(Mango recipe)
আমাদের একটা ছেলেবেলা ছিল। ছায়া ঘেরা আম কাঁঠালের বাগান ছিল। সবুজ মখমলি শ্যাওলা ছাওয়া ইঁট বাঁধানো উঠোন ছিল। সেই উঠোনে গুল শুকোতো, নীল দেওয়া সাদা সাদা শাড়ি শুকোতো। বারান্দায় বসে বসে আম দুধ মুড়ি খেতে খেতে আমরা সেসব ছবির মধ্যে ডুবে যেতাম। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা না থাক আম আঁটির ভেপু বাজাতে বাজাতে সেই ছোটবেলাটা চলে গেছে। সে তো যাওয়ারই ছিল। তবু, মনের মধ্যে সে ছবি ফেলে যায় নিরন্তর।
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪]
আমাদের এ দেশে না হোক, বাংলাদেশে গরমের ছুটির একখানা নাম আছে, আম-কাঁঠালের ছুটি। আসলে, সেসব ছুটির দিন আমের গন্ধে নীল মাছিদের উড়ানে ভরে আছে অবিরত। ব্যক্তিগত কথা বলতে খানিক সংকোচ হয় সকলেরই। কিন্তু সেসব গল্প আসলে ঠিক আমার নয় বোধহয়। সেসব গল্পে বরং আমের গন্ধ ম ম করছে আজও। সে যে কেমন করে ফিরে ফিরে আসে তা বড়ই আশ্চর্যের। (Mango recipe)
আমবাগানের ছড়া তাই অবান্তর ছায়া ফেলে যায় স্মৃতি সত্তায়। সে ছায়ায় বসে বসে শেষপাতে দুধের বাটিতে আম আর দুমুঠো ভাত মেখে খেতে খেতে দেখি হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা ওই নদী পাহাড় পেরিয়ে কোন সে ছেলেবেলার সকালে মিলেমিশে যাচ্ছে।
আমরা তখন কলেজে পড়ি। সত্যেন দত্তের কবিতার ছন্দকে খুঁজছি খাতায় কলমে। মনের মধ্যে দোলা দিয়ে যাচ্ছে দুই-তিনটি পঙক্তি। ‘আহা ঠুকরিয়ে মধু কুলকুলি পালিয়ে গিয়েছে বুলবুলি/ টুলটুলে তাজা ফলের নিটোলে টাটকা ফুটিয়ে ঘুলঘুলি…।’এই ছন্দের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে দেখি, আমাদের সামনের উঠোনে একখানা মধুকুলকুলি আমগাছ ছিল। নিটোল গড়ন তার। আমার ঠাকুমা – অনেক সময় নিয়ে আস্তে আস্তে টিপে টিপে আমগুলো নরম করে দিতেন। ভিতরের সবটুকু যখন নরম হয়ে যেত! তখন ছোট্ট একটা ফুটো করে নিলেই দিব্যি আমের রস খাওয়া যেত আরাম করে। তবে, সব আম তো আর এমন নরম নয়! একেক আমের গৌরব রকমফেরে। সেসব রকমফের স্মৃতিতে জুড়ে থাকে সেলাই করা নকশি কাঁথার মতো।

পড়ন্ত উনোনে দুধের কড়া বসিয়ে রাখার চল তখন প্রায় অনেক বাড়িতেই। বিকেলে ঘন ক্ষীর দিয়ে মুড়ি খাবে কেউ, রাতে রুটি দিয়েও খাবে হয়তো। কিন্তু গোলাপখাস দিয়ে সেই ক্ষীরের তুলনা নেই। আঁশ বহুল আম গোলাপখাস। কিন্তু, ওর গন্ধ পাগল করা। কী ওর রঙ! চিকণ খোসা! কাঁচামিঠে আমের মতো কিশোর সুলভ স্নিগ্ধতা ওর নেই। বরং গোলাপখাসের মধ্যে থিতু হয়ে আছে কস্তুরি মৃগের সৌরভ যেন।
পাড়াগাঁয়ের আমআদমির জীবনে আর কিছু না থাক, এমন আম-জাম-কাঁঠাল ঘেরা গ্রীষ্ম ছিল। প্রলম্বিত বর্ষা ছিল আমের খোসা আর কাঁঠালের গন্ধ জড়ানো। ভাত-মুড়ি-চিঁড়ে-খই-রুটি এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে আমের মতো আর কেইবা জুড়ে থেকেছে! হিমসাগর থেকে ল্যাংড়া, বোম্বাই থেকে ফজলি – আমেদেরও ক্রম আছে। হিমসাগর খাওয়ার সুখ প্রথম গ্রীষ্মেই, ল্যাঙড়া-ফজলির তখন দেখা নেই। শ্রাবণের সকালে আবার ফজলিতেই মানুষের ভরসা। কে যেন সময়ের গ্রন্থিমালায় ওদের জুড়ে রেখেছে আদরে সোহাগে।

যখন আর ভাতে মুড়িতে পান্তায় কুলিয়ে ওঠে না! মানুষেরা তখন আমসত্ত্ব দেয় কুলো বিছিয়ে পাটি বিছিয়ে। সন্দেশের মতো আমসত্ত্বের ছাঁচ কত নিপুণ হাতে গড়ে তুলতে জানতেন মানুষেরা। রান্নাঘরের এই শিল্প সুষমার দিকটি আমাদের সেভাবে বোধহয় তলিয়ে দেখা হয়নি। আমসত্ত্বের শরীরে লেগে থাকে রোদ্দুরের গন্ধ, আমাদের স্তরীভূত ঘ্রাণ। আশ্বিনের দুপুরেও সে চাইলে আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে জ্যৈষ্ঠ দিনে। আমেদের সেই ক্ষমতা আছে। (Mango recipe)

আকবর থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদের নবাবেরা ভালো আমের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কোহিতুর থেকে আরও কত কত বাদশাহী আমের গন্ধ মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহী চিনে এসেছে কত কত বছর ধরে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা তবু থেমে থাকেনি। উপনিবেশবাদের যুগে হুগলীর গির্জাগুলিও আরেকভাবে আমকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিল। পাদ্রিদের হাত ধরে কলমের পরীক্ষা চলেছিল একদা। সেসব আমও মিলেমিশে গেছে দেশজ ভাত মুড়ি আর সাবু মাখায়। মিয়াজাকির মতো চিত্তাকর্ষক আম খুব বেশি নেই হয়তো, তবু সব দেখে দেখে ক্রমে বুঝেছি – নামের মাহাত্ম্য খুব বড় কিছু নয়। আম্রপালি থেকে মল্লিকা, মানুষের হাতে গড়া স্বাদের বাইরেও দেশকালের স্রোতে যেন নামহীন হয়েও আমেরা টিকে আছে। কত মানুষের উঠোনে, খিড়কির বাগানে নামহীন আমগাছ স্বাদ আর ছায়া বিলোচ্ছে কত কাল ধরে। (Mango recipe)

সেই স্বাদের কথকতায় মনে পড়ে গেল কোন সে দ্বীপান্তরের কথা। উদ্বাস্তু মানুষের জাহাজ সেসব দ্বীপে ভিড়েছিল। সরকারি ডোল ছাড়াও সেখানে তাদের জুটে গিয়েছিল বুনো আম। ছোট ছোট গড়ন। আঁশ ভর্তি। তবু তো সেও খাদ্য। প্রকৃতি তো কৃপণা নয়। আমবাগানের ছড়া তাই অবান্তর ছায়া ফেলে যায় স্মৃতি সত্তায়। সে ছায়ায় বসে বসে শেষপাতে দুধের বাটিতে আম আর দুমুঠো ভাত মেখে খেতে খেতে দেখি হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা ওই নদী পাহাড় পেরিয়ে কোন সে ছেলেবেলার সকালে মিলেমিশে যাচ্ছে। (Mango recipe)
পাকা আমের জাউ
উপকরণ : পাকা আমের (একটু টক মিষ্টি ধরণের আম হলেই ভালো) রস এক কাপ, আধ বাটি মতো খুদ বা আতপ চাল, খুব সামান্য সর্ষের তেল, ফোড়নের জন্য শুকনো লঙ্কা ও পাঁচ ফোড়ন, স্বাদমতো নুন। নিম পাতা বা শুকনো নিম ফুল ইচ্ছে হলে যোগ করতে পারেন।

পদ্ধতি: খুদ বা চাল খুব ভালো করে ধুয়ে জল দিয়ে সেদ্ধ করতে বসান। বেশ ভালো মতো সেদ্ধ হয়ে গেলে কাঁটা বা হাতা দিয়ে একটু ঘেঁটে দিন। বেশ মোলায়েম হয়ে গেলে আমের রসটা দিয়ে অল্প নুন দিন। অল্প ফুটিয়েই আঁচ বন্ধ করুন। আলাদা একটি পাত্রে তেল গরম করে শুকনো লঙ্কা আর পাঁচ ফোড়ন সম্বর দিয়ে জাউভাতের উপরে ঢেলে ঢাকা দিয়ে দিন। ঘরের তাপমাত্রায় এলে পরিবেশন করুন আমের জাউ।
*উড়িষ্যা সংলগ্ন কোনো কোনো অঞ্চলে এই জাউভাতের উপরে ভাজা নিমপাতা বা নিমফুল দিয়ে পরিবেশনেরও প্রচলন আছে। (Mango recipe)
আঁটির টক
উপকরণ : বেশি পাকা আমের আঁটি, তেঁতুল অল্প পরিমাণে, গুড়, অল্প হলুদের গুঁড়ো, অল্প লঙ্কার গুঁড়ো, সর্ষের তেল, ভেজে গুঁড়ো করা পাঁচফোড়ন, ফোড়নের জন্য অল্প পাঁচ ফোড়ন, শুকনো লঙ্কা এবং স্বাদমতো নুন।

পদ্ধতি : একটু বেশি পাকা আমের আঁটিগুলি হাত দিয়ে আরেকটু মেখে নিন। কড়াইয়ে তেল দিন। গরম হলে পাঁচ ফোড়ন এবং শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে হাতে মেখে রাখা আমের আঁটিগুলি আমের রস সহই দিয়ে দিন। অল্প হলুদের গুঁড়ো, লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে নেড়েচেড়ে স্বাদমতো নুন দিন। বেশ মিলেমিশে গেলে ভিজিয়ে রাখে তেঁতুলের ক্বাথ দিন। ফুটে উঠলে গুড় দিন। বেশ মাখা মাখা হয়ে এলে উপর থেকে ভেজে গুঁড়ো করে রাখা পাঁচ ফোড়নের গুঁড়ো ছড়িয়ে রান্না শেষ করুন। (Mango recipe)
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons, Newness Plant, amazon.in
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।