পুজো— অবশ্যই দুর্গাপুজো (Durga Pujo)— মানেই নানারকম সম্ভব-অসম্ভবের সংমিশ্রণ। যা কখনও হয় না, তা ওই শারদীয় পাঁচদিনে হয়, বা হতেই পারে। তেমনই কিছু স্মরণবৃক্ষের ফল আপনাদের জন্য আহরণ করে এনেছি। সত্যির সঙ্গে সামান্য কল্পনা মিশিয়ে নিন (যেমন আমি করেছি), দেখুন তো, কেমন লাগে…
আমার যে কাকিমা আজ প্রায় এক যুগ শয্যাশায়ী, তিনি একসময় ডাকসাইটে সুন্দরী, প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্না এবং দক্ষিণ কলকাতার মুখোজ্জ্বলকারিণী লড়াকু মহিলা জেমস্ বন্ড ছিলেন। সেই গল্পই বলছি। কিন্তু তার আগে একটু বলি, সেই সময়ের হাজরা-ভবানীপুরের দুর্গাপুজোর মাহাত্ম্যের কথা। তিনদিক দিয়ে ঘিরে আছে সঙ্ঘশ্রী, যুবমৈত্রী ও ফরোয়ার্ড ক্লাব। আলোর চমক, আওয়াজের হুহুঙ্কার, মাইকের লড়াই, “তুমি যেখানেই থাকো”-র প্রতিযোগিতা, বাঁশের বেড়াজাল, সর্পিল গতির ভিড়, পুলিশের পরাক্রম, মাঝেমাঝেই বসুন্ধরা-কাঁপানো বাজি— এসব ছাড়া এই ত্রিকোণ সাম্রাজ্যে কি পুজো হত নাকি? সবাই মেনেও নিত।
কিন্ত, ওই যে বললাম— বাঁশ। সর্বস্বাধীনতাহরণকারী বাঁশ। আপনার বাড়ি, বেরিয়েছেন বেগুনি-ফুলুরি কিনতে, মনটা খুশি খুশি, সপ্তমীর বিকেল, ফিরছেনও খুশি খুশি। এহাত ওহাত করছেন গরম ঠোঙা। ওমা! বাড়ি ফেরার গলিটা কোথায় গেল? গলি উধাও! তার বদলে, সামনে বাঁশের ব্যারিকেড, তাতে “সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন” ব্যানার থেকে আপনার দিকে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাথাটা ঘুরল, তো? একটু সুস্থ হয়ে দেখলেন, ওই তো দু পা দূরেই বাড়ি, বারান্দায় দিব্যি আপনার চেক-কাটা লুঙ্গি ঝুলছে! কিন্তু গৃহপ্রবেশ হবে কি করে?
হবে না। দুর্গম গলি, দুস্তর দরজা…

কাকিমার যৌবনের স্বর্ণযুগে, উনিও একবার এই খুড়োর কলে পড়েছিলেন। নির্বিরোধী অমৃত ব্যানার্জি রোডে (ওঁরই পূর্বপুরুষের নামে রাস্তা) কাকিমার বাপের বাড়ি। পুজোর সময়ে কালীঘাট এবং ত্রিকোণ পুজো-সাম্রাজ্যের অস্বস্তিকর রকম কাছে। বেরিয়েছিলেন বিকেলে। তখন মহাষ্টমী স্নো-পাউডার মেখে সাজছে। কাকিমার কোলে তুতুলদি, পাশে বেবির বাধ্য আয়া, তার হাতে কয়েকটি ব্যাগ। শিশুহস্তে সুন্দরী কাকিমা ঠিক কেন ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, সে বিষয়ে আমাদের পারিবারিক ইতিহাস নীরব। কাকার এই কাহিনিতে কোনও ভূমিকা নেই।
আরও পড়ুন: পুজোর ফ্যাশনের সেকাল একাল
যাই হোক, ভ্রমণশেষে অমৃত ব্যানার্জি রোডের প্রায় দোরগোড়ায় এসে কাকিমাবাহিনী আটকে গেলেন। সেই যে সঙ্ঘশ্রীর আছড়ে-পড়া ভিড়ের সুনামি তাঁদের ঠেলতে, পিষতে এবং পথভ্রষ্ট করতে লাগল, আর বেরোতেই পারেন না। শিশু তুতুলদি সুযোগ বুঝে হাঁ হাঁ করে কাঁদতে লাগল।
সামনে বাঁশ ও নজরদারি গুঁফো পুলিশ। কাকিমা যত দেখাচ্ছেন, “ওই তো আমার বাড়ি, টুক করে গলে যেতে দিন, কোনো অসুবিধে হবে না,” তত কঠোর হয়ে পুলিশ বলছে, “মেয়েদের লাইনে দাঁড়ান, নিয়ম ভাঙার নিয়ম নেই।“ কাকিমা একবার বোঝালেন। দুবার বোঝালেন। তৃতীয়বার অর্ধেক বোঝালেন। ততক্ষণে ওঁর গোলাপি ফর্সা রং রক্তবর্ণ হয়ে গেছে, চোখ দিয়ে অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্ঘশ্রীর মা দুর্গা আর কাকিমার রূপে খুব একটা ফারাক নেই। কাকিমার সিংহ ছিল না, এই যা। মহিষাসুররূপী পুলিশ তো ছিল।
তুতুলদি কান্না থামিয়ে গুলুগুলু চোখে ভুবনদর্শন করছে। কাকিমা ওকে আয়ার হাতে দিলেন। কীসব কিনেছিলেন, সেই প্যাকেটও হস্তান্তর করলেন। জামদানি শাড়ির আঁচল কোমরে মজবুত করে গুঁজলেন। তারপর, নির্ভুল লক্ষে গুঁফো পুলিশের গালে একটি দুর্গাসুলভ চড় কষিয়ে, হতভম্ব আয়াকে ডানহাতের বকবার আঙুল বেঁকিয়ে ডেকে নিলেন। তারপর বাঁশ ডিঙিয়ে, লাইনে না দাঁড়িয়ে, সোজা এগিয়ে গেলেন অমৃত ব্যানার্জি রোডের পরিচিত আশ্রয়ে।
যা দেবী সর্বভূতেষু কাকিমারূপেণ সংস্থিতা —
শোনা যায়, পুলিশটি এরপর সমগ্র নারীজাতির প্রতি অতিমাত্রায় শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েছিল।

বাবার কাছে শুনেছি আমার মায়াপিসি ওর কিশোরী বয়সে খুব খুব শীর্ণকায় ছিল। প্রমাণ? হাজারিবাগের অনেক স্মরণীয় ঘটনার মধ্যে একটি, মায়াপিসী লু-তে উড়ে গিয়েছিল। মানে, পুরো উড়ে গিয়ে মোগলসরাইতে পড়েনি, খোলা মাঠে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। তাই বা কম কি?
যে সময়ের কথা, তখন মায়াপিসি সপরিবারে কোনও ‘নমো যন্ত্র’-টাইপের জায়গায় থাকে। পিসেমশাই মাইনিং এঞ্জিনিয়ার ছিলেন যে। পুজোর সময় অবশ্যই কলকাতায় আসত। আর আমরা সদলবলে ঠাকুর দেখতে যেতাম। ফুচকা খেতাম। মায়াপিসির পরিবার প্রবাসী বাঙালির উৎসাহে যেসব পুজোয় দুর্ধর্ষ ভিড়, সেসব পুজোয় আগে ছুটত। ‘দুর্ধর্ষ ভিড়’ কাকে বলে আপনারা জানেন? যে ভিড়ে চোখে সরষেখেত দেখতে হয়, প্রতিটি শ্বাস নিতে হয় কৃতজ্ঞ চিত্তে। প্রাণ হাতে করে প্রাণ ধারণ করতে হয়। তাকে বলে ‘দুর্ধর্ষ ভিড়’। যেমন হত সন্ধেবেলায়, মুক্তদলের প্যাণ্ডেলে দুর্গাবাহিনী ও মহিষাসুরের ‘লাইট ও সাউন্ড’ শো-তে। একেবারে সাংহাইয়ের সাংঘাতিক গোছের। হরিশ মুখার্জী রোডে পুলিশবাহিনী নামিয়েও কিস্যু করা যেত না। দেবীর হুঙ্কার, অসুরের আস্ফালন, সিংহের তর্জন, চারপাশে গুহাজাতীয় পরিবেশ থেকে কারা মুখ বাড়িয়ে ভয় দেখাচ্ছে, দুর্গার তৃতীয় নয়নে ভিসুভিয়াস জ্বলছে — উফ্, কোথায় লাগে সুপারহিরো সিনেমা!

তো, খুব সম্ভব নবমীর সন্ধেবেলা মায়াপিসি, ওর মেয়ে পিউ সহ, আমরা কজন হাজির মুক্তদলের যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশে। সামনে বললাম না, কারণ সামনে যাওয়ার সাধ্য একমাত্র মহাভারতের কৃষ্ণর থাকতে পারত— বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে যদি উন্মত্ত জনতাকে নিস্তেজ করে দিতেন। পরিবারের জ্ঞানীজনেরা বারণ করেছিলেন, যেও না। ভিড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে। আমরা শুনিনি।
ত্রিভুবন-কাঁপানো শঙ্খধ্বনির মধ্যে দিয়ে মহাসমর শুরু হল। এই সিংহ তেড়ে যাচ্ছে, তো অসুর বিকট অট্টহাসি হাসছে, সাপের ফোঁসফোঁস, অস্ত্রের ঝনঝন— নিয়মমাফিক চলতে লাগল। যখন দুর্গা শত্রুপক্ষকে কাবু করে ফেলেছেন, শান্তির বাজনা ইত্যাদি বাজছে— হঠাৎ আর্তনাদ!
কে রে বাবা! “নিয়ে গেল, নিয়ে গেল, পালাচ্ছে— শিগগির ধর! আর তুমি কী দেখছ, তাড়া করতে পারছ না?” কাকে ধরব? কে, কী নিয়ে গেল? ততক্ষণে ভিড় কিছুটা পাতলা হয়েছে। দেখি, মায়াপিসি হাপুসনয়নে কাঁদছে। “আমার সোনার হারটা ছিঁড়ে নিয়ে পালাল রে, কে যে নিল দেখতেই পেলাম না…”
স্বাভাবিকভাবেই পিসেমশাই ইত্যাদি যাঁরা সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা বকাবকি করতে লাগলেন। কেন গয়না পরে এই বীভৎস ভিড়ে এসেছিলে? বুদ্ধি নেই কোনও? আমাদের চারপাশে তখন সহানুভূতির স্রোত। ওমা, পুজোয় পরব না তো কবে পরব? এই শাড়িটার সঙ্গে ম্যাচ করে পরলাম।

হঠাৎ দেখি, মধুপিসির ছেলে মিন্টুদা। উত্তেজিত। “তোমরা এখানে? কী হিজিবিজি সময় নষ্ট করছ? ২৩ পল্লীতে দুর্গা দুধ খাচ্ছেন!” অ্যাঁ, সে কি? এমন হয় নাকি? হয় হয়, জানতি পারো না। মুহূর্তমধ্যে আবহাওয়ার পরিবর্তন। ম্যাজিক! যে মায়াপিসি এতক্ষণ শোকের মহাসমুদ্রে ডুবে ছিল, সে সকলকে ছাড়িয়ে আগে ছুটতে লাগল। “দাঁড়াও, আমরা আসছি।“ “শীগ্গির আয়, দুধ ফুরিয়ে যাবে যে! আমাদের কোলিয়ারি মুলুকে এসব কোথায় পাব?”
সেদিন কিন্তু লু বয়নি। তবু মায়াপিসি উড়ে গিয়েছিল। আর এই চমৎকার ঘটনার পর থেকেই ২৩ পল্লীর বিখ্যাত দুর্গামন্দিরের সামনে দিয়ে গেলেই মণিহারা মায়াপিসির ঊর্ধশ্বাস উড়ান মনে পড়ে।
ভবানীপুরের রূপচাঁদ মুখার্জী লেন সারা বছর একটি অতি সাধারণ গলি। যাই হোক, এই সাধারণ রূপচাঁদ মুখার্জী লেনের কিন্তু পুজোর সময়ে সম্পূর্ণ নতুন চেহারা। এক তো প্রতিমা সুন্দর, তায় সিদ্ধার্থ রায় তখন মুখ্যমন্ত্রী, উনি আসতেন প্রধান অতিথি হয়ে, কিন্তু তা ছাড়াও…
সারাদিন, সম্ভব হলে সারারাত, ওখানে কেউ না কেউ হারিয়ে যেত। না, ‘কালা জাদু’ নয়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভবানীপুরী সংস্করণও নয়। ঠাকুর দেখতে এসে ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া। একজন ঘোষক চিল-চিৎকার করে, মহোৎসাহে বলে যেতেন, “বেহালা-সরশুনা থেকে এসেছেন প্রভাত সমাদ্দার, আপনি যেখানেই থাকুন, অবিলম্বে আমাদের কার্যালয়ে চলে আসুন। এখানে আপনার জন্যে বিল্টু বিশ্বাস অপেক্ষা করছেন।” একটু বদলে দিন। নৈহাটির শুভা সাহারায় (ওনার পদবি, মরুভূমি নয়) হারিয়ে গেলেন, আকুল অপেক্ষায় রয়েছেন তপন সাঁতরা। বৈদ্যবাটীর আশা প্রামাণিক — স্বামী ভীম প্রামাণিক ও পরিবার। শোভাবাজারের নবকান্ত গুঁই — ভাই শ্রীকান্ত গুঁই। আমার দিদি একবার শুনেছিল, “নাকতলা থেকে এসেছেন দুর্গা ঠাকুর, আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন লক্ষ্মী ঠাকুর, আপনি অবিলম্বে আমাদের কার্যালয়ে চলে আসুন।“ এই পুনর্মিলন দেখার আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল। (Durga Pujo)

রাত দুটো-আড়াইটেতেও কতবার শুনেছি নিরুদ্দিষ্টদের প্রতি আহ্বান চালু আছে। এই হারিয়ে গেলেন গজানন তরফদার, বা বাপী সামন্ত, বা সৈকত ধর্মাধিকারী। খুঁজছেন শেফালি হাজরা, রবি গাঙ্গু্লি, দুলাল চট্টরাজ। ছোট ছেলে-মেয়ে তো হরদম হারিয়ে যেত। তপাই, বুলি, খোকন, মিতু — কোথায় কোথায় চলে যেত, আর “তোমাদের জন্যে তোমাদের বাবা-মা/ ফুলমেসো/ সবিতাপিসি/ মেজজেঠু/ মাস্টারমশাই অপেক্ষা করছেন” ঘোষণায় আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যেত। যদি ঘোষক জল বা চা খেতেন আর তাই কোনোরকম ফাঁক পাওয়া যেত, অবধারিতভাবে বেজে উঠত কিশোর কুমারের হিট গান, ‘নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে’!
একবার সপ্তমীর সন্ধ্যায়, যখন ‘নিরুদ্দেশ’ ঘোষণার চূড়ান্ত অবস্থা, তখন হঠাৎই রূপচাঁদ মুখার্জী লেন থেকে এক অদ্ভুত ঘোষণার শব্দ ভেসে এল। প্রথমদিকটা স্বাভাবিক। “জগাছা থেকে এসেছ বাবলা মিত্র, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে তোমার দাদা হাবুল মিত্র, তুমি যেখানেই থাকো… ইত্যাদি।”
পরবর্তী শব্দজব্দের জন্যে আমরা প্রস্তত ছিলাম না। হঠাৎই একটা ঝুটোপুটির আওয়াজ আর তারপরেই (সিকোয়েন্স খেয়াল করুন) — “আমি তো হারাইনি, কাকু, জোর করে চেয়ারে বসাচ্ছ কেন? ওই তো আমার মা— আমার আবার দাদা কোথায়?” “আরে দূর মশাই, কে হাবুল মিত্র? যা ইচ্ছে বললেই হল? আমার নাম লালু পাণিগ্রাহী — আমি তো কাউকে খুঁজছি না, এইখানটা ফাঁকা দেখে একটু দাঁড়িয়েছিলুম, অমনি একটা উটকো খোকাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন?” “কে রে! আমিও বাগবাজারের সবলা মিত্র — দেখিয়ে দেব যার তার হাতে আমার ছেলে তুলে দেবার ফল!”
তারপরেই কট্। চরম নৈঃশব্দ্য। ‘নয়ন সরসী’ ‘ভরেছে’র ভ–এর পরে আকস্মিক বিরাম। রূপচাঁদ মুখার্জী লেনের ঘোষণা স্রোতে অভাবনীয় ছেদ। আমাদের কানের বিশ্রাম। খুব ইচ্ছে করছিল বাবলা–সবলা–হাবুল–লালুর কী হল জেনে আসি, কিন্তু মা যেতে দেবে না, জানি।
যা অবশ্যম্ভাবী তাই হল। ঘোষক বদলে গেল। একটি কিঞ্চিৎ ঘুমন্ত কণ্ঠস্বর ‘টেক ওভার’ করল। বেশি জোর দেওয়া হতে লাগল “শারদীয় শুভেচ্ছা/ পল্লীবাসীরা ভালো থাকুন/ দর্শনার্থীরা ধীরে ধীরে আমাদের প্রতিমার কাছে এগিয়ে আসুন” ইত্যাদি বাক্যগুচ্ছে। ‘নয়ন সরসী’ অব্যাহত রইল। প্রাক্তন ঘোষক বোধহয় রিটায়ার করেছিলেন।

আর একটি হারানোর গল্প। অন্যরকম হারানো।
কলকাতার সুন্দরীশ্রেষ্ঠারা কোথাও একজোটে বাস করেন কিনা জানি না। মনে হয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন, যাতে আমরা সুযোগসুবিধা মতো তাঁদের দর্শন পাই। কিন্তু একথা গ্যারান্টি সহকারে বলা যায় যে পুজোর পাঁচদিন অন্তত দক্ষিণ কলকাতার সুন্দরীকুল ম্যাডক্স স্কোয়ারে একত্রিত হন। নিকট প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আছে সমাজসেবী-বালিগঞ্জ কালচারালের অপূর্ব বদ্বীপ। এদের সুন্দরী সমাবেশও যুগ যুগ ধরে ঈর্ষণীয়। আপনাকে শুধু চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। প্রজাপতিতুল্য হালকা পালকের মতো বিশ্বসুন্দরীরা আপনার চারপাশে ওড়াউড়ি করবে। তাদের পাখার দুষ্টুমিষ্টি ছোঁয়ায় আপনি আমূল শিহরিত হতে থাকুন। মাঝেমাঝে আইসক্রিম খান।
মুদিয়ালিতে বাস করতে এসে আমরা চমৎকৃত হলাম। পুজোর দিনে— দুপুরে, বিকেলে, সন্ধেবেলায় এবং সারারাত্রিব্যাপী সুন্দরের শোভাযাত্রা চলছে। আমরা বারান্দাতেই বাস করতে লাগলাম। শহরের সমস্ত বুটিক উজাড় করে এথনিক-নন এথনিক শাড়ির সমারোহয় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যেতে লাগল। এককালে বালিগঞ্জ-কাঁপানো দিদা, সঙ্গে অসাধারণ পরবর্তী প্রজন্ম; এবং মুক্তবন্যাধারার মতো কিশোরী-বালিকাবৃন্দ। বুদ্ধদেব গুহর বইয়ের পাতা খালি করে সুন্দরীরা রঙের ঝরনা হয়ে সারা এস. আর. দাস রোড জুড়ে ঝরছে। যৌবনজলতরঙ্গ! অরূপ বারান্দা ঘণ্টায় ভাড়া দিয়ে অসদুপায়ে কিছু উপার্জনের সম্ভাবনা খুঁজতে লাগল।

কিন্তু, কে না জানে বেহুলার বাসরঘরেও কালনাগিনী প্রবেশ করেছিল! অতএব, ক্রমশ বুঝতে পারলাম সুন্দরবনে বাঘ আছে। পদশব্দরূপী বাঘ। সে এক অদ্ভুত, সাররিয়াল শব্দ। মাইকের আওয়াজ ছাপিয়ে, মরমে প্রবেশ করে, শান্তি ছারখার করছে। ঘসঘস, ঘিসঘিস। ঘসঘস, ঘিসঘিস। ঘসঘস, ঘিসঘিস —
এই যে কোটি কোটি ফুটফল, তার সম্মিলিত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি! জুতোয় তো আর সাইলেন্সার লাগানো যায় না। তাই, কোরাসে দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম বাজতে লাগল আর আমাদের শ্রবণ দিশাহারা হতে লাগল।
দু’বছর এই শব্দতরঙ্গ সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার পর আমরা রণে ভঙ্গ দিলাম। আমার মেয়ে তিন্নি তখন ছোট, রাতে ঘুমোতেই পারত না। “এবার থেকে পুজোয় পালাব। অনেক হয়েছে,” অরূপ ঘোষণা করল। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য! সুন্দরীদের কী হবে? কে তাদের দেখাশোনা করবে? “কপালে থাকলে আবার দেখা হবে— কাশ্মীরে, কন্যাকুমারীতে,” অরূপের বুক ফেটে হাহাকার বেরিয়ে এল। আহা, বড় কষ্ট!
তার পরের পুজোয় আমরা পুরুলিয়ার আরাবাড়ি বলে একটি জায়গায় গেলাম। হাইওয়ের ধারে, নির্জন। একশো মাইলের মধ্যেও বালিগঞ্জ-বিলাসিনীদের দেখা পাবার ক্ষীণতম সম্ভাবনাও নেই। তার ওপর মুষলধারে বৃষ্টি হতে লাগল। “কলকাতাতেও বৃষ্টি হচ্ছে,” অরূপ বলল। “কী করে জানলে?” “নিশ্চয়ই হচ্ছে। কেউ বেরোতে পারেনি।“ মনশ্চক্ষে দেখলাম চান্দেরি/ পৈঠানী/ মুর্শিদাবাদ সিল্ক/ বালুচরি/ ইক্কত/ গাদোয়াল/ চাঁদের আলোর মতো কোটা বা বাঁধনি ইত্যাদি বেশে সুসজ্জিতা সুন্দরীগণ শকুন্তলার মতো দুয়ারপ্রান্তে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। কবে আসবে দুষ্মন্তরূপী রোদ? আমার পাশে, সর্বহারার বেদনা বুকে চেপে, অরূপ ঘুমোতে লাগল। তার পাশে তিন্নি। আরাবাড়িতে কিবা দিন, কিবা রাত!

পুজোর গল্প হবে আর হাজারিবাগের কোনও ঘটনা মনে পড়বে না, তা কি হয়? হয় না। শুনুন তবে।
সে বছর পুজোয় মাকে নিয়ে আমি সারিয়ায় পালিয়েছিলাম। তার আগে কখনও শরৎকালে হাজারিবাগ যাইনি। জম্মু-তাউই এক্সপ্রেসে চড়ে দিব্যি যাচ্ছি, আমাদের কামরায় একটি বেশ বড় অবাঙালি পরিবারও চলেছে। সঙ্গে একটি নববিবাহিতা বউ, আমার মায়ের পাশে সিটে পা তুলে বসে, জমিয়ে গল্প করছে। সিটের তলায় চটি খোলা। মা-ও পা তুলে বসে আছে, চটি নীচে। জানলার বাইরে প্রকৃতি বাংলার সবুজ থেকে ঝাড়খণ্ডের রুক্ষ বাদামি-খয়েরি-লালচে হচ্ছে। এই বরাকর নদী পেরিয়ে গেল, দিগন্তে ছোট-বড় টিলার ঢেউ, গোমো আসব আসব — প্রায় তো পৌঁছেই গেলাম। পরেশনাথ স্টেশন আসতেই, আমাদের পারিবারিক ব্যস্তবাগীশতার প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে মা সিট ছেড়ে উঠে পড়ল। মালপত্র সেই অর্থে কমই। চটি-টটি পরে নিলাম। পরের স্টেশনই হাজারিবাগ। মা নতুন বৌটিকে ভুল হিন্দিতে বিদায়-আশীর্বাদ ইত্যাদি বলে হৈ হৈ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আমিও।
ঘটাং ঘটাং করে ট্রেন আমাদের প্রিয়তম স্টেশনে দাঁড়িয়ে ঘোর নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। হেমলালকে (আমাদের ম্যান ফ্রাইডে) চিঠি অবশ্যই দেওয়া ছিল, “মাজী কো লেকে আ রহাঁ হুঁ, তুম অর বয়েলগাড়ি স্টেশন পে রহনা, ইত্যাদি”। সেই আমলে গরুর গাড়িই একমাত্র যানবাহন, রিক্সাও হয়নি। আমরা শান্ত মনে হেমলালের অপেক্ষায় রইলাম।
অপেক্ষা! আমরা মালসহ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কেউ এল না। অতএব, হন্টন। মাকে নিয়ে চিন্তা ছিল, কিন্তু দেখলাম মা বেশ হনহনিয়েই হাঁটছে । দুর্গাবাড়ির কাছে পৌঁছে অবশ্যই মর্মাহত মীরজাফরদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। চিঠি পৌঁছয়নি। আমরা শেষ ল্যাপটুকু গোরুর গাড়িতে লিফ্ট্ পেলাম, ‘নিরালা’য় পৌঁছে নিশ্চিন্ত হয়ে হাত-পা ধুয়ে, বিছানাপত্র পেতে, লণ্ঠন জ্বেলে বসা গেল, এবং মা চা পেল।
তারপরেই বোমা!
“আমার পায়ে তিনটে চটি! কী করে হল? কোথা থেকে এল রে?” মার চোখে স্তম্ভিত দৃষ্টি। টর্চ্ জ্বালিয়ে দেখি, মা নিজের হালকা ধূসর চটির সঙ্গে, প্রায় একই রঙের একটি কঠিন-কঠোরদর্শন, কিঞ্চিৎ হিলওয়ালা চটিও পরে আছে। এ কার?
আমি জানি কার। মনশ্চক্ষে দেখলাম ট্রেনের নতুন বৌটিকে। গয়া বা কানপুর বা অযোধ্যায় নামার সময় ওর কী হবে? পার্শ্ববর্তিনী, আশীর্বাদিকা, মধ্যবয়স্কা, আপাত–নিরীহ বঙ্গমাসীমা যে তার একপাটি চটি নিয়ে হাওয়া দিতে পারেন, তা কি বৌমা কোনোদিন ভেবেছিল? এক যদি না পাগল ভাবে। যাক্, চটির ওপর দিয়ে গেছে, যদি কামড়ে দিত? পরেশনাথ এসে গেছে, এই হৃদয়াবেগে, মা যা খুশি পরে চলে এসেছে। তারপর অতটা হাঁটা! বড় বড় পা ফেলে। সেখানেও মনটা গরুর গাড়ির দিকে। তার মানে, চটি, জুতো, জামাকাপড় — সবটাই মানসিক? কী বলেন?
পুজোর সময়ে কী না হয়! সত্যি সত্যিই হয় কিন্তু…
কলেজে পড়বার সময় থেকে অল্পস্বল্প লেখালেখি শুরু। অনুবাদক এবং প্রাক্তন সাংবাদিক। এখন একটি স্কুলের কাজে যুক্ত।