কী একটা গুনগুন করা সুর সারাক্ষণ কানে বাজছে। অটোরিকশায় পিছনের সিটে বসা যুবক কন্ঠ। চেনা সুর, অথচ শব্দগুলো মনে আসছে না কিছুতেই৷ গানের লাইন, অথবা গানের ইন্টারলিউড-ও হতে পারে – ‘আমলকি পিয়ালের কুঞ্জে, কিছু মৌমাছি এখনও যে গুঞ্জে’-র পর টিং টিং করে যেমন কয়েক মাত্রা বাজে। কিন্তু এ সুরটা তেমন উচ্ছল ছিল না। অনেকটা শান্ত ছিল, ধীর, হেমন্ত বাতাসের মতো। পথচলতি কাউকে এত নিখুত সুরে সচরাচর গাইতে শোনা যায় না। একবার ইচ্ছে হল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, তারপর ভাবলাম, যদি ঘোরটা ভেঙে যায়! সাকুল্যে চল্লিশ সেকেন্ড। ছেলেটা সুর ভাঁজল, তারপর কবরস্থানের উল্টোদিকে টায়ারের দোকান আসতেই “দাদা দাঁড়াবেন” বলে নেমে চলে গেল। আমি উঠেছিলাম আগের স্টপে। সামনের সিট ফাঁকা ছিল, আর পিছনের একটা সিট-ও। কেননা দুজন পুরুষ বসেছিলেন। ব্যস্ততায় প্রয়োজন পড়েনি তাদের কারও দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখার।
***
আমার নতুন প্রেমের কথা মধুমিতাকে বলিনি এখনও৷ প্রথমত, বললেই ‘এ আর নতুন কথা কী’, ‘এবারের মেয়াদ কদ্দূর’ এইসব নানাপ্রকার বাতেলা দিয়ে প্রথম দশ মিনিট কাটাবে। তারপর শুরু হবে ফোড়ন কাটা। আট বছরের ছোটো কেন, মা বাবা আলাদা থাকে কেন, পদবী লেখে না কেন। আরে ভাই আলাপই তো হল দেড় মাস আগে৷ এত প্রশ্ন করা যায়? নাকি করা উচিত! যেটুকু জানি – জানি। বাকিটা সময় জানাবে। প্রথম সন্ধেটার গল্প নিজেই দু’একবার বলে ফেলেছি চার্বাককে। শনিবার বিকেল৷ দুপুরের দিকে বৃষ্টি হচ্ছিল বলে আটজনের জায়গায় উপস্থিতি পাঁচ। পুরনো ছাত্রী হওয়ার সুবাদে আমি রক্তিমদার বাঁপাশে বসি। তানপুরা ধরি। একটা শ্যামবর্ণ মুখ, গালে খুব হালকা দাড়ি, গোল ফ্রেমের চশমা। সবুজ দরজা দিয়ে মুখ বাড়ালো। “স্যার আসবো?” আটষট্টির খেয়াল গায়ক তানপুরায় সুর লাগলেই সুকুমার সন্ন্যাসীটি হয়ে যান। অপরিচিত গলা শুনে চোখ খোলেন, তারপর হাসিমুখে ছেলেটিকে বলেন, “আয় বাবা আয়।” রক্তিমদা এমনই। বটবৃক্ষপ্রতিম। অথচ যে ছায়া পেল, পেল। যে খুঁজে নিতে পারল না, তার সঙ্গে নির্মম, পেলবতাহীন। কত ছাত্রছাত্রী ক্লাসে এসেছে, আবার চলে গেছে। ন’বছরের পরিসরে মুখুজ্জে বাড়িতে আমারও তো অভিজ্ঞতা কিছু কম হল না। রক্তিম মুখোপাধ্যায় প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী দম্পতির পুত্র। কিন্তু ওঁর চর্চা কখনওই রবীন্দ্রনাথে থেমে থাকেনি। কাজী নজরুল থেকে দিলীপ কুমার রায় সবেতেই রক্তিমদা আহির ভৈরব থেকে বেলা গড়িয়ে পূরবী রাগের গতায়াতের মতো সাবলীল।
রবিবারের ক্লাস আপামরের জন্য। দু’দফায় চলে। শনিবার মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থী আসার সুযোগ পায়। এ ছেলেটি নতুন হয়েও কেন আজকের ক্লাসে, প্রথমটায় আমার মতো বাকি চারজনেরও সন্দেহ জাগে। নীল জিন্স আর গোলাপি পাঞ্জাবির তরুণ একটু কোণাকুণিভাবে বসে পড়ে মেঝেয়। রক্তিমদা বলেন, “তোমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ওর নাম চার্বাক৷ চার্বাক কী যেন রে বাবা?” “শুধু চার্বাক স্যার। কারো খুব অসুবিধে হলে মায়ের পদবী বসিয়ে নিই। চার্বাক মাহাতো।” আমি ভাবছি এক্ষুনি রক্তিমদা খচে গিয়ে ‘তুমি অতি পশ্চাদপক্ক ছেলে, বেরোও এখান থেকে’ বলে না বসেন। দেখলাম তেমন কিছু ঘটল না। রক্তিমদা বলেন, “চার্বাকের মাতামহ আকাশবাণীতে আমার পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এ ছেলে ডাক্তার হওয়ার তাড়নায় গত পাঁচ বছর সঙ্গীত চর্চা প্রায় করেইনি। তার আগে প্রথাগতভাবে শিখেছিল। ওর মা ফোন করেছিলেন আমায়। বললাম এ সপ্তাহ থেকেই চলে এসো। বাবা চার্বাক, কিছু শোনাবে নাকি তোমার দিদি দাদাদের?” বছর চব্বিশের তরুণ হারমোনিয়াম টেনে নেয়। সি শার্পে স্কেল চেঞ্জ করে। আমার তানপুরা ন্যাচারাল বি-এ বাঁধা। রক্তিমদা ইলেট্রনিক তানপুরায় স্কেল সেট করেন। আজ তবলিয়াও আসেননি।
কথা বলার স্বরের তুলনায় গানের স্বর একটু বেশি ভারী ছেলেটির। চোখ বন্ধ করে শুনলে মনে হতে পারে বছর চল্লিশের কেউ গাইছে। ‘বরষার মেঘ নামে, ঝরঝর বরিষণে…’ হিমাংশু দত্তের সুর। ঘরের সকলেই স্তব্ধ হয়ে শুনছে। আমিও, প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো। শেষ পংক্তিতে ‘এমন বাদল রাতি/ কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে’-র জায়গায় ‘এমন আষাঢ় রাতি’ গেয়ে ওঠায় আমার সম্বিৎ ফেরে। বুঝতে পারি, এতক্ষণ আমি ওর দিকে প্রায় নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ও-ও চোখ খুলে তাকালো দু-চারবার। খুবই সংকুচিত হলাম। সেদিনের ক্লাস অনেকটা গল্পে গানে কেটে গেলো। রক্তিমদার ফ্লাস্কে আরেকটু লিকার চা করে রেখে বাকিরা চলে যাওয়ার দশ মিনিট পর আমি নিচে নামি। দেখি, মুখুজ্জে বাড়ির অনতিদূরে একটা পলাশ গাছের নিচে চার্বাক বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে। সামান্য বৃষ্টি তখনও পড়ছে। চার্বাকের হেলমেট মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে ঝোলানো। আমার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “আপনাকে এগিয়ে দেবো কোথাও?” আমি জানাই ক্যাব বুক করা আছে। “তাহলে গলির মোড় অবধি হেঁটে যাই?” চার্বাক খুব অনুমতির অপেক্ষায় প্রশ্ন করে না। আমি বলি, “চলো। কিন্তু আমার কাছে ছাতা নেই।” সে বলে, “আমারও নেই।” “তুমি ফিরবে কোথায়?” চার্বাক জানায়, কলেজের হোস্টেল৷ হাউসস্টাফশিপ অবধি ওরা থাকার পারমিশন পায়। “আপনি?” তার পালটা প্রশ্নে আমি বলি, “আপনি বলতে হবে না। দিদি বোলো। তুমি বোলো।” চার্বাক প্রায় আকাশ থেকে পড়ার মতো করে উত্তর দেয়, “বন্ধুকে দিদি কেন বলব!” “কেননা আমি তোমার থেকে সাত-আট বছরের বড় তো হবোই। আর বন্ধু কিসের। সবে তো আলাপ হল আজ।” “হয়ে যাবো। চাপ নেই।” এই চাপ কথাটা শুনলে রক্তিমদা খেপে লাল হয়ে যান আর নতুন প্রজন্মের বাপবাপান্ত করতে থাকেন। আমার অ্যাপে ‘ক্যাব অ্যারাইভড’ দেখায়। ড্রাইভারকে ফোন করে মিষ্টির দোকানের সামনেটায় আসতে বলি৷ তারপর দ্রুত হাত নেড়ে উঠে যাই।
বৃষ্টির জন্য রাস্তায় একটু যানজট। দশটা দশে বাড়ি ঢুকি। মধুমিতার আসতে এখনও ঢের দেরি। আইটি সেক্টরে দুটো থেকে বারোটা ডিউটি। দুজনের দুটো আলাদা ঘর। স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে একই বাড়িতে ভাড়া থাকার সুবিধে অসুবিধে দুইই আছে। বহুদিনের পরিচিতির সুবাদে একে অন্যের অভিভাবকত্ব যেচে গ্রহণ করে ফেলি। তার ওপর মধুমিতা ছোটোবেলা থেকেই একটু জ্যাঠাইমা গোছের। বড় বেশি জাজমেন্টাল। তিতাসদাকে কাটিয়ে দিল, ছেলেটা ওর কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে দু’মাসে একবার ট্রেকিং-এ যেত বলে। মূল কারণটা হল, সেই গ্রুপে তিনজন মেয়ে থাকত। তাদের একজন তিতাসদার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল বলে মধুমিতার দাবি। আপাতত মধুমিতা সিংগল। বত্রিশ বছরের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য রাতের ঘুম ছুটে যাওয়া বাবা-মা ফি হপ্তায় নতুন নতুন ছেলের ছবি ইমেল করছে। ক্যাব থেকে নেমে ফ্ল্যাটে ঢুকতে ঢুকতেই মাথাটা ভিজে গেলো। চুল মুছছি, একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন। ধরিনি। আগে চেঞ্জ করে নিয়ে ট্রুকলারে নাম দেখি, তারপর ধরব। স্লিভলেস টি আর ক্যাপ্রি পরতে পরতেই আবার রিং। “হ্যালো?” “রিচড?” “হু ইজ দিস?” “বাড়ি পৌঁছেছ কি?” “চার্বাক! যাব্বাবা! নম্বর কে দিল?” “রক্তিম স্যার।” “মানে!” “মানের কী আছে! বললাম ক্যাবে ওঠার সময় ছাতা ধরতে দিয়েছিলে। সেটা আমার কাছে রয়ে গেছে। উনি বললেন, দেখেছিস মেয়েটার এমন ভুলো মন…!” “মিথ্যে বললে?” “অর্ধসত্য।” “মানেটা কী!” “তোমার ডান কানের দুলটা খুলে পড়ে গেছে।” “সেকি কখন, আমি তো… তুমি দেখেছিলে অথচ বলোনি?” “ক্লাস থেকে বেরোবার সময়েই তো পড়ে গেছিল। আমি তুলে পাঞ্জাবির পকেটে রাখলাম৷ নিচে দাঁড়িয়েছিলাম দেবো বলে। তারপর মনে হল, না দিলেই বা কী।” “আশ্চর্য ছেলে তো! পরের শনিবার নিয়ে আসবে।” “কালও দিতে পারি। কাল তো রবিবার। আমার ডিউটি নেই।” আমি লাইন কেটে দিই। ছোটো ছেলেগুলোর স্পর্ধা একটু বেশিই বলে মনে হয়। না, মধুমিতার মতো সাদাকালোর বিচারে আমি পৃথিবীকে দেখি না, কিন্তু একটা দৃশ্যমান বা অদৃশ্য পাঁচিল তো থাকতে হয়। থাকাটাই সমীচীন।
মঙ্গলবার স্কুল থেকে ফেরার পথে আবার একচোট ভিজি। মাঝরাত থেকে জ্বর ভাব লাগতে শুরু করে। সঙ্গে শুকনো কাশি, গলাব্যথা। একবার ভাবি চার্বাককে ফোন করব। তারপর মনে হয়, এতদিন তো এমনিই দোকান থেকে ওষুধ এনে খেয়েছি। তাছাড়া ওর নম্বর স্টোর করা হয়নি। তিনদিনে কললিস্টেও আর আছে বলে মনে হয় না। মধুমিতা বেরোবার আগে চারটে প্যারাসেটামল আর একটা কাশির সিরাপ কিনে দিয়ে যায়। গলার যা অবস্থা, মনে হয়না এ সপ্তাহে গানের ক্লাসে যাওয়া হয়ে উঠবে। রেওয়াজের তো প্রশ্নই আসে না। শনিবার রাত্তির পৌনে এগারোটা৷ রুটি, বেগুনভাজা আর চিকেন দিয়ে গিয়েছিল ডাব্বাওয়ালা থেকে। খাওয়ার পর অ্যান্টিবায়োটিক গালে ফেলতে যাবো, তখনই একটা ফোন। শেষ দুই সংখ্যা এইট সেভেন। কেন জানিনা সংখ্যা দুটো মনে থেকে গিয়েছিল। “এলে না?” “জ্বর।” “সেকি, বলোনি তো!” “তোমাকে বলবই বা কেন!” “হুম। দুলটা এনেছিলাম।” “রেখে দাও। পরেরদিন নেবো।” “আমি কি তোমায় দেখতে যেতে পারি?” “দরকার নেই। জ্বর ছেড়ে গেছে। সোমবার স্কুল জয়েন করব।” “ও, কোথায় তোমার স্কুল? বলা যাবে? নাকি বাড়ির ঠিকানার মতো এটাও বলবে না?” “সেন্ট প্যাট্রিক্স। দারোয়ান আছে। উটকো লোক ঢুকতে পারে না।” “বেশ। টেক কেয়ার।” নিজের কড়া আচরণে নিজেরই একটু হাসি পেল। হায়ারার্কি দেখানোর সুযোগ পেলে কে আর ছাড়ে!
সোমবার ক্লাস করিয়ে বেরোচ্ছি সাড়ে চারটে নাগাদ, দারোয়ান দাদা এসে বললেন- “আপনার নামে একটা খাম আছে ম্যাডাম।” হ্যান্ড মেড পেপারের একটা খাম। মনে হল কোনও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেমন্তন্নর চিঠি। গানের অনুষ্ঠান হয়তো। অটোরিকশায় বসে খামটা খুলে দেখি একটা চার ভাঁজের কাগজে লেখা- ‘আরোগ্য কামনায়, চার্বাক।’ সঙ্গে খুব ছোট্ট একজোড়া সবুজ পাথর বসানো রুপোলি, নতুন ঝুমকো দুল। গত সপ্তাহে ক্লাবে যাওয়া হয়নি। ভাবছি আর দুটো দিন যাক, কাশিটা পুরো কমলে সাঁতারটা শুরু করব আবার। বাড়ি ফিরলাম পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ নাগাদ। চার্বাকের নম্বরে ফোন করলাম, কিন্তু বেজে গেল। সারা সন্ধে কোনও ফোন এলো না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুলটা পরলাম। পরে থাকলাম। পরেই ডিনার করলাম, ম্যাগাজিন পড়লাম, ক্লাস টেস্টের খাতাগুলো নিয়ে বসলাম। একটা দশে মধুমিতা এলো। ডুপ্লিকেট চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে আমার বেডরুমে আলো জ্বলছে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কাজ করছিস?” “ইয়েস।” “এই, ইয়ারিংস গুলো নতুন কিনলি! কী দারুণ! ওই তোদের স্কুলে যে মেয়েটা জুয়েলারি নিয়ে আসে ওর কাছ থেকে?” “হুম” বলে খাতায় চোখ রাখলাম। “ওকে, কাজ কর” – বলে মধুমিতা চলে গেল নিজের ঘরে। রাতের খাবার ও অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নেয়। কোনও ফোন এলো না সমস্ত সন্ধে-রাত। একটা এসএমএস লিখলাম- উপহার পেয়েছি, ভালো লাগল, এত সব না করলেও পারতে। তারপর পাঠিয়ে দিলাম চার্বাকের নম্বরে। উত্তর এলো না। এমনকি মঙ্গল থেকে শুক্র চারদিনে কোনও ফোন বা মেসেজও নয়। শনিবার ক্লাসে গিয়ে দেখলাম চার্বাক বসে বসে রক্তিমদার সঙ্গে গল্প করছে। শ্রাবণ মাস, দফায় দফায় বৃষ্টি চলছে দিনভর৷ রক্তিমদা জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে মেয়ে আজ ছাতা এনেছিস তো? আর জ্বর বাধাস না।” চার্বাক খুবই স্বাভাবিক মুখে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলল ক্লাসে। আমার দিকে তাকিয়ে দুবার হাসল। ক্লাসের শেষে দোতলা থেকে নিচে নেমে দেখি, পলাশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সে। “ক্যাব বলেছ?” আমি উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, কেন?” চারদিনের নীরবতা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত লেগেছে। “কারণ আমিও যাব তোমার সঙ্গে।” “স্ট্রেঞ্জ! এসবের অর্থ কী!” “সব কাজ অর্থ বুঝে করার মেয়ে তো তুমি নও স্নিগ্ধা। তুমি অনর্থ করার মেয়ে, আমি জানি।” বাধ্য ছাত্রীর মতো আমি একটা ছোটো ছেলের পাশে পাশে হাঁটছি। গাড়ির নম্বর মিলিয়ে সিটে বসছি। পাশে বসছে চওড়া ঠোঁটের কৃষ্ণবর্ণ তরুণ। মেরুন পাঞ্জাবির পকেট থেকে তার দু’সপ্তাহ আগের হারিয়ে যাওয়া দুলটা বার করে বলছে, “এটা আমার কাছে থাকে এখন। রোজ। আউটডোর করার সময়, ইনডোরে রাউন্ডের সময়, মাঝরাতে ডেলিভারি করানোর সময়। এটা রাখি?” আমি নিরুত্তর বসে আছি। ইচ্ছা করছে ওর খাদির পাঞ্জাবি সরিয়ে বুকে মুখ ঘষি। বয়সের ফারাক সংকোচ তৈরি করছে। চার্বাক ওর ডানহাত আমার পিঠের পিছন দিয়ে এনে নিজের কাছে টেনে নেয় আমায়। আমি কি অষ্টাদশী কিশোরী? বাড়ি ফিরে সমস্ত রাত সেই দুটো লাইন গাইতে থাকি অনবরত, ‘বরষার মেঘ নামে ঝঝর বরিষণে, প্রথম আষাঢ় সাঁঝে…’
***
চার্বাক অফথ্যালমোলজি-তে ডিপ্লোমা করতে চেন্নাই গেছে আজ ঠিক এক মাস হল। জুনের চার তারিখ সকাল আটটা পাঁচের ফ্লাইট ছিল। ওর মা এসেছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে। বড়মামাও। মামার বাড়িতেই তো মানুষ ও। ইদানিং যোগাযোগ কমে এসেছে আমাদের। একুশ শতকের সম্পর্কগুলো শরতের আকাশের মতো চরিত্র বদলায়। এই তিরিশ দিনে আমি একবারও ওকে স্বপ্নে দেখিনি। কিন্তু গতকাল সমস্ত দিন ওর দেওয়া সবুজ পাথরের দুল পরে গান গাইতে গিয়েছিলাম বলেই হয়তো, ভোর রাতে ভয়ানক স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে রইলাম বহুক্ষণ। নেতাজি সংঘের যে সুইমিং পুলে গত দু’বছর হল আমি সপ্তাহে তিনদিন সাঁতার কাটতে যাই, দেখলাম, সেই জল হঠাৎ শ্যাওলায় সবুজ হয়ে গেছে। আর সিঁড়ির কাছে আটকে কচুরীপানা জড়ানো একটা মৃতদেহ। তার সেই কৃষ্ণবর্ণ মুখ। হালকা দাড়ি। গায়ে গোলাপি পাঞ্জাবি। ঘুম ভেঙে কাঁদতে পারলে হালকা লাগত। কিন্তু কান্না তো পায়নি একবারও৷ গত একমাসে, একবারের জন্যও না। এই খাটেই চার্বাক শেষ রাতে আমার পিঠের ওপর হারমোনিয়ামের রিড বাজাতে বাজাতে বেহাগের সুর সেধেছিল। প্রত্যাশাহীন যৌথতায় কারো কোনও প্রশ্ন করার থাকে না, উত্তর দেওয়ার দায়ও না। আমাকে বিক্ষিপ্ত দেখে মধুমিতা বলল- “চল, তোকে মাহেশের রথ দেখিয়ে আনি।” ভিড়ভাট্টা ভালো লাগছিল না, তবু গেলাম। এক রাত থাকলাম মধুমিতাদের হরিপালের দালানওয়ালা মস্ত বাড়িতে। আর ফেরার দিন সকালে ওদের রান্নার দিদি তরুদি এসে বলল, আজ ভোরবেলা মেলার মাঠ থেকে অনতিদূরে, দত্তদের পুকুরে ডুবে আবার একটা ছেলে মারা গেছে। আবার মানে? “আবার মানে, প্রতিবার যায়” মধুমিতা বলল।”কী সব হাবিজাবি কথাবার্তা বলছিস!” “নাহ, এটা ফ্যাক্ট।” রান্নার দিদি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি বিশ্বাস করছেন না দিদিভাই, চলুন, বডি সবে তোলা হয়েছে জাল ফেলে।” মধুমিতা পরিস্থিতি সামাল দিল, “আষাঢ় শ্রাবণে জল বেশি থাকে তরুদি। পিছল থাকে। যাও তুমি পরোটার ক্যাসারল-টা আনো। আমাদের এগারোটা কুড়ির ট্রেন।” হাওড়া থেকে মধুমিতা সোজা অফিস যাবে৷ আমি ফ্ল্যাটে ঢুকব। হাওড়া থেকে ক্যাবে উঠে ঈষৎ দ্বিধান্বিত হয়ে চার্বাকের চেন্নাইয়ের নম্বরে মেসেজ পাঠাই- কেমন আছো বাবু, কাজ কেমন চলছে? তৎক্ষনাৎ উত্তর আসে- আই অ্যাম ফাইন, হাউ ইজ কলকাতা?
এ শহর নিয়ে চার্বাকের আলাদা কোনও আবেগ থাকার কথা নয়। ডাক্তারির ছ’বছর ছাড়া কলকাতার সঙ্গে তার সবিশেষ সংযোগ তো গড়েই ওঠেনি সেভাবে। আমারই টান কাটিয়ে বেরোনো হল না। অতএব সেন্ট প্যাট্রিক্সে ক্লাস করিয়ে স্বাস্থ্যসচেতন-আমি সোম, বুধ, শুক্র সাঁতার কাটি। শনিবার রক্তিমদার ক্লাসে যাই। মাসে দুবার নিয়ম মেনে মা-বাবা-ঠাকুমা-দাদুর সঙ্গে দেখা করে আসি, যেমনটা আগেও যেতাম। আজ হঠাতই নেতাজি ক্লাব থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তায় কে যেন গুনগুন করে ওঠে। চল্লিশ সেকেন্ডের সুর তুলে যে পুরুষটি টায়ারের দোকানের সামনে নেমে যায়, হয়ত তার কণ্ঠস্বর বয়সের তুলনায় একটু বেশি ভারী। অতএব, আমি ঘাড় ঘুরে দেখি না তার মুখ। পাছে ঘোরটুকু ভেঙে যায়।
মুখুজ্জে বাড়ির পলাশ গাছটার নিচে এবারের বর্ষায় হাঁটুজল। মাত্র এক বছরের ব্যাবধানে শহরগুলো কেমন বদলে যায় দ্রুত।
জন্ম ১৭ জুন ১৯৮৬। জে.বি.রায় স্টেট আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হসপিটাল থেকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক। মানসিক স্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর। কবিতা, সংগীত ও নাট্যচর্চার সঙ্গে নৈকট্য আশৈশব। জনস্বাস্থ্য, সমাজবিজ্ঞান, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে প্রবন্ধচর্চা করেন নিয়মিতভাবে৷ তাঁর 'অরুণা শানবাগ নিষ্কৃতিমৃত্যু ও ভারত' (২০১৭) বইটি এদ্যবধি ইউথেনেসিয়া প্রসঙ্গে লেখা একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বাংলা বই যা মনোজ্ঞ পাঠকমহলে প্রশংসিত। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজ-এর সর্বজনবিদিত 'হম দেখেঙ্গে' (দেখে নেবো আমরাই) কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করে অবন্তিকা জাতীয় স্তরেও জায়গা করে নিয়েছেন।
One Response
২৪ অক্টোবর ২০২১ রবিবাসরীয়তে মীনা কুমারীকে নিয়ে লেখা(‘কবিতার খাতাই ছিল তাঁর একাকিত্বের সঙ্গী’)টির বিষয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাসা ছিল। তাই অবন্তিকা পালের ফোন নম্বর বা ই:মেল পেলে উপকার হতো । আমি তরুণ সেন, ৯১৪৩৪৩৬৪১৪ e:mail sunenart@gmail.com আমাকে যোগাযোগ করে নিলে, বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ থাকবো । প্রতীক্ষায় রইলাম, ধন্যবাদ ।