Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

দুর্জয়বাবুর দুঃসময় (গল্প)

পিনাকী ভট্টাচার্য

জুন ৩, ২০২০

Illustration by Upal Sengupta
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

দুর্জয়বাবু সুখী মানুষ। একটি ফ্ল্যাট, একটি গাড়ি, একটি স্ত্রী, একটি কন্যা এবং বহু গার্লফ্রেন্ড নিয়ে তাঁর পরিপূর্ণ সংসার।

না, না। দুর্জয়বাবুকে লম্পট ভাবা এক্কেবারেই ঠিক হবে না। কারণ, শেষোক্ত সম্পত্তিটির ক্ষেত্রে মানুষগুলি রিয়েল হলেও সম্পর্কগুলি সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল। সমস্ত সম্পর্কই মুঠো-ফোন কেন্দ্রিক। ফলে যোগাযোগের সেতুটা, যাকে বলে, হাতের মুঠোয়।

ব্যাপারটা এবার একটু খোলসা করা যাক। এই পৃথিবীতে প্রায় অর্ধ-শতাব্দী কাটানোর পর দুর্জয়বাবুর উপলব্ধি হয়েছে,

১। একটা বয়েসের পর প্রায় সব্বাই চাওয়া-পাওয়ার ট্রায়াল ব্যাল্যান্স মেলাতে গিয়ে দেখেন, তাঁদের চোখে ডেবিট বেশি, ক্রেডিট কম।

২। ব্যাক্‌লগ ক্লিয়ার করার দুঃসাহস যাঁরা দেখান, সেই বীরপুরুষরা সামাজিকভাবে ঘৃণ্য এবং মানসিকভাবে পূজনীয় হন।

৩। এই পুরুষ-শাসিত সমাজে কেউ নারীজাতির যন্ত্রণা এবং শূন্যতার কথা ভাবেন না। বিশেষ করে ডিভোর্সি ও বিধবাদের কথা।

দুর্জয়বাবু নৈতিক কারণে এবং কিছুটা পুণ্যার্জনের নিমিত্ত আর অনেকটা শূন্যতা কাটাতে নিঃসঙ্গ মহিলাদের সঙ্গদানের দায়িত্ব আক্ষরিক-অর্থে হাতে তুলে নিয়েছেন।

মুঠোফোনের মাধ্যমে।

শুরুটা হয়েছিলো আচমকাই। সকলেই জানেন, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এখন বন্ধুর কোনও অভাব নেই। পরিচিত কাউকে কোনও ভালো কিছু পোস্ট করতে দেখলেই দুর্জয়বাবু সরল মনে তার তারিফ করতেন। অনেক সময় দু’এক লাইন কমেন্টও লিখে ফেলতেন। একসময় খেয়াল করলেন, যার পোস্ট তারিফ করেছেন সে একটা “লাইক” দিয়েই ছেড়ে দিলেও তার মন্তব্যের পিঠে বেশ কিছু অচেনা মানুষের প্রশংসা আসে। প্রশংসার পিঠে প্রশংসা আর তার পিঠে ধন্যবাদ- এই করতে করতে বিভিন্ন সেতু তৈরি হতে শুরু করল! আর সেই সেতুতে তাঁর বিপরীতে অবধারিত ভাবে কোনও একাকীত্বে ভোগা মধ্যবয়স্কা!

দুর্জয়বাবু চিরকালই ভালো শ্রোতা আর খুব অবাক হতে পারেন। আর তার সঙ্গে আছে বিস্তর বই-পড়া অভিজ্ঞতা। তাই তাঁর সঙ্গিনীর সংখ্যা ফুলে-ফেঁপে উঠতে বেশি দিন লাগল না। আর এই বন্ধুত্বে সুবিধে অনেক! পাপবোধ কামড়ায় না, কারণ অ্যাকচুয়াল কিছু নেই। পুরোটাই ভার্চুয়াল। অফিসের কাজের মধ্যে বা পথে যেতে যেতেও কথা থেকে আদর সবই অনায়াসে চালিয়ে যাওয়া যায়। কোনও সমস্যা হয় না। অফিসের সময় থেকে সন্ধে পর্যন্ত তাঁর সঙ্গদানের সময়। সন্ধের পর থেকে তিনি ও তাঁর বান্ধবীরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজ নিজ সংসারধর্মে। বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো।

কিন্তু সাধে কী বলে, সুদিন চিরকাল থাকে না? ধেয়ে এল করোনা। আর তার ল্যাজ ধরে লক্‌ডাউন।

দুর্জয়বাবুর দুর্নাম, তিনি বেশিদিন বিপদ থেকে বেঁচে থাকতে পারেন না। তাই ডেকে ডেকে আনেন। কিংবা বলা যায়, বিপদেরা দুর্জয়বাবুকে খুব ভালোবাসে বলে তারা ফিরে ফিরে আসে। কোনটা আদত ঘটনা, এটা বলা শক্ত। কিন্তু এর ভুরি ভুরি উদাহরণ শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর জীবনে ছড়িয়ে রয়েছে।

ইস্কুলে পড়ার সময় একবার দেশের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দুর্জয় দেখেন, বাড়ির কাছেই সার্কাসের তাঁবু পড়েছে। বাঘ-সিংহ ছাড়া সে সার্কাসে একটা ছাগলও ছিল। খেলা দেখাত। বাঘ-সিংহ খাঁচায় রাখা আর ছাগল খোলা জায়গায় রাখার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না। অস্বাভাবিক ছিল, দুর্জয়বাবুর অযাচিত কৌতূহল। সেই ছাগলের পাকানো সিং নিয়ে ঘোর কৌতূহলি হয়ে এক দুপুরে দুর্জয় ছাগলের শিং ধরে দিলেন টান। কিশোর দুর্জয়ের সমান লম্বা ছাগল সেই অপমান মেনে না-নিয়ে প্রথমে একটি ও পরে একাধিক ঢুঁ মেরে প্রত্যাঘাত করে তাঁকে ধরাশায়ী করে। তারপর তাঁকে ক্রমাগত পাকানো শিং দিয়ে গোঁত্তা মারতে থাকে। ভাগ্যিস সঙ্গে এক বন্ধু ছিল, তাই সে যাত্রা দুর্জয় উদ্ধার পান। কিন্তু এই ঘটনার পর দেশের বাড়িতে দুর্জয়ের থাকা একরকম অসম্ভব হয়ে উঠল। কারণ, সেই পরোপকারী বন্ধুর দৌলতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল সেই গঞ্জ-শহরের মাঠে-ঘাটে-রাস্তায়-ঘরে-ঘরে। এলাকার বহু বাসিন্দা হাসি ও টিটকিরি সহযোগে দুর্জয় নামক ‘আজব চিড়িয়া’কে দেখতে আসতে শুরু করলেন। ফলে অচিরেই দুর্জয় দেশের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় ফেরত আসতে বাধ্য হলেন।

দুর্জয়বাবু যখন বিশের কাছাকাছি, ওঁর মাঝেমধ্যেই কবিতা পেত। কোনও কবিতা ভালো লাগলে তিনি সেটা উচ্চকণ্ঠে আবৃত্তিও করতেন। ওঁর প্রজন্মের প্রায় সবাইই অবশ্য তখন একই দোষে দুষ্ট। দুর্জয়বাবুর বাবাও যথারীতি বাকি বাবাদের মতো এই কাব্য-প্রীতিকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখতেন। এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না। অস্বাভাবিক ছিল, তরুণ দুর্জয়ের হঠাৎ করে উদাত্ত স্বরে আবৃত্তি করে ওঠা, সদ্য পড়া কবিতা–
“কেন জন্ম দিলে?
কেন জন্ম দিলে?
কেন জন্ম দিলে?
কেন মধ্যরাতে প্রস্রাবের সাথে
বার করে দিলে না!”

ফলস্বরূপ দুর্জয়ের বাবা ওঁর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। আর দিন দুই বাদে কলেজ থেকে ফিরে দুর্জয় দেখেন, তাঁর কবিতার বইগুলো কাগজওয়ালার কাছে বিক্কিরি করে দেওয়া হয়েছে।

এরপর খেলার মাঠে পুলিসের ঘোড়ার লাথি খাওয়া, সিনেমা দেখতে গিয়ে গোলমাল দেখে পুলিশ আর ব্ল্যাকারদের মধ্যস্থতা করতে গিয়ে পুলিশি প্রহার এবং সংক্ষিপ্ত হাজতবাস, শখে রান্না করতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে লঙ্কাবাটা মাখা হাত দেহের এদিক-ওদিক লাগিয়ে ফেলে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে লাগাতার বরফ ঘষা, নতুন বউ নিয়ে বেড়াতে গিয়ে টিকিটের তারিখে গোলমাল-জাতীয় একের পর এক ঝড় সামলিয়ে অবশেষে মধ্যবয়সে এসে একটু থিতু হয়েছিলেন দুর্জয়বাবু। কিন্তু এই লক্‌ডাউন তাঁকে নতুন করে বিপদে ফেলল!

এতদিনের ‘ফোনাসঙ্গের’ অভ্যেস থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। তাছাড়া দুর্জয়বাবুর একটা নৈতিক দায়িত্বও তো আছে একাকিনী নারীদের প্রতি! তার সঙ্গে যোগ হয়েছে একটা চোরা-ভয়! এতদিনের সযত্নলালিত সম্পর্কসমূহ অব্যবহারের ফলে না মরচে ধরে ভেঙে যায়! ফোনের অন্য প্রান্তেও সমস্যা একই। ফাঁক বুঝে যখন সে দিক থেকে বার্তা আসে, ঠিক সময়ে উত্তর না-দিতে পারলে সেই ফাঁক ভরাট হতে কতক্ষণ! এই কুরুক্ষেত্রে কি প্রতিযোগিতা কম! এই বয়েসে এসে চ্যাংড়া ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে জিত তো প্রায় অসম্ভব! ফলে উপায় এক ও অদ্বিতীয়। যেমন করেই হোক যোগাযোগ রাখা।

লক্‌ডাউনের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরনোর উপায় বা ছুতো কোনওটাই নেই। অতএব দুর্জয়বাবু সবসময় বাড়িতে ফোন হাতে। যখন-তখন মেসেজ করছেন। এই হাসছেন। এই গম্ভীর হচ্ছেন। গিন্নি অপ্সরাদেবী গোড়ায় অবাক হলেন। ক্রমে বিরক্ত। আর শেষমেশ সন্দেহ করতে শুরু করলেন। দুর্জয়বাবু মেসেজে নিমগ্ন থাকাকালীন কারণে অকারণে অপ্সরাদেবী কাছে এসে কোল ঘেঁসে বসা শুরু করলেন, যা গত বিশ বছরে তাঁকে করতে দেখা যায়নি!

এই সবের ফাঁকে একদিন বিকেলে হঠাৎ দুর্জয়বাবু দেখেন, তাঁর সিগারেটের স্টক শেষ। রাত্তিরটা কোনওমতে কাটলেও পরের দিন সকালে বাথরুমে ঢোকার মতো সিগারেট পর্যন্ত নেই। সঙ্গিনীরা তো আর দুর্জয়বাবুর জন্য সক্কাল সক্কাল সিগারেট কতটা আবশ্যিক, সে কথা জানেন না! কারণ প্রেমালাপে কোষ্ঠকাঠিন্যের কোনও স্থান নেই। কাজেই দুর্জয়বাবু সব্বাইকে “অফিসের কনকলে থাকব” বার্তা পাঠিয়ে সিগারেট জোগাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে পাড়ার সিগারেটের দোকানি গোপালকে ধরতেও পারলেন। কিন্তু গোপাল বলল “জলদি জলদি আমার বাড়ি আসুন। দেরি করলে কিন্তু স্টক শেষ হয়ে যাবে। তখন আর কিছু কত্তে পারব না দাদা।” দুর্জয়বাবু দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়লেন পাড়ার মোড়ে গোপালের বাড়ি।

অচিরেই সিগারেট জোগাড় হল। আহহহ। পকেটে প্যাকেট পুরে ভাবলেন, বাড়ির কাছাকাছি এসে শান্তিতে নিরিবিলিতে গোটা দুই ফোন করে বাড়ি ঢুকবেন। বাড়ি থেকে ফোন করা মানে তো এক্কেবারে চোর-পুলিশ খেলা! এই বয়েসে বিপদ ডেকে আনতে আর ভালো লাগে? নিজের বাড়ির জাস্ট দু’একটা বাড়ি আগে আয়েস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বুকপকেট থেকে ফোনটা বার করতে গিয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠল। পকেট খালি কেন? ফোনটা কোথায় গেল? গোপালের বাড়ি ফেলে এলেন নাকি? মনে করার চেষ্টা করে সবে ফেরত যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছেন, এমন সময় কানে এল বিপদঘণ্টি! সাইরেন! নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে মেয়ে গিনির চিৎকার- “বাবাআআআআআ কোথায় তুমি!”

ডাকটা কানে আসতেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা বরফের হিমস্রোত বইতে শুরু করল। কারণ আর কিছুই নয়, পনেরো সেকেন্ড অন্তর ফোনের স্ক্রিনলক্‌ হয়ে যাওয়া আর প্রত্যেকবার নম্বর টিপে লক্‌ খোলাতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আজ দুপুরেই দুর্জয়বাবু সিকিউরিটি সেটিং বদলে লক্‌টাইমটা পাঁচ মিনিট করে দিয়েছেন। এবং, অবধারিত ভাবে গোপালের বাড়ি যাওয়ার সময় মাথায় সিগারেট ছাড়া আর কিছুই না থাকায়, ফোন বিছানার ওপর ফেলে রেখে চলে এসেছেন।

ব্যাস। গিনির চিৎকারের নেপথ্যকাহিনি লকডাউনের দূষণহীন যমুনার জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। দুর্জয়বাবুর কাছে ফ্ল্যাটের সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ মহাপ্রস্থানের হিমালয়ে পরিণত হল নিমেষে। দেহলতাটি টানতে টানতে কোনওক্রমে বাড়ির দরজায় পৌঁছে বেল বাজালেন। দরজার ওপারে গিনি। ঘরে ঢুকেই দুর্জয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “তোর মা কোথায়?”

–মা বারান্দায়। শীগগির যাও! গিনির গলায় ভয়-উদ্বেগ-উত্তজনার ককটেল।

ব্যাস। সব শেষ। স্খলিত পায়ে প্রায় টলতে টলতে দুর্জয়বাবু বারান্দায় গিয়ে পৌঁছলেন। সবে সন্ধে হয়েছে। বারান্দার আলো জ্বালানো হয়নি তখনও। সেখানে অপ্সরাদেবী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। ছলছল চোখে। দুর্জয়বাবু একটু তফাতে দাঁড়িয়ে অখণ্ড মনোযোগে স্ত্রীর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল জরিপে সবে মন দিতে যাবেন, কানে এল ভিজে ভিজে কণ্ঠস্বর।

–ওগো… পড়ে গেছে যে!

দুর্জয়বাবু হকচকিয়ে গিয়ে মাথা তুলে দেখলেন অপ্সরাদেবী আঙুল দিয়ে নিচের দিকে দেখাচ্ছেন। দুর্জয়বাবু রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে দেখলেন সেই অমোঘ দৃশ্য! নিচের ফ্ল্যাটের সানশেডে তাঁর ফোন গড়াগড়ি খাচ্ছে। দুর্জয়বাবু কী প্রতিক্রিয়া দেবেন খানিকক্ষণ ভেবেই পেলেন না। তারপর মাথা ঠান্ডা করে বললেন, “আমি নিচে যাচ্ছি। আমি হাঁক দিলে তুমি লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে ওটা নিচে ফেলে দাও। আমি ঠিক লুফে নেব।”

বোধিবৃক্ষের নিচে সমাহিত গৌতম বুদ্ধের মতো স্বামীর এই দুঃখেষনুদ্বিগ্নমনা সুখেষুবিগতস্পৃহ রূপ দেখে অপ্সরাদেবী হাঁ হয়ে গেলেন। হাঁ করেই দেখলেন দুর্জয়বাবু ধীরেসুস্থে টি-শার্ট ছেড়ে পাঞ্জাবি গলাচ্ছেন। তিনি একবার মিনমিন করে বললেন, “গিনিকে পাঠাই?” শুনেই আঁতকে উঠলেন দুর্জয়বাবু। “পাগল নাকি! খবরদার না। ও এসব পারে? বরং ওকে বলো ফোনটাকে খুঁচিয়ে নিচে ফেলতে!” তারপর গজেন্দ্রগমনে একতলায় গিয়ে ওই সান্‌শেডের তলায় মাপজোক করে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির দুটো খুঁট পেটের সামনে বাগিয়ে ধরে কোঁচড় তৈরি করে হাঁক দিলেন “এবার ফ্যালো!” গিনির হাতে তখন ঝুলঝাড়ু। তার লম্বা ডান্ডার এক খোঁচায় টপ্‌ করে সানশেড থেকে সাধের মোবাইল ফোনটি নিমেষের মধ্যে দুর্জয়বাবু নিরাপদ কোঁচড়ে এসে প্রবিষ্ট হল।

পরবর্তী দৃশ্যে আবার বারান্দা। আবার দুর্জয়বাবু আর অপ্সরাদেবী। এবার নরম গলায় দুর্জয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ফোনটা বারান্দায় এলই বা কী করে আর পড়লই বা কী করে?”

বাজখাঁই নয়। অভিমানসিক্ত গলায় উত্তর এল।

-সারাদিন হাঁড়ির মতো মুখ করে বসে থাকো। শুধু হাসি ফোটে হাতে ফোন থাকলে। তুমি ফোনটা ফেলে গেছ দেখে ভাবলাম, একবার দেখি কারা তোমার মুখে হাসি ফোটায়। আমি তো আর আজকাল পারি না!

-ওহ্‌ এই কথা! তা বারান্দায় কেন এলে?

-কী বুদ্ধি! মেয়ের সামনে বসে বাপের ফোন দেখব? তোমার কি কোনওদিন আক্কেল হবে না গো? মেয়ে বুঝতে পারলে তোমার সম্মানটা কোথায় থাকত?”

-অ। তা কী দেখলে?

-দেখতে আর পেলাম কই? বা হাঁতে ফোন ধরে ডান হাতে আঁচলটা টেনে ঘাম মুছতে যাব… আর টপ করে হাত ফস্কে পড়ে গেল! তাও ভাগ্যিস সানশেডে পড়েছে! নিচে পড়লে…”

দুর্জয়বাবু এবার হাসিমুখে গিন্নির দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলেন। “এই নাও। মনের সুখে দেখ।”

বলে জোর করে অপ্সরাদেবীর হাতে ফোনটা গুঁজে দিলেন। কোঁচড়ে ফোন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময়ে তিনি সযত্নে স্বহস্তে সমস্ত চ্যাট-হিস্ট্রি আর কল-হিস্ট্রি ডিলিট করে দিয়েছেন। কাজে কাজেই এবার স্ক্রিনলক্‌ খুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন “তুমি ছাড়া আমার আর কে-ই বা আছে! আমায় এতটুকুও বিশ্বাস করতে পারলে না গো!”

-ফোন সবসময় সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াও আর মেসেজ করো দেখেই তো দেখতে গিয়েছিলাম! আমার ভুল, বলো? গিন্নির গলা এবার কাঁদো কাঁদো।

-আরে না না! তোমার ভুল নয়! আসলে জানোই তো আমার ইস্কুলের কলেজের বন্ধুদের! কী সব ছবি আর জোক্‌স পাঠায় ভাবতে পারবে না! গিনি যাতে না দেখে ফেলে, তাই… এই দেখো না!” বলে বন্ধুদের কাছ থেকে আসা ‘আমিষ’ ছবি আর চুটকির নমুনা মেলে ধরলেন গিন্নির সামনে। পড়ালেন। তারপর গলায় মাপ মতো আদর আর প্রশ্রয় মিশিয়ে বললেন, “আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। এবার থেকে আর ফোন লক্‌ করে রাখব না! তাহলে খুশি?”

এ বার মুখে আঁচল চেপে শিউরে উঠলেন অপ্সরা!

-রক্ষে করো! এমনিতেই গিনিদের কলেজের মেয়েগুলোর গুণের ঘাট নেই! তার ওপর এই সব মেসেজ আর ছবি! না না না না বাবা, তুমি তোমার ওই ফোন তোমার কাছেই রাখবে আর লক্‌ করেই রাখবে!

দুর্জয়বাবুর চাপা হাসির আওয়াজটা পাশের বাড়ি থেকে উড়ে আসা শাঁখের আওয়াজ আর উলুধ্বনিতে চাপা পড়ে গেল।

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।

Picture of পিনাকী ভট্টাচার্য

পিনাকী ভট্টাচার্য

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।
Picture of পিনাকী ভট্টাচার্য

পিনাকী ভট্টাচার্য

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।

22 Responses

  1. আবারও এক পাওয়া। অলঙ্করণও অসাধারণ। কদিন ধরেই ভাবছিলাম যে, নতুন কিছু পাচ্ছি না কেন । বেশ ভালো লাগল পড়ে ।

  2. ভারি অন্যায় কিন্তু.. লেখার গুণে অমন মিষ্টি বৌ কে ধোঁকা আর অপরাধ বোধ দু’টো ই দিলেন ????
    Hahaha খুব enjoy করলাম.. দারুণ ????

  3. দুর্দান্ত লিখেছ Iএক্কেবারে অমোঘ বাণী I সত্যি বাবা ধন্য দাম্পত্য আজকের I মুখ পুস্তিকায় জড়াজড়ি I বছরে ৬ বার করে বেড়াতে যাওয়া I তার পর এক ঘরে থাকতে ঘোর সন্দেহ আর অশান্তি I মোক্ষম ধরেছ I midlife থুড়ি whole life ক্রাইসিস I কলম চলতে থাকুক I ভালো থেকো I

  4. Lol.. Bangali modhyobitter sokh ache sadhyi nei er chiraton golpo. Very smoothly depicted. I love the easy flow of humor. Speaks of a dissociating evolution from a lot of other writers with constipatory efforts. Hope you will transform Durjoybabu into a man of action, from a keyboard warrior in the next episode. Well done.

  5. এটা আত্মজীবনী মূলক নয়তো? হলে কিন্তু এই পরস্ত্রীকাতরতা খুব ই ঝামেলা সূচক। Jokes apart. খুব ভালো হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com