(Amar Pal) স্কুল যাওয়ায় একেবারে মন ছিল না কিশোর ছেলেটির। অথচ বাড়ির আদেশ, স্কুলে যেতেই হবে। অগত্যা ব্যাগ নিয়ে বেরোতেই হত। বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লার ব্রাহ্মণবেড়িয়া। মাঠ পেরিয়ে ছেলেটা যখন স্কুলের পথে পা বাড়াত, তার মন পাড়ি দিত কোনও এক অজানা প্রান্তে। সবুজ দেখে কিশোর ছেলেটি সুরের সাগরে ডুব দিত। পথেই পড়ত একটা কলের গানের দোকান। বই হাতে নিয়ে গান শুনতে শুনতে পেরিয়ে যেত সময়। স্কুল যাওয়া আর হত না। সুর এভাবেই তাঁকে গড়ে নিয়েছিল। তিনি লোকসঙ্গীত শিল্পী অমর পাল। ভাটিয়ালি গানের জনক। (Amar Pal)
১৯২২ সালের ১৯শে মে কুমিল্লার ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন লোকশিল্পী অমর পাল। বাংলাদেশের তিতাস নদীর পাড়ে শৈশব থেকে যৌবনের প্রথম ভাগ কেটেছিল। অল্প বয়সেই বাবাকে হারাতে হয়। লড়াই শুরু হয় দারিদ্র্যের সঙ্গে। মা দুর্গাসুন্দরী পালের কাছে হাতেখড়ি লোকসঙ্গীতের। জীবন সংগ্রামই অমর পালকে সুরসাধক করে তুলেছিল। যাত্রা, কবিগান, কৃষ্ণলীলা দেখতে ভালবাসতেন। বাবার থেকে পেয়েছিলেন এই নেশা। যাত্রায় বিবেকের পার্ট করতেন নিয়মিত। (Amar Pal)
ভিডিও: সুরের আকাশে শুকতারা: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
পরবর্তীতে কলকাতায় আসেন তিনি। প্রায় ৮ বছর ধরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের ছোট ভাই আয়াত আলী খাঁ’র থেকে। ১৯৪৮ সালে গীতিকার শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের হাত ধরে আকাশবাণীতে এসেছিলেন। আলাপ হয় সুরের জগতের দিকপাল মানুষদের সঙ্গে। মণি চক্রবর্তী, সুরেন চক্রবর্তী, ননীগোপাল বন্দোপাধ্যায়-এর মতো শিল্পীদের কাছ থেকে লোকসঙ্গীতের তালিম নেন। আকাশবাণী কলকাতার শিল্পী ছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালে তাঁর ভাটিয়ালি গান প্রথম সম্প্রচারিত হয় আকাশবাণীতে।
“বাঁচতে হলে লোকসঙ্গীত-এর জন্যই বাঁচব, মরতে হলেও এই সুরের জন্যেই মরব।” কথা ও সুর দিয়ে এভাবেই নিজেকে মাটির সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। লোকগানের সঙ্গে আধুনিক সুর মেলাতে চাইতেন না। ‘লোকসঙ্গীতের ভেতর লুকিয়ে থাকে সঙ্গীতের অনন্য বীজ’, এই কথাই আজীবন বিশ্বাস করতেন তিনি। অজস্র রেকর্ডের গান গেয়েছেন। বহু সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন। বাবা তারকনাথ, শিউলিবাড়ির মতো সিনেমায় রয়েছে তাঁর গান। রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে অগণিত গান গেয়েছেন। সত্যজিৎ রায়, দেবকীকুমার বসু থেকে শুরু করে ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গেও কাজ করেছেন।
ব্রহ্মপুত্রের কবি – জন্মদিনে ভূপেন হাজারিকা
“কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়” এই গানটি সত্যজিৎ রায় যেন অমর পালের জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। গানটিকে অর্থবহ রূপ দেওয়ার জন্য সত্যজিৎ রায় চাইছিলেন গানের ভিতরে হীরক রাজার দেশের রাজা আর প্রজার কথাও থাকবে সংলাপের আকারে। অমর পাল ধন্দে পড়েছিলেন। “ঠিক ঠিক পারব তো?” প্রশ্ন করেছিলেন। সত্যজিৎ রায় ঘাড় নাড়িয়ে তাঁর প্রতি নিজের আত্মবিশ্বাসের কথা জানালেন। সৃষ্টি হল সেই কালোত্তীর্ণ গান। একবার যখন কথা আর সুর স্রোতের মতো বইতে লাগল, শিল্পী নিজেও ভেসে গেলেন। একবারেই রেকর্ড হয়েছিল গান। গানের মাঝে মাঝে জোড়া হয়েছিল সংলাপ। সংলাপের পর আবার গাইলেন তিনি “দেখো ভালো জনে রইল ভাঙা ঘরে/ মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে।”
বিভিন্ন রকমের গান তার গলায় প্রাণ পেলেও লোকসঙ্গীত যেন দ্যুতি ছড়িয়ে দিত। তাঁর ভাটিয়ালি গানের টান অনুভব করেনি এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। “রাই জাগো, রাই জাগো”, “প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনা মাঝে”র মতো গান আজও শ্রোতাদের অন্য জগতে নিয়ে যায়।
গানের জন্যে তিনি পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে “সঙ্গীত মহাসম্মান” পুরস্কারে ভূষিত করে। এছাড়াও পেয়েছিলেন লালন পুরস্কার। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছিল সাম্মানিক ডিলিট উপাধি। সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কারও ছিল তাঁর ঝুলিতে।
তিনি বলতেন “গাইতে গাইতেই যেন পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারি।” তেমনটাই হয়েছিল। দিনটা ২০১৯ সালের ২০শে এপ্রিল। কলকাতার টালিগঞ্জের বাড়িতে গানের ক্লাস করাচ্ছিলেন। হঠাৎ করে শরীর খারাপ হয়, এবং হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। “প্রভাত সময়ে গোরাচাঁদ খেলিয়া বেড়ায়” গাইতে গাইতেই সুর আর জীবনকে একসঙ্গে বিদায় জানিয়েছিলেন। তাঁর জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। (Amar Pal)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।