ছেলেটা ছোট, বড্ডই ছোট। তাকে কীভাবে বলা যায় অমুক দিন থেকে তার বাবা মা আলাদা থাকবে? আলাদা মানে শুধু দুটো আলাদা বাড়ি নয়, আলাদা জীবনও। খাওয়ার মেনু থেকে টিভির চ্যানেল, বেড়ানোর জায়গা থেকে বন্ধুবৃত্ত, ছোট ছোট বহু অকিঞ্চিৎকর অভ্যেস– সেই দুটো জীবনের ভিন্ন ভিন্ন। যতই ঝিল্লি ছেলেকে আগলে রাখার চেষ্টা করুক, ওরও তো জীবনের অনেকখানি পালটে যাবে। সকালে, বিশেষত শীতের সকালে ছেলেটা কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে চায় না। অরুণাভ অনেক বাবা-বাছা সোনা বলে তুলে খানিকটা কোলে নিয়ে ঘোরালে তবে তার ঘুম কাটে। ঝিল্লি তো সেই সময় ভীষণ ব্যস্ত। অতখানি সময় ধরে ছেলেকে ঘুম থেকে তোলা তার পক্ষে অসম্ভব।
রান্নার ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে বলে সবজি কাটা, প্রয়োজনে মশলা বেটে নেওয়া, সবটাই ও নিজের হাতে রাখতে চায়। তার ওপর ছেলের জন্যে এক একদিন একেকরকম টিফিন। টিফিন বানাতে বানাতে ঝিল্লি দেখে অরুণাভ ছেলেকে টয়লেট করিয়ে ব্রাশ হাতে টিভির সামনে বসিয়ে দিয়েছে। ব্যস অমনি ওর মাথায় চড়াক করে রাগ চড়ে যায়। একটা বাচ্চার সকাল শুরু হবে কার্টুন নেটওয়ার্ক দিয়ে? একটা স্কুলে পড়া বাচ্চার! ঝিল্লিরা ছোটবেলায় ঘুম থেকে উঠেই মুখ ধুয়ে বিস্কুট খেয়ে বই নিতে বসত। বই না ছুঁয়ে সকাল শুরু হবে? অরুণাভ বলে ‘তুমি সেই মফসসলেই পড়ে রইলে। বাচ্চাদের দিনটা লটস অফ ফান অ্যান্ড হ্যাপিনেস দিয়ে শুরু করতে হয়। বই ওদের স্মাইলি দ্যায় না, বই হচ্ছে ওদের কাইন্ড অফ এনিমি…’
তা সেই লটস অফ ফানের দরজা পর্যন্ত তো ও বাবার কোলে চড়েই আসত। সেসব ও এখন কোথায় পাবে? সংসার চালাবার জন্যে ঝিল্লিকে তো চাকরি করতে হবে। ও তো ছেলেকে আর এত সময় দিতে পারবে না। দু’জন মানুষের ছায়া থেকে সরে ওকে আধখানা, তাও খিটখিটে অসুখী এক মানুষের তর্জনে গর্জনে বড় হতে হবে।সেটা কি একবারও ভাবল অরুণাভ? কথাগুলো অরুণাভকে বলবে না ভেবেছিল ঝিল্লি। বললে হয়তো অরুণাভ ভাববে ঝিল্লি তার কাছে ভিক্ষে চাইছে, এইভাবে ছেলেকে ঢাল করে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করছে, এইভাবেই ও অরুণাভকে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু যতই ও অরুণাভহীন জীবনের কথা ভাবল, ভাবল অরুণাভকে জড়িয়ে ছেলের ছোট ছোট অভ্যেস, আবদার, আনন্দের কথা– তত কথাগুলো বলার জন্যে হাঁপিয়ে উঠল সে। একদিন কথার ভার সে আর ধরে রাখতে পারল না।

অরুণাভ বেরবে, ভাত বেড়ে তার সামনে দিতে দিতে নিজের কথাগুলো একটু গুছিয়ে নিল। ভাত থেকে ধোঁয়া উঠছিল, সামনে বড়ি দিয়ে উচ্ছে-বেগুন, চিংড়ি দিয়ে মোচা, পোস্তর বড়া এবং পাবদার ঝাল। এই সমাহারের সামনে জগতের অতি বড় তালেবরও টলে যাবে, অরুণাভর মনে হল কোথাও যেন একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মধ্যরাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো রক্তপাতহীন বিচ্ছেদ এবং বাই-প্রোডাক্ট স্বাধীনতা। বরং প্রত্যাশিতই ছিল অন্তর্বর্তী এই সময়ে প্রতিদিন তুমুল কলহ, অকথ্য গালিগালাজ, কাপ ভাঙা, চুল্লি না জ্বালা। তার বদলে ঝিল্লি শান্ত সমাহিতভাবে জটিল ও সূক্ষ্ম সব রান্না করছে এবং সাজিয়ে দিচ্ছে তার সামনে, এ রীতিমতো অত্যাচার। এর থেকে ঝিল্লি যদি প্রাকৃত ভাষায় বলত ‘দু’দিন পরে যে ভাতার ভাত দেবে না, তার ভাত আমি রাঁধতে পারব না…’ তাহলে ঠিকঠাক লাগত। ভাত ভাঙতে ভাঙতে অরুণাভ ঝিল্লির দিকে তাকাল সোজাসুজি, বহু মাস পর। ওপর থেকে একইরকম চেহারা, শুধু চোখ দুটো লালচে ফোলা ফোলা। ঝিল্লি কি রান্না করতে করতে কাঁদছিল? অরুণাভকে তাকাতে দেখে ঝিল্লি বলে
– কী হল, কিছু লাগবে?
এটাই কি সে বলতে চেয়েছিল আদৌ?
অরুণাভ রাগে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে থালা, বলতে চাইছে,
– ঝিল্লি তোমার এই ন্যাকামি বন্ধ করো।
অথচ মুখে সে বলল,
– উচ্ছেটা না খেলে হয় না?
– না হয় না। তুমি যদি তেতো না খাও, ছেলে তোমাকে দেখে কী শিখবে? আচ্ছা গিমে শাক দেখো না বাজারে? গিমে শাক! হায়, এটাই কি বলতে চেয়েছিল ঝিল্লি?
– তুমি তেতো খেতে ভালোবাসো, না ঝিল্লি?
ঝিল্লির লালচে নিষ্প্রভ চোখদুটোতে নিমেষে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে। সে চলে যায় তার ছোটবেলায়। ভাতের সঙ্গে প্রথম পাতে তেতো খাওয়া তাদের বাড়িতে বাধ্যতামূলক ছিল। মায়ের কড়া নির্দেশ ছিল ‘তেতো না খেলে মাছ তুমি পাবে না।’ ফলে মেছো ঝিল্লি মাছ না পাবার ভয়ে তেতো খেয়ে নিত নিরুপায় হয়ে। পরে সেটাই ভালোবাসায় দাঁড়িয়ে যায়। তেতো মানে শুধু উচ্ছে বা করলা নয়। (অনেকে তো উচ্ছে আর করলার তফাতও বোঝে না) কতরকম তেতো হত তাদের বাড়িতে। নিম-বেগুন, গিমে-বেগুন, পলতা পাতা বা শিউলি পাতার বড়া, শুক্তো তো আছেই। ছোট মাছ দিয়েও শুক্তো করত মা। তবে জগতে যত তেতো আছে, যুক্তিফুলের মতো তেতো আর কিছুই নয়। সবুজ যৌগিক ফুলের মতো দেখতে এই সবজিটি বড়ি বেগুন দিয়ে মা চচ্চড়ি করত। তার তিক্ত স্বাদ পরের মহার্ঘ্য সব মাছ, মাংস, চাটনি, দই, খেলেও যেত না জিভ থেকে।

জিভ? না কি স্বাদ লেগে থাকে স্মৃতিতে? তার ছেলের কী থাকবে তাহলে? বাবা হইচই করে কিছু একটা এনে ডাকছে
– দেখে যাও কী অসাধারণ মাছ!
মা রাগ করে বলছে
– এত রাতে আবার?
তারপর কিন্তু কাটতে বসে যাচ্ছে। কিংবা বাবার সেই ইলিশ মাছ কাটা দেখতে ভিড় করে দাঁড়াচ্ছে তারা দুই ভাই বোন, এমনকি মা-ও। এই যূথচারী জীবন না থাকলে স্বাদ থাকে খাবারের? স্মৃতি কী বয়ে নিয়ে যাবে তবে? সে শূন্য চোখে তাকিয়ে বলল
– তেতো শরীরের জন্যে খুব দরকার। ছেলেটা তো তেতো খায়ই না, শুধু খুব কড়া করে উচ্ছে ভেজে দিলে… অরুণাভ মোচাচিংড়ি দিয়ে এক গ্রাস ভাত মুখে তুলে বলল,
– ওর পরীক্ষা যেন কবে?
– ফেব্রুয়ারির ফার্স্ট উইকে।
– মানে আরো পাঁচ মাস। পাঁচ মাস কি তোমার যথেষ্ট মনে হয় ঝিল্লি?
ঝিল্লি তীব্র চোখে তাকায় অরুণাভর দিকে। মোচার নরম শরীর জিভে অনুভব করতে করতে চোখ নামিয়ে নেয় অরুণাভ। জল দিয়ে ভাতটা কোনওরকমে গিলে সে আবার বলে,
– আমি জানি যথেষ্ট নয়, পরীক্ষাটা নষ্ট হয়ে যাবে।
শুধু পরীক্ষা! আর জীবনটা? ঝিল্লি কেবল বলে,
– একটু ভাত দিই?
ভাত দেওয়া, ভাতের বাটি সরিয়ে নেওয়া, এমনকী অরুণাভর এঁটো থালাবাটিও বেরবার আগে মেজে ফেলা পর্যন্ত (মা বলত এঁটোচণ্ডী রাগী দেবতা, কাজকর্ম উল্টোপালটা করে দেন।)– এইসব থেকে বেরতেই পারছে না ঝিল্লি। ও কী করে তাহলে ছেলেকে একা হাতে মানুষ করবে? ও নিজেই তো মানুষ নয় পুরোপুরি। রান্নাঘরে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিল্লি। আর সেই কান্নার আওয়াজ ভারি আরাম দ্যায় অরুণাভকে। এতক্ষণে সব ঠিকঠাক মনে হয় তার। তার চোখ থেকেও দু’ফোঁটা জল ঝরে পড়ে ভাতের ওপর। একটু বেশি নোনতা হয় খাবারের স্বাদ। সে বলে,
– ঝিল্লি, আমি বলি কি, এই পাঁচটা মাস আমরা সবাই এখানেই থাকি। একসঙ্গে। ছেলেটার পরীক্ষা হয়ে যাক। তারপর ধরো এপ্রিলে, এপ্রিলেই তো পয়লা বৈশাখ পড়বে..
বলতে বলতে সে খাওয়া ফেলে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। এখানে, সারাবাড়িতে মাত্র এখানেই রান্নাঘরের দরজার পেছনে একটা বাংলা ক্যালেন্ডার ঝিল্লি সেলোটেপ দিয়ে সেঁটে রেখেছে। বিশেষ বিশেষ তিথিতে নিরামিষ খাওয়ার কথা মনে রাখার জন্যে। সেইটা দেখতে এসে অরুণাভ দেখতে পায় রান্নাঘরের মেঝেতে ঝিল্লি পড়ে আছে রক্তের নদীর মধ্যে।
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৯ আগস্ট ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Shutterstock
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।
One Response
এত বাস্তব, অথচ কী বাঙ্ময় নীরবতা ! বড় ভাল লাগছে এই অপেক্ষা।