(Ooty)
দ্বিতীয় দিন :
আজ সফরসূচী বেশ লম্বা, চটপট ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পরলাম। দুপাশে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে চা বাগান, কোথাও কোথাও পাতা তোলা চলছে। আজকাল আর আগের মতো পিঠে ঝুড়ি নিয়ে ‘দুটি পাতা, একটি কুঁড়ি’ তোলা হয় না। কাঁচি দিয়ে ঘসঘস করে ঘাস কাটার মতো কেটে প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে ফেলে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় কচিসবুজ পাতার দুলুনি দেখতে দেখতে চলে এলাম হেয়ারপিন বাঁকের শুরুতে।
আরও পড়ুন: নীলগিরি ডায়েরি – প্রথম পর্ব
গতকাল সন্ধ্যায় ভাল বোঝা যায় নি, দিনের আলোয় বাঁকগুলো বেশ ভয়ংকর। এক এক বাঁকে অনেকটা করে উপরে উঠে যাচ্ছে গাড়ি। রাস্তা মন্দ নয়, কিন্ত বেশ সংকীর্ণ। অন্যদিক থেকে গাড়ি এসে গেলে, পাশ কাটানো বেশ কঠিন। রাস্তার দুপাশে সতর্কীকরণ বোর্ড, তাতে হেয়ারপিন বেন্ড-এর নম্বর লেখা। ভয়ে ভয়ে বাঁক গুনছি, আর ইষ্টনাম জপছি। আমরা সমতলি, রোজ রোজ তো আর ঘুরন্ত রাস্তা দিয়ে গাড়ি হাঁকাই না! সাহস করে যখন জলে নেমেই পড়েছি, তখন সাঁতার তো শিখতেই হবে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর, শেষ বাঁকটি পেরিয়ে ধড়ে প্রাণ এল যেন!

প্রথম গন্তব্য ছিল উটি বটানিক্যাল গার্ডেন। টিকিট কাটার লম্বা লাইন। উটি দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় শৈলশহর। ১০০ টাকা মাথাপিছু প্রবেশমূল্য দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। গুগল ঘেঁটে জানলাম, ১৮৪৮ সালে, মাদ্রাজের তৎকালীন গভর্নরের উদ্যোগে, ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ উইলিয়াম ম্যাকইভারের হাতে উটি বটানিক্যাল গার্ডেনের জন্ম। প্রায় ৫৪ একর জুড়ে পাহাড়ের ঢালে ধাপ কেটে কেটে তৈরি সুন্দর এই উদ্যানে হাজারেরও বেশি প্রজাতির গাছগাছালি আছে। বয়সের ভার একে ন্যুব্জ করেনি, বরং সমৃদ্ধ করেছে দেখে খুব ভাল লাগল।
স্টেশন পেরোতে না পেরোতেই সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল ট্রেন, বেরোতেই চোখ জুড়ানো সবুজ উপত্যকা, ঘন পাইন বন, দূরে পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে সাজানো ছবির মতো জনপদ, এভাবেই লুকোচুরি খেলতে খেলতে পৌঁছে গেলাম ছবির মতো সুন্দর ওয়েলিংটন স্টেশন, তারপর কুনুর।
এত যত্নে লালিত সরকারি উদ্যান সচরাচর চোখে পড়ে না। মূল প্রবেশদ্বারের কাছে নরম সবুজ ঘাসে ঢাকা এক সুবিশাল লন। তার পাশ দিয়ে হেঁটে আমরা এলাম গ্রিন হাউসে, যেখানে প্রচুর ফুল ও দুষ্প্রাপ্য অর্কিডের সম্ভার। ইটালিয়ান গার্ডেনটি আবার ইউরোপিয়ান শৈলীতে তৈরি। নানান রকম ম্যানিকিওর করা গাছ, ঝর্ণা, এঁকেবেঁকে চলা ছোট্ট জলধারা, লোটাস পন্ড, সব মিলিয়ে অপূর্ব। ২০০ লক্ষ বছরের পুরোনো ফসিল বৃক্ষটি পর্যন্ত কী মমতায় লালিত! সারাক্ষণ রক্ষণাবেক্ষণ চলছে, কোথাও কুটোটি পড়ে নেই। এত ভিড়, কিন্তু কোনও ধাক্কাধাক্কি, চেঁচামেচি নেই। সবাই নিয়ম মেনে ঘুরছে, যেখানে ‘নো এন্ট্রি’, সেখানে অযথা ঢুকে পড়ে কাউকে বিরক্ত করছে না।

নীলগিরির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘ডোডাবেতা পিক’ দেখতে গিয়ে সেই উচ্ছ্বাস একেবারে জল। গাড়ির পর গাড়ির লাইন, ক্রমে লম্বা থেকে লম্বাতর। বড় বাস থেকে পুচকে মারুতি সবাই দাঁড়িয়ে। শামুকের চেয়ে শ্লথ গতি। কিছুক্ষণ পর শুরু হল আসল খেল। কেউ লাইন ছেড়ে এদিক ওদিক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে, কেউ গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যেতে চাইছে, কোথাও গাড়ি থেকে নেমে মানুষজন হাঁটতে শুরু করেছে – সব মিলিয়ে মিশিয়ে সাংঘাতিক যানজট। ঘণ্টাখানেক ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থায় কাটিয়ে আমরা ডোডাবেতা পিক দর্শনের আশা ছেড়ে কোনোরকমে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলাম উটি লেক।
লাঞ্চ সেরে টিকিট কেটে ভেতরে এসে বেশ হতাশ হলাম। লেকে জল বিশেষ নেই। তার মধ্যেই বোটিং হচ্ছে – স্পীড বোট, রো বোট, প্যাডল বোট, নানা ধরণের ছোট বড় নৌকোতে ট্রাফিক জ্যাম হওয়ার জোগাড়। দাম বেশ চড়া। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্যে চারজনের বোট ভাড়া আটশ টাকা। লেকের পাশ দিয়ে টয়ট্রেন চলছে। ৫/৭ মিনিটের ছোট্ট রাইড, ভাড়া ষাট টাকা। তাতে কি? টিকিট ঘরের সামনে লাইন দুর্গাপুজোকে হার মানাবে। (Ooty)

সবে টয়ট্রেনে চেপেছি, বলা নেই কওয়া নেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। রাইড শেষ, এদিকে নামবার জো নেই। ওদিকে বোট অপারেটর কোম্পানি ইয়া বড় স্পীডবোট নিয়ে টুরিস্ট উদ্ধারে, মানে বৃষ্টির হাত থেকে উদ্ধারে নেমে পড়েছে। কাকভেজা হয়ে সব ফিরছে, মুখের হাসিটি কিন্ত অমলিন। সাড়ে চারটে বাজতে আমরাও শেষমেষ ভিজে ভিজেই দৌড় দিলাম পার্কিং অভিমুখে। আমাদের বুকিং করা রয়েছে নীলগিরি মাউন্টেন রেলে – ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। (Ooty)
১৯০৮ সালে নির্মিত মেটুপালয়ম-উটি-কুনুর নীলগিরি মাউণ্টেন রেলপথটি শুধুমাত্র ইউনেস্কো কালচারাল হেরিটেজ নয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেও খুব জনপ্রিয়, বিশেষত উটি-কুনুর সেগমেন্টটি। স্বভাবতই টিকেটের খুব টানাটানি। আগেভাগে টিকেট কেটেও আমরা কুনুর-উটির রিটার্ন টিকিট পাইনি। কুনুর থেকে আমাদের লোকাল বাসে চেপে উটি ফিরতে হয়েছিল। গাড়ি উটি স্টেশনে পার্ক করা ছিল কিনা! (Ooty)

যাত্রাপথটি সত্যিই সুন্দর। স্টেশন পেরোতে না পেরোতেই সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল ট্রেন। বেরোতেই চোখ জুড়ানো সবুজ উপত্যকা, ঘন পাইন বন, দূরে পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে সাজানো ছবির মতো জনপদ, এভাবেই লুকোচুরি খেলতে খেলতে পৌঁছে গেলাম ছবির মতো সুন্দর ওয়েলিংটন স্টেশন, তারপর কুনুর। স্টেশনের কাছেই বাস স্ট্যান্ড। বাস ধরবার আগে বাজার ঘুরে কিনলাম স্থানীয় হোমমেড চকোলেট, ইউক্যালিপটাস তেল ও কাঠের তৈরি ঘর সাজানোর কিছু জিনিস। (Ooty)

বেশ রাত হল ফিরতে। ফেরার পথে কোটাগিরি বাজারের কাছে “তন্দুর হাট” থেকে ডিনার কিনে আনলাম। এক চিলতে দোকান, সেভাবে বসার জায়গা নেই, কিন্তু চিকেন রোল, কাবাব, মোগলাই, মাটন কষা, অপূর্ব! এত ভাল লেগেছিল যে, পরেরদিন আবার ঢুঁ মেরেছিলাম। (Ooty)
তৃতীয় দিন :
সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। তাপমাত্রা এক ঝটকায় পাঁচ ডিগ্রি কমে গেছে। শীতবস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেবন্তীর হাতের চা বিস্কুট খেয়ে রওনা দিলাম কুনুর টি এস্টেট ঘুরতে। উটি কোটাগিরি সর্বত্র প্রচুর সুন্দর সুন্দর চা-বাগান দেখেছি, কিন্তু কুনুরের চা-বাগানের অনবদ্য রূপটি সবাইকে যেন হার মানায়। আদিগন্ত সবুজ কার্পেটে মোড়া পাহাড়ের গায়ে সারি সারি চা গাছ, শিশির ভেজা পাতায় মুক্তোদানার মতো টলটলে জলবিন্দু। (Ooty)

হঠাৎ হাওয়ার হালকা দোলায় ঢেউ খেলে যায় বাগান জুড়ে। শান্ত নিরুদ্বিগ্ন পরিবেশ, পাখির কিচিরমিচির ছাড়া কোনও শব্দ নেই। গাছেদের সঙ্গে দোস্তি করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। ভেতরের শুঁড়ি পথ ধরে বেশ খানিকটা চলে যাওয়ার পর সহসা সর্পভীতি জাগায় তৎক্ষণাৎ পিঠটান দিলাম। কোথাও একটা পড়েছিলাম, চা-বাগানে নাকি খুব বিষধর সাপ থাকে। (Ooty)
বাগানের পাশেই ছোট্ট টি স্টল। চায়ের স্বাদ অপূর্ব। দু কাপ চা নিয়ে বসে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম এর স্বাদ, গন্ধ।উপরি হিসেবে রইল সবুজের ক্যানভাসে প্রকৃতির আঁকা এক অপূর্ব জলছবি। চা কেনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আগে বার দুয়েক ঠকে গেছি বলে সাহস পেলাম না। যে চা খাওয়ানো হয় আর যে প্যাকেট বিক্রি করে, সেটা আলাদা হয়। (Ooty)

এবার ফেরার পালা। হোমস্টেতে ফিরে দীনেশ ও লিওকে বিদায় জানিয়ে, ব্যাগ, সুটকেশ গুছিয়ে রওনা দিলাম। পথে ডলফিন’স নোজ (Dolphin’s Nose) ভিউপয়েন্ট দেখে নেওয়ার ইচ্ছে। এটা প্ল্যানে ছিল না। কিন্তু গতকাল ভিড়ের চাপে ডোডাবেতা মিস হয়ে যাওয়ায় সবার মন খারাপ। যদিও উচিত ছিল সকালেই মালপত্র লোড করে একবারে গাড়ি স্টার্ট দেওয়া। এক্সট্রা ড্রাইভ করতে হত না তাহলে। (Ooty)
এখানেও এন্ট্রি টিকেট আছে। গাড়ির জন্য আলাদা, মানুষের জন্যে আলাদা। আজ তেমন ভিড় নেই বলে ঘুরে ফিরে খানিক সময় নিশ্চিন্তে কাটানো গেল। এখান থেকে কোটাগিরির পাহাড় দেখা যায়। দিনটা রোদ ঝলমলে হলে পাহাড়ের রূপ আরও খোলতাই হত, কুয়াশা ঢাকা ধোঁয়াশা চেহারাও মন্দ লাগল না। শুধু কোনো জলপ্রপাত দেখতে পেলাম না সে ভাবে। যা হোক, যা পেলাম তাই বা কম কী? স্মৃতির মণিকোঠায় এভাবেই তো ধীরে ধীরে মণিমুক্তো জমে উঠে। (Ooty)

কদিন ধরে হেয়রপিন বাঁকের ঘূর্ণিপাকে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত আমরা অন্য রুটে গুডালুর এলাম। সময় অনেক বেশি লাগল। গল্প শেষ হতে কিছু বাকি ছিল তখনও। উড়ুপি ভোজনালয়ে কফি খেয়ে দাম দেওয়ার সময় খেয়াল হল, হোমস্টের চাবিটা আমরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। ব্যস! হয়ে গেল। ফোন করে হোমস্টের মালিককে জানানো হল। সজ্জন মানুষটি বেশি বকাঝকা করেন নি। উল্টে দীনেশ সব চেক করে নেয়নি বলে কিঞ্চিত দুঃখ প্রকাশ করলেন। তীর্থের কাকের মতো বসে থেকে থেকে বড়া, ধোসা, ইডলি, কফি সব আত্মস্থ করে, বাইক আরোহী ডেলিভারি ম্যানকে চাবি হস্তান্তর করে শেষমেষ ঘরের পথ ধরলাম। (Ooty)
(সমাপ্ত)
ছবি:শুভাশীষ ব্যানার্জী
মণিদীপার লেখায় কল্পনা ও বাস্তব হাত ধরাধরি করে চলে। সহজ ঝরঝরে ভাষায় শিশুদের জন্যে মজাদার গল্প বোনার পাশাপাশি, তিনি তথ্যনির্ভর ভ্রমণসাহিত্য রচনায় সমান মুনশিয়ানা দেখান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ছাত্রী একসময় চুটিয়ে লিখেছেন দ্য স্টেটসম্যান, সানন্দা, ভ্রমণ, Better Photography, Times Journal of Photography, The China Post এবং Travel in Taiwan-এর মতো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
তার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে বিশেষ নিউল্লেখযোগ্য—ঠামমা ও গাভাস্কর, The Misadventures of Teddy Tumbledore, এবং Jungle Beats