(Western Ghats)
আমরা বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম – একটানা অঝোরধারায় বৃষ্টি, সহ্যাদ্রির বনে জঙ্গলে। সাত দিনে রোদের মুখ দেখতে পাইনি। জলে ধোয়া সবুজ অরণ্য, ঝরনার যৌবনপ্রাপ্তি, পাতা ধোয়া টুপটাপ জল পড়ার শব্দ – এই তো আদর্শ সময় পশ্চিমঘাট দেখার। বাদল মেঘগুলো পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় ধাক্কা খেলো মানেই, বর্ষা এল।
আরও পড়ুন: পাহাড়ের কোলে ঝান্ডি-সুনতালে
সহ্যাদ্রি আর পশ্চিমঘাট, ওই একই হল! চলতি নাম পশ্চিমঘাট। সে কি এতটুকু জায়গা নাকি? সেই মহারাষ্ট্র থেকে শুরু হয়েছে, তারপর গোয়া, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালা হয়ে কন্যাকুমারী শহরের কাছে ভারতের দক্ষিণ বিন্দুতে এসে মিলেছে। ১৬০০ কিলোমিটার এর বিস্তার। তার মধ্যে ষাট শতাংশই কর্ণাটকের দখলে। সুতরাং, এ বর্ষায় ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম কর্ণাটককে।
এ বছর সেই যে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ঢুকে পড়ল কেরালায় আর কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে গেল, তারপর থেকে বৃষ্টি থামার আর নামগন্ধ নেই। এমন দীর্ঘকালীন ঘন বর্ষা কলকাতা শেষ কবে দেখেছে, মনে পড়ে না। ভোররাতে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়েছিলাম ব্যাঙ্গালুরুর উদ্দেশে।
ছোট্ট পাহাড়ি শহরে এমনিতেই ঝুপ করে রাত নামে। তার সঙ্গে যদি বৃষ্টি আর ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ার দাপট চলে, তাহলে তো সন্ধ্যাতেই মধ্যরাত। গোটা এলাকাটাই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তায় টিমটিমে স্ট্রিটলাইট। পথঘাট ভালো বোঝা যায় না। পথ হারিয়ে দু তিনবার এদিকসেদিক করে মনে হলো, আরে! আসার সময় তো এতোটা সময় লাগেনি!
অনেক বছর বাদে বিশ্বানাথনের সঙ্গে দেখা। দক্ষিণভারতে আমার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সারথি কাম গাইড কাম দোভাষী। মালয়ালাম মাতৃভাষা হলেও তামিল, তেলেগু, কন্নড়, হিন্দি, ইংরেজি ঝরঝরে বলতে পারেন। বাংলা বোঝেন, তবে বলতে পারেন না। ২০১৮ সালে মুন্নার পাহাড়ে নীলকুরিঞ্জি দেখতে গিয়েছিলাম। ওই শেষ দেখা, তারপরে আর এদিকটায় আসা হয়নি। এই ক’বছরে উনি আরও বৃদ্ধ হয়েছেন, ড্রাইভিং-এর গতি কমেছে। তবু, তিনি আমার কাছে সেই বনস্পতির ছায়ার মতো, এক অদ্ভুত আস্থা!
ব্যাঙ্গালোরের আবহাওয়াটা বেশ উপভোগ্য। বর্ষাকালেই ঠান্ডা পড়ে যায়। বৃষ্টি বন্ধ হলেই ভ্যাপসা গরমে প্রাণান্তকর অবস্থা হয় না। এতদিন লোকমুখে শুনেছি, এবার নিজের অভিজ্ঞতায় অনুভব করলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। একটা গরম পোশাক গায়ে জড়ালে আরাম হয়।

মাইসোর হাইওয়ে ধরে সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটছে। পাহাড়ঘেরা বিস্তৃত উপত্যকা। আকাশপথেই দেখেছিলাম লাল সবুজ খোপকাটা জ্যামিতিক ছবি। লাল মাটির দেশে চাষের খেতগুলোই এমনটা দেখাচ্ছিল। ফসলভরা খোপগুলো সবুজ। আর বাকিগুলোতে মাটি কোপানো হয়েছে চারা লাগানো জন্য। গুগুলের দেখানো শর্টকাট রাস্তাগুলো বেশিরভাগ ভাঙাচোরা। গাড়ির গতি তখন থমকে যাচ্ছে।
একটা সময় মাইসোরকে বাইপাস করে চলে গেলাম। খুব জোড়ে না হলেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। সমতল ছেড়ে কখন যে পাহাড়ি পথে উঠে পড়েছি, খেয়াল করিনি। তখন সাড়ে তিনটের কাছাকাছি, বেশ বড় একটা জনপদ, দোকানের হোর্ডিং বলছে মাদিকেরি এসে গেছি।
পর্যটনের প্রচারে প্রায়শই মাদিকেরিকে “কুর্গ” বলা হয়, মানে যাহাই কুর্গ, তাহাই মাদিকেরি। মনে ধন্দ ছিল। ভাবতাম, পাশাপাশি টুইন সিটি বোধহয়। আসলে, কুর্গ জেলার সদর শহর মাদিকেরি। কুর্গ নামটা কিন্তু সাবেকি, এখন নাম বদলে কোড়গু। কুর্গ জেলায় বেশ কয়েকটি শহর এবং গ্রাম রয়েছে — যেমন মাদিকেরি, বিরাজপেট, কুশলনগর, সোমওয়ারপেট এবং গোনিকোপ্পাল — যাদের অবস্থান পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে।

আমাদের থাকার জায়গাটায় পৌঁছতে আরও আধঘন্টা সময় লাগলো। শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে খানিক দূরেই। এদিকটা পথঘাট সামান্য চড়াই। ফাঁকা ফাঁকা, গাছগাছালিতে ভর্তি রেসিডেন্সিয়াল এলাকা। কেন্দ্রিয় বিদ্যালয়ের ঠিক পাশেই আমাদের সাদামাটা হোমস্টে। উল্টোদিকের বড় লালবাড়িটা ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট।
আমাদের হোমস্টের নাম ‘কুর্গ গ্রিন মিস্ট’। এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নামকরণ। চারপাশটা জঙ্গল আর কুয়াশায় মাখামাখি। আমাদের বারান্দা থেকে উল্টোদিকের পাহাড়টা দেখা যায়। গায়ে টুকরো টুকরো মেঘ লেপটে ছিল। আধঘন্টা পর চতুর্দিক সাদা করে সবটা ঢেকে দিলো। মনে হচ্ছিল, এবার বোধহয় উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে।
এখন বৃষ্টি নেই। আমরা আসার পর বৃষ্টি হয়ও নি। তবে রাস্তা ভেজা। সন্ধ্যে একটু দেরিতেই হয়। বিকেলটুকু পাড়া বেড়াতে ভালোই লাগছিল – সুন্দর ডিজাইনের বাড়িগুলো ফুলের টবে সাজানো, কাঁঠাল ভরা গাছ, খানিক চড়াই উৎরাই পথে ওঠানামা।
কুড়ি কিলোমিটার ‘প্রাণ হাতে নিয়ে চলা’ কাদামাখা রাস্তায় চলতে চলতে শরীরের কলকব্জা সব আলগা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। একটা সময় মুড়ির কৌটোর ঝাঁকুনিটা অভ্যাস হয়ে গেল। তবে বেশ কয়েকবার মনে হয়েছিল, এই বোধহয় গাড়িটা উলটে পাহাড়ের ঢালে গড়িয়ে খাদে পড়ল।
রিসেপশনের ছেলেটির লম্বা পাঁচ শব্দের নাম। আমি শুধু সেখান থেকে ভেঙ্কটেশটুকুই তুলে নিলাম। সে স্ট্রিক্টলি কন্নড় আর ইংরেজি বলে। এক বর্ণ হিন্দি সে মুখে আনবে না। সন্ধ্যাবেলা দেখা হতেই কাল কোথায় কোথায় যেতে পারি, তার একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিলো। অমুক মন্দির, তমুক পার্ক, রাজা সিট, ফোর্ট, – আরও কীসব যেন আছে! কিন্তু, আমাদের ফোকাস তো শুধু বর্ষার জঙ্গল আর ঝরনা।
“রাতের খাবারের কোনও ব্যবস্থা নেই?” জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, “অনলাইন আনিয়ে নিন, নয়তো সিটি সেন্টার চলে যান। কাল সকাল সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্ট পেয়ে যাবেন”।
সন্ধ্যার দিকে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, এখন থেমেছে। উপভোগ করার মতো ঠান্ডা। বিশ্বনাথন গাড়ি চালিয়ে আমাদের মার্কেট এলাকায় নিয়ে এসেছে। সেন্ট্রাল জেলের উল্টোদিকে বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে সিটি সেন্টারে। শহরের কেন্দ্রস্থল। দোকান, বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ নিয়ে জমজমাট এলাকা। হলে কী হবে! রাত সাড়ে আটটাতেই বেশিরভাগ দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই ঝাঁপ বন্ধ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ডিনার সেরে আমরাও ঘরমুখো।
ছোট্ট পাহাড়ি শহরে এমনিতেই ঝুপ করে রাত নামে। তার সঙ্গে যদি বৃষ্টি আর ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ার দাপট চলে, তাহলে তো সন্ধ্যাতেই মধ্যরাত। গোটা এলাকাটাই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তায় টিমটিমে স্ট্রিটলাইট। পথঘাট ভালো বোঝা যায় না। পথ হারিয়ে দু তিনবার এদিকসেদিক করে মনে হলো, আরে! আসার সময় তো এতোটা সময় লাগেনি! এরপর জিপিএস অন করে ঘরে ফেরা। বৃষ্টি যেন আমাদের ঘরে ফেরার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সারারাত ধরে জানান দিলো তার দাপট। (Western Ghats)
সকালেও সে থামবার পাত্রী নয়। চতুর্দিক সাদা। ডট সাড়ে আটটায় ভেঙ্কটেশ যে ধোসাটা নিয়ে এলো, তা দেখে রীতিমত হতাশ! কোথায় সেই লম্বা কুড়মুড়ে পাটিসাপটা মার্কা পাতলাখোলের মধ্যে আলু, পেঁয়াজ, টমেটো, কারিপাতার পুর! আর কোথায় এই চাল-ডালের ব্যাটারে তৈরি মোটা গোলা রুটি! (Western Ghats)
বেরোতে বেরোতে একটু বেলাই হলো। অবিরাম বারিধারা খানিক কমলেও, পুরোপুরি থামে নি। এপাড়া ওপাড়া হয়ে, কফি বাগানের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা। বড় বড় গাছগুলো অভিভাবকের মতো ছায়া দিয়ে কফি গাছেদের আগলে রেখেছে। সূর্যের আলো তো ওদের গায়ে লাগলে চলবে না। একধারে শ্যাওলাধরা বুনো ফার্ণে ঢাকা স্যাঁতস্যাঁতে পাথুড়ে দেওয়াল। (Western Ghats)
অ্যাব্বে মোড় থেকে রাস্তা দুভাগ হয়েছে। বামহাতি উৎরাই পথ ধরেই পৌঁছে যাবো অ্যাব্বে ঝরনার কাছে। ব্যাঙ্গালুরুবাসীদের জন্য ছয় ঘন্টার গাড়িপথে ছোট্ট একটা উইকএন্ড। ট্যুরিস্ট সমাগম অন্তত তাই বলছে। অ্যাব্বের কাছে পৌঁছতে আরও খানিকটা পথ। টিকিট কাউন্টার পেরিয়ে বৃষ্টিভেজা পিছল সিমেন্টের সিঁড়ি। জলে ধোওয়া জঙ্গল থেকে ভেসে আসে প্রাণখোলা বর্ষার ডাক। ঝিঁঝিঁ, ব্যাঙ চেনা হলেও বাকিরা অচেনা। (Western Ghats)
অনেকটা নীচে নেমে ভিড় ঠেলে ঝরনার সামনে পৌঁছলাম। ৭০ ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বড় পাথরগুলোকে পাশ কাটিয়ে জংলি পথেই বয়ে গেছে। জলকণাগুলো ছিটকে ধোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। কোনওকালে ঝুলন্ত ব্রিজটা দিয়ে এপারওপার করা যেত। পর্যটকদের হুল্লোড় আর অত্যাচার সইতে না পেরে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। জলের তোড় যেন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সবকিছু। ঝরনার ওই গমগমে শব্দের অনুরণন নিয়ে ফিরেছিলাম। (Western Ghats)

অ্যাব্বে মোড় ফেরার পর ঝেপে বৃষ্টি নামল। এখান থেকে স্থানীয় সাফারি গাড়ি চেপে মন্ডলপট্টি ভিউ পয়েন্টে যাওয়া যায়। কিন্তু কুয়াশামাখা বৃষ্টির দিনে কোনও ভিউ যে দেখা যাবে না, তা আগে থেকেই অনুমান করেছিলাম। আপাতত আকাশ পরিষ্কার হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তবু ঝোঁক চাপল। দোকান থেকে সস্তার রেনকোট কিনে সাফারি জিপে চেপে বসলাম। যদিও, একে রেনকোট না বলে প্লাস্টিকের টুপিওয়ালা জামা বলাই ঠিক হবে। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটে এখানকার স্থানীয়রা এরকম বর্ষাতি পরেই কাজকর্ম করে। (Western Ghats)
সাফারি জিপের পিছনদিকে জলের ঝাপটা এসে গাড়ির ভিতর পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে। চড়াই পথের দুধারে অরণ্যের ঠাসবুনট। নামটা ভারি সুন্দর, পুষ্পগিরি অরণ্য। ডাকনাম, ‘মুগুলি-পেঠ’, অর্থাৎ ‘মেঘের বাজার’। তবে এই মেঘ বাজারে আজ চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি। মেঘ-কুয়াশার খেলায় ঢাকা পড়েছে পাহাড়ি খাদ। রাস্তার সামনের দিকে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। (Western Ghats)

শুরুতে কিছুটা পিচঢালা পথ, তারপর পুরোটাই কাঁচা রাস্তা। ভাঙাচোরা, বড় বড় গর্ত। লাল মাটির রঙে জমা জলটুকুও লাল হয়ে আছে। কুড়ি কিলোমিটার ‘প্রাণ হাতে নিয়ে চলা’ কাদামাখা রাস্তায় চলতে চলতে শরীরের কলকব্জা সব আলগা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। একটা সময় মুড়ির কৌটোর ঝাঁকুনিটা অভ্যাস হয়ে গেল। তবে বেশ কয়েকবার মনে হয়েছিল, এই বোধহয় গাড়িটা উলটে পাহাড়ের ঢালে গড়িয়ে খাদে পড়ল। (Western Ghats)
১৬০০ মিটার উঁচু মন্ডলপট্টি থেকে মনোরম সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যায়। পার্কিং থেকে ১০০ মিটার চড়াই ভেঙে টপে পৌঁছে ভিউ পয়েন্ট। সব ভিউ কুয়াশায় ঢাকা। চারপাশ থেকে সে ঘিরে ধরেছে। দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াচ টাওয়ারও দেখা যাচ্ছে না। দমকা হাওয়ায় ছাতা উলটে যাচ্ছে। ভিউ পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। প্লাস্টিকের জামা পরেও আপাদমস্তক ভিজলাম। আর ঘরে ফেরা পর্যন্ত সেই ভেজা জামাকাপড়েই থাকা, এও তো বর্ষার এক ভালোলাগা সিক্ত অনুভূতি। (Western Ghats)
(পরবর্তী পর্ব আগামী মঙ্গলবার)
ছবি ও ভিডিও: লেখক
দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, প্রতিদিন, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো আর ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি।