে। (Black Pagoda)
কলকাতার দৃশ্য ইতিহাসে এইভাবেই জড়িয়ে আছে গোবিন্দরাম মিত্রের ব্ল্যাক প্যাগোডা, তারই কিছু রং পাওয়া গেল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আয়োজিত সাম্প্রতিক বক্তৃতাসভায়। (Black Pagoda)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি সৌজন্য- আন্তর্জাল
আশিস পাঠক বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের প্রকাশনা ও বিপণন আধিকারিক।
আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি নানা সময়ে যুক্ত থেকেছেন সাহিত্য অকাদেমি, বাংলা আকাদেমি, কেন্দ্রীয় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা বিভাগের নানা প্রকল্পে, নানা পুরস্কারের বিচারক হিসেবে। সংস্কৃতির নানা মহলে তাঁর আগ্রহ, বিশেষ আগ্রহ রবীন্দ্রনাথ ও গ্রন্থবিদ্যায়।