সাফল্য কোনওদিন মাথায় ঢুকতেই দিইনি! ‘অপুর সংসার’ আর ‘কাশ্মীর কি কলি’-র পর যখন রাতারাতি সারা দেশে সব রকম দর্শকের প্রিয় নায়িকা, মানে হার্টথ্রব হয়ে উঠেছি তখন তো নয়ই। তারপরেও নয়। বম্বের বাড়িতে একদিন বাসু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তার মধ্যে এল একটা টেলিগ্রাম। আমি টেলিগ্রামটা পড়ে ভাঁজ করে রেখে দিলাম। বাসুর কিছু একটা সন্দেহ হল। জিগ্যেস করল, খবরটা কী? বললাম, ‘মৌসম’-এর জন্যে আমাকে সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার দিচ্ছে। বাসু চোখ কপালে তুলে বলল, এই তার প্রতিক্রিয়া!
ওইরকমই হয়। টিকিট কেটে সিনেমা দেখতে আসা দর্শক যখন অভিনয় দেখে ভালো বলে, উচ্ছ্বসিত হয়, তাঁদের হাসি বা কান্নার শব্দ শুনি, তখন মন ভরে যায়। আমি যেমন মানিকদার ছবিতে এমন বেশ কিছু বাস্তবনিষ্ঠ চরিত্র পেয়েছি, যাকে দর্শক চেনেন, জানেন। পরিচালকের প্রতিভায় দর্শক সেখানে আমার অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা মেলাতে পেরেছেন। সেখানে আমার কৃতিত্ব যত, পরিচালকের তার চেয়ে বেশি। তেমনই আবার ‘অমর প্রেম’ বা ‘আরাধনা’-র মতো ছবিতে যে সব চরিত্র, তারা লার্জার দ্যান লাইফ হয়েও আমাকে অভিনয়ের যথেষ্ট সুযোগ করে দিয়েছে। যাবতীয় অসঙ্গতি সত্ত্বেও দর্শকের কাছে এই সব চরিত্র যে আমিই বিশ্বাসযোগ্য তুলতে পারব, পরিচালকের সেই আস্থাটা ছিল। আমি যথাসাধ্য সেই দায়িত্ব পালন করেছি এবং দেখেছি, দর্শক আমাকে বিশ্বাস করেছেন। কখনও হেসে, কখনও কেঁদে আমার সঙ্গে থেকেছেন। ব্যাপারটাকে আমি এতই সিরিয়াসলি নিয়েছি, যে মাঝে মাঝে সেটা সমস্যা হয়ে উঠত।

‘মিলন কি রাত’-এ (১৯৬৩) আমি দুলালদার সঙ্গে ঝগড়া করলাম। এইখানে আমার কান্না আসছে না। বুঝতেই পারছি না, পার্বতী এখানে কাঁদবে কেন? দুলালদা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, অত ভাবছ কেন? কেঁদে দাও। আমি রেগে গিয়ে কাঁদলাম, কিন্তু এই উদ্ভট জিনিসটা করতে হচ্ছে ভেবে শেষের দিকে হেসেও ফেললাম। উনি বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এত ঝঞ্ঝাট হয়ে গেছে তার আগে, যে সেইটাই ওকে করে দিলেন। সিনটা ওইভাবেই রেখে দিয়েছিলেন ছবিতে। একদিন আমার এক বন্ধু ছবিটা দেখে বেরিয়েই ফোন করল। তুমি কি ওই কান্নার সিনে হেসে ফেলেছিলে? রিঙ্কু, বলতে পার, নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারো কেন!
শুধু সিচুয়েশনই নয়, সংলাপও নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না শোনালে কিছুতেই বলতে চাইতাম না। তর্ক করতাম ডিরেকটরের সঙ্গে। অধৈর্য হয়ে উঠত আমার সহ-অভিনেতারা। শশী কাপুর একদিন আর না পেরে বলল, ‘রিঙ্কু আমরা কি বাড়ি যাব? না এই তর্কই চালিয়ে যাব সারা দিন?’ লড়াই-টড়াই করে অনেক সময়েই সংলাপ পাল্টাত, কেউ কেউ আবার জেদ ধরত। সঞ্জীবকুমার বুঝিয়েছিল, ডিরেক্টর চাইছে যখন, তখন যতই আজগুবি লাগুক তোমার কাছে, যতটা পার বিশ্বাসযোগ্য করে তোল। এটাই তো আমাদের কাজ।

ঠিকই বলেছিল হরিভাই। একজন দক্ষ অভিনেতার কাছ থেকে সেটাই আশা করেন তাঁর পরিচালক। আর এই কাজে সে যতদিন সফল, ততদিন সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভালোবাসা সে পেয়েই চলে। যে চরিত্রে অভিনয় করছি, দর্শককে তার সঙ্গে ধরে রাখতে পারাটাই একজন অভিনেতার আসল সাফল্য। এই যে সব শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার আর লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, সবই সেই সাফল্যের বিলম্বিত স্বীকৃতি, তার দীর্ঘায়িত উদযাপন। পেতে ভালোই লাগে, আনন্দও হয়, তবে ওই পর্যন্তই। সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার থেকে পদ্মভূষণ – সাজিয়ে রাখিনি তো কোনওটাই। যে রকমভাবে পেয়েছি, সেই ভাবেই কোথাও রাখা আছে সেগুলো।
আর শুধু সাফল্যই তো নয়। পারফর্মেন্স যার জীবিকা, সে অভিনেতা হোক, খেলোয়াড় হোক, গায়ক হোক বা অন্য কিছু, তার জীবনে ব্যর্থতা নেই? ফ্লপ নেই? ব্যাড প্রেস নেই? চাহিদার জোয়ার-ভাটা নেই? অকরুণ কটু কথা নেই? আমাকে তো সেগুলোর মধ্যে দিয়েও যেতে হয়েছে। যারা বলেন সাম্রাজ্ঞীর মত, রানির মতো জীবন, তাঁদের কাছ থেকে সেগুলো লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। সাফল্যকে বেশি গুরুত্ব দিইনি, আঁকড়ে ধরে গোটা দুনিয়াকে দেখাতে চাইনি বলেই বোধ হয় এই আঘাতগুলোও কোনও চিহ্ন রেখে যেতে পারেনি।
***
১৯৮৪ সালে টাইগারের আম্মার শরীর যখন খুবই খারাপ হয়ে গেল, তখন ওঁর কাছে থাকব বলে বম্বের পাট চুকিয়ে দিল্লি চলে এসেছিলাম আমরা। তারপর আম্মা মারা গেলেন, কিন্তু আমরা দিল্লিতেই থেকে গেলাম। টাইগার চলে গেল ২০১১ সালে। ছেলেমেয়েরা এখন সব বম্বেতেই কাজ করছে। সকলেই স্বাবলম্বী, থাকে নিজের নিজের মতো। কেউ কারও ওপর নির্ভরশীল নয়। দিল্লির এই নতুন বাড়িতে এখন আমি একাই থাকি নিজের মতো। খানিকটা হৈচৈ হয় ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা এলে। নইলে শান্ত জীবন। কাজ অবশ্য থাকেই। সেন্সর বোর্ডের চেয়ারপার্সনের কাজ থেকে ছুটি পেলেও এখনও এটা ওটা সেটা, সরকারি-বেসরকারি পাঁচরকম কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়েই আছি। বিজ্ঞাপনের একটা কাজও করলাম বেশ অনেকদিন পর। বক্তৃতা দেওয়ার ডাক আসে নানা জায়গা থেকে। ফিরিয়েই দিই বেশিরভাগ, আবার গিয়ে ভালোও লাগে কোথাও কোথাও। বেড়াতে যাই। কাজ আছে, থাকে, তবে তেমন ব্যস্ততা নেই।

আয়নার সামনে যে মানুষটার সঙ্গে দেখা হয় আমার, সে আসলে খুব নিভৃতি-প্রিয়। তার ভালোলাগাগুলো একটু অন্যরকম। সে ফুল সাজাতে ভালোবাসে, রান্না করতে ভালোবাসে। একটু পিটপিটে তো, খুব ভালোবাসে বাড়ি পরিপাটি করে রাখতে। নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসে। চুপ করে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসে। সাধারণ, অখ্যাত মানুষের সঙ্গে মার্জিত, ভদ্র ব্যবহার করতে, তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে ভালোবাসে। তাকে ঘিরে থাকে যারা, খুঁটিনাটি প্রয়োজনের খেয়াল রাখে, অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যায়, তাদের জীবনে একটু ডিগনিটি, একটু মর্যাদার আলো দেখতে ভালোবাসে। তার সবচেয়ে আন্তরিক ইচ্ছে হল, আর একটু ভালো মানুষ হয়ে ওঠা। সে কি সোজা কাজ? কম চেষ্টা তো করতে হয় না তার জন্যে। চেষ্টাই করে যেতে হয় শুধু। তার জন্যে কি কোনও পুরস্কার আছে? সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু জানি, আছে। নিশ্চয়ই আছে। সভ্যতার ইতিহাস তো তা-ই বলে। (সমাপ্ত)
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
4 Responses
প্রতিটি পর্বই মনে থেকে যাবে। বড় ভালো লাগলো।
বাংলালাইভ-এ ‘মনে, রেখে দেব’-র ধারাবাহিক প্রকাশ আজ শেষ হল। কারো কারো মনে হয়েছে এটা আদতে অনুলিখন। না, সেটা ঠিক নয়। হাতে একটা প্রশ্নপত্র থাকত ঠিকই, কিন্তু তৃতীয় বা চতুর্থ দিন থেকেই ব্যাপারটা হয়ে উঠেছিল রিঙ্কুদির সঙ্গে আড্ডা। টানা দশ দিনের সেই দীর্ঘ আড্ডার লিখিত চেহারা দেওয়ার সময় আমি যে রচনাশৈলীটি বেছে নিয়েছিলাম, তাতে প্রশ্নকর্তাকে সরিয়ে নিয়ে অনেকটা আত্মকথার চেহারা দেওয়ার চেষ্টা ছিল। চেয়েছিলাম, প্রশ্নগুলোর মধ্যে দিয়ে নিজেকে জাহির না করে সলিলকির মতো একটা ইনটেনসিভ ন্যারেটিভ তৈরি করতে। অভিজ্ঞতা বলে, তাতে লেখা বেশি মনোজ্ঞ হয়। যে মানুষটির জীবন এবং কাজকর্ম নিয়ে লেখা, তাঁকে বুঝতে সুবিধে হয়। যাঁরা পড়লেন, তাঁরাই বলতে পারবেন, আমার এই ধারণা ঠিক না ভুল। যাঁরা এই ধারাবাহিক পড়তে পড়তে মন্তব্য করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন — তাঁদের সবাইকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ, গভীর কৃতজ্ঞতা।
একটু বিশেষ করে বলা দরকার বাংলালাইভ-এর প্রতিভাদীপ্ত সহ সম্পাদক এবং উজ্জ্বল লেখিকা পল্লবী মজুমদারের কথা। ‘শর্মিলা সৈকতে’ নামে ‘আজকাল’ শারদীয় সংখ্যায় পূর্ব-প্রকাশিত রচনাটির এই সম্প্রসারিত রূপটি প্রকাশ করা সম্ভব হল তাঁরই আগ্রহে। অবিকল্প নতুন নাম ‘মনে, রেখে দেব’ তিনিই বেছে দিয়েছেন অতুলনীয় মমতায়। পল্লবিত হোক তাঁর কাজ, তাঁর সংসার, তাঁর জীবন।
ধ্রুবজ্যোতি নন্দী
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ ধ্রুবদা। আমাদের পাঠকরা এবং আমরাও খুবই ভালোবেসে পড়েছি, কাজ করেছি এই ধারাবাহিক নিয়ে। ভবিষ্যতের জন্য আবারও এমন কিছু উপহারের আবদার রইল।
Opurbo. Onobodhhyo.
Manush ta ke aaro kach theke janlam mone holo. Oi lights, camera, action-er pechoner manush ta’r jibon take onubhob korlam. Golper moton tar shara jiboner ochena dik gulo janlam. Tar poribar, kormojibon, tar experiences, onar jibon japon-er dhoron- eishob e jeno kichu na kichu shekhaye manush ke.
Ebong apnar lekha’r bhoktoder oi lomba talikaye aarekta naam jurlo. Aaro notun kichu porar opekkhaye agrohi hoye roilam.