(Winter Recipe)
অঘ্রাণ ফুরোতেই এ-গাঁয়ে সে-গাঁয়ে লবান শেষ। মাসের শেষ দিনে তাই বাজারে বাজারে পাইকাররা হাঁক পাড়ে, “অঘ্রাণ ফুরালো, শেষ লবান! শেষ লবান!” সেই ডাক উত্তুরে হাওয়ায় পাক খেতে খেতে এ-গ্রাম সে-গ্রাম ঘুরে পৌষকে ডাক দিল। নরম কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে এসে পড়ল সে। মাস ফুরোয়, মাস আসে, মানুষেরও পালা-পার্বণ বদলে বদলে যায় সে নিয়মে। পয়লা পৌষে মাঠেঘাটে নদীর তীরে এখনও তাই চড়ুইভাতির সুখ। লবান পেরিয়ে এই চড়ুইভাতি, চড়ুইভাতি পেরিয়ে টুসু… চলতেই থাকা এক নদীবৎ এই মানবজীবন। (Winter Recipe)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯]
কেবল পাল্টে যাওয়া কৌম তার ছায়া ফেলে যায় ক্রমশ। তার ছাপগুলো রয়ে যায়, মুছেও যায়। জীবনের গল্পেরা এরকমই। সে তাই পৌষের দিনে এ-বাজার সে-বাজার ঘুরে চারা ভেটকির দর করে, কাঁচা টমাটম কেনে কী গভীর আহ্লাদে! এসব আহ্লাদ বদলে যায় বাজারের মানচিত্রে, বাজারের ভূগোলে। (Winter Recipe)
যে মানুষ মেঘ না চাইতেই বোরোলি পেয়ে যায় পৌষের সকালে, তার তখন আর কী চাইবার থাকে! কেউ বলবেন, বোরোলি আর কই! সেসব চুকেবুকে গেছে, এখন কেবল বোরোলি বলে নদীয়ালি মাছ। তবু, সত্যি সত্যি একেকদিন বোরোলি পেয়ে যায় পৌষের সকাল। তার বাজারের ব্যাগ উপচে তখন গাছ পেঁয়াজের অবিন্যস্ত কেশরাশি এলিয়ে পড়তে চায়।
কমলালেবুর মতো নরম আলোয় পিঠ দিয়ে তখন কেবল ভাত খাওয়ার প্রশান্তি। সকালে দুপুরে রাতে ভাতের ওম জড়িয়ে নিতে নিতে গ্রামের মাঠঘাট প্রান্তর প্রতিদিন পৌষের গান গাইছে। এক জীবনের ভিতরে কত কত গেরস্তজীবন, কতই না চড়ুইভাতির দুপুর– এইসব নিয়ে পৌষ তার গোলাখানা, মরাইখানা ভরে তুলছে বচ্ছরে বচ্ছরে।
কবেকার কোন রূপকথার গল্পের মতো ওর টান। তিস্তা তোর্সা ব্রহ্মপুত্রের মানুষ জানে শীতের দিনে লাল আলু ভাতে মেখে খাওয়ার কী সুখ! কচি লাল মুলা, বেগুন শাকের ডাঁটা দিয়ে বোরোলির ঝাল করে যেদিন মাখামাখা! সেদিন দু-মুঠো চাল বেশি নিতে হবে বৈকি। তবে, গাছ পেঁয়াজ দিয়েই বা স্বাদ কি তার কম? মানুষেরা জানে এমন মিঠে মাছ নদীর বুকে কমই আছে। গেরস্থালি জীবন এই শীতের দিনে আর কী চাইবে বলো! (Winter Recipe)

কমলালেবুর মতো নরম আলোয় পিঠ দিয়ে তখন কেবল ভাত খাওয়ার প্রশান্তি। সকালে দুপুরে রাতে ভাতের ওম জড়িয়ে নিতে নিতে গ্রামের মাঠঘাট প্রান্তর প্রতিদিন পৌষের গান গাইছে। এক জীবনের ভিতরে কত কত গেরস্তজীবন, কতই না চড়ুইভাতির দুপুর– এইসব নিয়ে পৌষ তার গোলাখানা, মরাইখানা ভরে তুলছে বচ্ছরে বচ্ছরে। গোলাভরা ধান, মাঠভরা আলুশাকের আলপনা আর খেজুর রসের আশ্বাসে ফিরে আসছে এই শীতদিন। যতদিন এই শেষ ভূখণ্ডের মতো যাপনেরা বেঁচে থাকে, টিকে থাকে, সেকদিনই চড়ুইভাতির সুখ। সেই সুখের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আছে কলাই শাক, আসকে পিঠে আর কালাই রুটি। চড়ুইভাতিও যেকদিন থাকে সেকদিনই। (Winter Recipe)

হারিয়ে ফেলা কঠিন কিছু তো নয়! বোরোলি মাছেদের মতো পৌষের এই দিন তার পুরনো আখরগুলি নিয়ে হারিয়ে যাবে না, সে আশ্বাস কে দেবে! প্রতিদিন দেখতে পাই পৌষের মাঠে মাঠে থার্মোকলের থালায় ডিজে বাক্সের স্পন্দনে চড়ুইভাতির জোব্বাখানা গায়ে জড়িয়ে কে যেন এক পিকনিকওয়ালা মাঠে মাঠে কৌম-হারানো জীবনের বেসাতিতে মেতেছে। জীবনেরা হারিয়ে গেলে, পৌষও হারিয়ে যায়। বাজারের ব্যাগ থেকে গাছ পেঁয়াজেরা তখন আর কেশবতী কন্যাদের মতো চুল এলিয়ে রোদ্দুর মাখার অবকাশ পায় না। (Winter Recipe)

বোরোলি মাছেদের মতো এই পৌষকে তাই ফিরে পেতে ইচ্ছে করে খুব। তার পুরনো উষ্ণতায় পুরনো আলোয়ানের ওমে। সেই ফ্যানাভাতের সকাল, রসবড়ার কড়াই আর পাটালি গুড়ের গন্ধ নিয়ে তাকে ফিরে পেতে চাইছি খুব। মেটে হাঁড়িরা হারিয়ে গেলে ভোর ভোর খেজুররসের গন্ধরাও বদলে যায়। এই বদলে যাওয়া গ্রাম লবানে আর সংক্রান্তির আলপনায় কাকে যেন খুঁজছে। সে কি আমাদেরই বঙ্গলক্ষ্মী? হবেও বা। (Winter Recipe)
স্নেহ ফুরিয়ে গেলে কৌমের নিয়মেরা দাঁড়িয়ে থাকে একা একা। সে ভারী বেদনার। রাঙা টুকটুকে চুকাইফলেরাও একদিন বর্ণ হারিয়ে ফুরিয়ে আসে। সেসব ভারী স্বাভাবিক। পৃথিবীর পুরনো রূপকথার মতো এসব বর্ণমালারা। মানুষের জীবনে সেই বর্ণপরিচয়ের সংযোগ কতটুকু জানি না, তবে এটুকু বুঝি থার্মোকলের থালা ছড়িয়ে আছে মাঠ ভরে। মাঠেরা তাই বর্ণহীন। পৌষের দিনে বর্ণপরিচয়ের পাতা খুলে বসবে নাকি কেউ! যেমন ওই চুকাই গাছটি। (Winter Recipe)

গাছ পেঁয়াজ দিয়ে বোরোলি মাছের ঝাল
উপকরণ: বোরোলি মাছ (না পেলে চেলা বা অন্য ছোট মাছ), গাছ পেঁয়াজ, সর্ষেবাটা, কাঁচালঙ্কা, মেথি, সর্ষের তেল, নুন, হলুদের গুঁড়ো, শুল্ফ শাক/ধনেপাতা।
পদ্ধতি: মাছগুলো ভালো করে পরিষ্কার করে নুন হলুদ মাখিয়ে কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখুন। কড়াইতে তেল গরম করে মাছ ভেজে নিন। বোরোলি মিষ্টি মাছ, হালকা করে ভাজলেই ভালো। ওই তেলেই মেথি, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিন। ফোড়নের গন্ধ বেরলে সর্ষেবাটা, অল্প জল আর হলুদ দিয়ে গুলে ছেঁকে কড়াইয়ে দিন। কিছুক্ষণ ফুটে সুন্দর ঝোল তৈরি হলে মাছ দিন।

মাছ একটু ফুটে উঠলে উপর থেকে কেটে রাখা গাছ পেঁয়াজ দিন। বেশ গা মাখা ঝোল হলে ওপর থেকে সামান্য কাঁচা সর্ষের তেল আর কাঁচালঙ্কা ছড়িয়ে রান্না শেষ করুন। উপরে অল্প করে শুল্ফ পাতা/শাক অথবা ধনেপাতা ছড়িয়ে দিতে পারেন। কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রেখে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন বোরলির গা মাখা ঝাল। (Winter Recipe)

চুকাইয়ের জেলি চাটনি
উপকরণ: চুকাই, চিনি, জল ও সামান্য নুন।
পদ্ধতি: চুকাইগুলো পেড়ে ভালো করে ধুয়ে নিন। বীজ ফেলে কেবল পাপড়িগুলো নিন। চাইলে এই পাপড়ি শুকিয়েও রাখতে পারেন বছরভর। সেক্ষেত্রে শুকনো পাপড়ি ফুটিয়ে কেবল জলটা ছেঁকে নেবেন চাটনির জন্য। টাটকা চুকাই দিয়ে চাটনি করলে এই ছাড়ানো পাপড়িগুলোর জল ঝরিয়ে নিন। কড়াইতে অল্প জল দিয়ে ফুটতে দিন।

ফুটে গেলে চুকাইয়ের পাপড়িগুলো দিন। সামান্য এক চিমটে নুনও দিন। কিছুক্ষণেই পাপড়িগুলো সেদ্ধ হয়ে নরম হয়ে যাবে। তখন চিনি দিন। চিনি গলে একদম জেলির মতো চাটনি তৈরি হলে রান্না শেষ করুন। কেউ চাইলে শেষে অল্প দারচিনির গুঁড়োও দিতে পারেন। শীতের দিনে চুকাইয়ের চাটনি ভারী সুন্দর। খিচুড়ি বা ডাল ভাতের সঙ্গেও ভারী উপাদেয়।
*লবান – নবান্ন (আঞ্চলিক উচ্চারণে)
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।
