(Fredericton)
এয়ারপোর্টে নেমে দেখি বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, চারিদিক জলে ঝাপ্সা হয়ে আছে। একটা কনফারেন্সে আটল্যান্টিক কানাডার ছোট্ট শহর ফ্রেডারিক্টনে (Fredericton) এসেছি। ফ্লাইটের প্রায় নব্বই শতাংশ লোক কনফারেন্সেই যাচ্ছে। কাল এই শহরে কনফারেন্স ছাড়াও একটা ম্যারাথন রেস শুরু হচ্ছে। এত লোক একসঙ্গে বাইরে থেকে আসার ফলে শহরের বেশ বেহাল অবস্থা। এয়ারপোর্টের বাইরে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে বিরাট লাইন। প্রমাদ গুনলাম। কতক্ষণে হোটেলে পোঁছবো কে জানে? অবশেষে চারজন মিলে আধা-ভিজে অবস্থায় একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। ট্যাক্সির এয়ারকনে বেশ শীত করছে। হোটেল যদিও এয়ারপোর্ট থেকে বেশি দূর নয়। সবাই এক হোটেলে উঠেছি, একসঙ্গে আসাতে কিছুটা সময় বেঁচে গেলো।
আরও পড়ুন: আলোকিত টিউলিপ বাগানে
রাত্তিরে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে এক কাপ কফি আর কুকিস খেয়ে কনফারেন্সে দৌড়লাম। তখন আকাশ পরিষ্কার হয়ে বসন্তের ঝলমলে রোদ্দুর উঠেছে। হালকা ঠান্ডামাখা মিঠে রোদ্দুরে মন ভালো হয়ে গেলো। ফ্রেডারিক্টন নিউ ব্রান্সউইক (New Burswick) প্রভিন্সের রাজধানী, খুবই ছোট শহর। জনসংখ্যা মাত্র ৬৬ হাজার।
দিনের শেষে কনফারেন্স থেকে বেরিয়ে, হোটেলে ল্যাপটপ রেখে এলোমেলো হাঁটতে বেরোলাম। কুইনস্ স্ট্রিট এই শহরের কেন্দ্রস্থল। উত্তরে চার্চ স্ট্রিট থেকে দক্ষিণে সেন্ট জন নদী পর্যন্ত, বড় জোড় ৫ কিলোমিটার হবে। দুপাশে পুরনো ঐতিহাসিক বাড়িগুলো গায়ে-গায়ে লাগানো। ভারি সুন্দর রং আর গড়ন। (Fredericton)

ফ্রেডারিক্টনের ইতিহাস ভারতবর্ষের মতো অতটা প্রাচীন নয়। আন্দাজ ১৭৮০ নাগাদ কানাডার আদিবাসীরা (Wolastoqey and Mi’kmaq) এই অঞ্চলে আস্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে। তারা বছরের কিছুটা সময় চাষবাস, শিকার এবং মাছ ধরার জন্য এখানে থাকতো, তারপর ফিরে যেতো। তারপর প্রায় দুশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপীয়ানরা (ফ্রেঞ্চ এবং ব্রিটিশ) এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেছিলো। (Fredericton)

কুইনস্ স্ট্রিটের ডান দিকে এগোতে প্রথমেই ফ্রেডারিক্টন রিজিওনাল মিউজিয়াম। জাদুঘরের কোণাকুণি সাদা ধপধপে লাইট হাউস। তার মাথায় টুকটুকে লাল টুপি পরা। লাইট হাউসের দরজায় তালা ঝুলছে। বিকেলে বন্ধ হয়ে গেছে! নাকি সবসময় বন্ধ থাকে, কে জানে! খানিক এগোলেই একটা ভারি সুন্দর লাল ইটের বাড়ির গায়ে হলুদ রঙে লেখা “পাবলিক লাইব্রেরি”।
কুইনস্ স্ট্রিটের সমান্তরালে সেন্ট জন নদী বয়ে চলেছে। কাল বিকেলের বৃষ্টি-স্নাত ঘোলাটে নদী, আজ ঝলমলে দিনে নীল-বর্ণ ধারণ করেছে। নদীর উপর দিয়ে ভারি সুদৃশ্য কতগুলো ব্রিজ এপার থেকে ওপারে চলে গেছে। নদীর ধারে একটা বেঞ্চে বসে লোকেদের যাওয়া-আসা দেখতে লাগলাম। ওপারে আধুনিক শহরের চালচিত্র স্পষ্ট দেখা যাছে। পুরানো শহরের মধ্য থেকেই ওপারে নতুন আধুনিক শহর গড়ে উঠেছে। (Fredericton)
তখন বেশ রাত হয়েছে, সব দোকান বন্ধ, পথঘাট একেবারে ফাঁকা। মনে হয় ছোট শহরে লোকজন অনেক আগেই ঘরে ঢুকে যায়। অ্যানা আর জুলিয়ান অতি উৎসাহী। আমিও সঙ্গী হলাম। পড়ন্ত রোদে দেখা শহর, এখন চাঁদের আলোতে মায়াবী লাগছে।
চলতে চলতে আবার একটা বড় লাল বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম – স্পোর্টস্ হল অফ ফেম। বাড়ির জানালায় সারি সারি খেলোয়াড়দের ফটো টাঙানো। ব্যানারে লেখা, “We honour our best and inspire the rest”। বাহ্, ভারি সুন্দর কথা। এখানে খেলাধুলার ইতিহাস এবং খেলোয়াড়দের জীবনচিত্র সংগ্রহীত। উলটো দিকের ফুটপাথ ধরে পুরানো বাড়িগুলোর এ,তলাতে আধুনিক বুটিক, রেস্টুরেন্ট, আর্ট গ্যালারি, আর্ট-ক্র্যাফটের দোকান। যেন পুরানো ক্যানভাসে নতুন জলরঙা ছবি আঁকা। (Fredericton)

একটু ঘোরাঘুরির পরে অনুভব করলাম যে, এই ছোট্ট শহরটার একটা মিষ্টি কমনীয়তা আছে। তার সঙ্গে মিশেছে ইতিহাসের রং। এবার একটু ক্লান্ত লাগছে। হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। হোটেলের ঠিক উলটোদিকে কনফারেন্স সেন্টারটাও ভারি সুন্দর, নদীর ঢেউ-এর ধাঁচে গড়া। বড় বড় কাচের জানালা দিয়ে ভিতরে প্রচুর আলো আসে। লাঞ্চের সময় আলোকিত করিডোরে কত নতুন মানুষের সঙ্গে কাজের কথাবার্তা হলো। পাশেই বিধানসভা ভবন, সামনে খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে। তিনতলা, বাদামি বেলে পাথরের ভবনের মাঝখানে ছাদ থেকে অনেক উঁচুতে অষ্টভুজাকার গম্বুজাকৃত টাওয়ার উঁকি দিচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রতীক এই টাওয়ারটা বহুদূর থেকে দেখা যায়।(Fredericton)

এতো সুন্দর একটা বিকেলে আর একটু হাঁটি। ভাবতে ভাবতে আবার এগোলাম। এবার গ্যালারি ৭৮-এর সামনে এসেছি। গোলাপি রঙের বাড়িটা বেশ অন্যরকম দেখতে। জানলায়, ছাদে নীল রং করা, একপাশে গম্বুজাকৃতি টাওয়ার। ১৭১৯ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত বহুবার মালিকানা বদল হয়ে, এই বাড়িটা এখন আর্ট গ্যালারিতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রায় দুশো বছরের ঐতিহাসিক সাক্ষী। এখন মূলত স্থানীয় আর্টিস্টদের কাজ গ্যালারিতে সাজানো। আর্টিস্টরা অনেক সময় স্টুডিও ভাড়া নেন। ঠিক যেমনটা ভাবছিলাম। আর্ট গ্যালারি বন্ধ হয়ে গেছে, ভিতরে যাওয়া হলো না।(Fredericton)

ফ্রেডারিক্টন নদী-ভিত্তিক শহর। এই শহরের সি-ফুডের রেস্টুরেন্টগুলো টুরিস্টদের খুব টানে। কনফারেন্সে এসে থেকে গলদা চিংড়ি, ঝিনুক, ক্ল্যাম, কাঁকড়া, স্যামন, কড মাছের খুব গল্প শুনছি। “একদম টাটকা” – “মুখে দিলে গলে যায়” – “দারুণ খেতে” ইত্যাদি। আটলান্টিক মহাসাগর খুব দূরে নয়। কাছে শেডিয়াক শহর, “Lobster capital of the world” বলে খ্যাত। অ্যানা আর জুলিয়ান – আমার দুই সহকর্মী কনফারেন্সে এসেছে। ওরা যাকে বলে ফুডি, খেতে খুব ভালোবাসে। সেদিন মাতৃদিবস, আগে থেকে রেটিং দেখে একটা সি-ফুড রেস্টুরেন্ট বুক করে রেখেছিল। তিনজনে মিলে ট্যাক্সিতে চেপে নদীর ওপারে খেতে গেলাম। রেস্টুরেন্ট ভর্তি, ভাগ্যিস বুক করা ছিল! (Fredericton)
চার্চের পিছনদিকে গিয়ে দেখি সেখানে থইথই অন্ধকারের মধ্যে একটা ছোট্ট গোরস্থান। আমার সঙ্গীরা সেলফোনের আলো জ্বেলে কবরের উপর কার নাম লেখা আছে, দেখতে চলল। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, সামনে কবরস্থান, পিছনে ন্যাড়া গাছের মধ্য দিয়ে ঘোলাটে হলুদ চাঁদ। একেবারে নিখুঁত হ্যালোইনের গা ছমছমে দৃশ্যপট।
একেবারে চেটেপুটে তিন কোর্স ভোজ খাওয়া হোল, মাতৃদিবসের বিশেষ মেনু। ফেরার পথে দেখি, নদীর উপরে চারিদিক আলো করে চাঁদ উঠেছে। আজ বোধহয় বুদ্ধ পূর্ণিমা। “এতো খেয়েছি, চলো একটু হেঁটে আসি”। তখন বেশ রাত হয়েছে, সব দোকান বন্ধ, পথঘাট একেবারে ফাঁকা। মনে হয় ছোট শহরে লোকজন অনেক আগেই ঘরে ঢুকে যায়। অ্যানা আর জুলিয়ান অতি উৎসাহী। আমিও সঙ্গী হলাম। পড়ন্ত রোদে দেখা শহর, এখন চাঁদের আলোতে মায়াবী লাগছে।
এরা দুজন কোনো ট্রাফিক লাইট না মেনে দিব্বি এগিয়ে চলেছে, আর আমাকে বলছে “চলে এসো। গাড়ি নেই, পুলিশও নেই। চিন্তা কী?” ওদের সাথে বেড়িয়ে আমি যেন কলেজ জীবনে ফিরে গিয়েছিলাম। অনেক বছর পরে আনন্দের, বাধা-বন্ধহীন সেই দিনগুলো মনের ভিতরে জেগে উঠেছে। ধীরে ধীরে এদের অনর্গল, অর্থহীন বকবকানির মধ্যে ঢুকে গেলাম। আমরা এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে কত যে বুটিকের জানালা দিয়ে ঝোলানো পোশাক দেখলাম, রেস্টুরেন্টের মেনু পড়লাম। এই উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরার মধ্যে আছে এক ছেলেমানুষী আনন্দ।

অবশেষে একটা বিশেষ পাড়ায় এলাম। এখানে ভারি সুন্দরি-বাহারি পুরনো বাড়ি। জুলিয়ান বলল, “নিশ্চয়ই বড়লোকদের পাড়া। তবে এক পুরুষের নয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। অন্তত একশ বছরের পুরনো”। ফ্রেডারিক্টনের একটা বিশেষত্ব হলো যে, বাড়ির সামনে খোলা বারান্দাগুলো খুবই সুন্দর করে সাজানো। একটা বাড়ির বারান্দায় বেশ দামী ইতালিয়ান ঝারবাতি ঝুলছে। দেওয়ালে আগেকার দিনের বনেদি ঘরানার মহিলা ও পুরুষের অয়েল পেইন্টিং টাঙানো। পাশে সাবেকি স্টাইলের চেয়ার পাতা। এই বাড়িতে সাবেকি সৌন্দর্যের সাথে অনন্য রুচি মিশেছে। (Fredericton)
আবার জুলিয়ানের গলা পাওয়া গেলো, “কে ভাই খোলা রাস্তায় এতো দামি জিনিস রেখেছে? কারা থাকে এই বাড়িতে?” বাড়ির লোকজন আমাদের উঁকি মারতে দেখে বেরিয়ে আসবার আগেই, দুই মহিলাকে কোনরকমে টেনে পাশের মাঠে নিয়ে এলাম। সেখানে আর এক বিপত্তি। মাঠের মধ্যে একটা বিশাল বড় চার্চ। আমরা তিনজনে চার্চের ছাদ থেকে নেমে আসা ফোকাস আলোতে দেখলাম যে, চার্চটা খুবই সুন্দর।(Fredericton)

চার্চের পিছনদিকে গিয়ে দেখি সেখানে থইথই অন্ধকারের মধ্যে একটা ছোট্ট গোরস্থান। আমার সঙ্গীরা সেলফোনের আলো জ্বেলে কবরের উপর কার নাম লেখা আছে, দেখতে চলল। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, সামনে কবরস্থান, পিছনে ন্যাড়া গাছের মধ্য দিয়ে ঘোলাটে হলুদ চাঁদ। একেবারে নিখুঁত হ্যালোইনের গা ছমছমে দৃশ্যপট। আমি ওদের ডাকতে লাগলাম “চলে এসো, মৃত লোকের নাম জেনে কী করবে? এখানে কাউকে তোমরা চেনো না। চার্চের কোন হোমড়া চোমড়া হবে”। এবার অ্যানা বলল, “আরে, এসেছি যখন, নাম না দেখে ফিরবো না”। কী আর করা? একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম “আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছি।” চার্চের ঘড়িতে রাত ১২টার ঘন্টা বাজলো।
পরের দিন খুব ভোরে ফ্লাইট। এলার্ম দিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজের মনে মনেই বললাম, “জীবনে মাঝে মাঝে এরকম লাগামহীন পাগলামির খুব দরকার”। (Fredericton)
ছবি: লেখক
কাকলির জন্ম এবং পড়াশুনা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান স্নাতকোত্তরের ছাত্রী, পেশায় রিসার্চ ফেসিলিটেটর। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, কলেজ, ফাউন্ডেশানে রিসার্চ স্ট্র্যাটেজি এবং গ্রান্ট ডেভালেপমেন্টের কাজ করেন। বর্তমানে তিনি কানাডার ক্যালগেরি শহরের অধিবাসী। ঘুরেছেন নানা দেশ, ভালবাসেন সৃষ্টিশীল কাজ। লেখা তাঁর বহুদিনের ভালোবাসা। তার লেখায় ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতি, প্রেম, পূজা আর মানুষের কাহিনি; কিছু গভীর অনুভবের আর অনুপ্রেরণার উপলব্ধি। গল্প ছাড়াও লেখেন প্রবন্ধ আর ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর বেশ কিছু লেখা দেশ, সাপ্তাহিক বর্তমানে এবং অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
