(Amitabha Chowdhury)
তিনি রবীন্দ্রঅনুরাগী, তিনি সাংবাদিক, অন্যদিকে তিনি সুচিত্রা সেনের বন্ধু। আর দ্রুততার সঙ্গে মুখে মুখে ছড়া তৈরিতে, তাঁর জুড়ি মেলা ভার। অনেকটা সময় পড়াশোনা করেছেন শান্তিনিকেতনে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি লিখেছিলেন একাধিক গ্রন্থ যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘জমিদার রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’, ‘রবি অনুরাগিণী’, ‘আমার বন্ধু সুচিত্রা সেন’ ইত্যাদি। আগেই বলেছি রসিকতা করে কথায় কথায় ছড়া বাধঁতেন। শ্রাবণের এক বর্ষণক্লান্ত বিকেলে অমিতাভ চৌধুরীর রিজেন্ট এস্টেটের আবাসনে প্রথম গিয়েছিলাম, বিশেষ কিছু আলোচনা করার জন্য ওঁর লেখা একটি বইকে কেন্দ্র করে।(Amitabha Chowdhury)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: আলী আকবর খান
সঙ্গে ছিলেন আমার প্রাক্তন স্ত্রী। অমিতাভদা গম্ভীর মুখে বসতে বলে কিছুক্ষণ ঘরের খোলা জানালার বাইরে চেয়ে থাকলেন, তারপর আমার সঙ্গিনীর নাম জিজ্ঞাসা করলেন। নাম জানার পরে বলে উঠলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে “শ্রাবণবরিষন পার হয়ে কিছু বাণী, আসে ওই রয়ে রয়ে”। এরপর কৌতুক করে সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি যদি গানের কথার একটু পরিবর্তন করে বলি, ‘শ্রাবণবরিষন পার হয়ে শিবানী আসে ওই রয়ে রয়ে।’ এরকম কথার পরে আর না হেসে পারা যায় না। (Amitabha Chowdhury)
সেদিন ওঁর ‘একত্রে রবীন্দ্রনাথ’ বইটির সম্পর্কে অনেক আলোচনা করলেন। অনেক নতুন তথ্যও পেলাম। কথা প্রসঙ্গে ওঁর শান্তিনিকেতনের দিনযাপন নিয়ে গল্প হল। মনে আছে আশির দশকের শেষদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীতজীবনের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম-এর অনুষ্ঠানে ওঁর সঞ্চলনার কথা। রবীন্দ্র অনুরাগের পাশাপাশি অমিতাভদার হেমন্ত অনুরাগও ছিল প্রবল।(Amitabha Chowdhury)

সেদিনের অনুষ্ঠানে উনি শুরুই করেছিলেন, ‘নামে হেমন্ত কণ্ঠে চিরবসন্ত’, বাক্যটি ব্যবহার করে। সেদিন তাঁর প্ৰিয় শিল্পীর সম্পর্কে বলতে গিয়ে, মাঝে-মধ্যে সিলেটি ভাষা ব্যবহার করে, আর ছড়া বলে গোটা স্টেডিয়ামকে মাতিয়ে তুলেছিলেন! এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে অমিতাভদা ওঁর ‘একত্রে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেছিলেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিচিত্রা সভাকক্ষে, আয়োজন করেছিলাম রবীন্দ্রকাহিনি ভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসবের। রবীন্দ্রভারতী প্রদর্শশালার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সেই চলচ্চিত্র উৎসবের উপলক্ষ্য ছিল কবির জন্মের সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপন। সেই উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা করার জন্য ওঁকে আমন্ত্রণ জানাই, উনি এসেওছিলেন।(Amitabha Chowdhury)
“বেশ কয়েকদিন শুটিং হয় অমিতাভদার রিজেন্ট এস্টেটের আবাসনে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এবং শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে।”
ওঁর সঙ্গে আমরা সেদিন উদ্বোধক হিসেবে পেয়েছিলাম নাট্যব্যক্তিত্ব দেবতোষ ঘোষকে। অমিতাভদা সেদিন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন ১৯৬১ সালে যদি কবির জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হয়ে থাকে, তবে কেন ২০১১-র পরিবর্তে ২০১০-এ কবির সার্ধশততম জন্মবর্ষ পালন করা হচ্ছে! সঠিক কথাই বলেছিলেন। এই নিয়ে আজও আমার সঙ্গে অনেকের মতপার্থক্য হয়।(Amitabha Chowdhury)

অমিতাভদার লেখা, ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’ বইটির প্রতি আমার আকর্ষণ অনেকদিনের। সেই বিষয়টা নিয়ে কোনও তথ্যচিত্র করা যায় কী না ভাবতাম। একদিন আমার পরিচিত একজনের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করবার সময় তিনি প্রস্তাব করেন যে বিষয়টা নিয়ে চলচ্চিত্র করা যেতে পারে। তাই নিয়ে অনেক আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পরে আমরা অমিতাভদার সঙ্গে কথা বলি।(Amitabha Chowdhury)

প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু করলেও শেষে অমিতাভদা রাজি হলেন, ঠিক হল ছবির চিত্রনাট্যটি উনি দেখবেন আর প্রয়োজন হলে সংশোধন এবং সংযোজন করবেন। ছবির জন্য বিভিন্ন জায়গায় শুটিং করা হয়েছিল। বেশ কয়েকদিন শুটিং হয় অমিতাভদার রিজেন্ট এস্টেটের আবাসনে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এবং শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে। একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির শুটিং করা মুখের কথা নয়। দিনেকয়েক অমিতাভদার বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছবির কাজ হত। উনি হাসিমুখে আমাদের সব অত্যাচার সহ্য করে সহযোগিতা করতেন, শুধু তাই নয়, পুরো ইউনিটের সকলের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতেন। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনিও আজ আর আমাদের মধ্যে নেই।(Amitabha Chowdhury)

কাজের ফাঁকে অমিতাভদা আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। সেইসব গল্প ঠিক ভূতের গল্প না হলেও শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে কবির পরলোকচর্চা নিয়ে গবেষণা করার সময় ওঁর কিছু অভিজ্ঞতার কথা শুনে বেশ অবাক হতাম। একদিন কথাপ্রসঙ্গে ওঁর কাছেই জেনেছিলাম যে ওঁদের ফ্ল্যাটের উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে অমিয়া ঠাকুর থাকতেন। ছবিতে কয়েকটি গান ছিল, তার মধ্যে একটা গান ছিল, ‘জয় তব বিচিত্র আনন্দ হে কবি জয় তোমারো করুণা’। অমিতাভদা আমাকে বললেন এই বিশেষ গানটি গাইতে, উনি জানতেন আমি গান করি। আরও অনেক অনুষ্ঠানে এবং অনেক অবকাশে অমিতাভদার সঙ্গে দেখা হলে পুরোনো দিনের গল্প করতেন, সমৃদ্ধ হতাম। কালের নিয়মে তিনিও একদিন পাড়ি দিলেন অজানায়, আমরা হারালাম এক মরমী রবীন্দ্রগবেষককে। যাঁরা অমিতাভদার বইগুলো পড়েননি, তাঁরা যদি সেগুলো সংগ্রহ করে পড়েন, তবে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন(Amitabha Chowdhury)
ছবি সৌজন্য- লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।