(Pre Winter)
অঘ্রাণের মাঠ অবিন্যস্ত কবিতার মতো এলিয়ে দিয়েছে ওর শরীর। মাঠে মাঠে শুয়ে আছে ধানের গোছা। আঁটি বাঁধা হলে ঘরে যাবে সব। ঘরে গেছেও বা কিছু। নিকোনো উঠোনে তাই মেঠো মানুষের পায়ের ছাপ ইতস্তত। শস্যে মুঠি ভরে নেবে সকলেই, তাও কি হয়! মাজরা পোকায় শতচ্ছিন্ন শরীরে কেবল অসহায় ব্যকুলতা। তবু সে আর কতটুকু! গ্রামদেশের ঘরে ঘরে এখন কাজের অন্ত নেই। বেলা ছোট হয়ে গেছে, রোদ্দুর এখন নরম। (Pre Winter)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮]
সেই ভোর ভোর কুয়াশা না কাটতেই ট্যাঁকে ছানাটাকে গুঁজে মাথায় ভাতের পুটুলি সাজিয়ে মায়েরা মাঠে যায় দলে দলে। শাড়ির উপরে ফুলশার্ট পরা শরীর উবু হয়ে কাস্তে চালাচ্ছে। কোনো তাড়া নেই, নেই কোনো জড়তা। কত বছরের অধ্যাবসায় আর অভ্যাসে গড়ে উঠেছে এই ছন্দ। কোলের শিশুটিও নিজের ছন্দে ধুলো মাখছে, মাটি মাখছে। পর্যাপ্ত আলোয় মাঠ আর রাঙাধুলোর পথে এখন কুয়াশা কেটে গেছে। স্পষ্ট হয়ে উঠছে জলছবির মতো এই পৃথিবী। (Pre Winter)

শুকিয়ে আসা নদীতীর, বিবর্ণ ঘাসের বনে এখন জেগে আছে শরফুলেরা। তিলা মুনিয়ার ঝাঁক শরের ডালে দুলে দুলে এই মাঠ আর আকাশ দেখবে দুপুরভর। অনন্ত আকাশ আর শস্যপূর্ণা পৃথিবীকে হাতের আজলায় তুলে ধরতে ইচ্ছে করে মানুষেরও। পরিচর্যার ওমে ওকে ভালোবাসতেও ইচ্ছে করে হয়তো। তাই বুঝি সে ইতুর ঘট পাতে। রোব্বারে রোব্বারে ফিরে আসে সেই উদযাপনের কাছটিতে। রবির সঙ্গে সে সূ্য্যিদেবকে জুড়ে নিয়েছে, এ কথা সহজেই বুঝতে পারি। তবে ঋণ নয়, সহানুভূতি নয়, এই পৃথিবীকে ভালোবেসে নয় – কেবলই নিয়মে তলিয়ে যেতে চাইছে গ্রামদেশ! সে বড় ব্যথার।(Pre Winter)

তার চেয়ে তিলা মুনিয়াদের উড়ান ঢের বেশি পার্থিব। আর কিছু নয়, এই মাটির পৃথিবীকে ভালোবেসে ইতুর ঘট পরিপূর্ণ হোক অনাবৃত আকাশের মতো। মানব সভ্যতার আদিম ভাষাগুলো ক্রমে ক্রমে সামাজিক হয়ে উঠতে উঠতে পৃথিবীর থেকেই আলগোছে সরে গেছে। আমার একেকদিন তাই মনে হয় যে, মানুষ কেবলই নিয়মে আর অভ্যাসে ইতুর ঘট পাতে। পৃথিবীকে স্পর্শ করে দেখার আকুলতা যার নেই – তার চেয়ে ঢের সুখী ওই ধুলোমাটি মাখা শিশু। ওর মাটি আর কাদাজলের রান্নাবাটি পার্থিব গন্ধে পরিপূর্ণ। (Pre Winter)
আর কদিন পরে ঘরে ঘরে নবান্ন হবে। লক্ষ্মীকে বেঁধে রাখার মন্ত্র মানুষেরা জানে। সে মন্ত্রের সাধ্য কতদূর, সে অবশ্য অন্য বিতর্ক। তবু নবান্নের পানীয়তে বাটি ভরে উঠলে আমি প্রাচীন পৃথিবীর সুঘ্রাণ পাই। মানুষের স্পর্শে মানুষের পৃথিবী শস্যের গন্ধ পাক প্রাণ ভরে। অঞ্জলি ভরে উঠুক নিটোল শস্যকণায়। ইতুর ডালা থেকে নবান্নের পাত্র ভরে উঠুক পৃথিবীর গন্ধে।
ইতুর ডালায়, ইতুর ঘটে বারে বারে ফিরে এসেছে এই বসুন্ধরার মুখখানি। শস্য আর ফুল-ফলে পরিপূর্ণা এক অপার্থিব, অথচ কী ভীষণ পার্থিব এই ব্রত। অগ্রহায়ণের ডালাখানি সে ভরে দিতে চাইছে প্রতিদিন আশ্চর্যকরা জীবনের গন্ধে। কবেবার কোন নতুন বছরের মন্ত্রে সেজে উঠছে ওর শরীর। ইতিহাস আসলে এমনই। সে কেবলই তার প্রত্নপ্রতিমাখানি ফেলে রেখে যায় ছায়াশরীরের মতো। মাঠের প্রান্তে বসে ইতুপুজোর খিচুড়ি খেতে খেতে সেকথা সামাজিক মন টের পায় হয়তো বা, হয়তো পায়ও না। (Pre Winter)

তবে, ঢের দেখে দেখে একথা বুঝেছি যাপনের মধ্যে সামাজিক মানুষের পার্থিব বিশ্বাসখানা থিতু হয়ে থাকে। সে সহজে তাই শস্যকণা অপচয় করতে চায় না। শীতের দিনে মানুষের কী আর পান্তা খেতে সাধ হয়! বাসি ভাতের চাপটি খাওয়ায় তখন সুখ বেশি। রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে কলের পিঠে খেতে খেতে মানুষেরা ফিরে যায় ছেলেবেলার দিনে। যে মানুষ যতই নতুন হোক না কেন! তারও একটা ছেলেবেলা থাকে। প্রজন্মের স্বাদ ফুরায় বটে, আবার ফুরায়ও না। নতুন তেঁতুল দিয়ে মুখী কচুর ডাল খেতে ইচ্ছে করে তখন। ইচ্ছে করে চাল-ডালের চাপটি দিয়ে মরিচবাটা খেতে। এই ইচ্ছেরা নিতান্ত পার্থিব, নিতান্ত সামাজিক।

মানুষের সামাজিক মন দিয়ে গড়া অঘ্রাণের সকাল, অঘ্রাণের বিকেল। এই এলিয়ে পড়া শস্যক্ষেত এসব জানে। মাজরা পোকায় কাটা শতচ্ছিন্ন শরীরের ব্যাকুলতা নিয়ে ও অভাবী মানুষের মুখের দিকে তাই তাকাতে পারে না। শোক সংক্রামক, একথা কে না জানে! আর কদিন পরে ঘরে ঘরে নবান্ন হবে। লক্ষ্মীকে বেঁধে রাখার মন্ত্র মানুষেরা জানে। সে মন্ত্রের সাধ্য কতদূর, সে অবশ্য অন্য বিতর্ক। তবু নবান্নের পানীয়তে বাটি ভরে উঠলে আমি প্রাচীন পৃথিবীর সুঘ্রাণ পাই। মানুষের স্পর্শে মানুষের পৃথিবী শস্যের গন্ধ পাক প্রাণ ভরে। অঞ্জলি ভরে উঠুক নিটোল শস্যকণায়। ইতুর ডালা থেকে নবান্নের পাত্র ভরে উঠুক পৃথিবীর গন্ধে। (Pre Winter)
গাঠি কচুর ডাল
উপকরণ: গাঠিকচু, সর্ষের তেল, পেঁয়াজ কুচি, আদা রসুন বাটা, তেজপাতা, গোটা দারচিনি, গোটা এলাচ, শুকনো লঙ্কা, ধনের গুঁড়ো, হলুদের গুঁড়ো, কাঁচালঙ্কা, ভাজা মশলার গুঁড়ো, তেঁতুল, স্বাদমতো নুন আর মিষ্টি।

পদ্ধতি: কচুগুলো, খুব ভালো করে সেদ্ধ করে নিন। ভালো করে মেখে নিন যেন দলা না থাকে। অল্প জল মিশিয়ে একবার ছেঁকে নিন। কড়াই বসান, গরম হলে তেল গরম করুন। তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, গোটা দারচিনি আর এলাচ ফোড়ন দিন। সুগন্ধ বেরোলে কুচানো পেঁয়াজ দিন। পেঁয়াজ ভাজা হলে আদা-রসুন বাটা দিন। ভালো করে মশলা কষিয়ে অল্প জলে গুলে ধনেগুঁড়ো, হলুদের গুঁড়ো দিন। সব মশলা ভালো করে কষানো হয়ে গেলে কচুসেদ্ধটি দিন। অল্প তেঁতুল দিন। সময় নিয়ে ফুটিয়ে নিন। স্বাদমতো নুন মিষ্টি দিন। সব ভালো মতো মিলেমিশে গেলে কাঁচালঙ্কা আর ভাজা মশলা দিয়ে রান্না শেষ করুন।(Pre Winter)
বাসি ভাতের চাপটি
উপকরণ: বাসিভাত, চালের আটা, পেঁয়াজ কুচি, কাঁচালঙ্কা কুচি, ধনেপাতা কুচি, সামান্য আদা কুচি, স্বাদমতো নুন, তেল আর কলাপাতা। (Pre Winter)

পদ্ধতি: বাসিভাত বেটে নিন। মিক্সিতেই ঘুরিয়ে নিতে পারেন। বেশি জল দেবেন না। অল্প দিন, যেটুকু না দিলেই নয়। এই বাটা মিশ্রণটিতে অল্প চালের গুঁড়ো এবং কুচানো পেঁয়াজ, আদা, লঙ্কা, ধনেপাতা আর নুন দিয়ে মেখে নিন। কিছুক্ষণ রেখে দিন। কলাপাতা কেটে নিন। কলাপাতার উপরে হাত দিয়ে বিছিয়ে রুটির মতো বিছিয়ে দিন। চাটুতে অল্প তেল বুলিয়ে নিন। গরম হলে কলাপাতা উলটে রুটিটি বিছিয়ে দিন। আলতো হাতে কলাপাতা উঠিয়ে নিন। উল্টেপাল্টে সময় নিয়ে ভাজুন। শীতের সকালে পরিবেশন করুন গরম গরম বাসিভাতের চাপটি। ইচ্ছে হলে সঙ্গে কোনো ঝাল চাটনিও দিতে পারেন।(Pre Winter)
ছবি সৌজন্য: লেখক, ChatGPT, Wikipedia
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।
