একটি সেকেলে মিষ্টি প্রেমের গল্প
এই কলাম শুরু করার সময় পাঠকদের জানিয়ে রেখেছিলাম লেখাগুলি আত্মজীবনীর অঙ্গ হবে না— দীর্ঘ প্রবাসজীবনে যা দেখেছি, যা শুনেছি, যা বুঝেছি সেসব নিয়েই লিখব।
এই লেখা ক্যানবেরার এক সান্ধ্য আসরে এক প্রবীন দম্পতির মুখে শোনা এক মিষ্টি প্রেমের কাহিনি। কাহিনির প্রেক্ষাপট কলকাতা এবং লন্ডন। সময়কাল গত শতাব্দের চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশক। আমার তখনও জন্ম হয়নি। তাই এক অজানা যুগের ঘটনাবলী মন ছুঁয়েছিল।
নায়ক-নায়িকার অনুমতি নিয়েই কাহিনিটি লিপিবদ্ধ করলাম।
***
অনেক দিন আগের কথা। দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে।
তেরো বছরের কিশোরী রেবা মজুমদার ভিক্টোরিয়া স্কুল থেকে ট্রামে বাড়ি ফিরছে এক দুপুরে। ট্রামটা হঠাৎ বিগড়ে গেল বৌবাজারের কাছে। এরকম পরিস্থিতিতে কোনোদিনও পড়েনি রেবা— একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল।
একই ট্রামে ছিল এক সহপাঠিনী। সেই মেয়েটির বাড়ি বৌবাজারেই। বলল, “ট্রাম চালু হতে তো ঘণ্টাখানেক লাগবে। আমাদের বাড়িতে চল না কিছুক্ষণের জন্য।”
প্রস্তাবটা চৈত্র মাসের গনগনে রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে অনেক লোভনীয়। রেবা সানন্দে রাজি হয়ে গেল।

বন্ধুর বাড়ি একটু ভেতরে, একটা গলিতে। বাড়ির রোয়াকে এক যুবক বসে। বছর ১৭ বয়স। ছিপছিপে চেহারা। রং কালোর দিকে হলেও বেশ সুদর্শন। সোজাসুজি রেবার মুখের দিকে তাকাল ছেলেটি। নিঃসংকোচ তাকানোর মধ্যে মুগ্ধতা লুকানোর কোনও চেষ্টা ছিল না। আয়তনেত্রে দেখেও না দেখার ভান করে রেবা বান্ধবীর সঙ্গে ভেতরে চলে গেল।
সেদিন বিকেলে অসীম মিত্র বোনকে বলল: “তোর ঐ বন্ধুটাকে আমি বিয়ে করব।”
বলাই বাহুল্য, কথাটা রেবার কানেও পৌঁছল পরের দিনই।
***
মাসখানেক বাদে অসীম বিলেতে গেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। ওর লন্ডনবাসী মামা-ই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। থাকার ব্যবস্থা মামার কাছেই। মামি মেমসাহেব। ভাগ্নেকে মায়ের স্নেহই দিয়েছিলেন।
দিন যায়। অসীম মন দিয়ে পড়াশোনা করে চলে। খুব একটা আবেগপ্রবণ নয় এই যুবক, তবে শয়নে স্বপনে জাগরণে না হলেও রেবার জন্য হৃদমাঝারের স্থানটি মাঝে মাঝে জানান দেয়, বিশেষ করে মেঘলা মন খারাপ করা দিনগুলিতে। তখন সে কিছুটা স্বভাববিরূদ্ধভাবে আনমনা হয়ে পড়ে। মেঘলা দিনে একলা প্রবাসে মন টেঁকে না। কাছে গিয়ে নিবিড়ভাবে পেতে ইচ্ছে করে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়া কিশোরীটিকে।
মামীমা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন। ভেবেছিলেন, নারীসঙ্গের অভাবটাই বোধহয় এই ম্লান মুখে ফুটে উঠছে। বিরহকাতরতার সম্ভাবনাটা মাথায় আসেনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তখনও বিধ্বস্ত ইংলন্ড। চার লক্ষের উপর তরুণ প্রাণ অকালে ঝরে গেছে যুদ্ধে। অল্পবয়স্কা ইংরেজ রমণীকূল হন্যে হয়ে বর খুঁজছে বেহাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মাঝে। নির্ভরতা পেতে জাত্যাভিমান ভুলে কালো, বাদামি রঙেও আপত্তি নেই।
মামি একদিন অসীমকে ডেকে পাঁচ পাউন্ড হাতে দিয়ে বললেন: “দেখছি তুমি খুব বিমর্ষ হয়ে আছ। আজ বিকেলে আমার ভাইঝি জুলিকে নিয়ে একটা ভালো রেস্তোরাঁয় খেয়ে এস। মনে হয় তোমার মেয়েটিকে ভালোই লাগবে।”
স্নেহময়ী মামি ভাবলেন একটা মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন। ভাগ্নের মনও ভালো হবে, একটা সৎপাত্র পেয়ে ভাইঝিটিরও দুঃখের বাজারে হিল্লে হয়ে যাবে।
***
সেদিনের আড়ষ্ট অসীম একটা বেশ অস্বস্তিকর সন্ধে কাটিয়েছিল। প্রথমত ‘ভালো রেস্তোরাঁ’ বলতে মামি কী ইঙ্গিত করেছিলেন, সেটা একদম না বুঝে একটা নেহাতই আটপৌরে মধ্যবিত্ত রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়েছিলেন জুলি সুন্দরীকে। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পরে কী বলতে হয় সেটাও অসীমকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। বলাই বাহুল্য, জুলি আর second date-এ উৎসাহী ছিল না।
***
পড়াশোনা একদিন শেষ হল। এবার দেশে ফেরার পালা।
মামা হালকা রসিকতা করে বললেন: “এখন তো তুই বিলেত–ফেরত ইঞ্জিনিয়র। সুন্দরী পাত্রী দেখতে বলি দিদিকে।”
লজ্জায় লাল অসীম কোনওরকমে বলল: “মামা, আমি একটি মেয়েকে ভালবাসি।”
মাই ডিয়ার মামা নড়েচড়ে বসে বললেন: “এ তো বিরাট খবর! এতদিন চেপে রেখেছিলি! তা বিবি রাজি তো!”
উত্তরটা শুনে মামা স্তম্ভিত: “ও জানে না আমি ওকে ভালবাসি। কোনোদিনও বলার সুযোগ পাইনি!”

যাইহোক , মামা ধৈর্য ধরে একতরফা প্রেম কাহিনি শুনলেন। মেয়ের বাবার নাম শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন। “আরে তুই উড়ের মেয়ের প্রেমে পড়েছিস!”
পৃথিবীটা শুধু আজ নয়, সেই পঞ্চাশের দশকেও বেশ ছোট ছিল। রেবার বাবা প্রখ্যাত দন্তচিকিৎসক ডঃ মজুমদার ছিলেন অসীমের মামার সহপাঠী— যিনি বন্ধুমহলে ‘উড়ে’ নামে পরিচিত ছিলেন।
দেশে ফেরার সময় অসীমের হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠালেন। “প্রিয় উড়ে, আমার ভাগ্নে তোর মেয়ের প্রেমে পড়েছে এবং বিয়ে করতে চায়। কিন্তু ইডিয়টটা সাহস করে প্রেম নিবেদন করে উঠতে পারেনি দেশ ছাড়ার আগে। তবে নিজের ভাগ্নে বলে বলছি না— ছেলেটা ভালো। তোর মেয়ে সুখীই হবে।…”
***
রহস্যটা জিইয়ে রাখার জন্য একটা কথা এখনও পর্যন্ত লিখিনি। বিগত কয়েক বছরে বৌবাজারে মিত্রদের যৌথ পরিবারে রেবার নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
বাড়ির লোকের, বিশেষ করে অসীমের ছোট কাকিমার এই সুন্দরী কিশোরীটিকে খুবই পছন্দ হয়েছিল। আদর করে ডাকতেন ‘ছোট বৌমা’ বলে।
বিয়েটা আড়ম্বর সহকারেই হয়েছিল।

ক্যানবেরার সবার প্রিয় এই অসীমদা এবং রেবাবৌদি। পঞ্চাশ বছর এই শহরে আছেন এই অজাতশত্রু দম্পতি। অসীমদা গত বছর ৯১ বছর বয়সে আনন্দময় জীবন শেষ করেছেন। ৮৬ বছরের বৌদি এখনও আছেন আমাদের মাঝে। বয়সের ভারে ইচ্ছে থাকলেও আর সামাজিক জীবনে সক্রিয় নন। কাছেই থাকেন— মাঝে মাঝে দেখা করে আসি।
আমি বানিয়ে গল্প লিখতে পারি না। সব কাহিনিই জীবন থেকে নেওয়া। তাই অনেক সময়ে নাম-ধাম গোপন রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রে বৌদির অনুমতি পাওয়ায় সেটার প্রয়োজন হয়নি।
ওঁদের তখনকার এবং এখনকার কয়েকটি ছবিও দিলাম।
শেষে বলে রাখি— অসীমদা ফাটাফাটি মাংস রান্না করতেন, আর বৌদির বানানো মিষ্টি কলকাতার ময়রাদের হার মানায়।

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।
One Response
bhalo bhabei poribeshon korechen….bhalo legeche aro kichu podaaben asha kori
nomoskaar.