সাধারণত শীতের শুরুতেই বাইরে যাওয়ার ইচ্ছেটা চাগাড় দেয়। তবে প্রকৃতি যে প্রতিটি মরশুমেই তার অফুরান সৌন্দর্য ভাণ্ডার রঙে-রসে অতুলনীয় করে সাজিয়ে রাখে, আর সেটা উপভোগ করতে গেলে যে প্রতিটি মরশুমেই একবার তার কোলে-পিঠে ঘুরে আসতে হয়, সেটা প্রথম বুঝলাম বছর পঁচিশ আগে মাইকতোলি ঘুরে আসতে গিয়ে। যাত্রাপথে সুন্দরডুঙ্গা পর্বত। তার হাতায় নানান ফুলের মেলা, টলটলে গ্লেশিয়ার আর সারি সারি জানা অজানা হিমলচূড়া। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে আধুনিক যন্ত্রদানবের কল্যাণে পথ অনেক কমে গেছে প্রতিটি দিকেই। আমার স্বপ্নের পায়ে চলা পথগুলো অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে। তবুও বলব সময় হাতে নিয়ে হাঁটুন। বিশেষত, আমার মতো পথ-পাগল মানুষদের সব দেখতে দেখতে, জাল বুনতে বুনতে সময় নিয়ে যাওয়াটাই এ পথে ট্রেকের সেরা উপায়।
আগেই বলেছি, গন্তব্য স্থির হয়েছে মাইকতোলি বেস ক্যাম্প। এ পথে আমার পূর্বপরিচিত গাইড বিখ্যাত রূপ সিং আছে। তাকে চিঠি লিখে দিলাম। তখনও মুঠো-ফোনের রমরমা হয়নি। এখন অবশ্য ওদের সবারই ফোন আছে। এখানে আরেকটা কথা বলে নেওয়া ভালো, এই গাইড কিন্তু ট্রেকপথে সর্বঘটের কাঁঠালি কলা। খাওয়া, শোওয়া, আকাশের অবস্থা, মোট বওয়া সব দায়িত্ব ওই একজনের। সে যেন একরকম ট্রেকারদের জন্য বলিপ্রদত্ত। এবার যাত্রা শুরু। তার আগে একটু প্রস্তুতিপর্ব সেরে নিই। জানিয়ে দিই যে এ পথে তাঁবুর দরকার হবে না। উইন্ডচিটার এবং স্লিপিংব্যাগ, ভাল জুতো এবং শীতের জামাকাপড় অবশ্য আনয়নযোগ্য। তাছাড়াও কিছু শুকনো খাবার দাবার, ওষুধপত্তর এবং অবশ্যই কৌটোভরা নুন। কারণ পথজুড়ে প্রবল জোঁকের উৎপাত।
এবার তাহলে জয় মা বলে বেড়িয়ে পড়া যাক!
২৫ মে
হাওড়া থেকে অমৃতসর মেলে রওনা হলাম আমি আর আমার তিন সঙ্গী। ২৬ সকাল পটনায়, দুপুর বারাণসীতে আর বিকেল হল লখনউতে। বড় ট্রেনের যাত্রা সেখানেই ইতি। পৌনে পাঁচটা নাগাদ নেমে প্রবল গরমে লস্যিবাজারে ঢুকে লস্যি, ঘোরাঘুরি। রাত নটা নাগাদ মিটারগেজের ছোট্ট গাড়ি নৈনিতাল এক্সপ্রেস।
২৭ মে
সকাল সাতটায় লালকুঁয়া। স্টেশনের বাইরেই সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে যাত্রীর অপেক্ষায়। দরদাম করে তারই একটাতে মালপত্র উঠিয়ে রওনা হলাম। গন্তব্য ১২৬ কিলোমিটার দূরের সাং গ্রাম।
একটু সমতলের পর চড়াই শুরু। ২৩ কিলোমিটার পেরিয়েই উঠে পড়লাম ৪৫০০ ফুট উঁচুতে – অপরূপা ভীমতাল। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা নৈঃশব্দপুরী! টলটলে নীল জলের হ্রদ। আশপাশে জানা অজানা ফুলেল জঙ্গলের বিস্তার। খানিক চোখ জুড়িয়ে নিয়ে ফের চলা। আরো ৫০ কিলোমিটার পরে আলমোড়ায় দুপুরের আহার। আবার চলা। ৭৩ কিলোমিটার পেরিয়ে এসে পৌঁছলাম শৈবতীর্থ বাগেশ্বর। সরযূ গোমতির সঙ্গমে এই বাগেশ্বর আমার মতে মোটের ওপর একটা জংশন। নয় তো কি? সোজা গেলে পিন্ডারি, মাইকতোলি, সুন্দরডুঙ্গা। বাঁয়ে গেলে গোয়ালদাম, রূপকুণ্ড, হোমকুণ্ড। ডাইনে চৌকুরি মুন্সিয়ারি হয়ে মিলাম। যেদিকে পা বাড়াবেন অরূপের হাতছানি। আমরা এগিয়ে চললাম। আরও ২৪ কিলোমিটার পেরিয়ে কাপকট ছুঁয়ে ভারারি। চায়ের তাগাদা উঠল দলে। চা খেতে বসা হল। কাপ হাতে কেউ কেউ এগিয়ে গেলেন কুলি, গাইড, রেশন ইত্যাদির কথা জানতে। এটাই কিনা এ পথের শেষ বাজার, তাই। তবে রূপ সিংয়ের নাম শুনে সব কুলি-গাইডের দলই দেখি ধীরে ধীরে কেটে পড়ল। আমরা হাল ছেড়ে এগোলাম সাং-এর দিকে।
এ অঞ্চলের মানুষ সাধারণত সকলেই বেশ সৎ ও কর্মঠ, এখনো। সাং-এ পৌঁছে দেখি, একটা সব পেয়েছির দোকান। মালিকের নাম মহীপাল সিং কুমলটা। আর সামনে নায়কের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আমাদের মুশকিল আসান রূপ সিং। ব্যাস, হয়ে গেল সব সমস্যার সমাধান। আমাদের রুকস্যাক টেনে নিয়ে নিল সে। তারপর দেখি একটা জিপ-ও ঠিক করে রেখেছে! যাব কোথায়? না ৫০০০ ফুট উপরে লোহারক্ষেত বাংলো। এই রাস্তায় যত বাংলো আছে সবের মালিকানাই হয় কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগম নয়তো পিডব্লুডি-র। অগ্রিম বুকিং হয় না, তবে মোটামুটি সবাই জায়গা পেয়ে যায়। প্রতিটি বাংলোতে ব্যবহারের জন্য কাঠ ও বাসনপত্র পাওয়া যায়।

২৮ মে
শীত খুব বেশী নেই। লোহারক্ষেত থেকে হাঁটা শুরু হল। প্রথম ন’কিমি পথ খাড়া চড়াই। ৫০০০ থেকে ৯২০০ ফুট। তারপর কিলোমিটার দু’য়েক উতরাই এসে ঢাকুরি পাস। উচ্চতা ৮৭০০ ফুট। চারধারের পাহাড়ে সবুজের হাল্কা গাঢ় রকমফের। ঢাকুরি পাসে পৌঁছে সবাই বসে পড়লাম। না, শুধু বিশ্রামের জন্যে নয়। সামনে সারি সারি উদ্ধত পর্বতশৃঙ্গ মাথা উঁচিয়ে নিল আকাশের গায়ে নাক ঘষছে। রূপ সিং বলল সেগুলোর একটা পরিচিতি দেবে। আমরা বাধ্য ছাত্রের মতো সারি দিয়ে বসে শুনতে লাগলাম কানে ঝিম ধরিয়ে দেওয়া সে সব নাম। মাইকতোলি, পানোয়ালিদুয়ার, ভামোটি, আরকোট, মৃগথুনী, নন্দাখাত, টেন্টপিক। ডানদিকে তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ের উপরে একটা মন্দিরের অবশেষের মতো কী যেন! শুনলাম নন্দাদেবীর মন্দির ছিলো। ঢাকুরি এমনিতে বেশ বড় জায়গা। আজ রাতে এখানেই থাকা। ৮০০০ ফুট উচ্চতায়। পুরোনো আমলের একটা বাংলোতে উঠলাম। মন ভরে গেল ঘরে ফায়ার প্লেস দেখে! রূপ সিং আগুনের বন্দোবস্তও করে ফেলল।
২৯ মে
সকাল হতে না হতে রূপ সিং তাগাদা দেওয়া শুরু করে দিল “জলদি কিজিয়ে, জলদি কিজিয়ে!” কী ব্যাপার? বিকালে নাকি বৃষ্টি হবে। তার আগেই উঠে যেতে হবে ওপরে। তাই তড়বড়ি। শুরু হল চলা। চার কিমি যেতেই ওমলা। ছোট্ট গ্রাম। চাষের খেতের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। নড়বড়ে একটা পুল পার হয়ে নামতে লাগলাম নিচের দিকে। সাত কিমি পরে ওয়াছাম। ওমলা থেকেই বাঁদিকে ঘুরে গিয়েছি। সোজা রাস্তা গেছে খাতি হয়ে পিন্ডারি। আমরা চলেছি অন্য পথে। জঙ্গুলে পাকদণ্ডী বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পরে এল একটা মজবুত পুল। সুন্দরডুঙ্গা নদীর ওপর। নদী পেরিয়ে ওয়াছাম। তারপর আরও আট কিমি। এই রুটের শেষ গ্রাম, জাতোলি। এখানে রূপ সিং এর বাড়ি। থাকা সেখানেই।
অদ্ভুত সে বাড়ি। ছবিতে অমনটা দেখা যায়। পাথরের দেওয়াল, পাথরের চাল। আর বাইরে বেরলেই চোখ জুড়নো নিসর্গ। পাহাড়, পাহাড়, আরও পাহাড়। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে ধাঁধা লাগে। মনে হয় স্বর্গ বুঝি এই রকমই হয়! ৮৫০০ ফুট, ঠান্ডা ভালোই। তবে হাড়কাঁপানো নয়।

৩০ মে
যাত্রা শুরু সকাল ছ’টায়। কিমি দু’য়েক যাওয়ার পরেই জাতোলি গ্রামটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সামনে পিছনে শুধুই পাহাড় আর জঙ্গল। রূপ সিং হাঁকলো, “কেউ দাঁড়িয়ে পড়বেন না- রাস্তা জোঁকে ভরা!” আরও দু’কিমি পর এল ভৈরবনালা। নালা নামেই। আদতে নদীর মতো চেহারা। অনেক কসরত করে পার হয়ে এক বড় চাতাল। আর সমতল দেখলেই বিশ্রাম। জঙ্গল ততক্ষণে হালকা হতে আরম্ভ করেছে। পথের তেমন কোনও নিশানা নেই। যতদূর চোখ যায় পাথর আর বোল্ডারে ভর্তি। ডানদিকে একটা গ্লেশিয়ার! আর অজস্র রঙিন পাথর মাটিতে যেন আলপনা এঁকে রেখেছে! সেসব পার হয়ে রূপ সিংয়ের পিছে পিছে দুর্গম পথে দশ কিমি হাটার পর এল ধুনিয়াডাং। ৯০০০ ফুট। কখনও ঝুরো, কখনও জমাট, আবার কখনও বা জলভরা বরফের চাদর বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতি! এরই নাম গ্লেশিয়ার! তারই উপর দিয়ে কায়দা করে চলা আর চোখ দিয়ে শুষে নেওয়া নিসর্গশোভা!
এই করতে করতে আরো ছ’কিমি পেরিয়ে দশহাজার ফুটের মাইলফলক পেরোলাম। সাড়ে দশহাজার ফুটে কাঁঠালিয়া। এখানেই আজ চটিতে রাত্রিবাস। জাতোলি গ্রামের একটি ছেলে এই চটি সামলায়। সেই চা, রাতের খাবার করে দিল। পরের দিন আমাদের গন্তব্যযাত্রা! আ লা মাইকতোলি!
৩১ মে
রূপ সিং জানাল, সুখরাম নালা আর মাইকতোলি নালার সঙ্গমে সুন্দরডুঙ্গা নদী। তার ধারে ধারে নাকি প্রচুর ভেড়া চরে বেড়ায়। মেষপালকদের বস্তিও কাছেই। রাস্তাটা বেশ একটু খটমট। ফি বছরই নাকি দুর্ঘটনা ঘটে। তবে আমরা নির্বিঘ্নেই পেরোলাম। পার হয়েই দেখি, দূরে এক ইয়া লম্বা ভদ্রলোক কাঁধে বরফের চাদর ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে। নাক ঊর্ধ্বমুখে উন্নত! অহো! ও তো রকি পর্বত! সুন্দরডুঙ্গায় এসে না পৌঁছনো ইস্তক এনার মুখদর্শন করা যাচ্ছিল না। এ বার দেখা গেল! ততক্ষণে হাড়ে লেগেছে কাঁপুনি। ঠান্ডায় জমে যাবার দাখিল। ১৫০০০ ফুট উঠে হাড় হিম। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ফিরলাম কাঁঠালিয়া। যাতায়াত নিয়ে ১৬ কিমি। তাতেই জিভ বেরিয়ে যায় আর কি!
১ জুন
পরের দিন ভোরে যাত্রা বালুনিটপের দিকে। উচ্চতা একটু কম – ১৩৮০০ ফুট। কাঁঠালিয়া থেকে একটু গিয়ে আজ বাঁয়ে ঘুরতে হবে। আর ঘুরেই দেখি আকাশ জুড়ে রঙের খেলা! উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ। ফুল তো নয়, যেন ফুলকাটা শামিয়ানা। কত রকম রঙ! লাল, গোলাপী, সাদা। আমরা সবাই স্রেফ মাটিতে শুয়ে পড়লাম। ধুলোবালির তোয়াক্কা করে কোন বেকুব? আকাশের দিকে মুখ করে চিৎপাত হয়ে রং দেখতে লাগলাম দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে। চারদিকে চেনা অচেনা পাখিদের অবিরাম কলকাকলি। মনে হোল যেন ফুলতোলা চাঁদোয়ার নিচে প্রকৃতি মাইফেল সাজিয়েছে! এদিকে রূপ সিংয়ের তাড়া। উপরে উঠতে হবে। শুয়ে থাকলে চলবে? আবার চড়াই শুরু। উঠলাম ঠেলে টপে। আর তারপরেই মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সামনে যেন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে মেরুমানবের দল। তুষারধবল মাথা ফুঁড়ে উঠছে নীলিমা ভেদ করে। রূপ সিং বলে যেতে লাগল – “উয়ো দেখিয়ে বালুনি, উসকে বগলমে ভানোটি, পাসমে দুর্গাকোট, উসকে পিছে টেন্টপিক, ফির বারকোট, উসকে বাদ মৃগথুনি। ফির উধার মাইকতোলি, পানওয়ালিদ্বার, বালজোয়ারি…” আমাদের কানে কিছু গেল, কিছু গেল না। সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে এই শ্বেতদৃশ্যের সামনে।
এদিকে ঘনিয়ে এল ফেরার পালা। মন পড়ে থাকল মাইকতোলির পায়ের কাছে। পা চলল উতরাই বেয়ে। সুন্দরডুঙ্গা-কাঁঠালিয়া-জাতোলি পেরিয়ে নামতে লাগলাম ওই পথেই। তবে ওমলা পর্যন্ত আর গেলাম না। আগেই বেঁকে গেলাম খাতি গ্রামের দিকে। পিন্ডারি যাব না? সে গল্প তোলা থাক আরেকদিনের জন্য!
জন্ম ১৯৪১ সালে খুলনায়। বাবার বদলির চাকরি সূত্রে কখনও সুন্দরবন, কখনও মালদা হয়ে ডালখোলা, কখনও বা কাটিহার। এভাবেই উড়ুউড়ু মনের সুত্রপাত। নিজের চাকরি সামরিক বিভাগে। সেই সূত্রেই হিমালয়ের প্রেমে পড়া। একুশবার কেদারনাথ যাত্রা, ছ'বার পঞ্চকেদার, পিন্ডারি হিমবাহ, রূপকুণ্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস, হেমকুন্ড সাহিব, গোমুখ, তপোবন, অমরনাথ, কালিন্দীপাস, সুন্দরডুঙ্গা... পরিক্রমার তালিকা অতি দীর্ঘ। সেই সূত্রেই পরিচয় উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ২০১১-এর পরে অবশ্য বয়সের কারণে আর পাহাড়ে যাননি। পঞ্চকেদার। জীবনের অপূরণেয় শোক - নিজের হিমালয়প্রেমী ছোটভাইকে হিমালয়েরই ফাটলে হারিয়ে ফেলা। আর সবচেয়ে বড় আনন্দ, অন্যকে হিমালয় দেখিয়ে!