পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বগুরান জলপাই গ্রামে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া এক ফিশিং ট্রলার ফিরে এল প্রায় দীর্ঘ কুড়ি বছর পর। দীর্ঘদিন বাদে জাহাজ নাহয় স্রোতে ভাসতে ভাসতেই ফিরে এল কিন্তু গ্রামের লোকজন, বিশেষতঃ যে জেলে পরিবার এতদিন ধরে তাদের বাড়ির কারোর স্বামী বা কারোর ছেলের জন্য একদিন শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল তারা যেন অনেকদিন পর একটু নড়েচড়ে বসল।
‘কী করে বুঝলে এটা সেই জাহাজ ?’ পাড়াপড়শিরা বলল।
বগুরান গ্রামের সবচেয়ে দক্ষ মাছ ধরিয়ে পুলিনের বু জবা আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘আমি জানতাম আমার ভগবান আছেন তাই এখনও সিঁদুর পরি আমি আর জাহাজটোয় সেই চিহ্নটা এখনও আছে।’
এখন সে মধ্যবয়সী এয়োতি । তবুও চেহারায় বেশ জৌলুস, ভেতরের জামা না পরা বুকদুটিও বেশ আঁটোসাঁটো। কালো হলে কী হয় লালিত্য যেন উপচে পড়ছে। জবা নিজের কুঁড়ের মধ্যে ঢুকে আরও খানিকটা সিঁদুর পরে সমুদ্দুরের পাড়ে এসে দাঁড়াল। ফিরে আসা জাহাজটার অবস্থা কিন্তু শোচনীয় নয়। কুড়িবছর বাদে তার রংচং একটুআধটু টসকালেও সেই যে পুলিনের জাহাজ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্র জবার । হাতে তেলের কুপি আর একটু জাহাজ বরণের সামগ্রী নিয়ে সে প্রস্তুত হল।
জবার স্বামী পুলিন যখন মাছ ধরতে গেছিল তখন জবা পোয়াতি ছিল। সেই ছেলে এখন বছর উনিশের । বাবা কে চোখেই দেখেনি। এক পড়শির কাছে ছবি দেখেছিল । জবা তাকে মাছ ধরতে দেয়নি, শেখায়ওনি জাল ফেলা । ছেলের নাম বিপিন। সে পড়াশশোনা করে। জবার শ্বশুরের একটু ধান জমি ছিল । সেখানে সে উচ্চমানের ধান ফলিয়ে বিক্রি করে । বিপিন এখন শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে সবে । মাছের জন্যই বাবা ফেরেনি ঘরে তাই মাছের ওপর জবা আর বিপিনের বড় রাগ। ওরা মাছ মুখে তোলেনি আর কোনওদিন ।
যে জাহাজটি নিয়ে পুলিন সে বার পাড়ি দিয়েছিল তার নাম ছিল সমুদ্রদেব। সেই ঘটনার পর থেকে আর কেউ মাছ ধরার জাহাজের নামও সমুদ্রদেব রাখেনি। সমুদ্রদেবের কাঠের রংচঙে শরীরে ছিল শাঁখের চিহ্ন। জবার খুব মনে পড়ে পুলিন মাছ ধরে ফিরেই কত আদর করত তাকে। সমুদ্রের গহন জমাট বাঁধা অন্ধকারেই এক দিন পেটে এসেছিল বিপিন। সে দিন সাক্ষী ছিল ক্যাসুরিনার জঙ্গল আর আকাশের একফালি চাঁদ।
বগুরান জলপাই সমুদ্র তটে ঢেউ নেই মোটে। নির্জনতা ভেঙে জোয়ার আসে শব্দ করে। তখনই সোনালি বালিতে আসর বসায় মুঠো মুঠো রকমারি শাঁখ। সে দিন ছিল বিপিনের উচ্চমাধ্যমিক পাশের খবরের দিন। বাবার জন্য বড় মন কেমন করে উঠেছিল তার।
সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে বিপিন একদৃষ্টে চেয়েছিল দূর দিগন্তপারে। বাবা হারিয়ে গেছিল যেখানে। পাশের খবর পেয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেই মনে হয়েছিল বাবার কথা। তাই দৌড়ে চলে এসেছিল সমুদ্রের কাছে। বাবার আশীর্বাদ নিতে। জোয়ারের জল সরে গিয়ে তখন ভাটার সময়। বালির চরে তখন আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে অগুন্তি লাল কাঁকড়ার সারি। চকিতে পায়ের শব্দে ঢুকে পড়ছে গর্তে।
সমুদ্রবুক ধরে হেঁটে চলেছিল বিপিন। হঠাৎ করেই পৌঁছে গেছিল যত্রতত্র বালির সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হরেক কিসিমের শাঁখের গালিচায়। ওখানকার মানুষেরা থকে গেছে কুড়িয়ে কুড়িয়ে। দুবেলাই ওই সমুদ্রতটে অমন শাঁখেদের আসা যাওয়া। জোয়ারের জলের তোড়ে ভেসে আসে। ভাটায় জল সরে গেলেই তাদের দেখা যায়। ততক্ষণে শাঁখের মধ্যেকার সামুদ্রিক প্রাণীটি আত্মারামের খাঁচাখোলস ছেড়ে হয় বেরিয়ে গেছে নয় তার মৃত্যু হয়েছে। কিম্বা সে শঙ্খের মধ্যেই ঘাপটি মেরে বসে আছে। নোনাজলের স্বাদ নিচ্ছে চুপটি করে।
বিপিন নিজের মনে বেশ বড়সড় একটা শঙ্খ কুড়িয়ে নেয়। কী সুন্দর শাঁখটা।বাকিদের থেকে আলাদা গড়নের। গায়ে আবার বাদামি ছিট ছিট। এ বার সে প্রাণপনে সেই শাঁখটি হাতে আরও এগিয়ে চলে সমুদ্রবুকে বালির পথ ধরে। সূর্যদেব তখন মেঘের আড়ালে। বৃষ্টি হলেও হতে পারে সে দিন। হলে তার মায়ের মনে সুখ হবে। ধানের ফলন ভাল হবে। হঠাৎকী মনে হল বিপিনের। অনেকটা দূর চলে এসে শাঁখটির কুন্ডলী পাকানো দেহের মধ্যে শান্ত হয়ে বসে থাকা জলপ্রাণীটির উপস্থিতি বুঝতে পারল বিপিনচন্দ্র বর।
নিজের মনে সে কথা বলতে লাগল শাঁখটির সঙ্গে। যেন কত চেনা তার সেই সামুদ্রিক প্রাণীটি। কেমন করে খায় তাদের গ্রামের লোকজন, এই নিরীহ, অবলা জন্তুগুলোকে? খুব রাগ হল বিপিনের। পকেট থেকে তার সস্তার মোবাইল বের করে শাঁখটির ছবিও তুলে নিল সে। তার পর দুহাতের মধ্যে শাঁখটিকে ধরে সে বলল, আমার বাবাকে গিয়ে বলবে তুমি? জন্তুটা যেন শুনতেই পেল না।
তারপরে আবারও বলল, কী হল শুনতে পেলে ? এ বার সেই জন্তুটি যেন রেস্পন্ড করল। সে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বুঝি ।
আবারও বিপিন বলল, আমার বাবা কে গিয়ে বলবে তুমি, আমি আজ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি, বায়োলজিতে লেটার পেয়েছি। বাবা শুনে খুব আনন্দ করবে। জন্তুটি তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেড়েচেড়ে অবশেষে বেরিয়ে আসবে এমন সময় বিপিন তার মায়া ত্যাগ করে সজোরে ছুঁড়ে দূর সমুদ্রে ফিরিয়ে দিল তাকে।
গাঁয়ের মানুষের এমন কি জবারও বিশ্বাস সমুদ্র দেবতা বিপিনের কথা শুনতে পেয়েছে ওই শাঁখের মাধ্যমে। তাই এক সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে এসেছে বিপিনের বাবা পুলিনের মাছ ধরার জাহাজখানি। বিপিন অবিশ্যি বিশ্বাস করেনি। প্রমাণ আছে কিছু? বাবা যখন ফিরে আসেনি তখন আর কী হবে? খালি জাহাজ ধুয়ে আমরা জল খাব বুঝি? বিপিন রেগেমেগে উত্তর দিয়েছিল।
জবা বলেছিল, নাম, ছবি সব মিলে গেছে যখন।
এতদিন পরেও কাঠের গায়ে রং দেখে তুমি চিনতে পারলে মা?
মা বলেছিল রং চটে গেছে বটে কিন্তু সেই রং আমার চোখে এখনো লেগে রয়েছে রে। এ দিন বাদে অতটাও রয়েছে বলেই তো…
ছেলে বলেছিল, তো? বাবা ফিরে এল না যে। রং নিয়ে, নাম নিয়ে, চিহ্ন নিয়ে কী হবে আমাদের?
সে দিন গ্রামের সব জেলে পরিবার ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে প্রস্তুত আগন্তুক ফিশিং ট্রলারটির দিকে। বিপিন তার মা’কে নিয়ে জাহাজের সামনে গিয়ে একটা প্রণাম করল। জবা ধূপ, দীপ জ্বেলে বরণ করল সমুদ্রদেবকে। ঠিক যেমন সব স্ত্রী আচার পালন করত তার স্বামী পুলিন এক পক্ষকাল পর মাছ বোঝাই জাহাজ নিয়ে বগুরানে ফিরলে। শাঁখ বাজালো। নিরুদিষ্ট স্বামীর প্রতি প্রণাম জানালো। মনে মনে বলল, দেখ আমি এখনো তোমার জন্য সিঁদুর শাঁখা পরে আছি। ততক্ষণে বিপিন একলাফে জাহাজের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আঁতিপাতি করে খুঁজতে লাগল বাবার শেষ চিহ্ন। যদি পায় কিছু সে। মা বলেছিল অনেকদিন আগে এক বিদেশী নাবিক নাকি পুলিন কে দিয়েছিল একটি নৌকম্পাস। যদি সেই মহার্ঘ্য বস্তুটি কোনওক্রমে পড়ে থাকে জাহাজের মধ্যে। তার বাবা সেটি নিয়েই সমুদ্র যাত্রা করত সর্বদা।
সেটি খুঁজতে গিয়ে বিপিন যা পেল তা আরও বিস্ময়কর। বিপিনের সেদিনের শাঁখটি পড়ে রয়েছে জাহাজের মধ্যে, এক কোণায়। অবিকল সেই শাঁখ। হাতে নিয়ে দেখল তার মধ্যের প্রাণীটি নেই আর।
বিপিন শাঁখ হাতে নিয়ে বাইরে এসে মা কে ডেকে দেখাল, মা দেখ সেই শাঁখটা। দেখ, দেখ আমি জানি সেটাই। মা বলল, ধুস!। বিপিন পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার নিজের হাতে তোলা শাঁখের ছবিটা মা কে দেখাতে গিয়ে দেখে সেটি নেই আর। তার বদলে পুলিনের ছবি সেখানে… তোলপাড় হল বিপিনের মন। কেঁদে ফেলল সে। বাবা সত্যিই এসেছে তবে।
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
2 Responses
খুব ভালো লাগলো।
চমৎকার