প্যারিসে এসেছি বেশ দিনকয়েক হল। টুকটাক কিছু দরকারি কাজ, পাশাপাশি চলেছে শহরটার আনাচকানাচে টহলদারি।
বড় রাস্তাগুলো দু’পাশে একই ধরনের স্থাপত্য নিয়ে একটু একঘেয়ে। কিন্তু আশপাশের কোনও পাথরবাঁধাই গলির রাস্তা ধরলেই মৃদু, ছায়াময় একটা আমেজ। সেখানে জিপিএস ব্যবহার করতে মন না-ও চাইতে পারে। এলোমেলো আন্দাজে ভিক্তর উগোর বাড়ি বা দালি মিউজিয়াম খুঁজতে খুঁজতে একটু ক্লান্ত লাগলেই পেয়ে যাচ্ছি পথচলতি কোনও ক্যাফে। ঝুপ করে পেভমেন্টের কোনাচে একটা টেবিল দখল করে বসে পড়লেই হল। তারপর একপাত্তর ওয়াইন, বা কফি উইথ ক্রিম, নিদেনপক্ষে একটা এস্প্রেসো শট নিয়ে কেটে যাবে অনেকটা সময়। সঙ্গেই থাকছে ‘আ মুভেবল ফিস্ট’ বইটা। হেমিংওয়ের চোখ দিয়ে প্রায় একশো বছর আগেকার প্যারির চালচিত্র খোঁজার একটা বায়বীয় প্ল্যান আঁকতে আঁকতেই চেয়ে নিচ্ছি দ্বিতীয় কাপ কফি। বিকেলের মেহগনি আলোয় লাবণ্যময় এই শহরটার আলগোছে বয়ে চলা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে মিউজিয়ামটা আজ থাক বরং? চিনেই তো গেলাম চত্বরটা, পরে আসা যাবে। আছি তো ক’দিন। একটু অলস টাইপের লোকের জন্যে প্যারিস ভারি মনোরম জায়গা।

আস্তানা গেড়েছি মমার্ত পাড়ায়। উনিশ শতকের শেষদিক থেকে বেশ কয়েক দশক এই অঞ্চল ছিল বোহেমিয়ান আর্টিস্টদের খাসতালুক। ভ্যান গঘ, পিকাসো, রেনোয়া, ক্লদ মোনে সহ বেশ কিছু শিল্পী তাদের ফেনিল, বর্ণময় সময় কাটিয়েছেন এখানে। সেই উদ্ভাসিত বাউণ্ডুলেপনার দিকচিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মমার্তের অলিগলিতে। রয়েছে একটা উনিশ শতকীয় ক্যাবারে, আস্ত একটা আঙুরখেত (যেটা থেকে একটা মহার্ঘ্য কিন্তু বেশ খারাপ ওয়াইন তৈরি হয়) আর দুর্দান্ত কয়েকটা মিউজিয়াম। আর রয়েছে প্লেস দ্যু তেরত্রে-র উঠতি আঁকিয়ের দল, জমজমাট চত্বরটায় পৌছলেই যাঁরা ঘিরে ধরবে আপনাকে। আর চাইলে কয়েক মিনিটেই আপনি পেয়ে যাবেন ছিমছাম একটা ছবি, অল্প পয়সাতেই।
তবে এই পাড়ায় আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা দু’টো। সন্ধের ঝোঁকে সাক্রে ক্যুর ব্যাসিলিকার উলটোদিকের সিঁড়িতে বসে একটা পানীয় নিয়ে বিনি পয়সার লাইভ কনসার্ট শুনতে শুনতে সামনের আদিগন্ত ছড়িয়ে থাকা প্যারিস শহরের ওপর কী ভাবে গোধূলির ম্যাজিকটা তৈরি হচ্ছে সেটা দেখা। তারপর গুটিগুটি ল্য কন্সুলাতের লাগোয়া টেরাসে একটা ফাঁকা টেবিল বেছে বসে পড়া। খাঁটি ফরাসি কায়দায় ডিনার সারতে লাগে পাক্কা দু’ঘণ্টা, অতটা নাহলেও চলে। কাটছাঁট করেও ঘণ্টাখানেকের মামলা। তার মধ্যে আপনি বুঁদ হয়ে ভাবতে থাকুন এই রেস্তোরাঁর টেরাসে আর ভেতরের বার্নিশ করা আদ্যিকালের টেবিলগুলোয় আনাগোনা লেগেই থাকত তুলুজ-লত্রেক, আলফ্রেড সিজলি, ভ্যান গঘ বা পরে খোদ পিকাসোর। আধো আলোয় ডেরায় ফেরার পথে পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করবে, গলায় এক ফোঁটা আবসান্থ না ঢেলেও। গ্যারান্টি।

‘আ মুভেবল ফিস্ট’ বইটার কথা বলছিলাম। প্যারিসে এটাই আমার গাইডবুক। তার একটা গোটা চ্যাপ্টার হেমিংওয়ে বরাদ্দ রেখেছেন একটা বইয়ের দোকানের জন্য। শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং। এর ঠিকানা প্যারিস লেফট ব্যাংক। যে অঞ্চল সম্বন্ধে বলা হয় এই শহরটা ভাবতে শিখেছিল সেইন নদীর এই দক্ষিণ পাড় থেকেই। নত্র দাম গির্জা থেকে নদী পেরিয়ে লাতিন কোয়ার্টারে ঢোকার মুখেই এই দোকান।
১৯১৯ সালে সিলভিয়া বিচ (Sylvia Beach) নামে এক আমেরিকান প্রকাশক দোকানটা খুলেছিলেন। অবশ্য অন্য এক ঠিকানায়। বছর দুয়েক পর সেটা সরে আসে রু ওদিয়ঁ নামে কাছাকাছি একটা রাস্তায়। ১৯২২ সালে সিলভিয়া এখান থেকেই প্রকাশ করলেন জেমস জয়েসের ইউলিসিস। ব্রিটেন এবং আমেরিকায় বইটা তখন নিষিদ্ধ। পরবর্তী দু’দশক এই শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং হয়ে উঠবে প্যারিসের অ্যাংলো-আমেরিকান সাহিত্যিকদের ভরকেন্দ্র, যেখানে আড্ডায় মাতবেন এজরা পাউন্ড, স্কট ফিটসজেরাল্ড আর গারট্রুড স্টেইন, সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন নিয়ে তর্ক জুড়বেন পল ভালেরি আর মান রে। আর হেমিংওয়ে যৌথ পাঠচক্রে আসবেন স্টিফেন স্পেন্ডারের সঙ্গে। প্রায় একটা সাহিত্য-কমিউন, যেটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় ১৯৪১ সালে, নাৎসি বাহিনী যখন প্যারিস দখল করে নেয়। একটা গল্প চালু আছে যে, একজন নাৎসি অফিসারকে জয়েসের ফিনিগান’স ওয়েক বইটা বিক্রি করতে অস্বীকার করেছিলেন সিলভিয়া। সেই কারণে দোকানটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যুদ্ধ থেমে যাবার পর হেমিংওয়ে দোকানটা খোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন বটে, তবে শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং, যার নাম জয়েস দিয়েছিলেন স্ট্র্যাটফোর্ড-অন-ওদিয়ন, তার ঝাঁপ আর খোলেনি।
এই গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু ১৯৫১ সালে। জর্জ হুইটম্যান। আমেরিকান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মেডিকেল ওয়ারেন্ট অফিসার। তার আগে চষে বেড়িয়েছেন গোটা লাতিন আমেরিকা – হেঁটে আর হিচহাইক করে। ১৯৪৬ সালে তিনি হাজির হলেন প্যারিসে, সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আনখশির বইপাগল জর্জের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় তালা দেওয়া থাকত না, যাতে যে কেউ এসে যখন খুশি নিশ্চিন্তে পড়তে পারে জর্জের বাড়ির বইয়ের বিশাল সম্ভার থেকে। ১৯৫১ সালে নিজের কালেকশন নিয়েই জর্জ শুরু করে দিলেন ‘লে মিস্ত্রাল’। বইয়ের দোকান, সেইন নদীর পাশে। বছরকয়েক বাদেই তার নাম বদলে হবে শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং, একেবারে পুরনো দোকানটার মতো তার স্বভাবচরিত্রও। অ্যালেন গিনসবার্গ, গ্রেগরি করসো, জ্যাক কেরুয়াক আর তাদের বিট আন্দোলনের একটা জায়গা হয়ে উঠবে এই নতুন দোকান। দেখেশুনে সিল্ভিয়া বিচ সানন্দে রায় দেবেন – জর্জ হুইটম্যান তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি! (স্পিরিচুয়াল সাক্সেসর)
ফ্রান্সিস এখন একটা কাজ করছে স্পেনের কবি লোরকার ওপর। দোতলার ঘরগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর ফাঁকে লাজুক হেসে জানাল, এরপর এখানে থেকে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে। কাউন্টারে বেশ ভিড়। ফ্রান্সিস সেখানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর হলুদ আলো জ্বলা, ভুরভুর করে পুরনো বইয়ের গন্ধে মাতানো কয়েকটা ঘরের মধ্যে আমি চরকিপাক খেতে খেতে প্রায় গুপ্তধনের মত খুঁজে পেতে থাকলাম ‘লেডি চ্যাটার্লি’জ লাভার’-এর একটা প্রাচীন এডিশন, উইলিয়াম বারোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ বইটা।
বুকস্টোর লাগোয়া ক্যাফেটায় আলাপ হল ফ্রান্সিসের সঙ্গে। স্পেনের গ্রানাদা শহর থেকে আসা অল্পবয়েসি একটা ছেলে। সপ্তাহ তিনেকের জন্যে সে এখন এই বইয়ের দোকানের বাসিন্দা। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং শুধুমাত্র একটা বইয়ের দোকান নয়, দুনিয়াজুড়ে উঠতি লেখক-কবি-শিল্পীদের জন্যে তার দরজা খোলা। দোতলার প্রাচীন চেহারার বইয়ের ক্যাবিনেটের ফাঁকে ফাঁকে পাতা সরু বিছানাগুলোয় তারা থাকতে পারে। একদম নিখরচায়। বদলে রোজ ঘণ্টা দু’য়েকের জন্যে দোকানের কাজে সাহায্য করতে হবে। আর শর্ত হল প্রতিদিন লেখার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। গত সত্তর বছরে প্রায় তিরিশ হাজার লেখক-কবি লেখালেখির কাজ করেছে এখানে ডেরা বেঁধে, শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং তাদের স্বপ্নকে আগলে রাখার একটা নিশ্চিন্ত ঠিকানা।
ফ্রান্সিস এখন একটা কাজ করছে স্পেনের কবি লোরকার ওপর। দোতলার ঘরগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর ফাঁকে লাজুক হেসে জানাল, এরপর এখানে থেকে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে। কাউন্টারে বেশ ভিড়। ফ্রান্সিস সেখানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর হলুদ আলো জ্বলা, ভুরভুর করে পুরনো বইয়ের গন্ধে মাতানো কয়েকটা ঘরের মধ্যে আমি চরকিপাক খেতে খেতে প্রায় গুপ্তধনের মত খুঁজে পেতে থাকলাম ‘লেডি চ্যাটার্লি’জ লাভার’-এর একটা প্রাচীন এডিশন, উইলিয়াম বারোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ বইটা। প্যারিস রিভিউ আর গ্রান্টা পত্রিকার নব্বই দশকের দুটো কপি। একটা ঘরের দেওয়ালে একটা সবুজ বোর্ড, সেখানে সারা পৃথিবীর পর্যটকরা চিরকুটে লিখে রেখেছেন এই বইয়ের দোকান নিয়ে তাদের মুগ্ধতার কথা। একটা ছোট্ট কাগজে আমিও সেঁটে রাখলাম কয়েকটা শব্দ। বাংলায়। বেরিয়ে আসছি, চোখে পড়ল একটা দরজার ওপর বেশ বড় করে লেখা ‘Be not inhospitable to strangers, lest they be angels in disguise. …’ ।
ফোটোগ্রাফার। লেখক। ইন্দোনেশিয়ার সালফার শ্রমিকদের ওপর ছবি তুলতে নেমেছেন আগ্নেয়গিরির মধ্যে, কাশ্মীরের মানুষের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখবেন বলে বারবার ফিরে গেছেন অশান্ত উপত্যকায়, চীন-ভিয়েতনামের অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়ান নতুন গল্পের খোঁজে। সেইসব লেখা-ছবি নিয়মিত বেরোয় দেশবিদেশের পত্রিকা-জার্নালে। তার মধ্যে আছে আল জাজিরা, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ট্রাভেলার, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ম্যাগাজিন। প্রকাশিত কফিটেবল বই ‘অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ডঃ আ ভিসুয়াল মেমোয়ার অফ লাদাখ’। নির্ভেজাল আরাম পান আড্ডা দিয়ে, আর বাংলায় লেখালেখি করে। আদ্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, তবে উত্তরের পুরনো বাড়ি, অলিগলি আর তার প্রাচীন কাফেগুলোর ওপর প্রবল টান।
One Response
Hoye Elam Shakespeare and Co. te..
Chobi r moto lekha..ar sathe itihash