কলকাতা শহরের পুজোকে আমি ভয় পাই।
পুজোর ওই সর্পিল মনুষ্যস্রোত, বরাবরই আমার বুকের রক্ত হিম করে দেয় !
সাধারণত, পুজোর মাসখানেক আগে থেকেই, কলকাতার রাস্তা-ঘাট সভ্য জগতের আসা-যাওয়ার অযোগ্য হয়ে ওঠে!
দশ মিনিটের পথ পেরতে সময় লাগে এক ঘণ্টা।
প্রতিটি মোড়ে সিগন্যালে দাঁড়াতে দাঁড়াতে, আপিস থেকে বাড়ি ফিরে মনে হয়, এইবারই শেষ। সামনের বার, সব ফেলে, বোলপুর পালাবই। আর মহালয়া পার হতে না হতে, ট্রাফিক জ্যাম-ঘর্মাক্ত খিটখিটে অফিস ফেরত লোক, গোটা পনের বিগশপার হাতে মাসিমাগণ, মোবাইলে ব্যস্ত অখুশি টিনএজার, এগরোল হাতে সদ্য বিবাহিতদের আদিখ্যেতা, পাড়ার সর্বজ্ঞ ভদ্রলোকেরা, সিগন্যাল না মানা মোটরসাইকেল আরোহীরা – অস্থির গাড়িবান জনগণ – সদাব্যস্ত পথচারীর ঝাঁক – রাস্তায় নেমে আসা বাজার – ধর্মতলার মোড়কে দার্জিলিং-এর ম্যাল বিবেচনা করা প্রেমিক প্রেমিকার চোরা হাত ধরাধরি, গিট্টু খেয়ে উলটো দিক থেকে ঢুকে পড়া ‘ছোটহাতি’, সর্বোপরি জনগণের গলায় বাঁশ দিয়ে চিল্লামিল্লি মিলিয়ে যে মহাজাগতিক কেওস রচিত হয়, তাতে মনে হয় পুজোর মরসুমে হেঁটে হিমালয়ে পাড়ি দিয়ে দিই!
[the_ad id=”266918″]
আমি আরামপ্রিয়, গুহাপ্রিয় বাঙালি।
পুজোর ঢাকে কাঠি পড়তে না পড়তেই, সেই-ই যে ঘরে ঢুকে পড়ি, দশমীর আগে আর কার সাধ্যি আমাকে বের করে সেই গর্ত থেকে!
বাজার-হাট আগে ভাগে সেরে ফেলা হয়! সেও কম ঝক্কি নয় !
সবজি বাজারে ভিড়, মাছের বাজারে পা রাখা দায়, মুদির দোকানে ফর্দ দিয়ে ঝাড়া এক ঘণ্টা পার করা আর ফলওয়ালার কাছে তো ক্রেতাদের চক্রব্যূহ পার হয়ে পৌঁছনই অসম্ভব।
আমার অবশ্য উপভোগের লিস্টিতে এত কিছু লাগে না – দু’রকম কফি, তিনরকম চা, প্রজাপতি বিস্কুট, নানখাটাই, বাপুজি কেক, একটু চাউমিন, ঘরে পাতা দই, মুড়ি-চিঁড়ে, হলেই দিব্যি চলে যায়! তবে কিনা পুজোর দুপুর-রাতে সামান্য ভালোমন্দ না খেলে বড্ড বঞ্চিত মনে হতে থাকে নিজেকে। উপভোগের ভাঁড়ারে যেন কোথায় কমতি থেকে গেল!
ফেসবুক ভরে যায় খাওয়াদাওয়া এবং রাঁধা-বাড়ার ছবিতে – সে সব দেখে লোভ সামলানো সহজ কম্ম নয় মোটেও। ফলে সে সবেরও যোগাড় রাখতে হয় আমাকেই।
কর্তাকে বাজারে পাঠালে সে ডজন চারেক কলা, গোটা কুড়ি পেয়ারা আর ডাস্টার, পেরেক, সেলোটেপ, গোলমরিচ ক্রাশার ইত্যাদি হাবিজাবি কিনে এনে খেতে বসে, ইলিশ-চিকেনের অভাবে পাঁউরুটি খাওয়ার দাবি জানাতে থাকবে। এবং সেই দাবি পূরণ করতে আমাকে পুনরায় ফিল্ডে নামতে হবে! সেও এক ঝঞ্ঝাট!

ফলে পুজোয় স্বেচ্ছা- গৃহবন্দিত্বকে নিশ্ছিদ্র ভাবে উপভোগ করতে গেলে, ফি-বছর আমাকেই থ্রি কোয়াটার প্যান্টকে ‘নি কোয়াটার’ বানিয়ে (হাঁটু পর্যন্ত তুলে) থলে হাতে বাজারে ছুটতে হয়! আমি এসব ক্ষেত্রে বেশ প্রাচীনপন্থী! ঠান্ডা বিপণির ফ্রোজ়েন ফিশে আমার অ্যালার্জি আছে। চোখের সামনে লাফানো মাছ না দেখলে, আমার স্বাদ কোরক উপভোগের জন্য প্রস্ফুটিত হতে চায় না।
মাছ কিনে, কাটিয়ে এনে, প্যাকেট করে, তাকে রেফ্রিজারেটরে বন্দি করে তবে ছুটি।
সেই যে কথায় বলে, শান্তি চাইলে যুদ্ধে নামো – আমারও সেই এক অবস্থা!
পুজোয় অনন্ত ল্যাদ উপভোগ করতে চাইলে চাইলে আগে সুপার অ্যাকটিভ হয়ে দেখাও।
[the_ad id=”266919″]
তবে দিনকাল চিরকালই এমন ছিল না! কয়েক বছর আগে পর্যন্ত, এক প্যান্ডেল-প্রেমী ছোকরার পাল্লায় পড়ে, আমা-হেন কূপমণ্ডূককেও নতুন জামা-জুতো হাঁকিয়ে ঠাকুর দেখতে যেতে হত! তবে প্রতিটি প্যান্ডেলের আড়াই মাইল আগে কার পার্কিং এরিয়া থেকে আমাকে নড়ানো তারও সাধ্যের বাইরে ছিল। বাপ রে, সেকি ঠাকুর দেখার এন্থু লোকের! দলে দলে পাক্কা আড়াই মাইল হেঁটে গিয়ে, লাইন দিয়ে প্যান্ডেলে ঢুকে, গুঁতিয়ে সেলফি তুলে, আড়াই মাইল পার হয়ে গাড়িতে ফিরে, আবার একশো মিটার গিয়ে গাড়ি থামিয়ে পার্ক করে, আগের ব্যাপারটার অ্যাকশন রিপ্লে করে ফিরে আসা – আমি সেই সব রণক্লান্ত জনতার ঘর্মাক্ত পদযাত্রা দেখতে দেখতে আয়েশ করে কোল্ড ড্রিঙ্কে চুমুক লাগাতাম! সে সব দিন আজকাল নেই। এখন মেহনতই জীবন!

পুজোর চারদিন আমাকে ঘিরে রাখে বই। মানে শারদীয়া পত্রিকা সব। ঢাকের বাদ্যিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে, আনকোরা উপন্যাসের পাতা উলটে যাওয়ার নামই দুর্গাপুজো উপভোগ। নতুন সব কবিতা, গল্প পড়তে পড়তে বিকেল পার হয়ে যায় যে কখন – খেয়াল থাকে না। ঢাক শেষ হয়ে কিশোরকুমার বেজে ওঠে পাড়ার মাইকে – ‘তোমায় পড়েছে মনে’… তারপর ধীরে ধীরে লতা, আশা ! বই রেখে ব্যালকনিতে এসে দেখি, নিচের প্যান্ডেলে বাচ্চারা জড়ো হয়েছে অনেক। মেয়েকে সাজিয়ে দিতে হয় ! সে বন্ধুদের দঙ্গলে মিশে গেলে আমি আয়েশ করে বসি। চা-পাতা ভিজিয়ে কুকিজ় বের করে সাজাই প্লেটে। দার্জিলিং চায়ের সুঘ্রাণ পাক খেয়ে মিশে যায় মণ্ডপ থেকে উঠে আসা ধূপের ভেতর। এ আমার একান্ত উপভোগের ক্ষণ… এই চেনা ঘর, সাদা পাথরের মেঝে, আধখোলা জানালা, হুহু হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার বারান্দা – আর তার ঠিক পাশে উৎসবের মৌতাত – ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যায়।
অথচ আমি নিজের গুহায়। আনন্দ হতে থাকে অকারণে।
দূর থেকে দেখা আনন্দিত মুখ – হৃদয় উপচানো হাসি – এসব দেখে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া হয়!
বুড়ি শহরটাকে কী সুন্দর মানিয়ে যায় লাস্যময়ীর মোড়কে! বড় উপভোগ করি।
প্রতি বছর সন্ধের এই মুহুর্তগুলো আমার একার তাই এত মনের কাছাকাছি!
[the_ad id=”270084″]
এক এক দিন দুপুর, বিশেষ করে সপ্তমীর দিনটায় সিনেমা দেখা রাখি!
আমার মতো সিনেমা-পাগলের কাছে দুনিয়ায় কোনও আনন্দই স্বাদু নয়, সিনেমা বাদ দিয়ে! পুজোর ছবি দেখাটা তাই ‘মাস্ট’।
সিনেমা হলেরও রূপ খুলে যায়! চারিদিকে কেতার পাঞ্জাবি, শাড়ির খসখস আওয়াজ – অনভ্যস্ত কিশোরীর লাজুক ভঙ্গি, নার্ভাস যুবকের ইতিউতি চাউনি, ভারি ভাল লাগে দেখতেও।
এসব দেখতে দেখতে ছবি শুরু হয়!
ডায়েটের পাহারা ভুলে গিয়ে, কোক কিনে আনি ইন্টারভ্যালে। কিংবা চিনি দুধ দেওয়া রাজকীয় কফি!
বিকেলের আগে বাড়ি ঢুকে যাব তাই, ছবি শেষ হতে না হতেই একছুটে ফেরা। কারণ ঠাকুর দেখার ঢল কাটিয়ে বাড়ির পথ সুগম থাকে না একেবারেই। তার আগে, তুলে নিই আরও কিছু পত্রিকা। ম্যাগাজিনের দোকান থেকে।
মাল্টিপ্লেক্সের পর থাকে ওয়েব সিরিজের হাতছানি! সবাই যখন অষ্টমীর অঞ্জলিতে ব্যস্ত, প্ল্যান করতে থাকি কী কী দেখা যেতে পারে! লুচির সকালের পর, বাকিরা ঘুমাতে গেলে আমি খুলে বসি অ-দেখা ওয়েব সিরিজ় কিংবা হঠাৎ টেলিভিশনে পেয়ে যাওয়া পুরনো প্রিয় ছবি।
চরিত্ররা ভিড় করে আসে। পুরনো ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনে পড়ে, সেই সব হারানো বন্ধুদের কথা, যাদের সঙ্গে একদা দেখেছিলাম সে সব সিনেমা!
রঙিন সেলুলয়েড একই রয়ে গেছে। মানুষগুলো কেবল ধূসর আয়নায় জায়গা করে নিয়েছে। সুখের মতো ব্যথা করে বুকের ভেতর !

পরিকল্পনা এবং আগাম বার্তা না দিয়ে বন্ধু-বান্ধবরা এসে উপস্থিত হয় এবং আড্ডাও হয় এক রাতে।
নবমী নিশিতে কেউ কেউ এসেই যায় বাড়িতে। মাদুর পেতে বসে সবাই ছিটিয়ে।
চট করে গোবিন্দভোগ চাল, সোনামুগ ডাল, নতুন ফুলকপি, আলু, কাঁচালঙ্কা দিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিয়ে আসি।
মাইক থেকে যায় – মেঝেতে বাবু হয়ে বসে গান ধরে কেউ – কেউ উদাস তাকিয়ে বাইরে – কারও আবার কফি চাই – কেউ চা খাবে বলে – আমি ছোটাছুটি করতে করতেই দেখি রাত পেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। রাত শেষ মানে গান শেষ। পুজোও। এমনকি ছুটিও। এবারই আমার সবচেয়ে পছন্দের মুহুর্ত! উপভোগের মিষ্টিসুখ!
[the_ad id=”270085″]
উৎসব শেষ। বাধ্যতামূলক আনন্দের সুর মিলিয়ে দ্রুত মিলিয়ে আসা হেমন্তের দিন, বড্ড আপন লাগে। আবার ডাল-ভাত-মাছ রান্না শুরু। পুজোর পোশাক কেচে তুলে রাখা। বাজনা ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলে স্বস্তির নীরবতা। মণ্ডপে ঝাড়বাতির জায়গায় ছোট্ট প্রদীপ।
মাইকের শব্দকে রিপ্লেস করে শাঁখের আওয়াজ। রাস্তা ফাঁকা হয়ে আসে। মেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে।
জমে থাকা কাজ শেষ করতে থাকি। এইবার জীবন যেন ছন্দে ফেরে!
সে বড় মধুর ফেরা – সে বড় মধুর উপভোগ – নিত্য পথের আসা-যাওয়ায় ভাল থাকি! বেশি ভাল থাকি।
ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি করে আদিতি কলেজে ও স্কুলে পড়িয়েছেন। এখন অবশ্য যুক্ত সাংবাদিকতার সঙ্গে। আদতে কবি হলেও গদ্য লেখেন প্রায়শই। প্রিয় কাজ বারান্দায় মোড়া পেতে বসে পড়াশোনা। শখ বেড়ানো। প্রকাশিত বই 'সাড়ে তিনটের উড়োজাহাজ', 'একশো সাতান্ন রকম মিথ্যে', 'অসতীপ্রবণতা' ইত্যাদি। পেয়েছেন মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরষ্কার।
2 Responses
She is my all time favorite writer and poet. I like to read her writing more often. Keep it up Nandini.
se boro modhur fera – aha, protibar jeno emon korei niyome firi