Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বৃত্তান্তর: ছোটগল্প: পর্ব ৩

স্নিগ্ধা সেন

ডিসেম্বর ২৫, ২০২০

Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

বরুণা কি হারিয়েই গেল? সুচারু যেন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে ওর মধ্যে একটা চাপা টান ছিল এই ছেড়ে যাওয়া জীবনের প্রতি। এই জীবনকে ও ভাবতে চাইত নিতান্ত আটপৌরে একটা অস্তিত্ব হিসেবে, প্রায় পেটপুরে খেয়ে ঢেকুর তোলার মতো হাস্যকর একটা তৃপ্তি নিয়ে থাকা। বেরিয়ে গিয়ে যে জীবনের মধ্যে ঢুকেছিল তাতে অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা ছিল প্রতি পদে। কিন্তু একটা দায়বদ্ধতার গৌরব ছিল সে জীবনে। তারই ফাঁকে গ্রামেগঞ্জে কারও বাড়িতে লুকিয়ে আশ্রয় নিত যখন, সে বাড়ির পারিবারিক ছবির মধ্যে কখনও কি ঝিলিক দিত না পুরনো দিনগুলো? আজও যে ওই কিছুক্ষণ আগে দেখা পরিবারটিকে ও আট বছর আগের স্মৃতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলছিল, তার কারণ এমন নয় তো যে ও আবার পুরোনো সুচারু হতে চাইছে? আর কাকতালীয়ভাবে এমন কাউকে দেখল, যে খানিকটা ওরই মতো, সেই সময়ের পারিবারিক সুচারুর মতো।  

[the_ad id=”266918″]

সুচারু এতদিন পর এ জায়গায় এসেছে কেন? ওর এই ছেড়ে যাওয়া জায়গায়? আট বছর আগে ঘর ছেড়েছিল যে কাজ করবে বলে, সে কাজের গুরুত্ব ওর কাছে ফুরিয়ে গিয়েছে কি? আস্থা,আদর্শ – শব্দগুলো ওর মনে একটা স্পর্শকাতর জায়গা করে নিয়েছে। আস্থা হারাবার চিন্তাটাই বড় বেদনাদায়ক। আস্থা দাঁড়িয়ে থাকে যে দলগত ঐক্যের ভিতের উপর, ও বুঝতে পারছিল, সেটাই নড়ে গিয়েছে। পরেশ জেলে অসুস্থ হয়ে মারা যান, নেতৃত্ব দেবার মতো তৈরি কেউ বাইরে ছিলেন না। ক্রমে নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা, আত্মগোপন করা মানুষগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রাখাটাই মুশকিল হয়ে উঠল। পুলিশি অত্যাচারে ভয় পেয়ে নিজেকে বাঁচাতে বিশ্বাসঘাতকতা করল কিছু দুর্বল লোক। সুচারুকে পুলিশ খুঁজেছিল। কিন্তু খবরমতো মনে হত ওর কাজ ছিল বয়স্কদের স্কুল চালান, আসলে অবশ্য যেটি ছিল একটি বিশেষ অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে পার্টির কর্মধারার ধারণা দেওয়া এবং তাদের সক্রিয় সমর্থন গড়ে তোলা। এই ‘সিলেবাসের’ কথা গোপনই ছিল। ব্যাপারটার চেহারা বাইরে  থেকে খানিকটা নিরীহ হওয়াতে কড়া অভিযোগ তৈরি করা যাচ্ছিল না। ‘একজন পাগলাটে মাস্টারমশাই উনি’, এমন ভাবে সুচারুর পরিচয় দিয়ে গ্রামের লোক ওকে বাঁচিয়ে দিল। পুলিশ সুচারুকে ওয়ার্নিং দিয়ে বলল ও যেন ওই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। গ্রামের লোকেরাও মনে করছিল ওখানে থাকা আর নিরাপদ নয় সুচারুর পক্ষে।

[the_ad id=”266919″]

সুচারু ফিরে এল কলকাতায়। তারপর কোচিং ক্লাস আর নোটবই লেখা । খুব একটা অর্থপূর্ণ বেঁচে থাকা নয়। কিন্তু বেঁচে থাকতে তো হয়। মাথাটা একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে। আজকে এখানে কোথায় পাবে বরুণাকে? সেই ছোট বিকু, এখন চোদ্দো বছরের হয়েছে… মাথায় কতখানি লম্বা হয়েছে কে জানে? সুচারু নিজে যথেষ্ট লম্বা। একবার মনে হল, বরুণা নিজেও তো একেবারে বেঠিকানা করে ফেলল নিজেকে। কখনও মনে হয়নি যে সুচারু ফিরে আসতে পারে, ওদের খোঁজ করতে পারে? 

আস্থা হারাবার চিন্তাটাই বড় বেদনাদায়ক। আস্থা দাঁড়িয়ে থাকে যে দলগত ঐক্যের ভিতের উপর, ও বুঝতে পারছিল, সেটাই নড়ে গিয়েছে। পরেশ জেলে অসুস্থ হয়ে মারা যান, নেতৃত্ব দেবার মতো তৈরি কেউ বাইরে ছিলেন না। ক্রমে নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা, আত্মগোপন করা মানুষগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রাখাটাই মুশকিল হয়ে উঠল। পুলিশি অত্যাচারে ভয় পেয়ে নিজেকে বাঁচাতে বিশ্বাসঘাতকতা করল কিছু দুর্বল লোক।

না, এই স্মৃতির বাঁধনে জড়াবে না ও। ফিরে চলে যাবে। কিন্তু যাবে কোথায়? ওর কাছে ফেরা কথাটারই আর মানে নেই। পথের কোনও প্রান্তেই কোনো ডেরা নেই।  অতনুর ছেলে ওই ছটফটে ছ’ বছরের পিকুর কথা মনে হল। বাচ্চাটা এই স্টেশনময় ছোটাছুটি করছিল। সুচারু নিজেও তাই করছে, ভেতরে  ভেতরে ছটফট করছে। ট্রেন এলে উঠবে কিন্তু কোন স্টেশনে নামবে নিজেই জানে না। চাওয়ালা ছেলেটি খুব সহানুভূতির সুরে বলল,’দাদা পুরনো মানুষজনকে পেলেন না,খারাপ লাগছে বুঝছি। আপনার আদত বাস কোথায়?’  এই এঁচোড়ে পাকা ছেলেটির প্রতি সুচারু মনে মনে একটু স্নেহ বোধ করছিল। ‘তুমি কোথাকার লোক?’
‘বর্ধমানের দাদা। মা বাবা নেই। বাবার যেটুকু জমি ছিল, দাদা নিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে এসে এর ওর দয়াতে চায়ের দোকানটা খুলতে পেরেছি।একজন ইস্টেশন মাস্টার বাবু ছিলেন,ভারী  ভাল লোক।’

***

বর্ধমান!…  গুপ্ত ডেরাতে বাইরের খবর একেবারে আসত না এমন তো নয়। বর্ধমান অঞ্চলে কাজ করত আর সুচারুদের পরিবারকে চিনত এই রকম কেউ ওর মাতৃবিয়োগের খবরটা এনেছিল। বিষাদের একটা হাল্কা মেঘ ওর মনের উপর দিয়ে ভেসে গিয়েছিল। বাবা যে একলা হয়ে গেলেন, কিংবা বরুণা এই পরিস্থিতিতে কী করবে, এত ভাবার সময় পায়নি। তবে আজ মনে হল, ও তো ছিল একমাত্র সন্তান। ওর জীবনে সামনে চলার রাস্তাটা তো তৈরি করে দিয়েছিলেন এই মানুষটাই। নিজে সামান্য চাকরি করতেন রেল কোম্পানিতে। কর্মস্থল কাছে হবে, সে কারণে এই জায়গায় থাকা। ছেলেকে দিয়েছিলেন ভাল স্কুলে। রেজাল্ট ভাল হওয়াতে সোজা কলকাতার কলেজে। এমন প্রত্যাশা বোধহয় কখনও ছিল না যে ছেলের উপার্জনে আয়েসে থাকবেন। 

[the_ad id=”270084″]

সেই বাবার খুব কাছাকাছি যেতে চেষ্টাও তো করেনি সুচারু। বরুণাকে নিয়ে গ্রামে গিয়ে দু’রাতের বেশি থাকেওনি। গ্রামের জীবন কেমন পানসে লাগত। আবার সে-ই নাকি গ্রামের সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছিল পরেশের কাজের অংশীদার হয়ে। সবটাই আত্মপ্রতারণা। সুচারু আত্মসমালোচনা করল– এই দ্বিচারিতার জন্য কোনও কাজে ও স্থিত হয়নি। আজ বরুণা, বিকু এদের কথা মনে করা কিছুক্ষণের দুঃখবিলাস মাত্র। 

এই ‘সিলেবাসের’ কথা গোপনই ছিল। ব্যাপারটার চেহারা বাইরে  থেকে খানিকটা নিরীহ হওয়াতে কড়া অভিযোগ তৈরি করা যাচ্ছিল না। ‘একজন পাগলাটে মাস্টারমশাই উনি’, এমন ভাবে সুচারুর পরিচয় দিয়ে গ্রামের লোক ওকে বাঁচিয়ে দিল। পুলিশ সুচারুকে ওয়ার্নিং দিয়ে বলল ও যেন ওই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। গ্রামের লোকেরাও মনে করছিল ওখানে থাকা আর নিরাপদ নয় সুচারুর পক্ষে।

ট্রেন আসছে। চায়ের ছোকরাটি বলল, ‘এই ট্রেনে বর্ধমান যেতে মন চায়। কিন্তু কার কাছে যাব?’ 

সুচারুর সিদ্ধান্তগুলি চিরকাল আকস্মিক। এবারও মনস্থির করে ফেলল কিছু না ভেবে। চট করে টিকিটঘরে গিয়ে বর্ধমানের টিকিট কেটে নিল। প্রায় ঘোরলাগা মানুষের মতো ট্রেন থেকে নামল বড়  স্টেশনে। এদিকওদিক চেয়ে দেখল দুটো অটো দাঁড়িয়ে আছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করল কোনওটা ওর গ্রামে যাবে কিনা। অন্য যাত্রী নেই, অটোচালক উৎসাহ দেখাল না। একটা ভ্যানগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। ভ্যানচালক বলল, সে ওদিকে যাচ্ছে কিছু মালপত্তর পৌঁছে দিতে। বাবু ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।

[the_ad id=”270085″]

ভ্যানে যেতে যেতে সুচারু ভেবে উঠতে পারছিল না, ঘটনা কী করে এমন ঝড়ের মতো দুর্দান্ত গতিতে  ঘটে যাচ্ছে। হুড়মুড়িয়ে এসে পড়া স্মৃতির তাড়না ঠেলে কোথায় নিয়ে ফেলবে ওকে কে জানে? ভ্যানে মালপত্র বলতে কয়েকটা বাক্স, দেখলে মনে হয় ওষুধের।
‘ওষুধের দোকান আছে নাকি গ্রামে?’
‘হ্যাঁ বাবু একটা ডিসপেনসারি আছে, হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা হয়, সেখানকার মাল নিয়ে যাচ্ছি।’ ‘আছেন ডাক্তার এখানে? ভাল তো।’
‘বুড়ো বাবু রোজ বসেন, ওষুধ বিলিও করেন। কিন্তু উনি ডাক্তার নন। ডাক্তারবাবু সপ্তাহে তিনদিন বসেন।’ 

‘রুগি হয়?’
‘অনেক হয় বাবু। গরিব মানুষ এখানে বেশি। খুব কম দামে ওষুধ পাওয়া যায়, ভালও হয়ে যায় লোকে। তারা খুব বিশ্বাস করে বুড়োবাবুকে।’              

বাবা যে একলা হয়ে গেলেন, কিংবা বরুণা এই পরিস্থিতিতে কী করবে, এত ভাবার সময় পায়নি। তবে আজ মনে হল, ও তো ছিল একমাত্র সন্তান। ওর জীবনে সামনে চলার রাস্তাটা তো তৈরি করে দিয়েছিলেন এই মানুষটাই। নিজে সামান্য চাকরি করতেন রেল কোম্পানিতে। কর্মস্থল কাছে হবে, সে কারণে এই জায়গায় থাকা। ছেলেকে দিয়েছিলেন ভাল স্কুলে। রেজাল্ট ভাল হওয়াতে সোজা কলকাতার কলেজে। এমন প্রত্যাশা বোধহয় কখনও ছিল না যে ছেলের উপার্জনে আয়েসে থাকবেন।                       

সুচারু দেখল ভ্যান যেদিকে যাচ্ছে ও সেদিকেই যাবে। কিন্তু রাস্তা ঠিক চিনতে পারছে না যেন। ওদের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে না তো! বাবা কি এ জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন? নাকি তিনিও গত হয়েছেন?
‘বীরেনবাবুর বাড়ি ছিল না এখানে? উনি বেঁচে আছেন? এখন বেশ বয়েস হবে, আশির কাছাকাছি।’
‘ও আপনি চেনেন? উনিই তো বুড়োবাবু।’ 

 

বৃত্তান্তর পর্ব ২   
বৃত্তান্তর পর্ব ১   

স্নিগ্ধা সেন পারিবারিক সূত্রে ওপার বাংলার হলেও আজন্ম কলকাতারই বাসিন্দা। চল্লিশ বছরেরও বেশি ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন, প্রথমে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনে, এবং পরে একাধিক ওপেন ইউনিভারসিটিতে। সাহিত্যচর্চার শখ বহুদিনের। আশি পেরিয়েও চর্চা চলছে পূর্ণ উদ্যমে। কলকাতার অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে - গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত দুটি বই – ‘হ্যামলেট’ এবং ‘ওদের কি খেতে দেবে’।

Picture of স্নিগ্ধা সেন

স্নিগ্ধা সেন

স্নিগ্ধা সেন পারিবারিক সূত্রে ওপার বাংলার হলেও আজন্ম কলকাতারই বাসিন্দা। চল্লিশ বছরেরও বেশি ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন, প্রথমে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনে, এবং পরে একাধিক ওপেন ইউনিভারসিটিতে। সাহিত্যচর্চার শখ বহুদিনের। আশি পেরিয়েও চর্চা চলছে পূর্ণ উদ্যমে। কলকাতার অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে - গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত দুটি বই – ‘হ্যামলেট’ এবং ‘ওদের কি খেতে দেবে’।
Picture of স্নিগ্ধা সেন

স্নিগ্ধা সেন

স্নিগ্ধা সেন পারিবারিক সূত্রে ওপার বাংলার হলেও আজন্ম কলকাতারই বাসিন্দা। চল্লিশ বছরেরও বেশি ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন, প্রথমে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনে, এবং পরে একাধিক ওপেন ইউনিভারসিটিতে। সাহিত্যচর্চার শখ বহুদিনের। আশি পেরিয়েও চর্চা চলছে পূর্ণ উদ্যমে। কলকাতার অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে - গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত দুটি বই – ‘হ্যামলেট’ এবং ‘ওদের কি খেতে দেবে’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস