১
মাঝরাতেই ঘুম ভেঙে গেল ঝিলমের। আবার ওই বাতাসটা বুকের মধ্যে উঠে এসেছে। বুকে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসল ঝিলম। না, এই সময় বুকে কোনও ব্যথা করে না। বা ঘাম হয় না। প্রথম প্রথম কার্ডিওলজিস্টকে ফোন করতেই তিনি ইসিজি করতে বলেছিলেন। বাঁ হাত দিয়ে কোনও ব্যথা হচ্ছে কিনা, ঘাম হচ্ছে কিনা, ঠিক বুকের মাঝখানে ব্যথাটা ছড়িয়ে যাচ্ছে কিনা, এসব নানা প্রশ্ন। ঝিলমেরও মনে হত, এসব কি হার্টের অসুখ? এমন চার পাঁচবার হওয়ার পরেই ঝিলম ডাক্তার জিৎ চক্রবর্তীর কাছে যায়। এই সময়ের একজন নামকরা কার্ডিওলজিস্ট তিনি। প্রায় সবরকম টেস্ট করেও কিছু পাওয়া যায়নি। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ঝিলমকে বলেন, ‘ সম্ভবত একধরনের প্য্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। আমি ওষুধ দিতে পারি, কিন্তু একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখানোই ভাল।’
সুমন এগিয়ে আসে ঘরের মধ্যে। যদি পারা যেত ঝিলমের বুকের ভিতরের সমস্ত হাওয়াটাকে টেনে নেওয়ার। যদি টেনে নিতে পারত সুমন ঝিলমের সমস্ত কষ্ট। বিছানায় শুয়ে ঝিলমের কাছে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সুমন। ঝিলমের মুখের ভিতরে ডুবিয়ে দেয় মুখ। ঝিলমের ঘুম ভেঙে যায় আর এই আকস্মিকতায় ঝিলম ছটফট করতে থাকে।
ডাক্তার অর্পিতা সরকারের চেম্বারে যখন প্রথম গেল ঝিলম, মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই আস্তে আস্তে সে অনুভব করতে শুরু করে দিয়েছিল, যে বুকের মধ্যে আবার সেই দলাপাকানো বাতাসটা উঠে আসছে। বেশ চৌকো একটা ঘর। একজন প্রসন্ন মানুষ তাঁর সামনে হাসিমুখে বসে। তিনি কিছু কথা বলে যাচ্ছেন, যা ঝিলমের কানে ঢুকছে না। একটা হাসিমুখ নিয়ে মাথা নেড়ে বা ঝুঁকিয়ে কথা শোনার ভান করে গেল ঝিলম। কিন্তু সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে তা ধরাও পড়ে গেল।
– আপনি সম্ভবত কিছু শুনছেন না। কারণটা জানতে পারি?
– না, আই অ্যাম সরি। আসলে আমার বুকের ভিতরে আবার সেই হাওয়াটা… পাক খাচ্ছে।
– এখন?
– হ্যাঁ, এখন।
– ঠিক কী মনে হচ্ছে? রাগ, অস্বস্তি, আপনার কি কারো কথা মনে পড়ছে? এখানে আসার আগে কি কিছু ঘটেছিল? বা, এখানে এসে কি কিছু কথা মনে পড়ছে যা আপনাকে বিপন্ন করে? মনে করুন একটু। এই হাওয়াটা উঠে এলে মানে আপনার যেটি মনে হয় আর কী, কারণ এমন কিছু তো মেডিকেল সায়েন্সে হয় না, যাই হোক, তখন আপনার কেমন মনে হয় ঠিক?
– একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলে গেলেন অর্পিতা। হয়তো একটু বিরক্ত।
– আমার তখন কিছুই মনে হয় না।
– এটা তো হতে পারে না, তাহলে আপনি কার্ডিওলজিস্টের কাছেই বা দেখাতে গিয়েছিলেন কেন? শারীরিক ভাবে অস্বস্তি তো হচ্ছিল। ভয় করছিল আপনার। ঘর বদ্ধ থাকলে কি এটা বেশি হয়?
– না, আমি ক্লস্ট্রোফোবিক নই। এই যে কিছুই মনে হয় না, এর একটা কষ্ট আছে। তখন মনে হয়, আমি কি মৃত না কি আমার মৃত্যু হবে? কিন্তু একই সঙ্গে…
– একইসঙ্গে কী? বলুন?
– একইসঙ্গে আমার তখন সকলের জন্যেই খুব মনখারাপ লাগে।
ডাক্তার অর্পিতা সরকারের চেম্বারে যখন প্রথম গেল ঝিলম, মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই আস্তে আস্তে সে অনুভব করতে শুরু করে দিয়েছিল, যে বুকের মধ্যে আবার সেই দলাপাকানো বাতাসটা উঠে আসছে। বেশ চৌকো একটা ঘর। একজন প্রসন্ন মানুষ তাঁর সামনে হাসিমুখে বসে।
বেশ কিছু ওষুধ এখন ঝিলমের ঘরে রাখা থাকে। রোজ রাতে একটা করে ওষুধ খাওয়ার আগে খেতেই হয়। যাতে ঘুম ভালো হয়। আর রোজ দুপুরে একটা করে অন্য ওষুধ। যাতে এই অবস্থা সৃষ্টিই না হয়। ডাক্তারের মতে এটা একধরনের ক্লস্ট্রোফোবিয়া। কিন্তু ঝিলম জানে, এটা ঠিক ক্লস্ট্রোফোবিয়া নয়। যেমন, এখন, রাতে ঘুম ভেঙে গেলেও আর ভয় করছে না। বরং বুকের মধ্যে যেন সকলের জন্য একটা দলাপাকানো দুঃখ জমে আছে।
[the_ad id=”266918″]
পাশেই সুমন শুয়ে আছে। একটু আগে তাদের এক সফল শারীরিক কামনাবাসনা ও প্রেমের পরে সে এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তখন কিন্তু কিছুই মনে ছিল না ঝিলমের। যখন একটা বিশ্ব তার শরীরের মধ্যে ওঠানামা করছিল, আর সে বুঝতে পারছিল এক শিরশিরে আনন্দ, একটা ধ্যান তার শরীরের নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে, তার সমগ্রে ছড়িয়ে যাচ্ছে নিয়তির মতো, মৃত্যুর মতো, তখন ঠিক এমন, এই হাওয়াটা বুকের মধ্যে উঠে এল। মনের মধ্যে থেকে চোখে উঠে এল কষ্ট। আর সে যে কী কষ্ট তা বোঝানো মুশকিল। সুমন থেমে গিয়ে তাকে আদর করতে শুরু করল। সে সময় ঝিলমের শরীরে আর কোনও সাড় ছিল না। সুমনের দিকে তাকিয়ে সে শুধুই বলে উঠেছিল, ‘ একেই কি মৃত্যু বলে সুমন?’
ঝিলম এখন ভাবে, সুমনের সঙ্গে তার আদৌ কেন প্রেম হয়েছিল। আইটির দক্ষ একজন ইঞ্জিনিয়র, সুদর্শন সুমনের জীবনে যে কোনও জটিলতা নেই, তা-ই একটা সময় ঝিলমের কাছে ছিল মুক্তি। এখন সেই মুক্তিই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিস্ময়। কেন কোনও জটিলতা নেই? কেন একটা কম্পিউটার অন অফ করার মতোই একজন ছত্রিশ বছরের যুবক চাকরি প্রমোশন, ফ্ল্যাট, হাইক, অনসাইট, ওভারটাইম, সেক্স আর কেরিয়ার নিয়ে বেঁচে আছে? সে যে বেঁচে আছে, সম্ভবত, সেটি অনুভব করার আগেই, তার জীবনের মুহূর্তগুলি আস্তে আস্তে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
[the_ad id=”266919″]
– আপনার একাকিত্ব থেকে এগুলি হচ্ছে। নিউটাউন আসলে মানুষকে খুব একাও করে দেয়। আপনি আপনার মা বাবার কাছে যেতে তো পারেন মাঝেমাঝে। বা আপনি চাকরি করতে পারেন।
– আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি আসলে। আর মা বাবার কাছে যাই। সপ্তাহে একবার। নিউটাউন থেকে গড়িয়া বড় বেশি দূর।
– হ্যাঁ কিন্তু একটু ঘোরাঘুরি করলে তো মন ভাল থাকবে। আপনারা তো বেড়াতেও যেতে পারেন উইকএন্ডে।
– হ্যাঁ, মাঝেমাঝেই যাই তো।
– ঘরে কি খুব একাকিত্ব গ্রাস করে? নিশ্চয় তাই। মনে পড়ে কি কিছু? কাউকে? বলতে পারেন আমায়।
– না না ডাক্তার সরকার। ব্যাপারটা খুব সিম্পল। আমার জীবনে এসব জটিলতা এখনও আসেনি। পরে আসবে কিনা জানি না। কিন্তু এই বুকের মধ্যে হাওয়াটা আটকে আসে। আর আমার যে কান্না আসে, কষ্ট হয়, এর সঙ্গে এসবের কোনও সম্পর্ক নেই।
– সম্পর্ক তো আছেই মিসেস ব্যানার্জি। আপনার ইনভলমেন্ট দরকার।
– যাতে আমার এসব মনেই না হয়? সুমনের মতো।
– একজ্যাকটলি। সুমন ইজ এ বিজি ম্যান। দেখুন, সকাল সাড়ে আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত অন্য কিছু ভাবতেই পারে না। ইন ফ্যাক্ট, আমিও ভাবার সুযোগ পাই না। কিন্তু ভাবছিনা কি আমরা? ভাবছি তো। আপনার মতো নেগেটিভ ইম্প্যাক্টের কথা ভাবছি না। বি পজিটিভ। – কষ্ট পাওয়াটা নেগেটিভ ব্যাপার? দুঃখ পাওয়াও নেগেটিভ ব্যাপার?
– অকারণে দুঃখ পাবেন কেন?
আইটির দক্ষ একজন ইঞ্জিনিয়র, সুদর্শন সুমনের জীবনে যে কোনও জটিলতা নেই, তা-ই একটা সময় ঝিলমের কাছে ছিল মুক্তি। এখন সেই মুক্তিই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিস্ময়। কেন কোনও জটিলতা নেই? কেন একটা কম্পিউটার অন অফ করার মতোই একজন ছত্রিশ বছরের যুবক চাকরি প্রমোশন, ফ্ল্যাট, হাইক, অনসাইট, ওভারটাইম, সেক্স আর কেরিয়ার নিয়ে বেঁচে আছে?
অকারণে কেন ঝিলম দুঃখ পাবে, কেন কষ্ট তার বুকের মধ্যে হাওয়ার মতো পাক খাবে, এ নিয়ে আস্তে আস্তে ঝিলমের মধ্যেও প্রশ্ন উঠে এসেছিল। কারণ ঝিলম ক্রমশ বুঝতে পারছিল, হাওয়াটার প্রতি তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। হাওয়াটা নিজের মতো আসে আর যায়। যেন হাওয়াটার নিজের কোনও ইচ্ছে আছে। হাওয়াটা যেন অপেক্ষাকরে থাকে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা বাঘের মতো। সময়-সুযোগ পেলেই সে উঠে আসে। আর ঝিলমের সমস্ত জীবনকে ওলটপালট করে দিয়ে যায়। কেন এমন হয়? এই হাওয়াটাকে বের করতেই হবে জীবন থেকে।
– সুমন, তুমি হাওয়াটাকে টেনে নিতে পারো আমার শরীর থেকে? রাতে ঘনিষ্ঠ অবস্থাতেই ঝিলম প্রশ্নটা করল সুমনকে।
– মানে, তুমি যে কী বলছ কিছুই বুঝি না আমি।
– সুমন, আমার ভিতরে যে হাওয়াটা আছে, তাকে তুমি তোমার মধ্যে টেনে নেবে?
[the_ad id=”270084″]
সুমন জাপটে ধরে ঝিলমকে অনেকক্ষণ ধরে একটা চুমু খেয়েছিল। যেন বুকের মধ্যে থেকে সমস্ত শ্বাস নিজের মধ্যে টেনে নিয়েছিল সে। কিন্তু সেই উন্মাদের মতো হাওয়ার রাত কেটে গেল যখন, তখন আবার ঘুমন্ত সুমনের পাশে ঝিলম টের পেল, আবার সে উঠে আসছে। রাত তখন আড়াইটে। ওদিকে এই ন’তলার ফ্ল্যাটের জানলার পর্দাটা ছটফট করছে হাওয়ায়। কোথায় যেন চাঁদ উঠেছে দেখা যাচ্ছে না। হালকা একটা আলোয় ভর্তি। কিন্তু মনের মধ্যে সেই দুঃখটা পাক খাচ্ছে।
– সুমন, সুমন, তুমি পারোনি, আমার হাওয়াটাকে টেনে নিতে। তুমি কি দুঃখ পেতে চাও না সুমন? তুমি কি অভ্যেসের জীবনটাই কাটিয়ে যেতে চাও?
সুমন উত্তর দেয়নি কোনও। সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা কোনওক্রমে ঘুমিয়ে পড়েছিল ঝিলমের এক কোণে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হচ্ছিল ঝিলমের। ভালবাসতে ইচ্ছে করছিল। আর আবার ঠিক তখনই বুকের মধ্যে সেই হাওয়াটা যেন ছটফট করছিল।
আসলে, ঝিলম এখন এই হাওয়াটাকে ভালবেসে ফেলেছে। বরং এই হাওয়াটা আছে বলেই ঝিলমের আর নিজেকে ফাঁকা লাগে না। বরং হাওয়াটার সঙ্গে একধরনের কথোপকথন তৈরি হয়েছে তার।
যদিও হাওয়াটা কোনও কথার উত্তর দেয় না।
কিন্তু ঝিলম কথা বলছে।
– আমি আসলে সেই সব ক্লাসের লোকেদের মধ্যেই পড়ি, যাদের কোনও কিছুতেই কিছু এসে যায় না। তারা খায় দায় শোয় ঘোরে ঘুমোয় মরে যায়। বিশ্বাস করো, আমি তাদের মতো। আমার এসে যায় না কিছু । আমি ভাল আছি, আমি ভাল আছি, তাই না হাওয়া? আমি ভাল আছি অনেকের থেকে। ন তলায় থাকি, ২০০০ স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাট, হাতে টাকা, ব্যাগে কার্ড, মনেও টাকা ঢুকে গেছে। এমনকী আমাদের যৌনতার মধ্যেও আমি এখন টাকার গন্ধ পাই। টাকার গন্ধ ঠিক কেমন জানো? একটা বদ্ধ ঘর বহুদিন পরে হঠাৎ খুললে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়, তেমন।
বুকের ভিতরে হাওয়াটা এক নির্বাক শ্রোতার মতো চুপ করে থাকে।
– তুমি কোথায় গেলে? কোথায়? কেন দুঃখ পাচ্ছি না আমি? কেন কষ্ট হচ্ছে না আমার?
সুমন জাপটে ধরে ঝিলমকে অনেকক্ষণ ধরে একটা চুমু খেয়েছিল। যেন বুকের মধ্যে থেকে সমস্ত শ্বাস নিজের মধ্যে টেনে নিয়েছিল সে। কিন্তু সেই উন্মাদের মতো হাওয়ার রাত কেটে গেল যখন, তখন আবার ঘুমন্ত সুমনের পাশে ঝিলম টের পেল, আবার সে উঠে আসছে। রাত তখন আড়াইটে।
আর ঠিক এভাবেই হাওয়াটা তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। এমনকি যেবার পিসিমা মারা গেল, তার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়েও ঝিলম একবিন্দু কাঁদতে পারল না। মা বাবা তো বটেই, সুমনও বেশ কিছুটা আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে কী , তেমন দুঃখও হচ্ছিল না ঝিলমের। অথচ এ কথাটা অন্য কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়াটাও কঠিন। হাওয়াটা কোথায় গেল এই সময়ে? তবে কি ওই ওষুধগুলো আস্তে আস্তে মেরে ফেলছে ঝিলমের বুকের ভিতরের সেই হাওয়াটিকে?
– আপনি যাকে স্বাভাবিক বলে মনে করছেন, তা আসলে অস্বাভাবিক। কারণ এমন কোনও বাতাস বুকের মধ্যে আটকে থাকে না। একে আপনি বানাচ্ছেন। এই যাবতীয় যা কিছুই ঘটছে তা আপনার মনের মধ্যে। আপনি সুস্থ হয়ে উঠছেন মিসেস ব্যানার্জি’।
[the_ad id=”270085″]
ডাক্তারের কাছ থেকে এই কথাগুলো শোনার সময় আবার হাওয়াটা বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছিল ঝিলমের। চোখে জল চলে এল ঝিলমের। ঘরের বাইরে ছুটে বেরিয়ে চলে গিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ঝিলমের। কিন্তু এভাবে বেরনো যায় না। এভাবে বেরতে গেলে অনেক সমস্যা।
– আপনি বলছেন হাওয়াটা মরে যাচ্ছে। আমি তাকে মেরে ফেলছি? আপনারা তাকে মেরে ফেলছেন?
– সে তো নেই, মরবে কেমন করে? সে তো আপনার মাথার মধ্যে ছিল। আর আপনাকে অসুস্থ করে দিচ্ছিল। আমরা তাকে সরিয়ে দিচ্ছি আস্তে আস্তে।
– কিন্তু এটাও তো হত্যা করা। সে যদি আমার সন্তান হত? সেই সন্তানও তো আস্তে আস্তে আমার রক্তমাংস নিয়ে আমার শ্বাসপ্রশ্বাসে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠত। সেও তো আমাকে সাময়িক ভাবে অসুস্থ করে দিত। তো, আপনারা কি তাকেও মেরে দিতেন?
– আবার ভুল করছেন মিসেস ব্যানার্জি। আপনার সন্তান এলে তা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার হবে। কিন্তু এই যে আপনার মনে হওয়াগুলো এগুলো স্বাভাবিক আর প্রাকৃতিক নয়।
– সেটা তো আপনি অনুভব করেননি বলে।
ডাক্তার একবার পূর্ণদৃষ্টিতে ঝিলমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, আমার মনে হয় এ নিয়ে আমরা পরের সিটিং-এ কথা বলি?
ঝিলম-সুমনের এখনও পর্যন্ত কোনও সন্তান হয়নি, তার কারণ তারা এখনও সন্তান চাননি। সুমন স্টেবল হলেও এখনও এই দায়িত্ব গ্রহণে নাকি সক্ষম নয়। অথচ তাদের ন’তলার ফ্ল্যাটের একটু দূরেই যে বস্তি দেখা যায়, সেখানে কত শিশু! কত মানুষ এত দায়িত্ববোধের কেয়ার না করেই শিশুকে আনে পৃথিবীতে। সে তুলনায় ঝিলম-সুমন তো মেঘের রাজ্যে বসবাস করে প্রায়। একটা শিশুকে পৃথিবীতে আনতে কি সুইস ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট লাগে? এই প্রশ্ন করে সুমনের কাছ থেকে একটি অর্থহীনতার হাসি ছাড়া আর কিছুই পায়নি ঝিলম। এসব কথা ভাবলেই বুকের ঠিক তলা থেকে হাওয়াটা আবার উঠতে থাকে উপর দিকে। হাওয়াটা কি সন্তান তবে? ঝিলম আস্তে আস্তে বুঝতে পারে, সে আর ভয় পাচ্ছে না হাওয়াটাকে। কারণ হাওয়াটা তার চেয়েও অনেক বেশি অসহায়।
২
ঝিলম ঘুমিয়ে পড়তেই সুমন আস্তে আস্তে ন’তলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সিগারেট ধরাতেই হবে এবার। বারান্দা থেকে তাদের শোবার ঘরটা স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। হালকা চাঁদের আলো পড়েছে দেওয়ালে। আর তার আভা এসে পড়েছে ঝিলমের মুখে। গত কয়েক মাস ধরে ঝিলমের এই বুকের ভিতরের হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চলছে। হয়তো ঝিলম ভাবে, সুমন এসবের কিছুই বোঝে না, অনুভব করতে পারে না। সিগারেটটা ধরিয়ে মৃদু হাসে সুমন। এই হাওয়া যে কী, তা সুমন অনেক আগে থেকেই জানে। বুকের ভিতরে যখন চাপচাপ ব্যথা হয়, তখন সুমনের একমাত্র বন্ধু সেই ওষুধ। বিষয়টি সম্পর্কে একমাত্র জানেন ডক্টর সেনগুপ্ত। তাদের আইটি কোম্পানিরই অ্যাপয়েন্টেড সাইকিয়াট্রিস্ট। চাকরিতে জয়েন করার কয়েকদিন পরেই বুকের মধ্যে এই কষ্টটা টের পেত সুমন। অফিসই সব চেক আপের ব্যবস্থা করে। আর তার পর দেখা হয় এই সেনগুপ্তর সঙ্গে। তিনি অসুখটা শুনে একবারের জন্যও হাসেননি। বরং, একটু নীচু গলায় তার দিকে চেয়ে বলেছিলেন, আপনাকেও ধরেছে?
– এটা কি একটা ইনফেকশাস ডিজিজ?
– ডাক্তারি শাস্ত্র তা বলবে না, কিন্তু সংক্রামক ব্যাধি তো বটেই। আর এই অরিজিন আমরা কেউ জানি না।
– তাহলে?
– ওষুধ। ও আমি দিয়ে দেব। আপনার তো সবে শুরু হল। এখানে সকলেই কমবেশি… আমিও…
– আপনিও?
– হ্যাঁ,প্রবল মনখারাপ হয় না? কান্না পায়, ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে? আপনি জানেন, আজ পর্যন্ত কজন আত্মহত্যা করেছে? এই বিল্ডিং-এই অন্তত সাতাশজন। পাগল হয়ে গেছে কমপক্ষে এর দ্বিগুণ। আর যারা স্বাভাবিক দেখছেন, তারা কি আদৌ স্বাভাবিক?
– তাহলে আমার কী করার?
– ইগনোর। ইগনোর। সঙ্গে ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। চোখের জল একেবারে শুকিয়ে যাবে।
ঝিলম-সুমনের এখনও পর্যন্ত কোনও সন্তান হয়নি, তার কারণ তারা এখনও সন্তান চাননি। সুমন স্টেবল হলেও এখনও এই দায়িত্ব গ্রহণে নাকি সক্ষম নয়। অথচ তাদের ন’তলার ফ্ল্যাটের একটু দূরেই যে বস্তি দেখা যায়, সেখানে কত শিশু! কত মানুষ এত দায়িত্ববোধের কেয়ার না করেই শিশুকে আনে পৃথিবীতে।
পাঁচ বছর আগের এই ঘটনা। এখনও বুকের মধ্যে হাওয়া পাক দিয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু করার নেই। একে দমিয়ে না রাখলে, এই মেরে ফেলে দেবে সুমনকে। ঝিলমের কাছে কিছুতেই প্রকাশ করা যাবে না এই অসুখে সুমনও আক্রান্ত। অথবা এও হতে পারে, সুমনের কাছ থেকেই ঝিলম এই অসুখে আক্রান্ত হয়েছে। হয়তো, সেই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে, উল্লাসের আশ্চর্য প্রহরে, সুমনের ঘামের সঙ্গে, শ্বাসের সঙ্গে এই হাওয়া চলে গেছিল ঝিলমের ভিতরে। তাই ঝিলম যখন সেদিন এই হাওয়াটিকে টেনে নিতে বলল, সেদিন সুমন প্রাণপনে চেষ্টা করেছিল এই হাওয়া টেনে নেওয়ার। কিন্তু সুমন জানে, এই হাওয়া টেনে নেওয়া যায় না। কোনওদিনই না।
[the_ad id=”270086″]
সুমন এগিয়ে আসে ঘরের মধ্যে। যদি পারা যেত ঝিলমের বুকের ভিতরের সমস্ত হাওয়াটাকে টেনে নেওয়ার। যদি টেনে নিতে পারত সুমন ঝিলমের সমস্ত কষ্ট। বিছানায় শুয়ে ঝিলমের কাছে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সুমন। ঝিলমের মুখের ভিতরে ডুবিয়ে দেয় মুখ। ঝিলমের ঘুম ভেঙে যায় আর এই আকস্মিকতায় ঝিলম ছটফট করতে থাকে। প্রাণপণে চেষ্টা করে সুমনের আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে আসার। কিন্তু তার গোঙানির শব্দ ডুবে যায় সুমনের মুখের ভিতর। সুমন অদ্ভুত ভাবে ঘামছে। যেন সারা শরীর দিয়ে শুষে নিতে চাইছে ঝিলমকে। বুকের ভিতর অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে ঝিলমের। যেন সমস্ত হাওয়া বুকের ভিতর থেকে উঠে আসছে এক শ্বাসরুদ্ধ যন্ত্রণার মতো। ঝিলম তার সমস্ত দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল সুমনকে ঠেলে সরিয়ে দিতে। সুমন একবার ক্ষুধার্ত বাঘের মতো তার মুখ থেকে মুখ তুলে বলল, ঝিলম, আমি আজ শেষ দেখে ছাড়ব। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঝিলমের মনে হল সুমন সেই মুহূর্তে একজন ধর্ষণকারী ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু যে কোনও মূল্যেই ঝিলম এই হাওয়াটাকে হারিয়ে ফেলতে চাইল না। কিন্তু সে দম হারিয়ে ফেলেছিল।
৩
পরের দিনটা শুরু হয়েছিল সাধারণ বাকি দিনগুলোর মতোই। চা, ব্রেকফাস্ট, স্নান, অফিস। ঝিলমের দু’চারটে ফোন এসেছিল। সুমনের সঙ্গেও এলোমেলো কিছু কথা। কিন্তু ঝিলম টের পাচ্ছিল একটা কিছুর অনুপস্থিতি। কিছু একটা হারিয়ে গেলে যেমন অনুভূতি হয়। নিজেকে পালকের মতো হালকা লাগছিল। সুমন দু’তিনবার ফোন করল। যেমন কথা হয়, তেমনই কথা। দুপুরের দিকে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল ঝিলম। কিন্তু ঘুম আসছিল না। আর ঠিক তখনই ফোনটা এল। ফোনটা পেয়ে ঠিক কী করা উচিত বুঝতে পারছিল না ঝিলম। সকলকে খবর দেওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। সুমন এটা কেন করল ঝিলম জানে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ঝিলমের আর কিছুই মনে হচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে না, ভয় করছে না, ছুটে যেতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। না, ঝিলম আর কোথাও যাবে না। এগারো তলার অফিসের বারান্দা থেকে সুমন লাফিয়ে আত্মহত্যা করলেও না।
কারণ ঝিলম এখন বুঝতে পারছে, এটা ঠিক একজনের আত্মহত্যা না। ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায় ঝিলম। একা।
হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।
24 Responses
নিভৃত চেতনার বিস্ফোরণ। অসাধারণ শৈলী
আশ্চর্য একটা গল্প । তন্ময় হয়ে পড়লাম।
মন ছুঁয়ে গেল। খুব ভালো লেখা।
খুব ভাল লাগল
এই সময়ের চাপা আক্রোশ আর ভয়ের গল্প। খুব প্রাসঙ্গিক।
অসম্ভব সত্যি একটা গল্প, এই হাওয়া, এই বিষাদ…
অসম্ভব ভালো একটা গল্প পড়লাম।
ঝিলম চরিত্রটি নিদারুণভাবে চিত্রিত হয়েছে।
অ সা মা ন্য!
ভীষণ ভালো লাগলো। এক শ্বাসে পড়ে ফেললাম ।
ভালো গল্প। মনস্তাত্বিক। আধুনিক সময়ের শূন্যতার চালচিত্র। সবাই একা। সবাই ক্লান্ত। সবাই ভেতরে একটা অসুস্থ মন পুষে রেখেছে। সবাই পরিস্থিতির কাছে অসহায়।
খুব ভালো লিখেছো হিন্দোল।
Suffocating.
গল্পটি ভালো। এই ভয়ানক বাজার, প্রতিযোগিতা, বিরামহীন কাজ মানুষকে এই আত্মবিনাশের পথে ঠেলেছে। কোন পৃথিবীতে প্রবেশ করছে এই সভ্যতা, ভাবলে কম্পিত হতে হয়।
হিন্দোল!!!
বেশ বেশ ভালো লাগল…
এই ভাবনাটা তোমার ভেতরে উসখুস করছে মনে হয়…
ছায়া পেয়েছি কি আগে?
গল্পটি যেন আমাদেরই কোনো অন্তর্গূঢ় বেদনাময় সত্তার কাছাকাছি নিয়ে আসে আমাদের। ক্লান্ত করে। অসামান্য।
বেশ জমাট গল্পের বুনন
সংক্রামিত হলাম। ভারি চমৎকার
গল্পটি ভাবালো হিন্দোল। নানাভাবে বাঁক নিতে নিতে শেষে গিয়ে কাহিনী বিদ্ধ করে পাঠককে। পাঠকেরও কল্পনা করার জায়গা থাকে -ঝিলাম কি করবে এবারে ? সে কি হওয়াটা ফিরে পাবে ?সুমন আর ঝিলাম -দুটি চরিত্রই বাস্তবসম্মতভাবে চিত্রিত। মনে দাগ কাটার মতো লেখা। আরো গল্প চাই তোমার লেখনী থেকে।
কি আশ্চর্য! এই শূন্যতা র এতো সুন্দর বিশ্লেষণ আগে পড়ি নি।একবার ও ছেদ পড়লো না পড়ার ইচ্ছেটায়।টান টান।আর ভীষণ জীবন্ত চরিত্রগুলো।
ভালো লিখেছ, হিন্দোল! বর্তমান সমাজের একটা বিশেষ অংশে এই শূন্যতা, অসহায়তা, বিচ্ছিন্নতার ভার নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব করতে পারবেন অনেকে। তোমার গল্পের ছকে, লিখনশৈলীতে সেই অনুভূতিটা জীবন্ত হ’য়ে উঠেছে।
এই গল্পটি যে পড়ে উঠবে শেষপর্যন্ত,তারও বুকের মধ্যে ঢুকে পড়বে এই হাওয়া। breathing space খুঁজে বেড়ানো আধুনিক মানুষের জন্য সভ্যতার অভিশাপ!!!
ভালো লাগল গল্পটি। চমৎকার বুনোট।
আমাদের এই নাগরিক যাপন এক ধরনের claustrophobic হয়ে উঠেছে, কমবেশি প্রায় সবারই জন্য বিশেষ করে হাইরাইজ ফ্ল্যাটের মানুষেরা; যারা ইচ্ছে থাকলেও সামাজিক হবার রাস্তাগুলি নিজের হাতেই বন্ধ করে ফেলেছেন।গল্পকার এই জায়গাটায় ফোকাস করেছেন একটি রূপকের সহায়তা নিয়ে- সেটি হাওয়া। আস্তে আস্তে আমরা সকলেই এই অদ্রৃশ্য হাওয়ার শিকার হয়ে উঠছি। এই হাওয়া আমাদের বস্তুনিষ্ঠ ভোগবাদী জীবনের এক ভাইরাস। মানুষে মানুষে সামাজিক ক্রিয়াশীলতা যখন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে অথচ নিশ্চিত ভাবেই সেই ক্রমবদ্ধর্মান শূন্যতা এমন হাওয়া এসে মানুষের মনে জাঁকিয়ে বসছে যা অর্র্থ দিয়ে নিরসন হচ্ছে না। গল্পকার এই জায়গাটা নিপুণভাবে এঁকেছে মুন্সিয়ানার সঙ্গে। সে সফল তার এই গল্পে।
Can I share your story In YouTube
Really liked your stores, are you permitted to share in YouTube?