২০০৬-এর কথা। কলকাতায় ছুটি কাটাতে গেছি অনেকদিন বাদে। একা ট্যাক্সিতে চড়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাচ্ছি| ট্যাক্সিতে চাপিয়ে দিলেন শ্বশুরমশাই, সঙ্গে বেশ লটবহর। উনি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দিলেন কোথা দিয়ে গেলে সুবিধা হবে।আমি জিনিসপত্র নিয়ে গুছিয়ে বসে “বাবা আসছি” বলতে গিয়ে দেখি, পাশে জানলায় উনি নেই!…আরে এই তো ছিলেন, কোথায় গেলেন? দেখতে গিয়ে পিছন ফিরে দেখি ট্যাক্সির পিছনের দিকে তাকিয়ে নিবিষ্ট মনে কি যেন করছেন। যাক, ট্যাক্সি তো দিল ছেড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ চলার পরই পার্ক সার্কাসের দিক থেকে আসা একটা সুদীর্ঘ লাল আলো জ্বালানো গাড়ির কনভয়…। আমাদের ট্যাক্সি গেল আটকে। কোনো ভিআইপি বা মন্ত্রী-টন্ত্রী যাচ্ছেন বোধহয়।
স্বভাব বকবকানির জেরে নিজের মনেই বলে উঠলাম- “ওরে বাবা এ কখন শেষ হবে…”
“ আরে এ তো সবে মুড়ো দেখছেন দিদিভাই, ল্যাজ কোথায় আছে কে জানে ? এসেছে বোধয় কেউ দিল্লি বা মুম্বই থেকে” ট্যাক্সি ড্রাইভার বলে উঠলেন।
ধীরে ধীরে কথা শুরু, অন্ধকার রাস্তায় টুকটাক জোনাকির জ্বলে ওঠার মতো। জানলার বাইরে সন্ধ্যের ট্রাফিকে সম্পূর্ণ থেমে যাওয়া কলকাতা।
তার পরের জিজ্ঞাসাটা ভেসে এলো একটু আকস্মিক।
“দিদি গাড়িতে তুলে দিয়ে গেলেন কে? বাবা না শ্বশুরমশাই?”
“শ্বশুরমশাই” –একটু অফ গার্ড আমি ।
“হুম দেখলাম আপনি বসার পর হাতের মধ্যে ট্যাক্সির নম্বরটা লিখে নিলেন।”
আমার কথা বন্ধ। আমি কিছু বলার আগেই- “না না একদম ঠিক কাজ করেছেন শ্বশুরমশাই। এটাই তো করা উচিত। যা দিনকাল পড়েছে। বুধবার দেখেননি এয়ারপোর্টের কাছে যা হলো…”
“কী হয়েছে?” ফস করে বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। খবরটা মিস করে গেছি।
“আরে কাজ থেকে ফিরছিলেন ভদ্রমহিলা। জোর করে তিনজন ট্যাক্সিতে উঠে সব কিছু কেড়েকুড়ে নিয়ে গেছে, ট্যাক্সি ড্রাইভারেরও। সে তো হাসপাতালে। কত কিছু যে হচ্ছে দিদিভাই…”
গল্পের ঝাঁপি খুলে গেলো। টুকরো টাকরা কথা গড়াতে গড়াতে রাতটা হয়ে উঠল আরব্য রজনীর শাহাজাদির হাজার বাতির ঝাড়ের আলো ঠিকরানো রোমাঞ্চকর কাহিনির একটা ছোট সংস্করণ। কী নেই তাতে? অন্ধকার জগৎ, রাজনীতির প্যাঁচপয়জার, রিয়েল এস্টেট টাইকুন…হাঁ করে গল্প শুনছি আমি, তার মধ্যেই চেষ্টা করছি কিছুটা মাথায় ধরে রাখার। বাড়িতে গিয়ে বলতে হবে তো!
কখন কথায় কথায় ভিআইপি রোডের থেকে আমাদের পাড়ায় ঢুকে পরেছে ট্যাক্সি, বুঝতে পারিনি।
সেই শুরু। পরের বছর মায়ের শরীর খারাপ। আবার ফিরে আসা। এদিকে বাচ্চারা ছোট, তাই কলকাতা গিয়ে অগুন্তিবার বাবা-মার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি — পেন্ডুলামের মতো দোলাচল শুরু হলো। আর শুরু হলো আমার নিয়ম করে বেশ কিছুটা সময় ট্যাক্সিতে কাটানো। প্রায় প্রত্যেকদিন। ওই অবকাশটাই ছিল আমার নিজের সময় । সেলফোন থাকতো না কাছে। এখন ভেবে দেখি, কী নিশ্চিন্তির জীবন।ওই আসা-যাওয়ার পথে আমার ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সাথে গল্প। নানা বয়সের মানুষ, বেশিরভাগ প্রতিবেশী রাজ্যের বা বাংলার। আর ইস্টার্ন বাইপাসের বিখ্যাত যানজটের কল্যাণে আধঘণ্টার রাস্তা প্রায়ই এক থেকে দেড় ঘণ্টার হয়ে যেত। সেই অন্তহীন ট্রাফিকে বসে শুনতাম, কারওর সারা উত্তর ভারতে ট্রাক চালানোর গল্প, কারওর পলিটিকাল পার্টিগুলোর অদূরদর্শিতা সম্পর্কে প্রচুর ক্ষোভ, কারও কিছুদিন ট্যাক্সি চালিয়ে ভবিষ্যতে নিজস্ব কিছু করার স্বপ্ন।
এই রকমই একদিন ফিরছি, যথারীতি প্রত্যেক মোড়ে ভীষণ জ্যাম। সেদিন নানা কারনে মনটা খুব বিক্ষিপ্ত ছিল…আর রাত্রিও হয়ে যাচ্ছিল। প্রত্যেকটা ক্রসিংয়ে গিয়ে আটকে যাচ্ছে গাড়ি। বাড়িতে দুটো বাচ্চা অপেক্ষা করে আছে। “কী জ্যাম”, “উফ কী গরম” — আমার এসব স্বগতোক্তিতে ড্রাইভার সম্পূর্ণ নির্বিকার। কিচ্ছুক্ষণ বাদে খুব হুড়মুড় করে পাশে এসে যাওয়া বাইক-আরোহীর দিকে ছুড়ে দেওয়া গরম, প্রায় গালাগালির কাছ ঘেঁষা খিঁচুনি শুনে বুঝলাম ওঁর মেজাজের পারা বেশ চড়ার দিকে।
চিংড়িঘাটার মোড়। গাড়িটা থেমে গেছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। দীর্ঘক্ষণ। পাশের থেমে থাকা বাসের একটা জানলায় ঘুমিয়ে পড়া বয়স্ক মানুষটার চশমা প্রায় খুলে আসছে। তার সামনের জানলায় মুখ দেখতে না-পাওয়া মহিলার শাড়ির আঁচলের সবুজ সোনালী ডিজাইন প্রায় মুখস্থ হয়ে এল। দূরের ট্রাফিক লাইটটা অবশেষে সবুজ হলো… । স্লো মোশনে আমাদের ট্যাক্সিটাও নড়তে শুরু করলো। ঠিক সেই সময়ে একটি অল্পবয়সি ছেলে এসে দাঁড়াল আমার জানলার কাছে, ভিক্ষা চাইতে। আমি তড়িঘড়ি ব্যাগ হাতড়ে যা খুচরো পেলাম দিতে গিয়ে দেখি ওই দিকের জানলার কাচটা নামছে না। আমি ব্যস্ত হয়ে ড্রাইভার কে বললাম, “দাদা এটা ওকে একটু দিয়ে দিন প্লিজ।”
উনি হাত বাড়িয়ে খুচরো টাকা পয়সাগুলো নিয়ে ছেলেটির হাতে দিতে দিতে ট্রাফিক সম্পূর্ণ চালু হয়ে গেলো। গাড়ির গতি স্বাভাবিক হযে আসার পর, এতক্ষণ ধরে চুপ করে থাকা ড্রাইভার মশাইয়ের কাছ থেকে বেশ চাঁচাছোলা গলায় একটা মন্তব্য ভেসে এলো।
“কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলছি, ভিক্ষা তো দিলেন। কিন্তু দেখলাম আপনি ভিক্ষা দেবার আর্টটা ঠিক জানেন না।”
“ভিক্ষা দেবার আর্ট?” এতোক্ষনের গুমোট ভেঙে আমার মনে বুজকুড়ি দিয়ে উঠেছে হাসি, আর প্রচুর কৌতূহল। খুব সরল গলায় প্রশ্ন করলাম- “কেন দাদা কী করলাম?”
“এই যে ছেলেটা এসে দাঁড়াতেই কিছু না ভেবেচিন্তে টাকা দিয়ে দিলেন, সেটা কি আদৌ ঠিক করলেন? আপনি কি জানেন ওই টাকাটা দিয়ে ও কী করবে?” গলা আরো তীক্ষ্ণ হয়েছে, বকুনির কাছ ঘেঁষে।
“কী করবে?” আমার গলায় ভিজে বেড়াল ভর করেছে।
“কিছু তো জানেন না!” শেষ পর্যন্ত বকুনি দিলেন ড্রাইভার দাদা, “আপনি জানেন ওই টাকা দিয়ে ছেলেটা নেশা কিনবে কিনা”?
খুব সরল গলায় প্রশ্ন করলাম “নেশা কিনবে?”
এবার সত্যি উনি বিরক্ত হয়ে উঠলেন। “নেশা..ড্রাগস”।
“না দাদা তা তো জানিনা, দেখলাম ছেলেটার একটা হাত নেই।”
“এটাই তো সমস্যা! সেটা দেখেই আপনাদের খারাপ লেগে যায়। ঠিক আছে। খারাপ লাগতেই পারে।” এবার ওনার গলাটা একটু নরম হলো… “শুনুন এটা একদম ঠিক না..কক্ষনও কাউকে এভাবে টাকা পয়সা দেবেন না।”
“তাহলে কী করব?” আমি বিভ্রান্ত।
“কেন? খাবার কিনে খাওয়াবেন!“ ওনার বলার ধরনে আমার অজ্ঞতার ওপর বিরক্তি ঝরে পড়ল।
রাস্তায় ট্রাফিক অনেকটাই কমে এসেছে। গিয়ার পাল্টে পাল্টে স্পিড বাড়িয়ে উনি বললেন-
“আমি বেহালার দিকে থাকি। পরশু রাত্তিরে আমাদের বড়ো রাস্তার মোড়ের পাইস হোটেলটাতে খেতে গেছিলাম। খেয়ে বেরিয়ে আসছি তখন একজন এসে ভিক্ষা চাইল। বুড়ো মানুষ। বলল, দু’দিন কিছু খায়নি। আমি বললাম “চলো -আমি তোমাকে বসিয়ে খাওয়াব।” ওকে বসিয়ে ভাত ডাল তরকারি মাছ সব খাওয়ালাম। এটাই হচ্ছে আর্ট। কক্ষনও টাকা দেবেন না। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবেন। বুঝলেন?” তারপর নিম্নস্বরে স্বগতোক্তি “আরে টাকা পয়সা দিলে তো হয়েই গেল।”
বাকি রাস্তা চুপ করেই রইলাম।
এটাই বুঝলাম কাউকে সাহায্য করতে গেলে হয় আমাকে কোনও খাবার হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, অথবা অন্য কোনও সময় যদি কেউ আমার কাছে ভিক্ষা চায়, আমায় হন্যে হয়ে খুঁজতে হবে কোথায় খাবার জায়গা আছে… অন্তত এঁর অনুমোদন পেতে গেলে।
নিতান্ত বিমর্ষ হয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে গেলাম।
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় বস্টন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মূলতঃ ছোট গল্প এবং আর্টিকেল লেখেন। ছোট গল্প সংকলন ক্যালাইডোস্কোপ এবং অপরাজিতা প্রকাশিত হয়েছে, কমলিনী,দেজ পাবলিকেশন থেকে।একটি ছোট গল্পের অনুবাদ শর্টলিস্টেড হয়েছে, ‘Armory Square Prize for women writers in South Asian literature’ এ। অনুদিত গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত Words Without Borders এর পাতায় ।আনন্দবাজারের বিদেশ পাতার নিয়মিত লেখেন তাছাড়া রোববার-সংবাদ প্রতিদিন, বাংলা লাইভ, গুরুচণ্ডালী এবং আরো কিছু ম্যাগাজিনে গল্প এবং ছোট বড় প্রবন্ধ নিয়মিত লেখেন।