শক্তিজি প্যারিসে নিয়ে গিয়ে শাম্মি কাপুর আর আমাকে রেখেছিলেন জর্জ সাঁক নামে ওখানকার একটা সেরা হোটেলে। অন্যরা ছিল কম দামি অন্য একটা হোটেলে। কিন্তু টাইগার পৌঁছতেই আমি কাউকে কিছু না-বলে জর্জ সাঁক ছেড়ে শাঁজে লিজে-র কাছে একটা ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট রুমে থাকতে শুরু করলাম টাইগারের সঙ্গে। কল টাইম ধরে নিজেই শ্যুটিংয়ে পৌঁছে যেতাম। শ্যুটিং শেষ করার পর আর কোনও সম্পর্ক নেই সিনেমা পার্টির সঙ্গে। তখন শুধু আমি আর টাইগার। পরের দিন আবার যথারীতি শ্যুটিংয়ে হাজির।

এতে ওঁরা ভয়ঙ্কর চটেছিলেন। কেন এরকম ব্যবহার করছে আমাদের মেয়ে? কোনও দায়িত্বজ্ঞান নেই? কাউকে কিছু না-জানিয়ে হোটেল ছেড়ে চলে গেল? শুধু মাত্র দরকারি কাজের কথা ছাড়া ইউনিটের কেউ কোনও কথা বলত না আমার সঙ্গে! টোটাল বয়কট। শক্তিজি সমেত সবাই। আমিও একটা ভাব দেখাতাম, তাতে আমার কিচ্ছু এসে যাচ্ছে না। দিন দশেক পরে টাইগার যখন ফিরে গেল, আমি কিন্তু কাউকে বলিনি আমার জন্যে আবার জর্জ সাঁকে ঘরের ব্যবস্থা করতে। সোজা গিয়ে উঠলাম অন্যরা যেখানে আছেন সেই সস্তার হোটেলে, আমার হেয়ার ড্রেসার মীনা রাওয়ের ঘরে, যেখানে বাথটাও ঘরের সঙ্গে লাগোয়া নয়। সবাই সব জানে, কিন্তু তাতে অবস্থা কিছু পাল্টায় না। কারণ, কেউ তো কথাই বলে না আমার সঙ্গে!

কয়েক দিনের মধ্যে প্যারিসে আমাদের কাজ শেষ। যাওয়া হল কানাডায়, নায়াগ্রা ফলসে শ্যুটিং করতে। খুব ছোট করে ফেলা হল ইউনিট। শক্তি, শাম্মি, রাজেন্দ্রপ্রসাদ আর আমি ছাড়া ক্যামেরাম্যান গোপীকৃষ্ণ, ডান্সিং মাস্টার রাজ, প্রোডাকশন কন্ট্রোলার গৌতম মুখোপাধ্যায় আর হয়তো একজন কি দুজন টেকনিকাল লোক। মীনা, যে আমার হেয়ারড্রেসার আর খুব ভালো বন্ধুও ছিল, প্যারিসে যার ঘর শেয়ার করেছিলাম, তারও জায়গা হল না। অথচ ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’-এ আমার লুক, মেক আপ, হেয়ার স্টাইল নিয়ে পেশাদাররা আজও শুনি মাথা ঘামান! ফলে অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যে শ্যুটিং টিমে আমি ছাড়া কোনও মহিলাই নেই। হোটেলের ঘরে আমি একাই থাকি, শ্যুটিং শেষ হলে সেই যে ঘরে ঢুকি, আর বেরোই না একবারও। বেরিয়ে করবই বা কী? কেউ তো কথাই বলে না আমার সঙ্গে। রুম সার্ভিসে খাবার আনিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ি।

তখন নয়, অনেক পরে মনে হয়েছে, শিল্পিত ছবি আর বাণিজ্যিক ছবির এই একটা মস্ত তফাৎ। ‘দেবী’ করার সময় মানিকদা আমাকে একটা চাপের মধ্যে রাখতেন যাতে আমি দয়াময়ীর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারি। আর, ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ যাবতীয় অ্যাকশন, থ্রিল সত্ত্বেও আসলে একটা ফান ফিল্ম, উচ্ছ্বল একটা মজার ছবি। তার নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করছে একুশ-বাইশ বছরের যে মেয়ে, তাকে একঘরে করে রাখত একটা পেশাদার ফিল্ম ইউনিট! কানাডার হোটেলে রুম সার্ভিসের একটা ছেলে প্রায়ই জিজ্ঞেস করত, তোমার কি মন খারাপ? বাইরে কোথাও ডিনারে নিয়ে যেতে পারি তোমাকে? যাক সে কথা। কানাডার পর আমাদের যাওয়ার কথা বেইরুট। তার টিকিট দিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাকে, জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কোন হোটেল থাকছি, বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে শ্যুটিং শিডিউল। কিন্তু লন্ডনে তখন টাইগারের সঙ্গে আমার একটা বিশেষ জরুরি কাজ, বলছি তার কথা।

শ্যুটিং যেদিন শেষ হওয়ার কথা, সেদিন আমি ডিনারে ডাকলাম ডেভিড ডানলপ নামে টাইগারের খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে, যে থাকত টরোন্টোতে। সে চলে এল গাড়ি চালিয়ে। ইতিমধ্যে আমি এয়ার ফ্রান্সের টরোন্টো-প্যারিস, প্যারিস-বেইরুট টিকিট বদলে করে নিয়েছি টরোন্টো-লন্ডন, লন্ডন-বেইরুট। ইউনিটের কেউ তো কথা বলে না, সুতরাং কাউকে এসব কিছু জানানোরও প্রশ্ন নেই। ডেভিডকে হোটেলের রুফ টপ রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে বললাম, আমি এখনই হোটেল ছেড়ে তোমার সঙ্গে টরোন্টোতে যাব। সেখানে আমাকে একটা হোটেলে পৌঁছে দিতে হবে আর কাল ফ্লাইটের সময় মতো এয়ারপোর্টে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। টাইগারও বোধ হয় ওকে সেই রকমই বলে রেখেছিল। তাই রাজি না হয়ে সে বেচারির আর উপায় কি!

এদিকে, তার মধ্যেই শক্তিজি, শাম্মিজি সমেত গোটা ইউনিট রুফ টপে উঠে এসেছে ডিনার করতে। আর, বসেছে ঠিক যাতায়াতের দরজাটার পাশে। এমনভাবে বসেছে যে, ওদের এড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ারও কোনও উপায় নেই। বেরোনোর সময় বাধ্য হয়েই তাই ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম, ইনি আমার বন্ধু ডেভিড ডানলপ, টরোন্টোতে থাকেন। কী আশ্চর্য, একটা হ্যালো পর্যন্ত বলল না কেউ! শুধু গম্ভীর একটা হুম্। ওখান থেকে বেরিয়ে এসেই ডেভিড বলল, ইউ হ্যাভ গট আ ভেরি রাফ বাঞ্চ দেয়্যর। আমি হাসতে হাসতে বললাম, তাও তো কেউ জানে না তখনও, যে আমি কিছু না-জানিয়েই হোটেল ছেড়ে চলে যাব!

লন্ডনে টাইগার এসেছিল আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে। এয়ারপোর্ট থেকে আমরা সোজা গেলাম ওদের লন্ডনের বাড়িতে। গ্রীষ্মটা লন্ডনেই কাটাতেন টাইগারের মা সাজিদা সুলতান – ভোপালের নবাব বেগম তখন তিনি। আমরা ডাকতাম আম্মা বলে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে টাইগার আম্মাকে বলল, আমরা বিয়ে করতে চাই। খুবই গুণের মানুষ হিসেবে পরে আবিষ্কার করেছি আম্মাকে। সে সব কথা বলব যথা সময়ে। কিন্তু সেদিন নানা কথার মধ্যে আম্মা হঠাৎ বললেন, তোমাদের বিয়েতে সম্মতি দিতে পারি, তবে একটা শর্তে। যদি তোমাদের প্রথম সন্তানকে আমাকে দিয়ে দিতে রাজি থাকো।
[the_ad id=”266918″]
আমি ততক্ষণে বেশ সহজভাবে কথা বলছি আম্মার সঙ্গে। হেসে বললাম, খুব দুঃখিত আম্মা, কিন্তু সেটা কিছুতেই পারব না। তখন কী আর করা, শর্ত ফিরিয়ে নিয়েই আমাদের বিয়েতে রাজি হতে হল আম্মাকে। আমাদের যে জরুরি কাজটার জন্যে লন্ডনে যাওয়ার কথা বলছিলাম একটু আগে, সেটা সেরে ফেলা গেল।

এদিকে ইউনিটের কেউ কিন্তু তখন জানেই না আমি কোথায়। মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগ নয় তো সেটা, সকলে দেখছে হিরোইন মিসিং। লন্ডনে টাইগার আর আম্মাকে ছেড়ে আমি কিন্তু বেইরুট পৌঁছলাম ঠিক সেদিন, যেদিন থেকে বেইরুটে আমাদের শ্যুটিং শুরু হওয়ার কথা। এবারও ইউনিটের কাউকে কিছু না জানিয়েই। আগে থেকে কিছু না জানিয়েই। দেখি শাম্মিজিকে ওখানে রাখা হয়েছে ফিনিশিয়া নামে খুবই ভালো হোটেলে। আর আমি তো ইউনিটের কাছে স্টেটাস হারিয়েছি ততদিনে। তাই আমার জন্যেও একটা রুম বুক করা আছে বটে, তবে সেটা অন্যদের সঙ্গে, কম দামি হোটেল। সেই ঘরে ঢুকেই ফোন করলাম প্রোডাকশন কন্ট্রোলার গৌতমবাবুকে। তিনি তো খলি পায়েই ছুটতে ছুটতে চলে এলেন আমার ঘরে, জুতো পরার সময়টুকু পর্যন্ত না নিয়ে, চুল প্রায় খাড়া। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছিল আপনার? কোথায় চলে গিয়েছিলেন?
[the_ad id=”266919″]
মানুষটা এমনিতে খুবই ভালো। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা ততদিনে আমাকে বুঝিয়েছে আসলে এরা কেউই আমার বন্ধু নন। ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলাম, সেসব জেনে তো কোনও লাভ নেই। কাজ ছিল, তাই চলে গিয়েছিলাম। এখন পৌঁছে গেছি, শ্যুটিংয়ের জন্যে তৈরি। এবার আপনাদের যা করবার করুন। তারপর থেকে দেখলাম ইউনিটের সবাই একটু নরম হয়েছেন। বলব না আবার আগের মতো বন্ধু হয়ে উঠেছেন, তবে ব্যবহারে ভদ্রতাটা ফিরেছিল।
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
3 Responses
বেশ ভালো লাগছে।
আন্তরিক ধন্যবাদ। সঙ্গে থাকুন।
কি অসমসাহসী, জেদি মহিলা! অথচ কি সহজভাবে বলেছেন সে কথা।
তবে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি রবি ঘোষের সাথে ওঁর সমীকরণটা। সেই বিষয়ে আরো জানতে পারলে খুব ভাল লাগবে।