জীবনের প্রথম চোদ্দো বছর কলকাতার পুজো দেখিইনি। পঞ্চমীর রাতে তল্পিতল্পা বেঁধে মা-বাবার সঙ্গে হাওড়া স্টেশন থেকে উঠতাম মিথিলা এক্সপ্রেসে। গন্তব্য মতিহারি।
জর্জ অরওয়েলের জন্মভিটে। আমারও।
বাবা-কাকারা বলতেন, ‘পুজো হো তো মতিহারি য্যায়সা।’
‘জয় জয়ন্তী’ ছবিতে পঞ্চপাণ্ডবের সেই গান মনে আছে তো?
‘ঝিকঝিক ঝিকঝিক চলছে রেলের গাড়ি
অনেক দূরের পাড়ি।
দিল্লি, বম্বে, ম্যাড্রাস ঘুরে
যাবে মতিহারি।’
১৯৭১ সালে ‘দ্য সাউন্ড অফ মিউজিক’-এর রিমেক এই ছবির গানে ‘মতিহারি’র উল্লেখে গর্ব হয়েছিল খুব। এটি উত্তর বিহারের পূর্ব চম্পারণ জেলার প্রধান শহর। এই জেলায় সত্যাগ্রহ করেই গান্ধীজির ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবেশ।
[the_ad id=”266918″]
‘জয় জয়ন্তী’র ট্রেন ছিল মিউজিক এক্সপ্রেস। তার ঐ রুট ধরে যেতে বাধা ছিল না। কিন্তু মিথিলা এক্সপ্রেস আমাদের নামিয়ে দিত মতিহারির অনেক আগেই। মজফ্ফরপুর থেকে মিটার গেজের ট্রেনে আরও আশি কিলোমিটার পেরিয়ে তবে আসত বাড়ি। স্টিম ইঞ্জিনের ধোঁয়ার কয়লার গুঁড়োয় চোখ জ্বালা করত। বার বার ভাপ দিয়ে মা সারিয়ে তুলতেন। বেশির ভাগ সময়ই আসা-যাওয়া হত সেকেন্ড ক্লাসে। ফার্স্ট ক্লাস কালেভদ্রে। সময়টা মধ্য-সত্তর। আটের দশকে, নেপালের অন্যতম প্রবেশদ্বার, রক্সৌল পর্যন্ত রেললাইন ব্রড গেজ হওয়ার পর এক ট্রেনে সরাসরি বাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য হল। মতিহারির অবস্থান ছিল মজফ্ফরপুর আর রক্সৌলের মাঝামাঝি। কলকাতা থেকে সাতশো কিলোমিটার পথ আসতে এখনও লাগে সেই ১৬ ঘণ্টাই।

ষষ্ঠীর দিন পৌঁছে গুরুজনদের ধপাধপ প্রণাম করে রাঙাকাকার সঙ্গে চলে যেতাম বাড়ির কাছেই বেঙ্গলি ইনস্টিটিউটের পুজোমণ্ডপে। তখন মাতৃমূর্তির সামনে বসে ‘আর্টিস্ট দাদু’ প্রবোধ কর্মকার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে কালোদাদু, লম্বোদর দাদু, চুনিদাদু, কেশবদাদু – পুজোর সব মাথারা। পরিচয়দানের পর আবার এক দফা প্রণাম। ‘ও, তুমি অশোকের ছেলে। এত বড় হয়ে গেছ? কোন স্কুল? কোন ক্লাস?’
[the_ad id=”266919″]
আমাদের বাড়ি গানের বাড়ি। সপ্তমীর সকালে মণ্ডপে অঞ্জলি দিয়ে আসার পর বৈঠকখানায় চলত গানের মহড়া। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেজকাকা ছোটপিসিকে তুলে দিলেন ‘মুসাফির মোছ রে আঁখিজল’ আর ‘মধুবনে বাঁশি বাজে।’ পরের শিল্পী ফুলকাকা ঝালিয়ে নিলেন ‘অভিমানে চলে যেও না’ আর ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে।’ তারই ফাঁকে ছোড়দাদু শোনালেন শচীনকত্তার মনকাড়া গান ‘প্রিয় আজও নয়, আজও নয়।’ অবাক হয়ে দেখতাম হারমোনিয়ামের রিডে তাঁর বিলি কাটা। এইচএমভি’র ‘শারদ অর্ঘ্য’ হাতে নিয়ে ছোটকাকা গাইতেন অনুপ ঘোষালের পুজোর গান। তবলা সঙ্গতে সেজকাকা ছিলেন অক্লান্ত। শুধু বাড়ির শিল্পীই নয়, সন্ধ্যার বিচিত্রানুষ্ঠানে অন্যান্য স্থানীয় শিল্পীদেরও প্রথম পছন্দ হতেন আমার সেজকাকাই। বাবা-মেজকাকা এক সময় শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের চর্চা করলেও, থাকতেন শ্রোতা-সমালোচকের ভূমিকায়।

ছেলেবেলায় মতিহারির মঞ্চে আমি অবশ্য আবৃত্তিই করেছি বেশি। কখনও ‘দুষ্টু’, কখনও ‘ছোট বড়’। শিখিয়ে দিতেন মা। যদি ভুলে যাই, তাই মাকে বলতাম, ‘বই নিয়ে উইংসে দাঁড়িয়ে থাক।’ মা নিজেও খুব ভালো আবৃত্তি করতেন। চক্রবেড়িয়ার কন্যা, মতিহারির বধূ, আমার অধ্যাপিকা-মায়ের প্রিয় কবিতা ছিল ‘বাঁশিওয়ালা’, ‘সাধারণ মেয়ে’ আর ‘দেবতার গ্রাস।’ প্রতি বার যা শুনে দাদুরা ধন্যি ধন্যি করতেন। একবার তো পুজোর মধ্যেই কালোদাদুর ছেলে, এলাকার নামী আয়ুর্বেদ ডাক্তার, গোপালকাকু মোনো রেকর্ড প্লেয়ার আর একটি ইপি রেকর্ড নিয়ে আমাদের বাড়ি হাজির। খুব ইচ্ছে মায়ের সঙ্গে ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ করার। ইপি রেকর্ডে আকাশবাণীর বিশিষ্ট ঘোষক দিলীপ ঘোষ এবং অপর্ণা সেনের পরিবেশনা শোনাও হল। কিন্তু হাতে সময় কম, তাই মা রাজি হলেন না। নিরাশ না হয়ে কাকু বললেন, ‘ঠিক আছে, আসছে বছর হবে না হয়। এখন ওঠ দেখি। প্রণাম করব।’ ওজন একশো কেজির উপর। লম্বায় ছ’ফুটের বেশি। কী করে নিচু হয়ে গোপালকাকু প্রণাম করবেন তাঁর পাঁচ ফুটের বৌদিকে? আনা হল কাঠের চেয়ার। তার উপর উঠে দাঁড়ালেন মা। শেষ হল প্রণাম পর্ব।

আমাদের বাড়ির রেওয়াজ ছিল অষ্টমীর অঞ্জলি হবে ধুতি-পাঞ্জাবিতে। সে দিন সকালে জ্যেঠতুতো-খুড়তুতো ভাইরা লাইন দিয়ে দাঁড়াত আর বিদ্যুৎগতিতে তাদের এক এক করে ধুতি পরিয়ে দিতেন সেজকাকা। কোঁচা সামলানোর কায়দাও তাঁরই কাছে শেখা। কাকাদের পরনে থাকত গিলে করা পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি।
[the_ad id=”270084″]
বেঙ্গলি ইনস্টিটিউটের ভবানী মণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়ার অভিজ্ঞতা কোনওদিন ভোলার নয়। পুরোহিত শ্যামাপদ ভট্টাচার্য, আমাদের শ্যামাজ্যেঠুর সংস্কৃত উচ্চারণ ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরেই। পুজোর পাঁচদিন বেঙ্গলি ইনস্টিটিউটের অন্তর্গত একশোরও বেশি বাঙালি পরিবারের মা-মাসি-বোন-দিদারা সবাই ভক্তিভরে দেবীর আরাধনা করতেন। একদিকে চলত মালা-গাঁথা, অন্য দিকে ফল কোটা। সার সার মাটির খুরিতে সাজিয়ে দেওয়া হত ফল-মিষ্টি প্রসাদ। নিমেষে শেষ হয়ে যেত। আবার আসত। ঠিক যেন মোটরগাড়ির অ্যাসেম্বলি লাইন। সব থেকে ভালো লাগত বাতাবি লেবু আর ভেজা মুগ কড়াইয়ের গন্ধটা। নবমীতে পাত পেড়ে ভোগও খেয়েছি কয়েক বার। প্রতি বছরই মণ্ডপের বাইরে অস্থায়ী হোটেল খুলত ছোটকাকার বন্ধুরা। পাওয়া যেত মাংসের ঘুগনি, ওমলেট, মাটন কিমার চপ। গন্ধেই জিভে জল আসত। শুধু আমার নয়, ছোট ভাই-বোনেদেরও। মা-বাবা-কাকাদের কাছ থেকে পাওয়া পার্বণী বেরিয়ে যেত তাতেই। আর ছিল পাচক। ওই টক-নোনতা কালো গুঁড়োর কাছে কোথায় লাগে আজকের করোড়পতি গোলি বা ফটাফট!

মতিহারির পুজোর একটা বড় আকর্ষণ ছিল নাটক। সাতের দশকে তাতে ছোটখাটো বিপ্লব আনেন সজল সেনগুপ্ত। আদতে পাটনাবাসী, বিমা কোম্পানির চাকুরে, সজলকাকু স্কুল-কলেজের ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তুললেন নাটকের দল। পর পর অভিনীত হল ‘মুকুট’, ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’, ‘উত্তাল তরঙ্গ’র মতো নাটক। নটদের বোঝাপড়া এত ভালো ছিল যে প্রম্পটারের কোনও কাজই থাকত না। অন্য দিকে, নাটকের প্রয়োজনে কাকুরা মঞ্চে সিগারেট ধরালেও কালোদাদু-চুনিদাদুরা কিছু বলতেও পারতেন না। তবে মতিহারির বাঙালি সমাজ রক্ষণশীল হওয়ায় সব নাটকই ছিল ‘নারীচরিত্র বর্জিত।’ মেয়েরা থাকত নাচ, গান আর আবৃত্তিতেই।
[the_ad id=”270085″]
দশমীর সকালে পুজোমণ্ডপে আরশিতে মায়ের মুখ দেখা, হোমের টিপ পরা আর হাতে অপরাজিতার ডোর বাঁধা ছিল অবশ্য কর্তব্য। বাড়ি ফেরার পথে সবার পথ আগলে দাঁড়াত রাজা আর তার বন্ধুরা। ‘দাদা, কাকু, পটকা সমিতির চাঁদা দাও।’ বিসর্জনের শোভাযাত্রায় বাজি ফাটানোর নেতৃত্বে থাকত সে-ই। সেদিন দুপুরে ঘুম আর হত না। সাড়ে তিনটেতেই বেজে উঠত ঢাক আর কাঁসর বাদ্যি। তিনখানা ট্রাক নিয়ে শুরু হত শোভাযাত্রা। মাঝে মধ্যেই রব উঠত ‘জয় হো’। মোতিঝিলে বিসর্জন সেরে, মণ্ডপে শান্তিজল নিয়ে বাড়ি ফেরা হত। ততক্ষণে সেখানে শুরু হয়েছে বিজয়ার অতিথি আপ্যায়ন। বাঙালি-অবাঙালি, সবাই আসতেন।

কাকিমারা বাড়িতেই বানিয়েছেন ঘুগনি, কুচো নিমকি আর বোঁদে। একাধিক দোকান থেকে কিনে আনা হয়েছে চার রকমের মিষ্টি। তবে মূল আকর্ষণ ছিল বাড়িতে তৈরি সিদ্ধির সরবত। তার স্বর্গীয় স্বাদ আজকের ঠান্ডাইকে অনায়াসে হার মানাবে। কাজু, কিশমিশ, বাদাম সহযোগে এই শিল্পকর্মটির মূল হোতা আমার মেজকাকা আর সেজকাকা। ডাইনিং রুমে রাখা বড় দু’খানা কাচের জগ থেকে গেলাসে একটু একটু করে ঢেলে স্বাদ পরীক্ষা করে বলতাম ‘বাঃ! তোফা।’ দেখে হাসতেন রাঙাকাকা। বিজয়া সম্মিলনী চলত রাত এগারোটা পর্যন্ত। অতিথির সংখ্যা হত একশোর কাছাকাছি। পরের দু’দিন সেনবাড়ির সদস্যরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সাইকেল রিক্সায় চেপে বেরিয়ে পড়তেন বিজয়া করতে। প্রত্যেকের লক্ষ্য থাকত সকাল দশটা থেকে দুপুর একটার মধ্যে অন্তত ছ’টা বাড়ি শেষ করা। রায়বাড়ি, মুখুজ্যেবাড়ি, মিত্রবাড়ি আবার কোনও দলই বাদ দিত না।
বাড়িতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পাট চুকিয়ে পরের দিন ফেরার ট্রেন ধরতে হত। বাড়ি থেকে কাকারা খবর নিতেন, ডাউন মিথিলা কত লেট? প্রতি বারই বুকে জমাট বাঁধত কান্না। মাথার উপর থেকে কাকা-কাকিমাদের হাত নামতেই চাইত না। ট্রেন ছাড়ার পর তাকিয়ে থাকতাম যতক্ষণ স্টেশনের মতিহারি নামটা মিলিয়ে না যায়।

গান্ধীজির স্মরণে মতিহারি স্টেশনের সঙ্গে এখন জুড়েছে বাপুধাম নামটি। বেঙ্গলি ইনস্টিটিউটের পুজো একশো বছর পার করেছে ২০১১-তে। তার স্মরণিকা বা সুভেনিরে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল এবং তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও। পুজোয় শেষ গিয়েছি দশ বছর আগে। বাঙালির সেই প্রভাব-প্রতিপত্তি সেখানে আজ অনেক কম। পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাঙালি পরিবারের সংখ্যা এখন কমতে কমতে চল্লিশে ঠেকেছে। স্বাভাবিক নিয়মেই বিদায় নিয়েছেন কালোদাদু-চুনিদাদুরা। গোপালকাকুর ভাই, পুজোর বড় পৃষ্ঠপোষক এবং পেশায় অ্যালোপ্যাথ নেপালকাকুও আর নেই। অকালে চলে গিয়েছে রাজাও। পুজোমণ্ডপে দর্শকদের বেশির ভাগই হিন্দিভাষী হওয়ায় এখনকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলা-হিন্দি মিলেমিশে থাকে। নাটকের চল উঠেই গিয়েছে। তার জায়গা নিয়েছে ফ্যাশন শো আর র্যাম্প ওয়াক।
[the_ad id=”270086″]
একটু আগে জানলাম করোনা মহামারি আর নির্বাচনি আচরণবিধির ডবল গেরোয় পড়ে বিহারে এ বছর বারোয়ারি দুর্গাপুজো বন্ধ। বেঙ্গলি ইনস্টিটিউটেও এ বার শুধু ঘটপুজো। অসমাপ্ত প্রতিমা পড়ে থাকবে দেয়ালের এক কোণে। উদ্যোক্তাদের পক্ষে নভোনীল চক্রবর্তী জানালেন, ‘এ বার অঞ্জলি নেই, ভোগ বিতরণ নেই, বিসর্জনও নেই।’
এই ভাবেই গোটা বিহার এক সূত্রে বাঁধা পড়ল লন্ডন, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে।
সেখানেও যে এ বার পুজো বন্ধ।
দু’দশক ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্তার টেবিলে কাটিয়ে কলমচির শখ হল বাংলায় লেখালেখি করার। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। লেখার বাইরে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতটাও নেহাত মন্দ গান না।