(Laxmi Sora Painting)
চারিদিকে টিনের দেওয়াল। ওপরে টালি। তারই নিচে বসে ঢাকাইয়া শৈলীর, লক্ষ্মী সরাচিত্র অঙ্কন করে চলেন বছর ৮২র মৃৎশিল্পী সুধীর পাল। বাঙালির আধ্যাত্মিকতার মধ্যে শিল্পচেতনা প্রবলভাবে যুগের পর যুগ ধরে থেকে গিয়েছে। সেই শিল্পচেতনার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ লক্ষ্মীসরা। আর সেই শিল্পধারাকেই উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটি শহরের কাছে রাজেন্দ্রপুর অঞ্চলের মামুদপুর গ্রামের বড়ায় বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। প্রায় ষাট বছর ধরে লক্ষ্মী সরাচিত্র অঙ্কন করে চলেছেন। পিতা পাঁচকড়ি পালের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই শিল্পশৈলী শেখা। (Laxmi Sora Painting)
শিল্পীর পৈতৃক বাড়ি ছিল ঢাকা বিক্রমপুরের খড়িয়া গ্রামে। তারপর কেটে গিয়েছে বহু দশক। দেশভাগ। ওপার থেকে এপারে চলে আসা। শিকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েও বংশপরম্পরায় চলে আসা এই শিল্পশৈলীকে নিজের আঙুলের ডগা থেকে ভুলতে দেননি তিনি। তাই এবার, বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষ্যে দেড়শোটির মতো সরা অঙ্কন করেছিলেন তিনি। শিল্পীর কথায় চলতি বছরের শ্রাবণ মাস থেকে সরা অঙ্কনের কাজ শুরু হয়েছিল। (Laxmi Sora Painting)
আরও পড়ুন: বাংলার পুতুলের শ্রমজীবী ধারা
পোড়ামাটির সরাতে প্রথমে খড়িমাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। তারপর জোড়া ময়ূর আঁকা হয়। এরপরে কাটাম দেওয়া হয়। অর্থাৎ একাধিক চতুষ্কোণ ঘর তুলির মাঝারি টানে সরার ওপর অঙ্কিত করা হয়। তারপর একে একে কৃষ্ণ, রাধা, লক্ষ্মী, জয়া ও বিজয়া রুপ পায় সরার মধ্যে। এক একটা সরা অঙ্কন করতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। রঙ করার ক্ষেত্রে গুঁড়ো রঙ ব্যবহার করা হয়। বৃদ্ধ বয়সে চোখে চাপ লাগলেও শিল্প সাধনার অধ্যাবসায়ের মধ্যেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। (Laxmi Sora Painting)

সহধর্মিনী শোভা পাল জীবিত থাকাকালীন সরা অঙ্কনের ক্ষেত্রে শিল্পীকে সাহায্য করতেন। এখন কন্যা শিখা পাল, তাঁকে কিছুটা সাহায্য করে থাকেন। আক্ষেপের সুরে শিল্পী জানিয়েছেন যে তাঁর পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম এই শিল্পশৈলী শেখেনি। ফলে তিনি নিজেই এই শৈলীর শেষ উত্তরাধিকার। আগে লক্ষ্মীসরা তৈরির পাশাপাশি পোড়ামাটির আসবাব যেমন হাঁড়ি, কলসি, থালা-বাটি বানাতেন। কিন্তু মৃৎসামগ্রী চাহিদা কম থাকায় বর্তমানে গেঞ্জির কারখানায় সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। (Laxmi Sora Painting)
কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো উপলক্ষ্যে সরা অঙ্কন করেন। শিল্পী হিসেবে কোনও সরকারি ভাতা এখনও পর্যন্ত তিনি পাননি। এমনকি বার্ধক্য ভাতার থেকেও তিনি বঞ্চিত। এত বঞ্চনা ও প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে ঢাকাইয়া শৈলীর সরা শিল্পকে তিনি উজ্জীবিত করে রেখেছেন। (Laxmi Sora Painting)
“শিল্পী তৈরি এই সরাগুলোর মধ্যে আলাদা করে মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি আঁকা হয়নি। এমনকি দশভূজার হাতেও কোনও অস্ত্র নেই। শিল্পীর কথায় বংশ পরম্পরা মেনে এগুলো অঙ্কিত হয়ে আসছে দশকের পর দশক ধরে।”
তাঁর নির্মিত ঢাকাইয়া শৈলীর সরার গড় উচ্চতা সাড়ে ১০ ইঞ্চি। সরা কানার দিকটা মাটির আস্তরণ দিয়ে উঁচু করে তৈরি করা। শিল্পীর কথায় এই উঁচু দিকটাকে বিট বলা হয়ে থাকে। মা লক্ষ্মীর শারীরিক গঠনের মধ্যে দেবোত্তর থেকে লোকজ শৈলী বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। মা লক্ষ্মীর গলার মালা ও হাতের চুড়ি অলংকরণের ক্ষেত্রে কালো রং ব্যবহার করা হয়েছে। লাল রং দিয়ে মা লক্ষ্মীর শাড়ি ও মুকুট তৈরি করা হয়েছে। ঠিক একই শৈলীতে সরার মধ্যে থাকা জয়া বিজয়া রাধা কৃষ্ণ তৈরি করা হয়েছে। (Laxmi Sora Painting)

সরা চিত্রে, একমাত্র মা লক্ষ্মীর মাথাতেই মুকুট রয়েছে। ময়ূরপঙ্খী নৌকোর ওপর বিরাজ করছেন মা লক্ষ্মী। দুটি ময়ূরের পেখম যেখানে মিশে গিয়েছে সেখানেই শিল্পী তৈরি করেছেন প্যাঁচা। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সরার মধ্যে থাকা শ্রীকৃষ্ণের গহনার অলংকরণ হলুদ রঙের। (Laxmi Sora Painting)
মা লক্ষ্মী ও অন্যান্য নারী মূর্তির গায়ের রঙ হলুদ বর্ণ। কালো রঙের ময়ূরের শরীরের মধ্যে হলুদ রঙ দিয়ে অলংকরণ করা হয়েছে। প্রতিটা শরীরের হাত উপর দিকে তোলা। হাতের গঠনের অভিব্যক্তি বিমূর্ত। সরু তুলির দ্রুত লয়ে মা লক্ষ্মী ও অন্যান্য চরিত্রগুলির অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। (Laxmi Sora Painting)
আরও পড়ুন: মাটির শরীরে তুলির টান
শিল্পীর কথায় এটি হচ্ছে পাঁচ পুতুলি সরা। অর্থাৎ পাঁচটি চরিত্র সরার মধ্যে অঙ্কিত হয়েছে। এ ছাড়াও সরা চিত্রের মধ্যে মা দুর্গা, লক্ষ্মী-গণেশ, কার্তিক-সরস্বতীকে দেখা যায়। তারই নিচে বিরাজ করেন মা লক্ষ্মী ও তাঁর দুই পাশে জয়া ও বিজয়া। আবার আরেক সরা চিত্রে দেখা যায় ময়ূরপঙ্খী নৌকোর মধ্যে জয়া ও বিজয়াকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মা লক্ষ্মী। (Laxmi Sora Painting)
“লোকসংস্কৃতি গবেষক বিধান বিশ্বাসের মতে “পূর্ববঙ্গে ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, যশোর, টাঙ্গাইল, রঙপুরে সরায় পুজো করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।”
তাঁর মাথার ওপর হলুদ রঙের রশ্মি সহ অর্ধ সূর্য আকৃতি অংকন করা হয়েছে। বিশালাকার পেঁচার পিঠে থাকা পদ্মের ওপর মা লক্ষ্মী বসে। তার দুইদিকে একটি করে পদ্ম এবং জয়া ও বিজয়া। শাড়ি পরার শৈলীর মধ্যে অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গ রমনীর ছাপ স্পষ্টভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। আবার কদম গাছের তলায় রাধা ও অন্যান্য গোপিনীদের নিয়ে বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন কৃষ্ণ। ঠিক তার নিচে জয়া ও বিজয়াসহ মা লক্ষ্মী। (Laxmi Sora Painting)

শিল্পী তৈরি এই সরাগুলোর মধ্যে আলাদা করে মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি আঁকা হয়নি। এমনকি দশভূজার হাতেও কোনও অস্ত্র নেই। শিল্পীর কথায় বংশ পরম্পরা মেনে এগুলো অঙ্কিত হয়ে আসছে দশকের পর দশক ধরে। (Laxmi Sora Painting)
লোকসংস্কৃতি গবেষক বিধান বিশ্বাসের মতে “পূর্ববঙ্গে ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, যশোর, টাঙ্গাইল, রঙপুরে সরায় পুজো করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ঢাকায় মুন্সিগঞ্জ ও বিক্রমপুরে সরা তৈরি হয়ে থাকে। ফরিদপুরে সুরেশ্বরী শৈলী সরার জনপ্রিয়তা রয়েছে। মূলত নদীয়া জেলার তাহিরপুরে এই শৈলীর সরা দেখতে পাওয়া যায়। ঢাকাইয়া শৈলীর সরার সঙ্গে সুরেশ্বরী সরার পার্থক্য রয়েছে। (Laxmi Sora Painting)

সুরেশ্বরী সরাতে অলংকরণের পরিমাণ অনেক বেশি। সেখানে ঢাকাইয়া শৈলী সরায় অলংকরণ কম। সুরেশ্বরীতে অলংকরণের ক্ষেত্রে সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। ঢাকাইয়াতে কালো রঙ ব্যবহৃত হয়েছে। সুরেশ্বরীর সরার কানার দিকটা আলাদা করে উঁচু করা হয়নি এবং সেখানে খুব সুন্দরভাবে অলংকরণ করা হয়েছে। কিন্তু ঢাকাইয়া সরার ক্ষেত্রে কানার দিকটা উঁচু এবং সেখানে গেরুয়া রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। (Laxmi Sora Painting)
“প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে সরার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম হলেও, সুধীর পালের মতন শিল্পীরা বঞ্চনার অন্ধকারেই থেকে যান। তাঁদের পরিশ্রম, সাধনা ও চেষ্টার প্রকৃত মূল্য তাঁরা পান না।”
ঢাকাইয়া শৈলী সরার অঙ্কনের মধ্যে তুলির টানে দৃঢ়তা লক্ষ্য করা যায়। তুলির লম্বালম্বি টানে শাড়ির ওপর নকশা আঁকা হয়। আরও একটি বিশেষত্ব হল এই সরার মধ্যে লক্ষ্মী, জয়া ও বিজয়া ছাড়াও জোড়া রাধাকে দেখতে পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন শৈলীতে সরা অঙ্কিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকাইয়া শৈলীর লক্ষ্মীসরা।” (Laxmi Sora Painting)

উল্লেখ করা যেতে পারে লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরার পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীর সমাজ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে দেশ বিভাগের পর সরা শিল্পীরা নদীয়া এবং ২৪ পরগনা জেলায় চলে আসেন। এর ফলে কলকাতাসহ তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে লক্ষ্মীপুজোয় এই চিত্রিত সরা দেখতে পাওয়া যায়। মূলত কুম্ভকার সম্প্রদায়ের শিল্পীরা লক্ষ্মীসরা নির্মাণ করে থাকেন। (Laxmi Sora Painting)
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে সরার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম হলেও, সুধীর পালের মতন শিল্পীরা বঞ্চনার অন্ধকারেই থেকে যান। তাঁদের পরিশ্রম, সাধনা ও চেষ্টার প্রকৃত মূল্য তাঁরা পান না। তাই সংসার চালানোর জন্য আজও গেঞ্জির কারখানায় সেলাইয়ের কাজ করতে হয় প্রতিভাবান এই শিল্পীকে। তবুও শীর্ণকায় শরীর ও ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের গালভরা হাসি মেখে একনিষ্ঠ হয়ে সরাচিত্র অঙ্কন করে যান। (Laxmi Sora Painting)
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: প্রবীণ গবেষক বিধান বিশ্বাস
গ্রন্থঋণ: পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ, তারাপদ সাঁতরা
প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবিগুলো প্রতিবেদকের নিজের তোলা
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
পেশায় সাংবাদিক। কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়ের থেকে সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপনে স্নাতকোত্তর। বাংলার পুতুল শিল্পকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। লেখকের, ‘আমাদের কথা’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। সেখানে বাংলার বিভিন্ন জেলার মাটির পুতুল নিয়ে ১৫০ টি পর্বে ভিডিও করেছেন তিনি। শিল্পীদের ঘরে গিয়ে শুনেছেন তাঁদের মনের কথা। এছাড়া শিবের মুখোশ, চালচিত্র, লক্ষ্মী সরা, মনসা ঘট, মনসা চালি, ছলনের ঘোড়া নিয়েও তিনি পর্ব তৈরি করেছেন তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে। লেখক নিজে পুতুল সংগ্রাহক। এই লেখায় ব্যবহৃত ছবিগুলো লেখকের নিজের সংগ্রহে থাকা পুতুলের।