এক বন্ধুর পোস্টটি ছিল এরকম।
আমার ক্যামে মার্চে বর্ষা নামে
দাবদাহ ছবি এক স্পর্শেতে এসি
এসএলআর তুমি পাড়া ফুটবলই খেলো
এআই পিক আমার কাছে মেসি।
পোস্টের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া আছে দুটো ছবি। জুলজুল করে দেখি, একটি ছবিতে খটখটে রোদে জ্বলা শহরকে চিরে দিয়েছে ঝমঝমিয়ে বর্ষা। ভাবলাম, এমনটা আবার হয় নাকি? অন্য ছবিতে হাওড়া ব্রিজের গায়ে লেপ্টে রয়েছে বরফ। নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার জল স্থির। ওই দেখা যায় হিমশৈলের চূড়া। আর চূড়ার উপরে যে তিন চারটি প্রাণী লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, তারা কে? পেঙ্গুইন? নদীর ওপারে কয়েকটা ইগলুও দেখতে পেলাম যেন। কমেন্টে সে প্রশ্ন করা হলে ঝটিতি উত্তর এল, ‘যেটা জানো না জানো না সেটা না জানাই থাক, বেশি জ্ঞানে নষ্ট জীবন।’
পোস্টের নীচে আরও কয়েকটা লাইন ছিল কলার তুলে। ‘শট উইথ মাই ৬০ মেগাপিক্সেল প্রাণভ্রমরা এআই ক্যামেরা, উইথ ম্যাজিক জুম, ট্রু কালার প্রিসিশন টেকনোলজি, উষ্ণ চুমুর টাইম ফ্রিজ, পরমানন্দ প্যানোরামা, প্যারালাল ওয়ার্ল্ড, ফ্লাডলাইটমাখানো নাইট মোড, ফ্রিজ ফ্রেম ভিডিও আর ওয়াও টেলিম্যাক্রো লেন্স। এআই লেন্স ও অ্যাপের অন্তহীন ফিচার্স পেয়ে আমার লাইফ বিন্দাস।’

বছর সত্তরের এক ফোটোগ্রাফির মাস্টারমশাইকে দিনকয়েক আগে বলতে শুনেছিলাম, “বুঝলে ভাই, অ্যাপারচার সম্পর্কে সেদিন একটা ক্লাস নিচ্ছিলাম। আমার এত বছরের অভিজ্ঞতা। বোঝাচ্ছিলাম যত্ন করে। আঠেরো বছরের এক ফচকে ছেলে ওর পাঁচটা লেন্স লাগানো সদ্য কেনা স্মার্টফোনটা আমার চোখের সামনে দুলিয়ে বলল, আমার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরে সে ধন আছে? আপনি আপনার কামানের মতো লেন্সটা ঘোরাতে থাকুন স্যার। দেখুন, ক্রমে আলো কমে আসিতেছে। আমি চললাম। বেরোনোর সময় বলে গেল, যত সব ফালতু টাইম ওয়েস্ট।” আমি বললাম, “এত কথা শোনার পরে আপনি চুপ করে রইলেন?” ভদ্রলোক বললেন, “কী করব বল বাবা! আমি তো ছবি তোলা শেখাই। এরা যে সব অ-ছবি শিখতে চায়। ছবির থেকে অ-ছবির বাজার ঢের বেশি এখন।” মাস্টারমশাইয়ের একটা ফিচার ফোন ছিল। বললেন, “আরও শুনবে? ক্লাস ছেড়ে চলে যাওয়ার পরের দিন ছেলেটা আবার আমায় একটা মেসেজ করে পাঠিয়েছে। কি লিখেছে জানো? শোনো তাহলে।
গুরু, তোমার লেন্সে ছত্রাক শুধু
যাকে বলি আমি ছাতা,
দুনিয়া বদল হয়েছে জেনো
ক্লাসে কমে যাবে মাথা।
ফুটনোটে আবার লিখেছে, এবারে এআই ক্যামেরা ( (AI camera) আর ছবি এডিট করার এআই অ্যাপটা (AI app) শিখে নিন স্যার। ডারউইন সাহেব কি বলে গিয়েছিলেন, মনে আছে তো?”
আমার কলেজের এক বান্ধবী মাস তিনেক হলো শহরের এক নামী মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছে। শুনেছি, ডিপ্রেশনের কড়া ওষুধ খেতে হয় ওকে। সব ঠিকঠাকই ছিল। এক সূর্যস্নাত সকালে সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাপ শুধিয়েছিল, ‘অ্যাই শোনোনা! তোমার ছবি তো আমার কাছে আছে। বছর পঁচিশ পরে তোমায় কেমন দেখতে হবে দেখবে? বলে দেবে আমার এআই।’ কপালে অজস্র বলিরেখা, সার্জারি হওয়া নাক, থুতনিতে ব্ল্যাক স্পট আর চোখের তলায় আলকাতরার প্রলেপ দেখতে পেয়েই ও বিগড়ে যায়। ডাক্তারবাবু যত বোঝান যে এ সবই মিছে কোলাহল, আমার বান্ধবীর মন মানে না। ও বলে চলে, “এই অ্যাপেতে এআই আছে। আপনি কি ওর থেকেও বেশি বোঝেন?”
এত দিনের বন্ধুদের চেনা মুখগুলো দুম করে অচেনা ঠেকে আজকাল, সামাজিক মাধ্যমে। ঠোঁটের উপরে একটা আঁচিল কিংবা কপালে একটা কাটা দাগ নিয়ে যাদের দেখে এসেছি জীবনভর, তারা হঠাৎ, যাকে বলে ভোল পাল্টেছে। অধিকাংশ ছবিই, কেমন যেন, বড্ড বেশি নিখুঁত। ছবিগুলো যেন এইমাত্র তৈরি হল কুমোরটুলিতে, শারদপ্রাতে। আমার বাহাত্তুরে মেজমামি নতুন যে ছবিটি দিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে সবে কলেজে ভর্তি হলেন যেন। চিল্কা হ্রদের ধারে তোলা মামা-মামির যুগল ছবিতে মামিমা শুধু নিজের ছবিটুকুতে এআই অ্যাপ চালিয়েছেন। মেজমামা রয়ে গিয়েছেন সেই তিমিরেই। ফলে পোস্ট করে দেওয়া ছবিতে আটাত্তর বয়সী এক প্রবীণের পাশে ‘আলো’ হয়ে রয়েছেন আমার অষ্টাদশী মামি। ছবির তলায় লিখেছেন, ‘কবে যে বুড়ো হল চুপিসাড়ে।’ এর মধুর প্রতিশোধ নিয়েছেন মেজমামাও। দার্জিলিংয়ে তোলা এমনই এক কাপল পিকচারে বদলেছেন শুধু নিজেকে। মাথায় একরাশ কালো চুল। সিক্স প্যাক ঠিকরে পড়ছে জামার ভাঁজে। পাশে কুঁজো হয়ে যাওয়া, হাতে লাঠি সম্বল করে চলা স্ত্রী। ছবির ক্যাপশন দিয়েছেন, ‘প্রস্তরযুগের রমণী ও এক সদ্য অঙ্কুরিত ছোলা।’ বাইনারি দুনিয়ায় যে বিবাদ তৈরি করেছিল এআই, ‘অর্ডার অর্ডার’ বলে তা মিটিয়েও দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (artifical intelligence)। পরিচিতবৃত্তের এক মানুষ একটি জব্বর ছবি পেশ করেছেন কমেন্টে। যেন ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে ধ্বনিত হল বিচারের রায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, টাইটানিকের ডকে মেজমামির কোমর জড়িয়ে রয়েছেন জ্যাকরুপী মামা। আর মামি হাত মেলে রয়েছেন রোজের মতো। তলার ক্যাপশনটিও জব্বর। কমিক্সের স্ট্রিপের মতো ছবিটিতে মামির মুখে ডায়লগ বসানো। ‘এআই ডাকে আজ আমায়।’

এআই উত্তমকুমারকে দেখে আমার এক কবিবন্ধু বলল, “মহারাজ এ কি সাজে, এলে সোশ্যালোমিডিয়া মাঝে।” লিংক পাঠালো আমায়। দেখি বাঙালির চিরাচরিত আইকন কয়েকটি নব বেশে। দেখি ভদ্রলোকের মাথা থেকে নেমে আসা স্ট্রিং কপালে দোল খাচ্ছে। গায়ে ডবল লেয়ারের বাহারি জ্যাকেট। তার তলায় সলমন খানের মতো চোস্ত টিশার্ট। বাঁদিকের কানের উপরের চুলে আবার সোনালী রঙের প্রলেপ। ঘাড়ের পিছনে হয়তো ট্যাটুও ছিল। ঠিক মালুম হল না। অন্য একটি ছবিতে দেখি সাদা জামার দুটো বোতাম খুলে, সোনালী রঙের ব্লেজার পরে পোজ দিচ্ছেন মহানায়ক। অন্যছবিতে আবার তিনি বৃষ্টিস্নাত, কিংবা ঘন্টাদুয়েক জিম করে বেরিয়ে আসা লুক। এমন ছবিতে নেটদুনিয়ায় ফুলকির মতো উড়ে আসছে কমেন্ট। কেউ বলছেন, ‘কোথায় ছিলে ওস্তাদ, কোথায় ছিলে?’ একজন লিখেছেন, ‘প্রেম পাচ্ছে খুব।’ কেউ আবার কেউ প্রবল নাক সিঁটকিয়ে লিখেছেন, ‘এ তুমি কেমন তুমি! এ উত্তম আমার উত্তম নয়। নায়কের চোখের বুদ্ধিমত্তাটাই তো ভ্যানিশ।’ মাঝখানে কেউ ফোড়ন কেটে বলছেন, ‘উত্তম তো হল। এবারে একটা রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাক।’ দেখলাম, কমেন্টবক্সে মুহূর্তে হাজির হয়ে গেলেন বাল্মীকিপ্রতিভার রবীন্দ্রনাথ। গায়ে সবুজ কোট। মুখে চাপদাড়ি। একেবারে ম্যাচো লুক যাকে বলে।
বিশ্বকবির কলম আজও সচল থাকলে হয়তো তিনি লিখতেন, ‘তুমি নব নব রূপে এসো স্ক্রিনে।’ কোনও মানুষের সঙ্গে যে লুক কিংবা পোশাকের কল্পনা দুঃস্বপ্নকেও হার মানায়, তেমনই স্বপ্নমাখা ছবিতে উথলে উঠছে ল্যাপটপ মোবাইলের পর্দা। একটি ছবিতে দেখলাম পোপ ফ্রান্সিস মহাকাশচারীদের মতো জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সালমা হায়েক গেরুয়া শাড়ি পরে কোনও মন্দিরে পুজো দিতে চললেন বোধহয়। জীর্ণ ঘরে শুধুমাত্র একটি পাজামাকে সম্বল করে বসে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গায়ে একটি জামাও জোটেনি তাঁর। তুমুল নোংরা এক বস্তির গলির মধ্যে সব হারিয়ে শূন্য চোখে জিরিয়ে নিচ্ছেন ইলন মাস্ক। শীর্ণ, রুগ্ন অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ছবি দেখলেই বলতে ইচ্ছে করবে, “দশটা টাকা রাখুন দিদি। কিছু একটা মুখে দিয়ে নেবেন।”

দুনিয়াকাঁপানো মনীষীরা আজকের দিনে সেলফি তুললে কেমন হতো? এর উত্তরও আছে আন্তর্জালে। চোখ গোল গোল করে দেখেছি, একগাল হেসে গান্ধীজি সেলফি নিচ্ছেন অনুচরদের সঙ্গে। এই তো অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। কোনও গেট টুগেদারে গেলেন নাকি স্যার, পাহাড়ি লোকেশনে? দেখলাম সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সেলফি নিতে ব্যস্ত নেতাজীও। ব্যাকব্রাশ করা চুল আর চকচকে গালের এ কেমন স্বামীজি? ছবির পরে ছবি আসে। কোনও ছবির সঙ্গে ‘এটা দারুণ তো’ গোছের ভাললাগা যেমন থাকে, ঠিক তেমনই কোনও ছবির সঙ্গে মিশে থাকে প্রবল অস্বস্তি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মেশানো ছবি নিয়ে কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের আঙুলের গতিবেগ হয়তো শ্রীহরিকোটা থেকে এইমাত্র মাটি ছেড়ে যাওয়া রকেটের থেকেও বেশি। বার্বি ছবি নিয়ে হৈ হট্টগোল শুরু হওয়ামাত্র নেটদুনিয়া ছেয়ে গিয়েছিল সেলিব্রিটিদের বার্বি মেকওভারে। সৌজন্যে এআই। দেখেছি গোলাপি রঙের গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসছেন রাজ্যের শীর্ষনেত্রী। শাড়ি হাওয়াই চটি উধাও হয়েছে। পরণে বার্বির গোলাপি ড্রেস। শুধু তিনিই নন, গোলাপি আভায় সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল সোনিয়া-রাহুল-অমিত শাহ, এমনকী মোদীকেও। একপাল গরুর সামনে একটি গোলাপী ফতুয়া পরে বেশ পোজ দিচ্ছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। নেটিজেনরা জানেন, মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল এমন কয়েক হাজার ছবি। ক্ষিপ্রগতি ছাড়া এমন হওয়া সম্ভব নয়।

তবে সাবেকি ‘লেন্সে ছত্রাক শুধু, যাকে আমি বলি ছাতা’ আউড়াতে আউড়াতে আমরা কি মেশিনের মধ্যে পুরে দিচ্ছি আরও বেশি অ্যালগোরিদম? ফর্মুলার ওভারডোজে মেশিনেরও কি হ্যাংওভার হচ্ছে ক্রমশ? নেটদুনিয়াই বলল, অনেক জায়গায় এআই ছবিতে নাকি ভুল হয়ে গেছে বিলকুল। ক্যালেন্ডারমার্কা কোনও ছবি দেখিয়ে হয়তো হুকুম করা হয়েছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে—“ফর্মুলা তো কম খাওনি। অতএব, লিখে ফেলো কোটেশন, এক্ষুণি।” কৃত্রিম বুদ্ধির সাদা মনে কাদা নেই। প্রভাতী সূর্যের সামনে ডানামেলা ঈগল দেখে লিখে দিল, ‘সাফল্য পাওয়ার জন্য কোনও কারসাজি নয়। নগ্ন হোন।’ মরুভূমিতে হেঁটে চলা এক একাকী মহিলার নয়নাভিরাম ছবি দেখে লিখল, ‘পারমাণবিক পরীক্ষা করার জন্য আরেকটি শব্দের নাম বিয়ে।’ বিরাট লেকের কিনারায় এক চুম্বনরত দম্পতির ছবি দেখে এআইবাবুর ইনস্পিরেশনাল কোট ছিল, ‘জীবন্ত অবস্থায় কবর দেওয়ার জন্য শৈশবই আদর্শ। কারণ তুমি জানোই না পরে কি পেতে চলেছ।’ অনেকে অবশ্য পেন কামড়াতে কামড়াতে বলতে পারেন, “কথাগুলো তো কালটিভেট করতে হচ্ছে মশাই। খুব ভুল তো কিছু বলেনি!” তবে ঘেঁটে যাওয়া ফর্মুলার এমন হাজারও উদাহরণ আছে আন্তর্জালে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশেরই মতে, আসুক এআই। সবকিছুতেই আসছে যখন, চলে আসুক ফটোতেও। তবে আব্রুটা মানুক। ফর্মুলার মধ্যে মিশে যাক শালীনতাবোধও। আর, যে পুরাতন সাদা কালোতেই চকচক করে, স্ফটিকের মতো আলো ঠিকরায়, তার গায়ে মেকি রং না চাপালে ক্ষতি কি! আমরা সম্মিলিতভাবে এ নিয়ে ভেবে দেখতে পারি।
পরিশেষে বলি, এআই ফোটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করা আমার এক জুরিখনিবাসী বন্ধু সম্প্রতি আমায় একটি ইমেল পাঠায়। দেখি কলকাতারই রেললাইনের ধারের কোনও বস্তির ছবি। পূতিগন্ধময় এক নর্দমায় মুখ ঢোকাচ্ছে এক উলঙ্গ শিশু। ছবিটা ও কোথা থেকে পেয়েছিল, জানি না। মেইলে লিখেছিল, ‘আমি ড্যাম শিওর ছবিটা এআই দিয়ে করা। তুমি কী বলো?’
ছবি সৌজন্য: Facebook
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
One Response
বাংলায় “খাসা” হয়েছে