(North Bengal)
উত্তরবঙ্গে যখন বন্যায় ভেসে যাচ্ছে অনেক জেলা, তখন কী করে কলকাতায় রেড রোডে পুজো কার্নিভাল হয়?
এই দু’চার লাইন লিখে ফেসবুকে অনেকেই ঝড় তুলতে চেয়েছেন দু’দিন আগে। যাঁদের অনেকের উত্তরবঙ্গ সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই তেমন।
উত্তরবঙ্গের অনেক মানুষের মনের মধ্যেও কাজ করে অবহেলা এবং বঞ্চনার কথা। কী কীভাবে উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত এই তালিকা তাঁদের কাছে সব সময় থাকে। খুব স্বাভাবিক। উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত বহু ক্ষেত্রেই। (North Bengal)
আরও পড়ুন: বাংলার মৃত পুজোর গান ও এক অসমিয়া গায়কের মায়াজাল
তবে এই বাক্যটি লেখার পর আরেকটি বাক্য লেখা উচিত।
মালদা থেকে কোচবিহার উত্তরবঙ্গ বিস্তৃত হলেও, মালদার ভূতনি বা মহানন্দাটোলায় কয়েক হাজার লোক প্রতিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কলকাতার মতো কোচবিহার-শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ার কিন্তু তাঁদের নিয়ে ভাবে না। বালুরঘাট বা রায়গঞ্জও উদাসীন থেকে যায়। (North Bengal)
তাহলে কি প্রশ্ন করা যায়, ভূতনিকে নিজেদের অংশ ভাবেই না উত্তরবঙ্গ?
উত্তরবঙ্গে বন্যা হচ্ছে বলে কলকাতায় যদি সেদিন কার্নিভাল বন্ধ করতে হয়, তাহলে তো ভূতনিতে বন্যার জন্য প্রতিবারই শিলিগুড়ি-কোচবিহারের পুজো ঘিরে উৎসব বন্ধ করা উচিত। এসব কিন্তু হয় না! মালদা-রায়গঞ্জ-বালুরঘাটকে তাঁদের অংশই ধরেন না উত্তরবঙ্গের অনেক মানুষ। আবার উল্টোদিক থেকে ওই তিন জেলার অনেকে শিলিগুড়ির তুলনায় কলকাতাকেই বেশি কাছের ভাবেন। নিজেদের জন্য এঁরা একটা নামও বরাদ্দ করেছেন ইদানীং— গৌড়বঙ্গ। (North Bengal)

আর উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত, উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত এই কথাগুলো বেশি শোনা যায়, লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের আগে। বিধানসভার ভোট আসছে তো, এজন্য আরও বেশি শোনা যাবে এসব তত্ত্বকথা। আর একটা কথা এসেই যায়। কদিন আগে যখন কলকাতা ভেসে গেল পুজোর আগে, তখন তা উত্তরবঙ্গের লোকেদের মনে বেশি প্রভাব ফেলেছিল? তার তো কোনও লক্ষণ দেখিনি। (North Bengal)
অবশ্যই উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত। যেভাবে বঞ্চিত জঙ্গলমহল বা পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় বা সুন্দরবন। বঞ্চনার কথা ওঠা উচিত সেখানেও। অথচ সেইভাবে এসব ওঠে না ভোটের আগে! (North Bengal)
“সর্বত্র রাজ্যের উত্তর অংশ অবহেলার শিকার। কেন জানি না, ভারতের পূর্ব অংশে সব রাজ্যেই উত্তরপ্রান্ত অনেকটাই অবহেলিত। রাজ্যের রাজধানী গুলো দক্ষিণ প্রান্তে হওয়ায় উত্তরে উন্নয়নের প্রতিফলন পড়েনি।”
আমাদের বাংলায় যেমন উত্তর-দক্ষিণে একটা তীব্র বঞ্চনা-অবহেলার অংক জড়িয়ে রয়েছে, খুব তাৎপর্যপূর্ণ হল, পূর্ব ভারতে সব রাজ্যেই এরকম পরিস্থিতি। সর্বত্র রাজ্যের উত্তর অংশ অবহেলার শিকার। কেন জানি না, ভারতের পূর্ব অংশে সব রাজ্যেই উত্তরপ্রান্ত অনেকটাই অবহেলিত। রাজ্যের রাজধানী গুলো দক্ষিণ প্রান্তে হওয়ায় উত্তরে উন্নয়নের প্রতিফলন পড়েনি। বিহার, অসম ওড়িশা এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ রাজ্যেই এক ছবি দেখবেন। সর্বত্র বঞ্চিতদের তালিকাতেই উত্তর। (North Bengal)

শুধু পূর্ব ভারতের কথাই বা লিখছি কেন? পূর্বদিক থেকে সরে যদি দেশের অন্য রাজ্যেও চোখ রাখি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিন্তু এক জিনিস দেখব। গোয়ার মতো ছোট জায়গা, সেখানেও উত্তর-দক্ষিণে উন্নয়নের ফারাক অনেক। সেখানে পানাজির মান্ডবী নদী তৈরি করেছে উত্তর ও দক্ষিণের সীমানা। দক্ষিণে উন্নয়ন অনেক। তুলনায় উত্তরে কম। দক্ষিণের হীরের টুকরো হয়ে রয়েছে পানাজি, মারগাও, ভাস্কোর মতো বড় শহর। তুলনায় উত্তর গোয়ায় মাপুসা বাদে বড় শহর নেই। আর্থিক উন্নয়ন বা পরিকাঠামোগত পরিবর্তনও নেই। (North Bengal)

পূর্বাঞ্চলের কথায় ফিরে আসি এবং ফিরে আসি বিহারে।
উত্তর বিহারে রয়েছে বেগুসরাই, সমস্তিপুর, মুজফফরপুর, কাটিহার, পূর্ণিয়ার মতো শহর। এখানে শিল্প এবং অর্থনীতির বিচারে অলিখিত রাজধানী বেগুসরাই। তবে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ওড়িশা বা ঝাড়খণ্ডের মতো সব আলো সব উন্নয়ন কেড়ে নিয়েছে রাজধানী। শুধু কলকাতাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, বিহারের যাবতীয় বিকাশও পূর্ব ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পাটনাকে কেন্দ্র করে। যা দক্ষিণ বিহারের মধ্যে পড়ে। (North Bengal)
পাটনা ছাড়া পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে যেসব জায়গাকে ধরা হয়, নালন্দা-রাজগীর-গয়া সবই দক্ষিণ বিহারে। যোগাযোগের ব্যবস্থা অনেক ভাল বিহারের এই অংশে। শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, কর্পূরী ঠাকুর, আবদুল গফুর, জগন্নাথ মিশ্র থেকে আজকের লালু বা নীতিশ— যেই মুখ্যমন্ত্রী হোন না, পরিস্থিতি পাল্টাতে পারেননি! (North Bengal)
“অসমের দিকে যাওয়া যাক। সেখানেও একই ছবি কিন্তু। উত্তর আসামে বড় শহর বলতে তেজপুর। সাধারণত আপার আসাম ও লোয়ার আসাম বলি আমরা। আপার আসাম মানে কিন্তু উত্তরেরই কথা। এবং সেখানে অনেক বেশি অনুন্নয়ন।”
উত্তর বিহারে লোকসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, শিক্ষিতের হার কম, বন্যার সম্ভাবনা বেশি। দক্ষিণ তো এগিয়ে থাকবেই।
ওড়িশায় চলুন যাই। এখানে উত্তরে রয়েছে ময়ূরভঞ্জ, কেওনঝড়, সুন্দরগড়, বোলাঙ্গির ও ঝাড়সুগুডার মতো আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। উন্নয়ন শব্দটি এখানে অনেক পিছিয়ে। রাজ্যে তিনটি সবচেয়ে এগিয়ে থাকা শহর ভুবনেশ্বর, কটক ও পুরী খুব কাছাকাছি। বাকি অংশে তাই ‘আমরা তো কিছুই পাইনি’ অভিযোগ প্রতিদিনই শোনা যায়। (North Bengal)

অসমের দিকে যাওয়া যাক। সেখানেও একই ছবি কিন্তু। উত্তর আসামে বড় শহর বলতে তেজপুর। সাধারণত আপার আসাম ও লোয়ার আসাম বলি আমরা। আপার আসাম মানে কিন্তু উত্তরেরই কথা। এবং সেখানে অনেক বেশি অনুন্নয়ন। লোকে উত্তর বাংলার মতোই নিজেদের বঞ্চিত ভেবে থাকেন দীর্ঘদিন ধরে। (North Bengal)
দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে যাই, কেরলে। সেখানে উত্তর কেরালাকে সাধারণত মালাবার অঞ্চল বলে। তুলনামূলক ভাবে সেখানে কিন্তু দারিদ্র অনেক বেশি দক্ষিণ কেরালার তুলনায়। কারণটা সেই একই। তিরুবনন্তপুরম বা কোচি, কেরলের নতুন ও পুরনো রাজধানী এই এলাকাতে। সার্বিক উন্নয়নও এখানেই বেশি। সেখানে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট সরকার কার্যত পালা করে আসে। উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ছবিটা কিন্তু পাল্টাল না এতদিনেও। কাসরগড় বা কান্নুর, উত্তরের দুটো শহরে দুদশক আগে গিয়ে দেখেছি উন্নয়ন দক্ষিণের মতো নয়। এখনও ছবিটা এক রয়েছে। কিছুটা ব্যতিক্রমী কোঝিকোড় শহর। (North Bengal)
আরও পড়ুন: দুর্নীতির শিকড় ও ডালপালার খোঁজে
উত্তর প্রদেশ বা মহারাষ্ট্রের মতো বড় রাজ্যে উত্তর বা দক্ষিণ বলে কোনও ভাগ হয়নি। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত এসেছে। মজা হল, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আমরা কখনওই ভাবিনি, পূর্ব-পশ্চিমবঙ্গ বা পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গের কথা ভাবতে। রাজ্যের ম্যাপটাই এমন সরু, এখানে ওই ধরনের ভাবনাটা হাস্যকর। রাজস্থানের ক্ষেত্রে কিন্তু উত্তর এবং দক্ষিণ সংক্রান্ত ভাবনাটা হয়ে থাকে। এবং সেখানেও সেই একই দৃশ্যমালা, উত্তরকে ছাপিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ। (North Bengal)
একটা সমীক্ষা নজরে এল উত্তর রাজস্থানের বিকানের এবং দক্ষিণ রাজস্থানের উদয়পুরকে নিয়ে। স্পষ্ট দেখা গেল, রাজস্থানের দক্ষিণ প্রান্তে মানুষের শিক্ষা এবং আয় অনেক বেশি উত্তরের তুলনায়। পরিকাঠামো অনেক ভাল দক্ষিণ রাজস্থানের। ফলে যা অবশ্যম্ভাবী, দক্ষিণে চাকরির সম্ভাবনা অনেক বেশি। (North Bengal)

অবিকল এক ছবি, বা তার থেকেও স্পষ্ট ছবি কর্নাটকে। বেঙ্গালুরু, মহীশূর ও ম্যাঙ্গালোর— তিনটি বড় শহরই রাজ্যের দক্ষিণে। তাই যা অবধারিত, তাই-ই হয়ে চলেছে। পরিকাঠামো, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য, তিনটেতেই দক্ষিণ কর্নাটক অনেকটাই এগিয়ে উত্তর কর্নাটকের তুলনায়। (North Bengal)
নরেন্দ্র মোদির রাজ্যে আমেদাবাদ বা গান্ধীনগরের মতো শহর কার্যত উত্তর গুজরাটে পড়ছে। অথচ দক্ষিণ গুজরাটই ব্যবসা এবং শিল্পের বিচারে উত্তরের থেকে অনেক এগিয়ে। উত্তর আবার এগিয়ে ডেয়ারি বা কৃষিজাত পণ্যের বিচারে। জানতে চাইবেন, দক্ষিণ গুজরাট কী করে শিল্প বা ব্যবসায় এগিয়ে গেল অনেকটা? এখানে হীরে এবং টেক্সটাইল এর ব্যবসায় সুরাট একাই একশো। তার সঙ্গে বালসাড, ভারুচ ও নবসারী— এই তিনটে শহর এক অন্য মাত্রা দিয়েছে দক্ষিণ গুজরাটকে! (North Bengal)
এত তথ্য পড়ার পরেও যদি উত্তরবঙ্গের কোনও মানুষ ভাবেন, আমরা অবহেলিত থেকে গিয়েছি, তাহলে এসব থেকে সান্ত্বনা খুঁজতে পারেন! উত্তরকে অবহেলার কথা বর্ষে বর্ষে দিনে দিনে ভারতের সব রাজ্যেই প্রায় হয়ে চলেছে। হয়তো শহর ধরে ধরে হিসেব করলে এমনই দাঁড়াবে। (North Bengal)

কলকাতাতেই দেখুন না, উত্তর কলকাতার থেকে দক্ষিণ কলকাতাতেই উন্নয়ন বেশি। উত্তর কলকাতা অনেকটা পিছিয়ে। নয়াদিল্লি এবং মুম্বইয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা। দক্ষিণ দিল্লি এবং দক্ষিণ মুম্বই অনেক অভিজাত, অনেক বর্ণময়। সেখানে উত্তরের লোকেরা উত্তরবঙ্গের মতোই বলে থাকেন, কোনও ঘটনা দক্ষিণ দিল্লি বা দক্ষিণ মুম্বাইয়ে হলেই অনেক বেশি গুরুত্ব পায় সংবাদ মাধ্যমে। শহরের উত্তরাংশে হলে অতটা গুরুত্ব পেত না। (North Bengal)
লেখাটা শেষ করার আগে একটা তথ্য যোগ করা দরকার। বছর তিন আগে জলপাইগুড়ির মালবাজারে বিজয়া দশমীর দিন মাল নদীতে হরপায় ভেসে গিয়েছিল অনেক মানুষ। মৃত্যু নগরী হয়ে ওঠা মালে চারদিক ভরে উঠেছিল বিষণ্ণতায়। অথচ কয়েক মাইল দূরে শিলিগুড়িতে একদিন পরে দুর্গা পুজো নিয়ে কার্নিভাল কিন্তু বন্ধ হয়নি। দিব্যি চলেছিল। ভিড় করেছিল হাজার হাজার মানুষ। জলপাইগুড়িতে বন্ধ হয়েছিল কার্নিভাল, কিন্তু শিলিগুড়িতে উৎসব বন্ধ হয়নি। অথচ মালের অধিকাংশ লোকই কিন্তু শিলিগুড়িকেই তাঁদের কাছের শহর মনে করেন। (North Bengal)
আরও পড়ুন: ফুলের জলসায় ফুলমালা ডোরে কলকাতা
উত্তরবঙ্গের বন্যার দিন কেন কলকাতায় কার্নিভাল হল, এই প্রশ্নটা অবশ্যই ওঠা উচিত। কিন্তু যাঁরা তুলবেন, তাঁদের একবার মালের সেই বেদনাদায়ক ঘটনা এবং ভূতনির বন্যার্ত মানুষদের তীব্র যন্ত্রণার কথাও ভাবা দরকার। ভাবা উচিত প্রশ্নটা দ্বিচারিতার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে কী না। ভাবার চেষ্টা করছি, গোটা দেশেই উত্তর বনাম দক্ষিণের এই বৈপরীত্য কেন। এবং সেই অঘোষিত যুদ্ধে উত্তরের বারবার হেরে যাওয়ার পেছনে আর কী কী সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ থাকতে পারে। খুঁজেই বেড়াই সেই উত্তর! (North Bengal)
অলঙ্করণ: আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
বিশিষ্ট সাংবাদিক। এই সময় সংবাদপত্রের প্রাক্তন সম্পাদক ও ক্রীড়া সম্পাদক। উত্তরবঙ্গ সংবাদের প্রাক্তন কার্যনির্বাহী সম্পাদক। আনন্দবাজার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে কভার করেছেন একাধিক বিশ্বকাপ ফুটবল ও অলিম্পিক গেমস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, খেলা, গান, সিনেমা, ভ্রমণ, খাবারদাবার, মুক্তগদ্য— বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।
