Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

মেঘরাশি ঢেউলগ্নের মেয়ে (গল্প)

অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০

Illustration for bengali short story মেঘরাশি ঢেউলগ্ন
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

ইশ্‌ আজকেও এগারোটা হয়ে যাবে ফিরতে ফিরতে। মোবাইল সুইচড্‌ অফ দেখে রাহুল নিশ্চয়ই বাড়িতে ফোন করবে। পাবে না। দেখা হয় না কতদিন। আকাশে ঘন মেঘ। সেই সন্ধ্যের পর থেকেই। দমকা ঠান্ডা হাওয়ায় জানলা খোলা রাখা যাচ্ছিল না। তাই বাইরেটা দেখা না গেলেও শব্দের ঘনঘটায় বোঝা যাচ্ছিল একটা বেশ ওলটপালট হচ্ছে। এখন আবার বৃষ্টিও নেমেছে। সঙ্গে নাছোড়বান্দা হাওয়ার অবাধ্যতা। ছাতাটা সঙ্গে নেই। নির্ঘাত ভিজতে হবে। শাড়িটাকে নিয়ে হয়েছে যত অশান্তি। তাড়াহুড়োয় আঁচলটায় সেফটিপিন দেওয়া হয়নি। উড়ে উড়ে যাচ্ছে খালি। কী দরকার ছিল শাড়ি পড়ার! সিল্কের শাড়ি বৃষ্টিতে ভিজলে আর দেখতে হবে না। একেবারে চেপে বসবে গায়ে। কে যেন বলেছিল এই শাড়িটা পড়লে তোকে দারুণ লাগে। এহে! কিছুতেই মনে পড়ছে না। আসলে কত লোকেই তো কত কী বলে। এই তো সেদিন পাশের বাড়ির কাকিমার কোন এক দুঃসম্পর্কের পিসি মার কাছে এসে বলেছে তার ডাক্তার নাতির বৌ করে নিয়ে যেতে চান আমায়। 

প্রায় ফাঁকা বাস। লেডিস সিটে তিতির একা। আঁচলটা পিঠে জড়িয়ে সামনে টেনে বসে। অসহায়ভাবে ঘড়ি দেখছে। অন্‌ করার চেষ্টা করছে মোবাইলটা। বাসে হাতে গোনা দশ বারো জন। ময়দানের উপর দিয়ে বাসটা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাইরে নিঝুম অন্ধকারটায় কিছু অশরীরি শিহরন পায়চারি করছে বলে মনে হয় একটানা তাকালে। ছাঁট আসছে। বন্ধ করতেই হল জানলাটা। খিদিরপুর থেকে বাসটা বেহালার দিকে ঘুরতেই একটা লোক ওঠে কাকভেজা হয়ে। দাঁড়াতে পারছে না সোজা হয়ে। টলছে। গুটখা আর বাংলা মদ মেশানো একটা কড়া গন্ধ। বাসের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে।

জেনারেল সিট খালিই ছিল কিন্তু লোকটা বসল তিতিরের পাশে। তিতির ব্যাগ খুলে পয়সা বার করতে গিয়ে দেখল ওর ব্যাগের মধ্যে রাহুলের একটা রুমাল। এখনও একটা আলতো গন্ধ লেগে রয়েছে পারফিউমের। হঠাৎ তিতির খেয়াল করল লোকটার চোখ জরিপ করছে ওর শরীর। অস্বস্তিটায় একটা গা রিরি করা খোঁচা। তিতির ভাবছিল, লোকটা একটু এগোলেই ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে। তারপর যা হয় হবে। কনডাকটর ছেলেটি তিতিরকে দেখে বুঝতে পারে হয়ত। তিতির জানে ও খুব ট্রান্সপারেন্ট। সবাই বুঝে ফেলে কোনটা ওর মন খারাপ কোনটা রাগ। এই সবাই বুঝে ফেলাটা খুব সমস্যার। সবাই সব কিছু না বুঝলেই ভালো।

মাতাল লোকটাকে কনডাকটর উঠে অন্য জায়গায় বসতে বলে। ‘এই যে দাদা এটা লেডিস সিট, ওইদিকে যান।’ জড়ানো গলায় বেয়ারা উত্তর আসে। ‘কেন? লেডিস সিট তো কী হয়েছে?’ সব কনডাকটরই অভদ্র অশিক্ষিত নয়। ‘কিছু হয়নি, বললাম তো ওদিকে চলে যান, যান।’ ভদ্রতা অবশ্য সবার জন্য নয়। তাই অনেকে ঘি-টা প্রথমেই বাঁকা আঙুল দিয়ে তোলেন। সমস্যা হচ্ছে এটা অভ্যেসে পরিণত হয়। তখন মনে করে সব মানুষই এক গোয়ালের। মানে যাহাই জাবর তাহাই গোবর। যাই হোক, মাতালটিও বাজারের ষাঁড়ের মতো থেবড়ে আছে সিটে। কনডাকটরের সোজা আঙুলে ঘি উঠছে না। তর্কাতর্কিটা বাড়ি মারছে কানের পর্দায়। সবাই কিছু না কিছু বলছে। যেন অনেকগুলো এফ.এম একসাথে চলছে বাসের ভেতর। তিতিরের ইচ্ছে করছে চিৎকার করে সবাইকে চুপ করতে বলতে। অসুবিধেটা তার তো, সে বুঝে নেবে। সবাই মিলে হামলে পড়ার মতো কিছু হয়নি। যখন সত্যি প্রয়োজন হবে একটাকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সেদিনও, দিন সাতেক আগে যখন রাহুলের সাথে দেখা করল আকাডেমির বাইরে, উফ্‌ কি ঝামেলা! ভাঁড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে কথা বলছিল দুজনে। রাহুল বলছিল ওকে মাস ছয়েকের জন্য অনসাইট পাঠাবে ওর কোম্পানি। এদিকে ওর মায়ের চোখ অপারেশন হবার কথা। দিদির বাচ্চা হয়েছে, এসে থাকতে পারবে না। আর বাবা তো বছর খানেক হল সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট। রিটায়ারমেন্টের পর থেকেই। চুপ করে শুনছিল তিতির। ‘ডঃ ঘোষ বলেছেন দেরি না করাই ভালো। একবার ভাবছি অপারেশনটা করিয়ে তারপর যদি যাওয়া যায়। কিন্তু, একা মাকে রেখে এতটা দূরে চলে যাওয়াটা ইটস নট পসিবল্‌ অ্যাকচুয়ালি। একটা চোখের ভিশন কমপ্লিটলি চলে গেছে, অন্যচোখটা যদি ঠিকও হয় আগের মত সেই কনফিটা তো পাবে না। তাছাড়া অপারেশনের পর চেক্‌ আপ এর জন্য নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। সবমিলিয়ে খুব কনফিউজড্‌ লাগছে বুঝলি।’

এলোমেলো লাগছিল তিতিরেরও। ও কিছুতেই বুঝতে পারছিল না রাহুল কেন একবারও তিতিরকে একটু সময় দেবার কথা বলছে না! ওর কি মনে হচ্ছে তিতির পারবে না? নাকি ভাবছে ওর মার জন্য তিতির কেন এতটা করতে যাবে? তা সে হোক না হবু শ্বাশুড়ি! বিয়েটা তো এখনও হয়নি! ‘আমি তো আছি। এত ভাবছিস কেন?’ জোর করে অধিকার তৈরি করার মত শোনাল কথাগুলো। উত্তরের অপেক্ষায় রাহুলের দিকে তাকিয়ে তিতির। রাহুল ভাঁড়টা ফেলে সিগারেট ধরিয়ে দেশলাই কাঠিটা টোকা মেরে ফেলতেই কী ভাবে যেন ওটা সামনে দাঁড়ানো একটা লোকের গায়ে গিয়ে লাগে। রাহুল সঙ্গে সঙ্গে দুঃখপ্রকাশ করে নিজের ভুল স্বীকার করে নেয়। কিন্তু লোকটা হঠাৎ তাচ্ছিল্য নিয়ে সেটার উত্তর দেয় – ‘এগুলো কমন সেন্স ভাই! সরি বললেই হবে? পায়ের কাছে ফেলতে কি হাত কাঁপছিল? সিন্থেটিক কিছু থাকলেই পুড়ে যেত। তখনও কি সরি বলতে?!’ অ্যাকাডেমির বাইরে আজকাল এরকম অনেক লোক ঘুরে বেড়ায়। যারা সব জানে সব বোঝে। যারা মনে করে ভারতবর্ষে জন্মে তাদের জীবনটা বৃথা হয়ে গেল। এরা আগেও ছিল হয়ত। বেশি ক’রে চোখে পড়ছে তিতিরের আজকাল। তিতির রিয়্যাক্ট না করে পারল না। ‘ঠিক আছে দাদা, কেউ তো ইচ্ছে করে করেনি। ভুল হয়েছে, স্বীকার করে নিয়েছে। তারপরেও এত কথা আসছে কী করে?’ এই জায়গাটা তিতিরের। তাই গলার জোরও বেশি। যদিও হিতে বিপরীত হল এতে।

‘আপনাকে কিছু বলেছি আমি? আপনি কথা বলছেন কেন? সব জায়গায় মহিলা হবার সুযোগ নেবেন নাকি?’ তিতির কিছু বলার আগেই রাহুল প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে গেল। তাকে তোল্লাই দেবার জন্য চারপাশে জুটে গেল অচেনা কয়েকজন। রাহুল যেভাবে লোকটার কলার চেপে ধ’রেছিল সেটা একমুহুর্তের জন্য হ’লেও ভালো লেগেছিল তিতিরের। কিন্তু তাকে নিয়ে এতো সিন ক্রিয়েট হচ্ছে দেখে খুব আত্মসম্মানে লেগেছিল পরক্ষণেই। কী ভাষার ব্যবহার! কি কুরুচিকর ইঙ্গিত! কত দর্শক! 

অবশেষে তিতিরের বাসস্টপ। আরও কিছুটা গেলে বাড়ি। তবু প্রায়দিনই এখানে নামতেই মনে হয় বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি। একরাশ বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা হাওয়া রাস্তা পেরলো। অটোর লাইনে জনা দশেক মানুষ আর মুখে মুখে অঙ্ক। কত নম্বর অটোয় উঠতে পারবে সেই চেনা হিসেব। রিকশাওয়ালারাও বাড়ি ফিরে গেছে কিংবা বাংলার ঠেকে। আর অপেক্ষা না করে তিতির হাঁটতে শুরু করল। আবছায়া মাখা নিঝুম রাস্তা। ফ্ল্যাটবাড়ির জানলা থেকে ছুড়ে দেওয়া এক টুকরো আলো। আজ শরীরটা ভালো নেই তিতিরের। শাড়ি খুলে নাইটি পরে বিছানায় গা লাগাতে পারলেই ব্যস্‌।

কিন্তু উপায় নেই। বাড়ি ফিরেই হয়ত হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। না খেয়ে বসে থাকবে হয়ত। ‘তিতির ভাতটা বাড় না মনা, সব গরম করা আছে। তুই শুধু দিয়ে দিস।’ ‘কেন তুমি বসবে না মা?’ ‘না রে। ভাবছি খাবো না। সন্ধ্যে থেকে বুকটা জ্বালা জ্বালা করছে।’ এই সব পরিচিত সংলাপ স্রোতের মতো আছড়ে পড়ে তিতিরের মাথার ভেতর। একটা বিশাল বড় ধেড়ে ইঁদুর ড্রেন থেকে উঠে রাস্তা পেরিয়ে গ্যারেজে ঢুকে গেল। আচ্ছা বেড়াল রাস্তা কাটলে যদি সেটা অশুভ হয় ইঁদুর রাস্তা কাটলে কি ব্যাপারটা শুভ? মানে দুই শালিকের মতন। মনে মনে হাসল তিতির। 

মশারিটা টাঙানো। দেখা যাচ্ছে বাবা মার শোবার ঘরের জানলা দিয়ে। মোবাইলটা চার্জে বসাতে বসাতে তিতির বুঝতে পারে মা ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তিতির প্রশ্ন করে – ‘রাহুল ফোন করেছিল গো?’ বেসুরো উত্তর আসে – ‘ফোন বন্ধ ছিল কেন তোর?’ তিতির গলার ভেতর ঝাঁজটাকে মেরে ফেলে বলে – ‘বন্ধ ছিল না মা। বন্ধ হয়ে গেছিল। দেখলেই তো চার্জে বসালাম। খেয়েছ?’

‘সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে, মেয়ে বাড়ি ফিরছে না। ফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না! চারপাশে যা খবর শুনি তার পরেও খাওয়া যায়!’  তিতির মায়ের টেনশনটা মেনে নিল মনে মনে। কিন্তু বাড়ির হাওয়া ভারী। প্রচন্ড আর্দ্রতা। গায়ে গায়ে ঘষা লাগলেই চিড়বিড় করে উঠছে। তিতির অনুভব করল মা’র এই উপস্থিতিটা ওর ভালো লাগছে না। একটু একা হতে ইচ্ছে করছে। একটুও ইচ্ছে করছে না কথা বলতে। ‘এইমাত্র তো ফিরলাম মা, বিশ্বাস করো খুব টায়ার্ড লাগছে। কাল এগুলো নিয়ে বোলো।’

পাশ কাটিয়ে বাথরুমের দিকে চলে যেতে গিয়েও মায়ের কথায় আটকে গেল তিতির। ‘আজ আমি বলছি কাল পাড়ার লোক বলবে।’ এই ঠোকাটা অপ্রত্যাশিত। অন্তত মা’র কাছে। ‘মানে!!! আজ মানে? আমি তো বলেইছিলাম মা আজ গ্রুপের জন্মদিন, প্রোগ্রাম আছে। ফিরতে দেরি হবে। তাছাড়া …’ মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিতিরের মা। শেষ হল না কথা। বৃষ্টি, অটো বন্ধ এসব যুক্তি দাঁতের চাটাইয়ে ধাক্কা খেয়ে জিভে লেগে থাকল। অবশ্য বললেও খুব একটা লাভ হত না কিছু। পাল্টা উত্তর তৈরিই ছিল তার। ‘লোকের ভারী ব’য়ে গেছে এসব জানতে। তারা দেখবে দিনের পর দিন রাত করে হেলতে দুলতে বাড়ি ফিরছে মেয়েটা!’ কথাটা বলেই পাশের ঘরে পা বাড়ালেন তিতিরের মা।

ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থাকল তিতির। চোখটা ভিজে যাচ্ছে অভিমানে। গলার কাছে একটা কষ্ট আড়মোড়া ভাঙছে। বেরতে দিলেই একটা গোঙানির শব্দ হবে। সেটা একেবারেই চায় না তিতির। কারণ সেটা তার হেরে যাওয়া। শব্দটা যে কান্না! বাড়িতে আরও দু’জন মানুষ। অদ্ভুত উদাসীন। একজন তো কেউ জানতে চাইতে পারে আজ নাটকের শো কেমন হল! কেমন ভাবে ফিরল তিতির! 

তিতিরের মা’র মেয়ের নাটক নিয়ে কোনও উৎসাহ না থাকলেও সিরিয়ালে আছে। পড়শিদের সাথে ছাদ-জানলা-রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার নেশা আছে। খবরের কাগজে খুন ধর্ষণ রাহাজানির খবর পড়ার অভ্যেস আছে। লতায় পাতায় আত্মীয়ের নিজের পছন্দে বিয়ে করা মেয়ের স্বামী কতটা রোজগেরে আছে তার হিসেব নিকেশ করার প্রচুর সময়। অন্য ঘর থেকে ঘুরে এসে তিনি আবার স্বমহিমায়। ‘মেয়ে মানুষের এতো বাড় ভালো না তিতির। এরপর একটা অঘটন ঘটে যাবে, লোককে মুখ দেখাতে পারব না। ভাবছিস রাহুল তোকে বিয়ে করবে? ছাই করবে!’ এবার ঝলসে উঠল তিতির। ‘চুপ করবে তুমি, আবার রাহুলকে টানছ কেন? রাতদিন শুধু বিয়ে বিয়ে বিয়ে! আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোমরা বেঁচে যাও না?’ 

তিতিরের মা কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। অন্য ঘর থেকে ভাইয়ের গলা ভেসে এলো – ‘তুই বুঝবি না দিদি। তুই অ্যাট লিস্ট চুপ কর! আরে তুই না ফিরলে আমাদের টেনশন হয়, কী করা যাবে! সবাই মিলে এমন বাড়ি মাথায় ক’রে চেঁচাচ্ছে মনে হচ্ছে বস্তিতে থাকি।’ তিতির মায়ের মুখের দিকে তাকাল। নির্বিকার। ছেলে বলেছে তো। নয়নের মণি। শেষ বয়েসে মাথায় করে রাখবে। বেনারস কেদারবদ্রি ঘোরাতে নিয়ে যাবে! আসুক না ছেলের বউ। তারপর শুরু হবে অধিকারবোধের লড়াই। দেখব তখন ছেলে কত মা মা করে। নিজের মনেই কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে আওড়ে নিল তিতির। নিজের কাছে একটু ছোটও হয়ে গেল। রাগের মাথায় এসব কী ভাবছে! তার মানে কি ও মনে মনে চায় এ রকমই হোক?

তবে আর কিছু না হোক, ভাইয়ের নাক গলানোতে মা যেন হঠাৎ নিজেকে পাট করে ভাঁজ ক’রে নিল। হাঁড়িমুখ। কথাহীন। যেটা বেশি অস্বস্তিকর তিতিরের কাছে। বাথরুমে চলে গেল তিতির। বাথরুমটা বেশ শান্তির জায়গা। ইচ্ছে করছে মাথায় শাওয়ার খুলে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু জলটা বেশ ঠান্ডা। বাড়ির পরিবেশ যতই গরম তাওয়া হয়ে থাকুক, বুকের ভেতরে একটা মন খারাপের নদী বয়ে যাচ্ছে। সেটা গলার কাছে এসে বাঁক নিয়ে কোথায় যে হারিয়ে যাচ্ছে এতক্ষণ বুঝতে পারছিল না তিতির। হঠাৎ চোখ থেকে ঝরঝর করে বেরিয়ে আসা জলে যেন সেই নদীটারই নাম লেখা। বালতি উপচে পড়ছে কলের নিচে। টনসিল, জ্বর গলাব্যথা, রিহার্সাল কামাই এসব কোলাজ করে শাওয়ারটা আর চালানো হল না। আজ হঠাৎ করে বাথরুমটাকে শান্তির জায়গা মনে হচ্ছে না। বদ্ধ লাগছে খুব। টাওয়েল নাইটি কোনওটাই সঙ্গে নেয়নি মনে পড়ল ওর। মাকেও ডাকতে ইচ্ছে করছে না। কি করবে শাড়িটা জড়িয়ে বেরিয়ে যাবে? 

নিজের উপর বিরক্তিতে দুপুরে ছেড়ে রাখা নাইটিটাই পড়ে নিল ভেজা শরীরে। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আজ। না হলে বাইরে থেকে এসে শাড়ি পরে কবে কোনদিন বাথরুমে ঢুকেছে! গামলায় সব ফেলে রেখে বেরিয়ে আয়নার সামনে এল তিতির। ঘুম ক্ষিদে দুটোই খোঁচা মারছে। কিন্তু এখন আর গলা দিয়ে খাবার নামবে না। তিতিরের মনে হল নাইটিটা কিছুতেই সতেজ হতে দিচ্ছে না। বাসি গন্ধ। ভেজা ভেজা ভাব। অতএব দরজা বন্ধ। আলমারি থেকে ঝরঝরে শুকনো একটা রাত পোশাক নামানো। আচমকা দরজার বাইরে মায়ের গলা। ‘কীরে, দরজা বন্ধ করছিস কেন? খেতে আসবি না?’ তিতির শুনতেই পেল না যেন। রাত পোশাকের ভেতরে ঢুকে পড়ল। আয়নায় একটু বড়সড় লাগছে নিজেকে। আসলে এটা একদম নতুন, একবারও কাচা হয়নি। মা’র জন্য এনেছিল। পছন্দ হয়নি। তিতির নিয়ে নিয়েছে। কাচলে নিশ্চয়ই একটু কাপড় টানবে। ঠিকঠাক ফিটিংস হবে তখন। এসব ভাবতে ভাবতেই তিতির বিছানায় মেলে দিল নিজেকে। বিছানায় যেন ঘুম পড়েছিল। মুহুর্তে চোখে লেগে গেল। টিউবের আলোটা বাড়তি লাগছে। নিভিয়ে দিল। ওর মনে হল ঠিক যখন ঘুমটাকে জড়িয়ে ধরে একটা পা তুলে দেবে গায়ে। তখনই হয়ত ফোনটা বেজে উঠবে। তারপর উল্টোদিকে সব চুপচাপ। হ্যালো হ্যালো করেও সাড়া পাওয়া যাবে না। বেশ কয়েকদিন হল রাতেই আসছে ফোনটা। ঘুমের ঘোরে দম দেওয়া পুতুলের মত হয়ে গেছে তিতির। রাহুলকে ফোন করে শুতে হবে। অন্ধকারটা, ফ্যানের হাওয়া, মোবাইলের আলো সব মিলিয়ে পরিবেশটা দারুন। কিন্তু রাহুলের ফোন বেজেই চলেছে। একবার দু’বার তিনবার এবং আরও কয়েকবার।

ঘুমটা হঠাৎ যে কোথায় হারিয়ে গেল! একটু আগেও মনে হচ্ছিল বিছানায় শরীরটা ফেলতে পারলেই একঘুমে ভোর। মড়ার মতো ঘুমোবে। মাথার ভেতরের দেয়ালে একটা ফড়িং ছটফট করছে যেন। আসলে এই বাড়িটার মধ্যেই একটা নেগেটিভ এনার্জি আছে। কিছুতেই ভালো থাকতে দেয় না। ভালো থাকাগুলো এখানে খুব মেকি। স্নানের পর ভেজা ভেজা গায়ে ওডিকোলন মেখে নেবার মতো। আসলে ভালো থাকার গন্ধ বয়ে বেড়ানো। কিন্তু মানসিকতাটা প্যাচপ্যাচে ঘাম শুকনো নুনের মতো। 

যেসব মানুষ মরে গেলে মনে হয় ঘুমিয়ে আছে বা যারা ঘুমের মধ্যে মারা যায় তারা কি এক? তার মানে যারা তিতিরের মতো মড়ার মতো ঘুমোতে চায়, নিজের অজান্তেই কি তারা মৃত্যুকে কাছে ডাকে? তিতির শুনেছে মৃত্যুচেতনা একটা অসুখ। ওর প্রিয় কবি সাহিত্যিকরাও বেশিরভাগ মারা গেছেন সুইসাইড করে বা দুর্ঘটনায়! এটা কেন? তিতির জানে না, কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে। রাহুলকে বললেই ও বলবে – ‘তুই সহজ করে কিছু ভাবতে পারিস না, না?’ আশ্চর্য! উত্তর জানা না থাকলে বা প্রসঙ্গটাকে দীর্ঘায়িত করতে না চাইলে তো ‘কো-ইনসিডেন্স’ ব’লেও রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু এতে রাহুলের ব্যক্তিসত্ত্বায় আঘাত লাগে হয়ত। আসলে তিতিরেরও অবুঝ হতে ইচ্ছে করে। মন চায় ছেলেমানুষি। অথবা মাসুলের কথা চিন্তা না করেই দু’চারটে ভুল, জেনেশুনেই। সব বুঝে ফেলার, মেনে নেবার অলিখিত দায়ভার নিতে নিতে মাঝে মাঝে মনে হয়, মাথাটা একটা বহুকাল বন্ধ বাড়ির অন্ধকার ঘর। নিজেকে একটা বৃত্তে ঘোরাফেরা করা গোল জারের মাছের মতো মনে হয়। সেও তো আসলে পরজীবি। শুধু খাবার নয়, গভীরতা হারানো ঘোলাটে জল বদলে দেবার জন্যও যাকে অন্যের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়! 

তাহলে কেন রাহুল? কেউ তো মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রাখেনি! নিজেকে এসব প্রশ্নগুলো করার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল তিতির। মড়ার মতো। পাশের ঘরে গাঁক গাঁক করে টিভির শব্দ, ঘরে লাইট জ্বালিয়ে মা ভাই বাবার কথা সব কিছুর কোরাসেও চোখ খুলল না।

ভোর। অসময়ের বৃষ্টিতে ছাদের শ্যাওলাগুলো পিছল। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে ধারে এসে দাঁড়ানোর জন্য। সামনে বিশাল ঝিল। নানা রকম বক জাতীয় পাখি আসে। বিশেষ করে শীতে। এদের বাড়ি এখানে নয়। এরা অনেক দূরের। আসে, কিছুদিন থেকে যায়। বাসা বাঁধে, বাচ্চা হয়। তারপর একদিন দল বেঁধে ফিরে যায় নিজের দেশে। খালি বাসা, বাসায় দেশের ঠিকানা, ভালোবাসার নাম এইসব খুব কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করে তিতিরের। আবার এও জানে, ঝিলের আশেপাশে বহুতল হবেই, কাল বা পরশু। সেদিন পাখিগুলো আর আসবে না। মানুষের কৌতুহলকে ভয় পায় সবাই। মানুষও।

কিছু মানুষের জীবনে রোমান্টিসিজমটা অন্যরকম। তারা প্রগতি চায়। চায় ভালোথাকার সবরকম মেটিরিয়ালগুলো তালুবন্দি করতে। যেমন রাহুল চায় এই বোবা ঝিলটার সংস্কার। পার্ক। ছোট বাচ্চাদের সুইমিং ক্লাব। প্যাডেল বোট। রাহুল চায় ঝিলের পাশে একটা আকাশছোঁয়া ঘর। দক্ষিণ খোলা জানলা। উত্তরের দিকে একটা চওড়া বারান্দা। শীত। স্কচ। সম্ভব হলে জোনাকির পাড়া। বলিহারি সাধ। তিতিরকে বলে শান্তি হয়নি, ওর ভাই টিক্কুকেও বলে রেখেছে। প্রোমোটারের খবর পেলেই তাকে জানাতে, সে অ্যাডভান্স বুকিং করবে। সমস্ত ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মনটা সকালের আকাশের মতো মেঘলা হয়ে গেল তিতিরের।

এককাপ চা যদি কেউ করে এনে দিত! কে করবে, সারা বাড়িটাই ঘুমোচ্ছে। একটা অদৃশ্য চায়ের গন্ধ লাগা রুমাল কেউ যেন চেপে ধরল তিতিরের নাকে। নাকছাবিটায় হাত চলে গেল ওর। বহুকাল মামাবাড়ি যাওয়া হয়নি। মামাতো দাদার সঙ্গে রাজবাড়িতে সারা দুপুর একা কাটিয়ে মাথায় খড়, গায়ে ধুলো লাগিয়ে ফেরার পর বাবা আর মামাবাড়ি আসতে দেবে না বলেছিল। আর সেটা নিয়ে মা’ও যে মেজোমামির সঙ্গে তুলকালাম করবে এটা তিতির বিশ্বাস করতে পারেনি প্রথমে।

মামাবাড়িতে নদীর পাড় ভাঙতে দেখেছিল তিতির। এ বার দেখল সম্পর্কেও ভাঙন ধরে নদীর মতো। অনেকেই আর নেই সেইসব মানুষেরা। অসুখ, অ্যাক্সিডেন্ট, অন্য শহর।  তিতিরের থেকে বছর দুয়েকের বড় ওর মামাতো দাদা কর্ণ এখনও ওখানেই আছে। রাজবাড়ির একটা অংশ ওর ওয়ার্কশপ। পেইন্টিং, স্কাল্পচার। রাজবাড়িতে এখন প্রায়ই শ্য়ুটিং করতে লোকজন আসে। জমিদার, একান্নবর্তী পরিবারের একটু পুরনো ধাঁচের গল্প। ভূতের গল্পের শ্য়ুটিং। কর্ণ এখনও বলে রাজবাড়িটা নেশার মতো। আর কোনও নেশার প্রয়োজন হয় না। শরীরেরও না। তা কখনও হয়! একা মানুষ আর কিছু পুরুষ সহকারি। একটা অভাববোধ থাকবে না! না থাকাটাই মনে হয় অস্বাভাবিক।

কর্ণ অনেকবার বলেছে একবার এসে থেকে যেতে। যোগাযোগ তো ছিলই একটা চিরকাল। কেউ জানতে পারেনি। তিতির যে কেন যায়নি সেই নিয়ে ভাবতে আর ইচ্ছে করছে না ওর। নিজেকে খুব বোকা আর ভীতু মনে হচ্ছে। ভয়টা নিজেকেই। যদি আর ফিরতে ইচ্ছে না করে। আজ খুব পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তিতিরের। দুপুরের ফাঁকা ট্রেন। তবু জানলা থেকে উঠে দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে। অন্য কোনও সিটে গিয়ে বসবে। তারপর ঘাসজমির কার্পেটে মোড়া একটা ছোট স্টেশন। খুব একা। তিতিরের কাছে দু’টো পথ খোলা। হয় কর্ণর কাছে চলে যাওয়া অথবা ছাদের ভিজে শ্যাওলার উপর দিয়ে আনমনে হেঁটে চলা। হঠাৎ বৃষ্টি নামল অঝোরে। তিতির চোখ বন্ধ করে লেগে থাকল একটা ভেজা ক্যানভাসের উপর।

Abhirup bandyopadhyay

সত্তরের দশকের শেষের দিকে কলকাতায় জন্ম অভিরূপের। স্কুলজীবন থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক। কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার পাশাপাশি পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ। কিছুদিন ফ্রিলান্স সাংবাদিকতাও করেছেন। এরপরেই ঢুকে পড়া টেলিভিশনের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার আঙিনায়। সম্পূর্ণ আলাদা এক পরিবেশ এবং প্রস্তুতির সঙ্গে পরিচয়। একইসাথে চলতে থাকে গল্প-কবিতার পালা। দেশ, এই সময়, আজকের সম্পূর্ণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা।

Picture of অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

সত্তরের দশকের শেষের দিকে কলকাতায় জন্ম অভিরূপের। স্কুলজীবন থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক। কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার পাশাপাশি পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ। কিছুদিন ফ্রিলান্স সাংবাদিকতাও করেছেন। এরপরেই ঢুকে পড়া টেলিভিশনের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার আঙিনায়। সম্পূর্ণ আলাদা এক পরিবেশ এবং প্রস্তুতির সঙ্গে পরিচয়। একইসাথে চলতে থাকে গল্প-কবিতার পালা। দেশ, এই সময়, আজকের সম্পূর্ণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা।
Picture of অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

সত্তরের দশকের শেষের দিকে কলকাতায় জন্ম অভিরূপের। স্কুলজীবন থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক। কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার পাশাপাশি পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ। কিছুদিন ফ্রিলান্স সাংবাদিকতাও করেছেন। এরপরেই ঢুকে পড়া টেলিভিশনের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার আঙিনায়। সম্পূর্ণ আলাদা এক পরিবেশ এবং প্রস্তুতির সঙ্গে পরিচয়। একইসাথে চলতে থাকে গল্প-কবিতার পালা। দেশ, এই সময়, আজকের সম্পূর্ণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com