কাম্বোডিয়ার অন্যতম শহর ক্রং সিয়েম রিয়েপে পৌঁছেই হোটেলে লাগেজ রেখে টুকটুক চড়ে চললুম ডাউনটাউনে। খেতে যেতে হবে সস্তার হোটেলে, রাস্তার ধারে। কারণ দাম তো দিতে হবে ইউএস ডলারে!
তখন আমাদের ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী মন্দিরময় (আসবার পথেই বই পড়ে পড়ে বিস্তর জ্ঞান লাভ করে আমাদের তখন শয়ন স্বপন জাগরণ মন্দিরময়)। পেটে ছুঁচোবাবুর ডন-বৈঠকের দিব্যি শব্দ পাচ্ছি আমি। তবুও কল্পনার দৌড়ে লাগাম নেই! ভেবে ফেললাম, গড়িয়াহাটে অদূর ভবিষ্যতে এমন ঝাঁ চকচকে সাজানো গোছানো টুকটুকের দেখা পেলে কেমন হবে সে দিন! পাব স্ট্রিট পৌঁছে গেলাম দু’মিনিটে। পরে বুঝলাম টুকটুক নেওয়াটা বেকার হল, কারণ হোটেল থেকে পাব স্ট্রিট হাঁটা পথ। পাব স্ট্রিট হল অনেকটা দেশের পার্ক স্ট্রিটের মতো। রাস্তার দুই ধারে কাতারে কাতারে রেস্তোরাঁ আর বার। অলিগলিতে দোকান বাজার, হ্যান্ডিক্রাফট, পোশাক-আশাক। তাকালেই মিষ্টি হেসে সেলস গার্ল বলে উঠছে, “মাদাম অনলি তু দলার ফর ওয়ান… ফাই দলার ফর তু” কিম্বা বুদ্ধমূর্তি হাতে তুললেই স্বল্পবাস গৌরী তণ্বী বুঝতে পারে আমার পছন্দ আর মৃদু হেসে গড়িয়ে পড়ে। আমার মন ভিজিয়ে বলে ওঠে… “আই ক্যান বারগেন ফ ইউ মাদাম।” খেয়াল হল এই “মাদাম” সম্বোধনটি হল কাম্বোডিয়া দেশটির ওপর উনিশ শতাব্দীর ফরাসি প্রভাব।
ইতিউতি চাই আর মনে পড়ে আমেরিকার নিউ অর্লিয়ঁন্স শহরের কথা। ফুটপাথে চেয়ার পেতে বিয়ার মাগ হাতে সারসার সাহেব-মেমের কলকলানি মনে করায় প্যারিসের ক্যাফে কালচারের কথা। পাব স্ট্রিটের সব ফুটপাথ রেস্তোঁরার দখলে, তবুও পথ হাঁটতে অসুবিধে হয় না। দেখতে দেখতে চলতে চলতে হঠাৎই ঢুকে পড়ি তেমনই এক পথ রেস্তোরাঁয়।

সেখানে বসবার সঙ্গেসঙ্গেই কমপ্লিমেন্টারি মিনারেল জল প্রথমেই মন ভেজায়। তেষ্টা তো মেটায়ই। তারপর এল বিয়ারের সঙ্গে কমপ্লিমেন্টারি পপকর্ন। এবার আমাদের খাবার অর্ডার দেবার পালা। গোরু-শুয়োরের মাংস আমার চলে না। কিন্তু এ যাত্রা পরখ করতে হবে কাম্বোডিয়ার “খামের” কুইজিন। অতএব চিকেন আর ডিম জিন্দাবাদ! স্টার ফ্রায়েড ভেজ নুডলস উইথ ফ্রায়েড এগ আর চিকেন উইথ লেমন গ্রাস এন্ড চিলি….স্বাদু…অতীব সুস্বাদু। কিন্তু মেইন কোর্সে মাংসের সঙ্গে একটু ভাত থাকবেই। অতএব চিকেনের পাশে কিছুটা ভাত। তবে ভাতটি আমাদের ঝরঝরে আর ফেনভাতের মাঝামাঝি। অর্থাৎ স্টিকি রাইস। সেটা অবশ্য মোটেই ভালো লাগছিল না। তবে খাবার খুব ঝাল মশলাদার নয়। টাবাসকো, চিলি সস আর চিলি ভিনিগারের কৃপায় খিদের মুখে তা-ই অমৃত।
এক কলসি (পিচার) বিয়ার মাত্র তিন ডলার আর খাবার ও দাবার নিয়ে আরও ছয় ডলার। নো ট্যাক্স, নো ভ্যাট। মনে বড় ফূর্তি। বেশ কলকাতা কলকাতা চাইনিজ খেয়েছি। হোটেলে ফেরার পথ হাঁটতে মাত্র পাঁচ মিনিট। এবার নো টুকটুক। কিন্তু টুকটুকওলা পিছু ছাড়ে না। বলতেই থাকে “টুকটুক স্যার…টুকটুক মাদাম?”

এবার হল বিপত্তি। রেস্তোরাঁ থেকে রাস্তায় নেমেই দেখি আমাদের ফুচকাওয়ালার মত স্টিলের পরাত ভর্তি করে কী সব ভাজাভুজি বিক্রি হচ্ছে। গিয়ে দেখি ঝাঁটার কাঠিতে গাঁথা কমলা রঙের মশলা, তেল আর সস মাখানো চিতি সাপের বারবিকিউ! পাশের পরাতে স্পাইসি ট্যারেন্টুলা!

আর সবশেষের পরাতে স্তূপীকৃত উচ্চিংড়ে, ডুমো মাছি (ড্রাগন ফ্লাই) আরও কী সব পোকামাকড় মুচমুচে করে ভেজে রাখা! তেল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ। আলোর নিচে গরম গরম… রোদের তাপে আরও কড়কড়ে! মনে হল, এই দেখাও বাকি ছিল জীবনে!!! সেই শুনে আমার কর্তামশায় একগাল বললেন, “আর তুমি বুঝি কুচো চিংড়ি, ঘুসো মৌরলাভাজা খাও না? কথা না বাড়িয়ে বললাম, “শিগগিরই এখান থেকে চলো… বমি করব একটু।”

পরদিন ভোরে হোটেলের ব্রেকফাস্ট ব্যুফেতে আমার সাত্ত্বিক প্রাতরাশ শুরু হল দুধ কর্নফ্লেক্স, ফ্রুট জুস আর ফলের কুচি দিয়ে। কিন্তু তার পরেই ছোঁকছোঁকানি। টোস্ট, ক্রোয়স্যাঁ, ড্যানিশ পেস্ট্রি পর্যন্ত ঠিক আছে… কিন্তু বাকি সবই যে বাদ আমার তালিকা থেকে। বাকি অর্থে গলা ভাতের কাম্বোডিয়ান ফ্রায়েড রাইস, মিক্সড নুডলস, হ্যাম, বেকন, সসেজ। হঠাৎ দেখি দূরে একজন ডিম বানিয়ে দিচ্ছেন খদ্দেরের পছন্দ অনুয়ায়ী। গেলাম তাঁর কাছে। মসালা অমলেটের অর্ডার পেশ বললাম। সে একটা ডিম ভরা কইমাছের মত মোটাসোটা স্টাফড অমলেট বানিয়ে দিল। আমার কর্তা দেখেই সন্দেহ প্রকাশ করা শুরু করলেন, “ভেতরটা ভেজেছে ভালো করে?” তাঁর আবার প্রবল সালমোনেল্লার বাতিক। আমি বললাম “এ কি তোমার বৌয়ের রান্নাঘর পেয়েছ? যা দিয়েছে খাও। চেনা বামুনের পৈতে লাগে না। ডিম ইজ ডিম।”

কিন্তু খেতে গিয়েই বিপত্তি। ভিতরে গলা গলা। ব্যাস। সেদিনই প্রথম আর সেদিনেই শেষ। নো ওয়ে! অতএব অমলেটে ইতি। পরদিন ভাবলাম, ডিমের পোচ খাব। এরা কেউ ইংরেজি বোঝে না। গেলাম শেফের কাছে। বললাম, “পোচড এগ ফর টু অফ আস।” সে দেখি গ্যাসটা সিম করে দাঁড়িয়েই আছে। ভাগ্যিস পাশে একটি মেয়ে এসে তাকে বুঝিয়ে দিল, যে পোচড এগ নয়, ফ্রায়েড এগ। এবার নন স্টিকে তেল পড়ল ছিঁটে ফোঁটা। ঝপাং করে দুটো ডিমের পতন, অক্ষত কুসুম দু’টি। দিয়েই শেফের সে কী হাসি! আমি মরিয়া হয়ে বলি, “টার্ন আপ সাইড ডাউন!” কিন্তু হায়। বোঝে না সে বোঝে না। প্লেটে ঢালতে যায়। আবার বলি, “গ্যাস বাড়াও।” নিজেই বাড়িয়ে দিলাম, কমিয়ে দিলাম, আর হাত নেড়ে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে বলতে লাগলাম, উল্টে দাও। উল্টেই সে প্লেটে দেবার জন্য মরিয়া। আবারও চোখ পাকিয়ে বলি “সালমোনেল্লা… স্টপ!” রাখো বৎস। তিষ্ঠ ক্ষণকাল!
দু’দিন ডিমের পোচ খেয়ে বোরড। চতুর্থ দিনে ডাইনিং হলে ঢুকতেই কত্তামশায় বললেন, “তুমি ওকে একটু অমলেট করাটা শিখিয়ে দাও দিকিনি।” আমি ওড়না জড়িয়ে শেফের টেবিলে। সে ভাষা বোঝে না। আগেই দেখেছি, অমলেট চাইলে কাঁচা থলথলে গোছের কী একটা বানিয়ে দেয়। প্রথমেই বললাম, “লংকাকুচি আনো। আই মিন চপড গ্রিন চিলি।” এসে গেল কাঁচের বাটিতে করে। পাশে থরে থরে রাখা স্প্রিং অনিয়ন, টোম্যেটো আর পিঁয়াজ কুচি, ক্যাপসিকাম কুচি আর হ্যামের টুকরো, চিজ কুরোনো। তাই দিয়ে ডিম ফেটিয়ে ফ্ল্যাট অমলেট বানানোর পরে আবার সালমোনেল্লার ফান্ডা দিয়ে নিজেই উল্টে দিলাম সেটা। তখন শেফ এক গাল হেসে বলে…”ওহ!! পিৎজা?” আমি গম্ভীর মুখে বললাম “পিৎজা নয়। ফ্রিটাটার অপভ্রংশ।” এই না হলে কাম্বোডিয়ান শেফ! এবার তার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললাম, “উই কল ইট অমলেট। আমবাঙালি বলে মামলেট।” সে বলে “হোয়াত?” আমি বললাম, “আচ্ছা বাবা, তুমি এ বার নিজের ফ্রাইপ্যানে তেল দাও।”

ডিম পাঁউরুটি খেয়ে মুখে পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে বেরুতে যাব, পেটমোটা এক মাসি গোছের শেফ রান্নাঘর থেকে এক থালা পাতুরি নিয়ে হাজির। বড়দিনের মিষ্টি! সে বলল হাসিমুখে টেস্ট করতে। কলাপাতা থেকে ধোঁয়া উঠছে। ভাবলাম, স্পেশ্যাল কেক টেক হবে। ও বাবা! পাতার মোড়ক খুলে দেখি নারকোল নাড়ু। কিন্তু নাহ, নেহাতই নাড়ুর অপভ্রংশ। নারকেল কোরা, চিনি আর জেলাটিন মিশিয়ে মেখে কলাপাতায় সেঁকেছে। মুখে দিয়ে মনখারাপ হয়ে গেল। কোথায় আমার মায়ের হাতের রসকরা… তাতে ভুরভুরে এলাচি গন্ধ আর কর্পূরি মাদকতা।
মনে হল বলি, “চল মাসি তোমার রান্নাঘরে যাই, তোমায় একটু নারকেলের ক্যান্ডি বানানোটা শিখিয়ে দিই। মাসিমা গো, তোমাকে আর কী করে বোঝাই যে নারকেল নাড়ুর আসল হল কড়াতে পাক! কোথায় একটু ক্ষীর দেবে বাঁধবার জন্যে, তা না…দিয়েছ জেলাটিন! চাঁদে আর এলইডি বাল্বে কি তুলনা হয় মাসি গো?”
এ দেশে বারোমাসই গ্রীষ্মকাল। জানুয়ারির দশ-পনেরোটা দিন হালকা শীত পড়ে। আর বর্ষার খুব আনাগোনা। তাই বড্ড সবুজ এ দেশ। নারকেল, তাল আর খেজুর গাছের প্রাচুর্য্য এখানে। আঙ্কোরথম, আঙ্কোরভাট দেখতে দেখতে থকে যাই গরমে। তখন ডাবের জল একমাত্র ভরসা। ডাবের সাইজ দেখে চোখ ছানাবড়া। একটা ডাব এক ডলার। জল থাকে কমপক্ষে আধা লিটার! আর কী মিষ্টি সে ডাবের জল! কিন্তু কলকাতার মতো জল খাওয়ার পর ডাবের শাঁসটা কেটে খাবার মত রীতি নেই ওখানে। পথের ধারের বাঁদর খায় শাঁসটুকুন। তাই জয় বাবা বজরংবলি বলে মনে মনে এঁটো ডাবটি নিবেদন করি বানর সেনাকে। কাম্বোডিয়ানরা ডাবের জল বাদে আর ব্যবহার করে নারকেলের দুধ। সেইটে দিয়ে “খামের” চিকেন কারি বানায়। আর ভাতের পাশে কলাপাতার বাটির মধ্যে সেই সাদা সাদা চিকেনের মালাইকারি পরিবেশন করে। সেই মালাইকারির স্বাদে গদগদ মেমসাহেবরা। সুড়ুত সুড়ুত ঝোল আর ভাত চপস্টিক্স দিয়ে মুখে পুরছে।
খেজুরগাছে ডিসেম্বরের ভরা শীতে আমরা বাঁধি হাঁড়ি। আহা সেই খেজুর রসের কী সোয়াদ! কাম্বোডিয়ায় ডিসেম্বরের গরমে খেজুরগাছ অন্তঃসলিলা। সফিসটিকেটেড পাইপ বাঁধা প্রতিটি গাছে। আর পাইপের শেষটা একটা হাঁড়িতে। সে হাঁড়িটা ঠান্ডায় রাখা আছে নয়তো ওই রস তো গেঁজে গিয়ে তাড়ি! ওই প্রবল গরমেও মেয়েরা বাঁশের কাসকেডে ঠান্ডা রেখে বিক্রি করছে “ডেট-পাম-জুস”। তালপাতার হ্যান্ডিক্রাফটসও আছে প্রচুর। এখানে আমাদের গাইড ‘সেং’। বাচ্চা ছেলে হলে কী হবে? জবরদস্ত ইংরিজি শিখে ফেলেছে এই বয়সে। তালগাছ দেখিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করি, “আচ্ছা বল তো এই গাছের ফল কী ভাবে খাওয়া হয়?” সেং সপ্রতিভ ভাবে জবাব দেয়, তালের ফোঁপলের কাঁচা অবস্থায় খাওয়া, পাকা অবস্থায় হলুদ রস দিয়ে আমাদের তালের পিঠে বানানোর সমতুল্য কিছু একটা রেসিপির কথা। বুঝি কাম্বোডিয়ায় ভারতের প্রভাবও আছে কিছুটা।
পাম গাছ আর কলাগাছ, সোনাঝুরি আর বাঁশঝাড়। কোথাও কোথাও রাঙামাটি আর গরমের ঘাম মনে করায় দেশের মাটির গন্ধ। আর আছে থরে থরে আমগাছ। ডিসেম্বরেও দোকানে আম থৈথৈ। সেই সঙ্গে আছে আনারস আর ড্রাগন ফ্রুট। বিটের মত টুকটুকে লাল গা। মধ্যে সাদা কালোয় ফুটফুট। তবে খুব একটা আহামরি স্বাদ নয়। বেশ ডিসেপ্টিভ রূপ সে ফলের!

এই হল কাম্বোডিয়া। আমরা পাকা কলার বড়া খাই আর কাঁচাকলার কোফতা বানাই। অপ্সরা ডান্স এন্ড ডিনারের অন্যতম সান্ধ্য শো, “স্মাইল অফ আংকোর”-এ গিয়ে দেখি, ও হরি! ডিনার ব্যুফেতে কাঁচকলার কোফতা পরিবেশন হচ্ছে স্যুপের সঙ্গে! কিন্তু সেই বিনা মশলার কাঁচকলার কোফতা আমাদের বাঙালি কোফতার কাছে স্বাদেগন্ধে একশোর মধ্যে দশ পাবে কিনা সন্দেহ! আর কুলেন মাউন্টেনের পথে হাঁটতে গিয়ে দেখি, পাকাকলা চটকে মালপোয়ার মত ডিপ ফ্রায়েড একটা ক্রিস্পি মিষ্টি বানাতে। অন্যদিকে আর একটি মেয়ে রোটিমেকারের দু’পাশে প্লাসটিক রেখে কলা চেপ্টে নিয়ে সেই ফ্ল্যাট কলাকে ব্যাটারে ডুবিয়ে ভাজছে। কী ভিড় সেই দোকানে! ঠিক আমাদের তেলেভাজা-বেগুনির মত দোকান। আর এক জায়গায় দেখি ক’টি মেয়ে কয়লা উনুনের নিভু নিভু আঁচে রোটি মেকারে একহাতা করে চালের গুড়ির ব্যাটার দিয়ে দোসার মত রুটি বানাচ্ছে। রোল করে তার ছেলের হাতে দিল। পাঁপড়ের মত কুড়কুড়ে সেই কাম্বোডিয়ান সরুচাকলি পেয়ে ছেলের মুখে সে কী হাসি!
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।