নদীর নাম কালাপানি। অনেকটা যেন কাঁঠালবাড়ি চা বাগানের পরিখা। প্রায় দেড় কিলোমিটার বিস্তৃত নদীখাত। বছরের অধিকাংশ সময় সামান্য জল। পুরোপুরি স্বচ্ছ। তলার প্রতিটি পাথরকুচি স্পষ্ট দেখা যায়। পাড় পরিষ্কার ঝকঝক করছে। নদী টপকাতে পারলে পাহাড়। ভুটান পাহাড়। স্থানীয় ভাবে নদীর নামে কালাপানি পাহাড়ও বলা হয়ে থাকে।
সত্তরের দশকে পাহাড়ে তখন ঘন জঙ্গল। বনের ঝোপঝাড় যেমন বন্যপ্রাণি, পাখি, পোকামাকড়কে আশ্রয় দিত, তেমনই প্রতিবাদী, বিদ্রোহী মানুষকেও আড়াল দিত। হ্যাঁ, কাঁঠালগুড়ি চা বাগানের বিদ্রোহীদের, যাঁদের প্রথাগত শিক্ষা বলে কিছু ছিল না। কিন্তু পৃথিবীর পাঠশালায় সামান্য কিছু শ্রমিক শিখেছিলেন, আপন ভাগ্য জয় করতে হবে নিজেদের। নিজের, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্য গড়ার স্বপ্নের নাম কাঁঠালগুড়ি।
[the_ad id=”266918″]
আসলে ইতিহাসের মধ্যেও ইতিহাস থাকে। ঠিক তেমনই নকশালবাড়ির মধ্যেও আরেকটা নকশালবাড়ি ছিল। তবে নকশালবাড়ির ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আর একটা নকশালবাড়ি নয়। এই ভূখণ্ড সম্পূর্ণ আলাদা এক নকশালবাড়ি। নকশালবাড়ির বার্তা ছিল, বিদ্রোহ ছিল, বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ ছিল। ছিল না শুধু নকশালবাড়ির লাইন। একসময় যে লাইনের অর্থ দাঁড়িয়েছিল ব্যক্তিহত্যা, মূর্তি ভাঙা, পুলিশের বন্দুক লুট ইত্যাদি। সেই অর্থে এই আর একটা নকশালবাড়িকে বিকল্প নকশালবাড়িও বলা যেতে পারে।

না, নকশালপন্থা নিয়ে আলোচনা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। এই কলাম এখনও পর্যন্ত রাজনীতি বিবর্জিতই। যদিও রাজনীতিবিহীন কিছু হয় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে এই কলামে হঠাৎ নকশালবাড়ি তুলে আনার কারণ দ্বিবিধ। প্রথমত, নকশালবাড়িকে বাদ দিলে, উহ্য রাখলে, উত্তরবঙ্গের সামগ্রিক পাঠ সম্পূর্ণ হয় না। দ্বিতীয়ত, এই বিকল্প নকশালবাড়িকে ইতিহাসের জন্য উল্লেখ করে রাখা দরকার। বিকল্প নকশালবাড়ি ইতিহাস থেকে হারিয়েই গিয়েছে। নকশালবাড়ি বিদ্রোহ বলুন কিংবা নকশাল আন্দোলন, কোনটির ইতিহাসেই এই বিকল্প নকশালবাড়ির স্থান হয়নি। আত্মত্যাগ, দায়বদ্ধতা, মতাদর্শের প্রতি অবিচলতা ইত্যাদি কোনও কিছুতেই তরাইয়ের নকশালবাড়ির চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না এই বিকল্প নকশালবাড়ি।
[the_ad id=”266919″]
এই বিকল্প নকশালবাড়ির কুশীলবদের কেউ মনে রাখেনি। নকশালবাড়ি নিয়ে এত লেখা হয়েছে, এত গান-কবিতা-নাটক বাঁধা হয়েছে। তার কোথাও যেমন বিকল্প নকশালবাড়ির উল্লেখ নেই, তেমনই অনুপস্থিত তার কুশীলবরা। নকশাল বিদ্রোহের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল শিলিগুড়ির অনতিদূরে তরাইয়ের নকশালবাড়ি গ্রাম থেকে। দ্বিতীয় নকশালবাড়ির অবস্থান ডুয়ার্সে, অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলায়। এখনও এলাকাটি জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যেই পড়ে। বানারহাট থানা এলাকায় ভুটান সীমান্ত লাগোয়া এই বিকল্প নকশালবাড়ির আসল ভৌগোলিক নাম কাঁঠালগুড়ি চা বাগান।

উত্তরবঙ্গের ভুটান সীমান্ত বললে সাধারণত সকলের জয়গাঁর কথা মনে আসে। জয়গাঁ এখন আলিপুরদুয়ার জেলায় পুরসভার স্বীকৃতিহীন একটি গঞ্জ শহর। জয়গাঁর অপরদিকে ভুটানের ফুন্টশিলিং শহর। দুই দেশের টুইন টাউন। ডুয়ার্সে কেউ বেড়াতে গেলে ফুন্টশিলিং হয়ে ওঠে অবশ্য গন্তব্য। ভুটানের প্রবেশদ্বার বলেই পরিচিত এই শহর। বানারহাট থানা এলাকায় ভুটানের আরও একটি প্রবেশদ্বার এই বিকল্প নকশালবাড়ির কাছে। নাম চামূর্চি। চারদিকে বিভিন্ন চা বাগান। চামূর্চি, আমবাড়ি, কাঁঠালগুড়ি ইত্যাদি চা বাগানের মাঝে এক গঞ্জ এলাকা। এখন অবশ্য অনেক উন্নত হয়েছে। নকশাল বিদ্রোহের কালে চামূর্চি ছিল নিছক বাজার। প্রতি বুধবার হাট বসত চামূর্চিতে। সেজন্য আশপাশের আরও কয়েকটি চা বাগানের মতো কাঁঠালগুড়িতেও সাপ্তাহিক ছুটি বুধবার। সেই আমলে হাট মানে শুধু বেচাকেনা নয়, কয়েক ঘণ্টার জন্য অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিকতা, লৌকিকতা, আত্মীয়তা, প্রশাসনিক নানা কার্যকলাপ, এমনকি প্রেম-ভালোবাসার তীর্থস্থান হয়ে উঠতে হাটগুলি। এই চামূর্চির অপরদিকে ভুটানের গঞ্জ শহর সামচি। ফুন্টশিলিংয়ের মতো অত জৌলুস ছিল না তখন, কিন্তু গুরুত্ব ছিল। এখন আরও বেড়েছে।
আসলে ইতিহাসের মধ্যেও ইতিহাস থাকে। ঠিক তেমনই নকশালবাড়ির মধ্যেও আরেকটা নকশালবাড়ি ছিল। তবে নকশালবাড়ির ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আর একটা নকশালবাড়ি নয়। এই ভূখণ্ড সম্পূর্ণ আলাদা এক নকশালবাড়ি। নকশালবাড়ির বার্তা ছিল, বিদ্রোহ ছিল, বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ ছিল। ছিল না শুধু নকশালবাড়ির লাইন।
বিস্তীর্ণ আবাদ নিয়ে কাঁঠালগুড়ি চা বাগান। তখনকার দিনে দাপুটে চা শিল্পপতি রায় গ্রুপের মালিকানাধীন ছিল। জলপাইগুড়ির নানা ক্ষেত্রে এই গ্রুপের প্রথম কর্ণধার সত্যেন্দ্রনাথ প্রসাদ রায়ের (এসপি রায় নামে পরিচিত) ভূমিকা ছিল। ভৌগোলিক ভাবে কাঁঠালগুড়ি সত্যিই বিদ্রোহের আদর্শস্থল। বানারহাট-চামূর্চি সড়কের পাশে হলেও তার অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে পুলিশেরও অনেক সময় লাগত। মূল শ্রমিক মহল্লাগুলি ছিল পাকা রাস্তা থেকে অনেক দূরে। বাগানের গেট দিয়ে পুলিশের জিপ ঢুকে রাস্তা ধরে শ্রমিক মহল্লায় পৌঁছনোর অনেক আগে দ্রুতগতি সাইকেল চা গাছের ফাঁকে একচিলতে পথ ধরে পুলিশ আগমনের বার্তা পৌঁছে দিত। শঙ্খধ্বনি বা উলুধ্বনি দিয়ে পুলিশকে উল্টে সজাগ করার প্রয়োজন পড়ত না। তাছাড়া উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, কোনওটাই তো আদিবাসী বা নেপালি আচারে ছিল না! কাঁঠালগুড়ির উত্তরপ্রান্ত আগলে রাখে কালাপানি নদী। নদী পেরোলেই ভুটান পাহাড়। এক দৌড়ে চলে যাওয়া যায়। পুলিশের তাড়া খেয়ে ওই পাহাড়ে আত্মগোপন করা ছিল কাঁঠালগুড়ির শ্রমিকদের কাছে খেলা মাত্র। পাথরে ভর্তি নদী দৌড়ে পার হয়ে ওই পাহাড়ে পৌঁছনো তখন পুলিশ কেন, সিআরপিএফের পক্ষেও দুঃসাধ্য প্রায়। ঝাঁকে ঝাঁকে পাহাড় থেকে তির ছুটে আসার ভয় ছিলই। তবে সে রকম তির ছুটে আসার ঘটনা কখনও ঘটেইনি। কারণ, শ্রমিকের চেতনায় ছিল, তির ছুঁড়লে পুলিশবাহিনী তাদের আত্মগোপনের নির্দিষ্ট জায়গাটি চিহ্নিত করে ফেলবে।

পুলিশ, সিআরপিএফ সেই চেষ্টা অবশ্য কখনও করেনি অন্য কারণে। পাহাড়টি পুরোপুরি ভুটানের ভূখণ্ড। সীমান্ত লঙ্ঘন করে শ্রমিকরা চলে গেলেও সেই ঝুঁকি স্বাভাবিক কারণেই নিত না পুলিশ, সিআরপিএফ। সেই অর্থে গেরিলা যুদ্ধের জন্য মডেল এলাকা। মূল নকশালবাড়ি লাগোয়া জঙ্গলও একসময় ছিল বিদ্রোহীদের আশ্রয়স্থল। নকশালবাড়ির সেই দুনিয়া কাঁপানো কৃষক বিদ্রোহের প্রায় ২০ বছর পর সেখানে গিয়ে আর সেই জঙ্গল দেখিনি। নকশালবাড়ির নায়ক কানু সান্যাল কেটে ফেলা সেই ফাঁকা বনের এলাকা দেখিয়ে বলেছিলেন, হাতি আর অজগরে ভর্তি ছিল ওই বনাঞ্চল। কিন্তু অজগর কখনও নকশালবাড়ির বিদ্রোহীদের স্পর্শ করেনি। একজন বিদ্রোহীরও ক্ষতি করেনি হাতি। অথচ সেই হাতি ও অজগরের ভয়ে পুলিশ জঙ্গলে ঢুকতে সাহস পেত না। সেই সুযোগে অনিশ্চিত জীবনেও জঙ্গলবাস অনেকটা নিরাপদ হত বিদ্রোহীদের। পুলিশ রসিকতা করে বলাবলি করত, হাতি, অজগররাও নকশালদের ভয় পায়। তাই ওদের কিছু করে না।
[the_ad id=”270084″]
কাঁঠালগুড়ির পাশে ভুটানের পাহাড়ি জঙ্গলটাও একই রকম ভাবে বিদ্রোহীদের বড় ভরসা ছিল। তাঁবু গেড়ে শিবির না বানালেও মাথার ওপর প্ল্যাস্টিক টাঙিয়ে স্বচ্ছন্দে রোদ, বৃষ্টি, শীতে কাটিয়ে দিতেন নকশালপন্থী কাঁঠালগুড়ির বিদ্রোহীরা। কাঁঠালগুড়ি কিন্তু কখনও গেরিলা যুদ্ধ করেইনি। এমন যুদ্ধে নীতিগত আপত্তি ছিল কাঁঠালগুড়ির। এমনকি, অন্য শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে হিংসা, অশান্তিতেও সায় ছিল না তাঁদের। একবার সিপিএম প্রভাবিত সিটুর সঙ্গে গন্ডগোল বাধল। শ্রমিক-শ্রমিকে মারপিট এড়াতে পিছু হটলেন নকশালপন্থীরা। সুযোগ পেয়ে সিটুর লোকেরা তাড়া করল। যদিও শক্তিতে ও মনোবলে নকশালপন্থীরা অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তাড়িয়ে কালাপানি নদী পার করে দিয়েছিল সিটু। সেখানেই জরুরি বিতর্ক চলতে থাকে পিছু হটা নকশালপন্থী শ্রমিকদের মধ্যে। শ্রমিকদের আশঙ্কা হয়, তাদের তাড়িয়ে এলাকার দখল নেবে সিটু। বিপাকে পড়বেন শ্রমিক মহল্লায় থাকা শিশু ও মহিলারা। স্থির হয়, এবার প্রতিরোধ করা হবে। তির ছুড়ে শক্তি প্রদর্শন করা হবে। যদিও সেই তির যাতে প্রাণঘাতী নাহয়, সেজন্য নিচের দিকে ছোড়া হবে, যাতে লাগলেও হাঁটুর নিচে লাগে। কিন্তু খুব বেশি তির ছোড়ার দরকার হয়নি। ঘোর অন্ধকারে প্রবল চিৎকারের সঙ্গে একঝাঁক এলোপাতাড়ি তির মাটিতে ছুড়তেই নকশাল আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল সিটুবাহিনী।
নকশালবাড়ির নায়ক কানু সান্যাল কেটে ফেলা সেই ফাঁকা বনের এলাকা দেখিয়ে বলেছিলেন, হাতি আর অজগরে ভর্তি ছিল ওই বনাঞ্চল। কিন্তু অজগর কখনও নকশালবাড়ির বিদ্রোহীদের স্পর্শ করেনি। একজন বিদ্রোহীরও ক্ষতি করেনি হাতি। অথচ সেই হাতি ও অজগরের ভয়ে পুলিশ জঙ্গলে ঢুকতে সাহস পেত না।
সিপিএম বাহিনীর পরিবারের যাতে কোন ক্ষতি না হয়, সেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন নকশালপন্থী শ্রমিকরা। নকশালবাড়ির বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষকের অভ্যুত্থান। আর কাঁঠালগুড়ির বিদ্রোহ পুরোপুরি শ্রমিকের গণজাগরণ। পুলিশকে আক্রমণ বা বন্দুক লুঠের মতো হঠকারী পথে কখনও হাঁটেইনি কাঁঠালগুড়ি। সিআরপিএফ একবার মারতে মারতে বিদ্রোহীদের নেতা চারোয়া ওঁরাওয়ের দেহটাকে দলা পাকিয়ে ট্রাকের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে নিয়ে গেলেও প্ররোচনায় পা দেননি বিদ্রোহী শ্রমিকরা। গুটিকয়েক বিদ্রোহীর পুলিশ খুন বা বন্দুক লুঠের রাজনীতিতে কখনও বিশ্বাস করত না কাঁঠালগুড়ি। গণসংগঠন গড়াটাই ছিল ওখানকার চা শ্রমিকদের একমাত্র উদ্দেশ্য। চারোয়া ওঁরাওয়ের মতো আরও কয়েকজন শ্রমিক নেতা ছিলেন এই গণজাগরণের অগ্রণী সৈনিক। রঘু লোহার, বুধু মহালি, কারি লোহার। চারোয়া ও বুধু সামান্য লেখাপড়া শিখেছিলেন বিদ্রোহ চলাকালীন। নাম সই করতে পারতেন। চারোয়া অবশ্য নিজের চেষ্টায় বই-ও পড়তেন।
রঘুর সেসবের বালাই ছিল না।
[the_ad id=”270085″]
দশাশই চেহারার রঘু কিন্তু আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। দেখলে যাঁকে ভয় লাগত, তিনি আবার সুন্দর মাদল বাজাতেন। তাঁর মাদলে বিদ্রোহের বোল বাজত। পরবর্তীকালে শহর থেকে যাঁরা যেতেন কাঁঠালগুড়িতে, তাঁরা রঘুর মাদলে প্রায় উন্মাদ হয়ে যেতেন। মাদল নিয়ে রঘু ছিলেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। তাঁর ডাকে বয়স, লিঙ্গভেদে সবাই বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। অত দশাসই চেহারা, দেখলে মনে হত এখনই বুঝি হা রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। মোটা গোঁফে ডাকাবুকো লোকটার মুখে কিন্তু হাসি লেগেই থাকত। স্বভাবরসিক রঘু কালাপানি পাহাড়ে আত্মগোপন পর্বে সবাইকে জমিয়ে রাখতেন। চারোয়া ওঁরাও ছিলেন উল্টো প্রকৃতির। রাশভারি ব্যক্তিত্ব। সবাই তাঁকে ডাকত সর্দার বলে। আসলে পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন সর্দার পদে। চা শ্রমিকদের পরিচালনা ছিল কাজ। সেই নেতৃত্বগুণটা কাজে লেগেছিল সংগঠনে। তিনি হাঁক পারলে বিরোধীরা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে পড়ত। লম্বা, ঋজু চেহারাটার ওপর পুলিশি নির্যাতন কম হয়নি। কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শ্রমিক ইউনিয়নটা আগলে রেখেছিলেন অভিভাবকের মতো।

আর ছিলেন বুধু মহালি। বেঁটেখাটো চেহারা, স্বভাবে নির্বিরোধী, কিন্তু চেতনায়, দায়বদ্ধতায় দৃঢ়। তিনিও ছিলেন শ্রমিক ইউনিয়নটির আর এক অভিভাবক। চা বাগান মালিক, পুলিশ বলত নকশাল ইউনিয়ন। একসময় এই ইউনিয়নের প্রথম সদস্যরা সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটুতে ছিলেন বটে। কিন্তু নকশালবাড়ির ডাক শুনে সিটু ভেঙে পৃথক ইউনিয়ন গঠন করেন তাঁরা। যদিও ষাট-সত্তর দশকের সেই উত্তাল সময়ে এই ইউনিয়নের সঙ্গে নকশালবাড়ির মূল নেতাদের কোন যোগ ছিল না। মূলত এক বাঙালি যুবক ছিলেন এই বিকল্প নকশালবাড়ির প্রাণভোমরা। অনেকটা ছত্তিসগড়ের শঙ্কর গুহনিয়োগীর মতো। শ্রমিক জীবনের দৈনন্দিনতায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন আদতে জলপাইগুড়ির বাসিন্দা শঙ্কর।
[the_ad id=”270086″]
কাঁঠালগুড়ির সুজিত বসুও ছিলেন আদতে জলপাইগুড়ির যুবক। কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে জড়িয়ে পড়েছিলেন সিপিএম রাজনীতিতে। নেতৃত্বের নির্দেশে ওই বয়সেই চলে গিয়েছিলেন বানারহাট থানা এলাকার চা বাগিচায় শ্রমিকদের মধ্যে থেকে ইউনিয়নের কাজ করতে। নকশালবাড়ি বিদ্রোহের ডাকে সাড়া দেওয়া সুজিত বসুকে আশ্রয় দিয়েছিল কাঁঠালগুড়ি। বিকল্প নকশালপন্থার সূতিকাগার এই কাঁঠালগুড়ির বিদ্রোহে, সংগঠন বিকাশে সুজিতের অবদান অপরিসীম। শ্রমিক মহল্লাই ছিল তাঁর ঘরবাড়ি। খাওয়া, শোওয়া ইত্যাদি সব শ্রমিকের বাড়িতে। মাতৃভাষার মতো চা শ্রমিক আদিবাসীদের ভাষা সাদরি এবং নেপালি বলতেন। সমান দক্ষ ছিলেন ইংরাজি ও হিন্দিতে। মূলত তাঁরই উদ্যোগে কাঁঠালগুড়িতে রাজনৈতিক শিক্ষা সম্প্রসারিত হয় একেবারে সাধারণ শ্রমিক পরিবারে।
[the_ad id=”270088″]
নকশালপন্থার বিকল্প সর্বভারতীয় ধারার সঙ্গে কাঁঠালগুড়ির যোগ তৈরি হয়েছিল বটে, কিন্তু কাঁঠালগুড়ি বরাবর গুলি-বন্দুকের বদলে বিশ্বাস রেখেছে গণচেতনার বিকাশে। অপরিসীম দুঃখ-কষ্ট সয়ে এই রাজনৈতিক জীবন কাটাতে কাটাতে শরীর ভেঙে গিয়েছিল সুজিত বসুর। অল্পবয়সে হৃদরোগ তাঁকে কাবু করে। অর্থসংকটে তেমন ভাবে চিকিৎসা হয়নি। মাত্র ৪০ বয়সে সুজিতের মৃত্যু হয়। বিকল্প নকশালবাড়ির প্রধান প্রাণপুরুষ চলে যান নিঃশব্দে। আরও দু’জন বাইরের মানুষ এই বিকল্প নকশালবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। একজন জলপাইগুড়ির অনিল মুখোপাধ্যায়, অন্যজন কবি দিলীপ ফণী। বর্ণময়, ঘটনাবহুল তাঁদের জীবন। নকশালবাড়িকে বাদ দিয়ে যেমন উত্তরবঙ্গকে জানা সম্পূর্ণ হয় না, তেমনই কাঁঠালগুড়িকে না চিনলে নকশালপন্থা তো বটেই, উত্তরবঙ্গে বিদ্রোহের আরেকটা স্ফূলিঙ্গ উপেক্ষিত থেকে যায়। পাঠকের জানার উৎসাহ থাকলে এই স্ফূলিঙ্গ তৈরি করা নেতাদের আত্মত্যাগের অধ্যায় আলোকিত করা যেতেই পারে ভবিষ্যতে।
কর্মসূত্রে কলকাতায় দীর্ঘদিন বসবাসের পর থিতু শিলিগুড়ি শহরে। নিজেকে ডুয়ার্সের সন্তান বলতে ভালোবাসেন। গ্রামের আদি বাড়ির একপাশে বোড়ো আদিবাসী বসত, অন্যপাশে সাঁওতাল মহল্লা। বক্সার রায়ডাক জঙ্গল গ্রামের কাছেই। শৈশব, কৈশোরে বাড়ির উঠোনে চলে আসতে দেখেছেন হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ। জঙ্গলে কুল কুড়োতে কুড়োতে আর নদীতে ঝাঁপিয়ে বড় হওয়া। প্রকৃতি আর উপজাতিরাই প্রতিবেশী। যৌবনে এই পরিবেশে কিছুকাল বাউন্ডুলে জীবনের পর সিদ্ধান্ত, সাংবাদিকতা ছাড়া আর কোন কাজ নয়।
One Response
উত্তরের আরও এক অজানা অধ্যায় জানলাম। তবে আরও কিছু অপূর্ণ রইল।