‘দেবুদা আপনি তো রনজি খেলেছিলেন না? ‘ কৌস্তভ জিজ্ঞাসা করে।
— ‘না রে… সে সৌভাগ্য হয়নি। স্পোর্টিং ইউনিয়নে তিন বছর আর মোহনবাগানে দু বছর ছিলাম। খুব ইরেগুলার ছিলাম ফার্স্ট ইলেভেনে। আর বাকি কেরিয়ার তো নবদিগন্তে মানে, নবদিগন্ত স্পোর্টিং-এ খেলেই কেটে গেল।’
কৌস্তভ বলল, ‘অম্বরীশ কাকু বলত আপনার মতো টেকনিক্যালি পারফেক্ট ব্যাটসম্যান খুব কম দেখা যায়। আপনার আরও অনেক অপরচুনিটি পাওয়া উচিৎ ছিল।’
যে পুরনো সোফাটায় বসে ছিল তাতে হেলান দিয়ে দেবপ্রসাদ ব্যানার্জি বলল, ‘আর বলিস না… অনেক শুনেছি … আর ভাল লাগে না। এইসব স্তোকবাক্য শুনে শুনে দেখতে দেখতে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেল। কাজের কাজ কিছুই হল না আজ পর্যন্ত।’
বাইশ বছরের তরুণ কৌস্তভ চুপ করে বসে রইল মেঝের দিকে তাকিয়ে। পাড়ার ছেলে কৌস্তভ জয়পুরিয়া কলেজে কমার্স পড়ে। নাইট ক্লাস। সারাদিন ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকে। নবদিগন্ত স্পোর্টিং-এর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। সাধারণত চার নম্বরে নামে এবং পার্টটাইম অফস্পিনার। সকলেই বলে হাতে খেলা আছে। ‘বার’ খেয়ে গেঁজিয়ে না গেলে অনেক দূর যাবে। বাঁ হাতে ব্যাট করে, বোলিং করে ডানহাতে। ঠিক দেবপ্রসাদ বা ময়দানে পরিচিত দেবু ব্যানার্জির মতো। কৌস্তভ এখন পর্যন্ত ক্লাব ক্রিকেটে ছটা সেঞ্চুরি, তেরটা হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছে। আশা করা যায় সামনের সিজনেই বড় ক্লাবে ডাক পাবে। কালীঘাট ক্লাবের এক কর্মকর্তা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে তার সঙ্গে। কৌস্তভ মিত্রর পা কিন্তু মাটিতেই আছে। সাফল্যের মদীরায় মাথা টাল খেয়ে যায়নি। দেবু ব্যানার্জির কাছে প্রায়ই আসে টিপস নেওয়ার জন্য। সে খুবই পরিণতমনস্ক। বুঝতে পেরে গেছে লম্বা রেসের ঘোড়া হতে গেলে ব্যাটসম্যান হিসেবে টেকনিক্যালি কারেক্ট হওয়াটা বিশেষ জরুরি।
নবদিগন্ত স্পোর্টিং-এর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। সাধারণত চার নম্বরে নামে এবং পার্টটাইম অফস্পিনার। সকলেই বলে হাতে খেলা আছে। ‘বার’ খেয়ে গেঁজিয়ে না গেলে অনেক দূর যাবে। বাঁ হাতে ব্যাট করে, বোলিং করে ডানহাতে। ঠিক দেবপ্রসাদ বা ময়দানে পরিচিত দেবু ব্যানার্জির মতো।
রবিবার সকালে নবদিগন্ত ক্লাবের কার্যকরী কমিটির একটা মিটিং ছিল। সেখানে ক্লাব সেক্রেটারি প্রদ্যুৎ ঘোষ একটা প্রস্তাব রাখলেন। বললেন, ‘দেবুদা আমাদের ক্লাবে একটানা চোদ্দ বছর খেলেছেন। বড় ক্লাবে অবশ্যই তাঁর খেলার যোগ্যতা ছিল বলে আমি মনে করি। রনজি খেলাও অবশ্যই উচিৎ ছিল। যে কোনও কারণেই হোক দু:খের ব্যাপার, তা হয়নি। দেবুদা ক্রিকেটকে, বিশেষ করে আমাদের নবদিগন্তকে অনেক দিয়েছেন সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তাই, আমি মনে করি আমাদেরও কর্তব্য তাকে কিছু সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া। কারণ, তিনি আমাদের কিছু বলুন বা না বলুন, আমরা জানি তিনি ইদানীং যথেষ্ট আর্থিক অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি ক্রিকেটে এত ডেডিকেটেড ছিলেন যে, চাকরি বাকরির দিকে ঠিকমতো মন দিতেই পারলেন না। এই ডেডিকেশানকে আমরা কুর্নিশ জানাই। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ক্লাবের কোর কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দেবপ্রসাদ ব্যানার্জির সাহায্যার্থে একটা চ্যারিটি ম্যাচের আয়োজন করা হবে নবদিগন্ত স্পোর্টিং-এর সঙ্গে বেঙ্গল রনজি দলের। আমরা চেষ্টা করব যাতে ইডেনে খেলাটা হয়। টিকিট বিক্রির পুরো টাকাটাই দেবুদার হাতে তুলে দেওয়া হবে। এই সামান্য একটা ম্যাচে স্পনসরশিপ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ডোনেশানের জন্য কিছু ইন্ডাস্ট্রিতে আবেদন করা যেতে পারে। এছাড়া আর একটা প্রস্তাব আছে। ওই ম্যাচে নবদিগন্ত স্পোর্টিং টিমে খেলবেন দেবুদা এবং ব্যাটিং অর্ডারে ওই চার নম্বর পজিশানে। সবকিছু যদি পরিকল্পনামাফিক এগোয় তাহলে আগামী সেভেন্থ জানুয়ারি ম্যাচটা হবে বলে আশা রাখি।’
প্রস্তাবটা সাতাশজন কমিটি মেম্বারের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে গেল দু মিনিটের মধ্যে।

হাতের পাঁচ আঙুল কিন্তু সমান হয় না। সজল দাস আর পার্থ মুখার্জি একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিল।
সজলবাবু বললেন, ‘প্রোপোজালটা পাস হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু ব্যাপারটা একটু কেমন হল না!’
পার্থ বলল, ‘কেন সজলদা, কোন ব্যাপারটা?’
— ‘এই দেবুকে চার নম্বরে খেলানোর ব্যাপারটা। ফিনান্সিয়াল হেল্পের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। দেবুর হয়ত কন্ডিশান সত্যি খারাপ…’ এই অব্দি বলে আবার ধোঁয়াশা বজায় রাখেন— ‘যদিও ওর কী আছে না আছে আমরা কেউই ঠিক জানি না… এই আর কি…’
— ‘এটা মানতে পারলাম না সজলদা। এটুকু স্বীকৃতি দেবুদার অবশ্যই প্রাপ্য। তিনি কেমন খেলতেন আমরা অনেকেই জানি। খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়। ওরকম লেফট হ্যান্ডার বাংলায় বেশি আসেনি। এখন আর কতটুকু খেলা আশা করা যায় তার কাছে। সেটা কোনও ব্যাপার নয়। আর ফিনান্সিয়ালি স্ট্রং উনি হবেন কী করে! তার তো সেরকম কোনও সোর্স অফ ইনকাম নেই।’ পার্থ জোরালো সওয়াল করে।
— ‘ হ্যাঁ… সে তো বটেই… এই মনে হল… তাই বললাম আর কি… নবদিগন্তে আছি প্রায় বিশবছর আর কোনও ক্লাবে যাইনি। টিমে আমি দেবুরই সমসাময়িক। ও কীরকম ব্যাট করত আমি জানব না!’…সজল দাস সামলে নিলেন নিজেকে।
পার্থ আর কোনও কথা বলল না। দুজনে চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
দেবপ্রসাদ বাড়ি ঢুকে বললেন, ‘মা তোমার অম্বলটা আজ একটু কম আছে?’
গৌরীদেবী বললেন, ‘হ্যাঁ একটু কম মনে হচ্ছে। তুই আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করিসনি। আমি বারোমেসে রুগী। এইভাবে যে কদিন থাকি… তুই ভালো থাকলেই আমার শান্তি। বিয়ে থা কিছু করলি না। আমি চলে গেলে কে দেখবে তোকে তাই ভাবি রাতদিন…’
দেবু ব্যানার্জি মায়ের পাশে এসে বসে। বলে, ‘আমাকে নিয়ে অত চিন্তা করে শরীর খারাপ কোর না মা। আমি ঠিক থাকব। অবিবাহিত মানুষদের কি জীবন কাটছে না? তাছাড়া ফ্যামিলি হয়নি বেঁচে গেছি। কোনও ফিক্সড ইনকাম নেই। খাওয়াতাম কীভাবে! ক্রিকেটের পেছনে ছুটেই তো জীবন কাটল। কিছু করতেও পারলাম না। অর্ধেকের ওপর জীবনও ফুরিয়ে গেল। আর তো কটা দিন।’
গৌরীদেবী বুড়ো ছেলে দেবপ্রসাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ওরকম কথা বলিস না বাবা… আমি এখনও বেঁচে আছি। বেঁচে থাক বাবা। সুখে থাক। সব রেখে যেন যেতে পারি, ভগবানের কাছে শুধু এই কামনাই করি…’
দেবুর একটা আফসোসের শ্বাস পড়ে। বলে, ‘তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না… এতখানি জীবন কেটে গেল। বাবার তেমন চিকিৎসাও করাতে পারলাম না। ওই সরকারি হাসপাতালে… তাও ভাগ্যিস পারমিতা প্রায় সব খরচটা সামলে দিয়েছিল। প্রভাসদার মতো লোক হয় না।’
পারমিতা দেবপ্রসাদের তিন বছরের ছোট বোন। আর প্রভাস হল ভগ্নিপতি। ব্যবসায়িক সূত্রে শক্তপোক্ত আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে আছে।
বিভিন্ন প্রয়োজনে বোনের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেওয়া দেবুর আত্মগ্লানির অন্যতম কারণ।

কৌস্তভই খবরটা দিল দেবু ব্যানার্জিকে।
— ‘দেবুদা সব শুনেছেন নিশ্চয়ই!’
— ‘কী ব্যাপারে…’
— ‘আপনার জন্যে একটা চ্যারিটি ম্যাচ অ্যারেঞ্জ করা হচ্ছে… মোস্ট প্রোব্যাবলি সেভেন্থ জানুয়ারি। নবদিগন্ত ভার্সেস বেঙ্গল ইলেভেন। আপনিও খেলবেন নবদিগন্তে… ব্যাটিং অর্ডারে চার নম্বরে। জেনারেল বডি মিটিং-এ কাল ডিসিশান ইউন্যানিম্যাসলি পাস হয়ে গেছে।’
— ‘সে কী ! এত কাণ্ড হয়ে গেল, আমি তো কিছুই জানি না।’
— ‘না…মানে, ডিসিশান পাস হবার আগে বোধহয় আপনাকে জানাতে পারছিল না ওরা।’
তারপর একটু চাপাস্বরে বলল, ‘কাঠি করার লোকও তো আছে দু একজন…’
— ‘কী জানি। আমার আর কী বাকি আছে! আমার পেছনে কাঠি করে কার আর কী ফয়দা হবে? এতকাল তো অনেক কাঠি করা হল। তবে কী জানো, হাতে খেলা থাকলে তাকে আটকানো যায় না। কিন্তু খেলতেই যদি না দেওয়া না হয় তাহলে সে এগোবে কী করে…’
— ‘সে যাই হোক, ওরা আজ কালই আপনাকে জানাতে আসবে। আপনি প্লিজ ‘না’ করবেন না। আমি খুব এক্সাইটেড হয়ে আছি আপনার ব্যাটিং দেখব বলে… অম্বরীশ কাকুর কাছে অনেক শুনেছি আপনার স্কোয়্যার কাটের কথা।’
— ‘দূর পাগল… অম্বরীশটাও যেমন পাগল! আমার কি আর কোনও রিফ্লেক্স আছে নাকি? ওসব দিন এ জীবনের মতো বিদায় নিয়েছে।’ দেবুর কথায় পূরবীর বিষাদ। সন্ধে নেমে এসেছে। বাতাসে হিমের পরশ লাগছে। ব্যস্ত রাস্তার দুপাশে দোকানগুলোয় জ্বলে উঠেছে ঝলমলে আলো।
— ‘সে সব সেদিন দেখা যাবে… এখন চলি। আপনি কিন্তু না করবেন না প্লিজ…’
কৌস্তভ সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।
নিকাশিপাড়ার মাঠে নেট প্র্যাকটিস হচ্ছিল। দুপুর একটা বাজে। দেবু দেখল আঠারো থেকে আটত্রিশ সব বয়সের পনের ষোল জন ছেলে নেট প্র্যাকটিস করছে। কোন ক্লাবের নেট পড়েছে বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেগুলো সবই অচেনা। উঠতি প্লেয়ারদের নেট দেখলে দেবু দাঁড়িয়ে পড়ে। এটা দেবুর স্বভাব। ওদের প্র্যাকটিস দেখে মন দিয়ে। টেকনিকে হোক, হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশানে পারফেকশান আনতে হোক নেট প্র্যাকটিসের কোনও বিকল্প নেই। ক্রিকেটারদের যতটা বেশি সম্ভব নেটেই পড়ে থাকা উচিৎ।
নেটে একটা ছেলে ব্যাট করছিল। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়েস। ডানহাতি ব্যাটসম্যান। একটা ছেলে লেগব্রেক করাচ্ছিল অনেকটা করে। ডানহাতি ব্যাটসম্যান একটা বলও ঠিক মতো খেলতে পারছিল না। হয় অফস্টাম্পের বাইরে মিস করছিল বা কানায় লাগছিল কিংবা ফরোয়ার্ড শর্টলেগে ক্যাচ হচ্ছিল। দুবার লেগস্টাম্পের বাইরে পড়া বলে টার্ন মিস করে ল্যাজেগোবরে হয়ে বোল্ড হল। তিনজন মিডিয়াম পেসার আর একটা অফস্পিনারের বলগুলো মোটামুটি ভালোই সামলাচ্ছিল।
দুপুর একটা বাজে। দেবু দেখল আঠারো থেকে আটত্রিশ সব বয়সের পনের ষোল জন ছেলে নেট প্র্যাকটিস করছে। কোন ক্লাবের নেট পড়েছে বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেগুলো সবই অচেনা। উঠতি প্লেয়ারদের নেট দেখলে দেবু দাঁড়িয়ে পড়ে। এটা দেবুর স্বভাব। ওদের প্র্যাকটিস দেখে মন দিয়ে।
আবার একবার অফস্টাম্পের ওপর লেগব্রেকটা কানায় লাগাল। ফার্স্ট স্লিপে পরিষ্কার ক্যাচ হত।
দেবু ব্যানার্জির কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। সে দূর থেকে দেখছিল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে নেটের সামনের দিকে, শর্ট এক্সট্রা কভার যেখানে দাঁড়াত সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। তার পায়ে একটা অনেক পুরনো স্নিকার শ্যু। পারমিতা কিনে দিয়েছিল।
ওখান থেকে বেশ জোরে নেটের ব্যাটসম্যানকে বলল, ‘আরে কী করছ কি! বাঁ পা আরও বাড়াও। ফোর্থ স্টাম্প কভার কর। মাথা ওপরে থাকছে কেন? ঝোঁকাও ঝোঁকাও… বাঁ পায়ের টো মিড অফের দিকে থাকছে না, সেই জন্যই বিট হচ্ছ…’
ব্যাটসম্যান এখনকার ছেলে। দেবুকে চেনে না। আসলে এরা কেউই চেনে না। ছেলেটা স্টান্স থেকে উঠে অবাক হয়ে দেবু ব্যানার্জির দিকে তাকিয়ে রইল। ক্লাবের একজন সিনিয়র প্লেয়ার বোলিং ক্রিজের ওখান থেকে বলল, ‘আরে দূর দূর… খেল খেল… ফালতু জ্ঞান দিচ্ছে।’ দেবু শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।বলল, ‘বাচ্চা ছেলে সব, যথেষ্ট প্রমিসিং… প্রপার গাইডেন্স দিন।’
এই কথা শুনে গ্রুপ লিডারের মাথা গরম হয়ে গেল। ঠোঁট বেঁকিয়ে তেতো স্বরে বলল, ‘তা দাদা আপনি একটু দেখিয়ে দিন না। দেখি কেমন ক্যালি… মলয়েশের লেগব্রেক খেলতে গিয়ে সাঁতার কাটতে হবে… কেউ পারে না… কোথাকার কে!’
দেবু একটুও উত্তেজিত হল না। বলল, ‘সে তো খুব ভাল কথা। জেনুইন অরথোডক্স রিস্ট স্পিনারের খুব অভাব এখন। বিশেষ করে লেগস্পিনার।’
কথা বলতে বলতে ওর দিকে এগিয়ে যায় দেবু। আবার বলে, ‘… কিন্তু তাই বলে ব্যাটসম্যান নেগোশিয়েট করতে পারবে না এটা কোনও কথা হল না।’
বছর পঁয়ত্রিশের সিনিয়র প্লেয়ারটি এ কথায় আরও গরম খেয়ে গেল। উৎকট ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘ ও-ই তো, বললাম তো, দয়া করে একটু দেখিয়ে দিন না… আমরা শিখতে চাই।’
অহংবোধে ঘা লাগা ওই প্লেয়ার কাম কোচ ভাবল, দেবু এবার রণে ভঙ্গ দিয়ে ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে। কিন্তু দেবু মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই… দুটো প্যাড আর গার্ডটা দিন।’
নেটে ব্যাট করা ব্যাটসম্যান নেট থেকে বেরিয়ে এল। দেবু প্যান্টের ওপরেই গার্ড পরে নিল। বলল, ‘ওই ছেলেটিকেই শুধু বল করতে বলুন। মানে ওই লেগস্পিনার…’

দেবু ব্যানার্জি বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান। মলয়েশের লেগব্রেক তার অফব্রেক হবে। তাতে কিছু আসে যায় না। ম্যাট পাতা পিচ। বলের টার্ন নিশ্চিত একই থাকবে।
প্রথম বল। মলয়েশ থ্রি কোয়ার্টার লেংথে বল রাখল অফস্টাম্পের একটু বাইরে। বীভৎস টার্ন নিল। প্রথম বলের সামনাসামনি হয়েছে দেবু অনেক দিন পরে। পা নড়ল না। ব্যাট আর প্যাডের খোলা দরজা দিয়ে বলটা ঢুকে এসে দেবুর লেগস্টাম্প ফেলে দিল। সিনিয়র প্লেয়ার কাম কোচ ভদ্রলোক কুৎসিতভাবে হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ করে হেসে উঠল। মলয়েশ খিক খিক করে হাসতে লাগল মুখে হাত চাপা দিয়ে। অন্য কয়েকজন হাততালি দিতে লাগল। বোধহয় মলয়েশকে অভিনন্দন জানাবার উদ্দেশ্যে। দেবু অচঞ্চলভাবে ব্যাট ঠুকে ঠুকে স্টাম্পটা খাড়া করল। বেল সাজিয়ে দিল। তারপর আবার স্টান্স নিল লেগস্টাম্প গার্ড নিয়ে।
পরের বল একই লেংথে ছাড়ল মলয়েশ, ফ্লাইটটা একটু বেশি রেখে। ব্যাটসম্যানের ফুটওয়ার্কের যোগাযোগ সরাসরি বাঁধা মস্তিষ্কের সঙ্গে। মনে চাপ থাকলে ব্যাটসম্যানের পা নড়ে না। দেবু মাথার ভার ঝেড়ে ফেলে বিশ বছর আগে ইস্টবেঙ্গল মাঠে একটা বিরানব্বই রানের প্রাণবন্ত ইনিংসের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চটপটে পায়ে দু স্টেপ এগিয়ে মাথা একদম বলের লাইনের ওপরে নিয়ে বলটা হাভভলিতে নিল। নিখুঁত টাইমিং-এ বল উড়ে গেল টার্নের দিকে মিড অনের ওপর দিয়ে। সিনিয়র প্লেয়ার উড়ন্ত বলের দিকে তাকিয়ে রইল কোমরে হাত দিয়ে। মলয়েশ আদৌ বিব্রত বোধ করল না। বল হাতে পেয়ে পরের বল করার জন্য তৈরি হল। এবারেও একই লাইনে রাখল কিন্তু একটু বড় লেংথে এবং জোরের ওপর। দেবুর ফুটওয়ার্কে এখন তরঙ্গ খেলছে। সে চকিতে ইনসাইড আউট করে লেগস্টাম্পের দিকে সরে গিয়ে আবার হাফভলিতে বলটা মিট করল মাথা একদম সোজা রেখে বল ঘোরার কোন সুযোগ না দিয়ে। কভারের ওপর দিয়ে বল উড়ে গেল আবার অন্তত পঁচাত্তর মিটার। মাঠের বাইরে একটা বাড়ির দোতলার বারান্দায় বসে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক প্র্যাকটিস দেখছিলেন। তিনি হাততালি দিতে লাগলেন।
মলয়েশের রোখ চেপে গেছে। পরের বলটা আবার একটু ছোট লেংথে করল জোরের ওপর মিডল স্টাম্পে, দেবু যাতে চালাতে না পারে। দেবু বুঝে গেছে গুগলি এখনও রপ্ত হয়নি ছেলেটার। সবকটাই লেগব্রেক ছাড়বে। বলটা ছেড়ে দিলে লেগস্টাম্পের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু দেবু বলটা ছাড়ল না। লেংথ ছোট ছিল। ব্যাকফুটে গিয়ে টার্নের জন্য অপেক্ষা করল… তুলে দিল মিড উইকেটের ওপর দিয়ে। বারান্দায় বসা ভদ্রলোক আবার হাততালি দিতে লাগলেন। মলয়েশের মুখ লাল হয়ে গেল। বোকার মতো হাসল একবার। সিনিয়ার প্লেয়ার প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে জুতোর টো দিয়ে মাঠে আঁকিবুকি কাটতে লাগল।

মলয়েশের জেদ আরও বেড়ে গেল। সে তার হাতের সবচেয়ে বড় টার্ন করবার জন্য তৈরি হল।
বলটা করল অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে। গুড লেংথে। তার হাতে প্রচুর টার্ন আছে। বল ঘুরে লেগের দিকে যাচ্ছিল। দেবু পিটারসেনের মতো সুইচ হিট মারল পপিং ক্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে। সবাই দেখল, বিশ বছর আগে যেমন দেখত, বলটা ফাইন লেগের ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে একটা গোডাউনের চালের ওপর গিয়ে পড়ল। মাঠের সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
এরপর আর একটা বল করল মলয়েশ। হতাশা এবং উত্তেজনায় বলটা হয়ে গেল নীচু ফুলটস, অফ এবং মিডলে। ঠিক ছবির মতো কপিবুক স্টাইলে শরীর সোজা রেখে সোজা ব্যাটে মিডলিং করল। বল তীরের মতো সোজা গতিতে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
দেবু গ্লাভস খুলে নেট থেকে বেরিয়ে এল। নেটে যে ছেলেটা আগে ব্যাট করছিল সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকু আপনি কোন ক্লাবে খেলতেন?’
দেবু আর কোনও ক্লাবের নাম করল না। বলল, ‘নবদিগন্ত স্পোর্টিং ক্লাব’। ততক্ষণে ক্লাবের অন্য ছেলেগুলো ঘিরে ধরেছে দেবু ব্যানার্জিকে। এক ফাঁকে ওই নেটে ব্যাট করা ছেলেটা বলল, ‘নবদিগন্তে আমাকে ঢুকিয়ে নিন না কাকু! আমি খুব খাটব। আমার নাম কান্তম মুখার্জি।’
দেবু তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘হ্যাঁ দেখব… এখন এখানেই ভাল পারফর্ম করার চেষ্টা কর।’
বল ঘুরে লেগের দিকে যাচ্ছিল। দেবু পিটারসেনের মতো সুইচ হিট মারল পপিং ক্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে। সবাই দেখল, বিশ বছর আগে যেমন দেখত, বলটা ফাইন লেগের ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে একটা গোডাউনের চালের ওপর গিয়ে পড়ল।
সিনিয়র প্লেয়ার কাম কোচ এবার দেবুর সামনাসামনি এল। বলল, ‘আপনি কি আগে খেলতেন? আপনাকে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে। বোধহয় স্পোর্টিং ইউনিয়ন টেন্টে। আমি তখন খুব ছোট। আমার পিসেমশায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম। উনি একজন মিডিয়াম পেসার ছিলেন। চোটের জন্য বেশিদিন খেলতে পারেননি অবশ্য।’ ছেলেটির অহমিকা কিন্তু জেগে আছে এখনও। ভাঙে তবু মচকায় না। সে বলে, ‘তবে জানেন কি দাদা আপনি হলেন বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান। মলয়েশের লেগস্পিন আপনার অফস্পিন হচ্ছে। তাই অনেকটা অ্যাডভান্টেজ পেলেন আর কি…’, বলে দাঁত বার করে চালাকের মতো হাসে।
দেবুর কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না ওর কথায়। বলে, ‘চায়নাম্যান বোলারকেও একইভাবে খেলতে পারি। আসল হল প্রপার ফুটওয়ার্ক। আর হ্যান্ড আই কোঅর্ডিনেশান… ঠিক আছে চলি এখন। আবার পরে দেখা হবে। ছেলেগুলোকে দেখবেন ঠিকমতো। চলি…’
দুপুর প্রায় আড়াইটে বাজে। বাড়ি ফিরে দেবু বলল, ‘মা ভাত দাও। এ কী! তুমি এখনও না খেয়ে বসে আছ? না না মা… তুমি এত দেরি কোর না। তোমার বয়েস হয়েছে… ঠিক টাইমে খাওয়াদাওয়া কর।’
— ‘তুই থাম দেবু… তোর খাওয়া হয়নি… আর আমি খেয়ে দেয়ে বসে থাকব! আর জ্বালাস না।’
গৌরী দেবী ভাত বাড়তে থাকেন। আর দেবপ্রসাদ ভাবতে থাকে— মায়ের এতখানি বয়েস হয়ে গেল। আর কদিন আছে কে জানে! সে মায়ের জন্য কিছুই করতে পারল না। এখনও যদি একটা সুযোগ হয়… হায় ভগবান।’ নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে দেবপ্রসাদের।
সন্ধে সাতটা নাগাদ নবদিগন্তের সেক্রেটারি প্রদ্যুৎ ঘোষ আরও দুজন কমিটি মেম্বারকে সঙ্গে নিয়ে দেবু ব্যানার্জির বাড়ির দরজায় কলিং বেলে চাপ দিল।
***
প্রদ্যুৎ ঘোষেরা ঘরে ঢুকে একবার, আবার বেরোবার সময় একবার গৌরীদেবীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। গৌরীদেবী ছেলের গৌরবে প্রগাঢ়ভাবে আপ্লুত হলেন। তার জীবনে সুখের মুহূর্ত খুব বেশি আসেনি। যে কবার এসেছে তার মধ্যে এটা একটা। গৌরীদেবী বললেন, ‘বেঁচে থাক বাবা। বড় ভাল লাগল… আবার এস।’
প্রদ্যুৎবাবু অকৃত্রিম আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ মাসীমা নিশ্চয়ই আসব। দেবুর জন্যে আমাদের যা করণীয় সবই করব। ভাল থাকবেন।’
রাস্তায় নেমে প্রদ্যুৎ বলল, ‘দেবু তালে ওই কথাই রইল। ডেটটা সেভেন্থ জানুয়ারি। স্পনসর বা ডোনারের ব্যপারটা দেখছি কী করা যায়।’
দেবু বলল, ‘আমি আর কী বলব! এসব তো ভাবিনি কখনও…’
— ‘না না… আমাদের তো অনেক আগেই ভাবা উচিৎ ছিল। নবদিগন্তে তুই এত বছর সার্ভিস দিয়েছিস। তাছাড়া আমি অন্তত পার্সোনালি মনে করি তোর অনেক বেশি রেকগনিশান পাওয়া উচিৎ ছিল। তাই চ্যারিটিটা কোনও বড় কথা নয়। আমরা একটা বড় প্ল্যাটফর্মে সুযোগ দিতে চাই, তুই আসলে কোন লেভেলের ব্যাটসম্যান ছিলি সেটা তোকে যারা পেছনে টেনে ধরার চেষ্টা করেছে পুরো কেরিয়ার, তাদের মুখ তোবড়ানো একটা জবাব দিতে চাই। আর পাবলিকের আদালতেও খোলামেলা বিচার হোক।আমরা অনেক প্রাক্তন প্লেয়ারকে ইনভাইট করব খেলার দিন।’
— ‘ও বাবা… আমার পক্ষে এই বুড়ো বয়সে কি ওরকম পারফর্ম করা সম্ভব নাকি! কী যে বলিস!’
— ‘ ওটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমি বিশ্বাস করি রিয়্যাল ক্লাস কখনও মরে না। ট্যালেন্টকে ধ্বংস করা যায় না। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিসনি। ঠিক পারবি তুই… আমরা তোকে চার নম্বরেই খেলাব। তোর পার্মানেন্ট ব্যাটিং অর্ডার। তুই এক কাজ কর। আমাদের প্র্যাকটিসেই আয়। কিছুদিন নেট কর ওখানে।’
দেবু বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
—‘ঠিক আছে, আসি এখন ।’
প্রদ্যুৎ ঘোষ একটা সিগারেট ধরায়। তারপর ওরা তিনজন রাস্তার মোড়ের দিকে হাঁটতে থাকে।

পরদিন সকালে থলে নিয়ে বাজারে যাওয়ার জন্য বের হল দেবু ব্যানার্জি। মীনা বাসন মেজে ঘর মুছে দিয়ে চলে গেছে। মীনা এ বাড়িতে কাজ করছে প্রায় পাঁচবছর। অসুখ বিসুখ না করলে কামাই করে না। সে কৌস্তভদের বাড়িতেও কাজ করে। সে হঠাৎ বলল, ‘দাদা আপনি নাকি আবার খেলবেন! খুব বড় খেলা হবে নাকি… ও বাড়ির দাদা বলছিল। আমাকে দেখতে নিয়ে যাবেন?’
—‘হ্যাঁ, ওই হবে একটা… দেখা যাক,’ দেবু দায়সারা গোছের উত্তর দিল।
রাস্তায় বেরোতেই দেখল বাড়ির উল্টোদিকে নিকাশিপাড়ার মাঠে নেটে ব্যাট করা সেই ছেলেটা, কান্তম না কী নাম, দাঁড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা। দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটার মা। দেবুকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে ওরা দুজন এগিয়ে এল।
কান্তম বলল, ‘বাজারে যাচ্ছেন কাকু। আপনার কাছে এলাম।’
সঙ্গের ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বলল, ‘আমার মা।’
দেখে দেবুর মনে হল ভদ্রমহিলা খুব নিরীহ এবং নরম বিনয়ী ধরণের। তিনি হাত জোড় করে বললেন, ‘নমস্কার দাদা। কান্তম আমাকে সেদিনের কথা সব বলছিল।’
— ‘কী কথা?’
— ‘এই… আপনি কীভাবে সেদিন ওকে ট্রেনিং দিয়ে দিয়েছিলেন’
— ‘না না আমি ট্রেনিং দিইনি। আমি কোনও ট্রেনার নই। খেলতাম এক সময়ে তাই একটু আধটু জানি এই আর কি….’
— ‘হ্যাঁ সেটাই। আপনি কীরকম খেলতেন সেটা আমার ছেলে সেদিন বুঝতে পেরেছে। আমার ছেলে যদি কোনওদিন ওরকম খেলতে পারে তালে ওর ওপরে ওঠা কেউ আটকাতে পারবে না। জানেন… ওর বাবা মারা গেছে দুবছর আগে। এখন এই ছেলেই আমার একমাত্র ভরসা।’
দেবু একটু অধৈর্য হল —‘আপনি আমাকে কী করতে বলেন?’
— ‘আপনি যদি কান্তমকে একটু গাইড করেন কীভাবে নবদিগন্তে ঢোকার চান্স পাওয়া যায়, আর আপনি যদি একটু কোচিং করেন।’
তিনি আবার বললেন, ‘এই ছেলেই আমার একমাত্র ভরসা। খেলে যদি একটা চাকরি বাকরি পায় সেই আশায় দিন গুনছি। দয়া করে যদি একটু সাহায্য করেন। আমাদের তো জানাশোনা তেমন কেউ নেই… তাই আপনি যদি একটু…’
— ‘দিদিভাই আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। আমার কোনও ক্ষমতাই নেই। বলছেন যখন ব্যাটিং-এর ব্যাপারে আমি নিশ্চয়ই কিছু সাজেশান দেব। কিন্তু এর বেশি কিছু তো আমার… হ্যাঁ নবদিগন্ত ক্লাবকে আমি অবশ্যই একবার বলব ওকে রিক্রুট করার জন্য। কিন্তু ডিসিশান তো তাদের হাতে। তারা আমার কথা শুনবেই তেমন কোনও কথা নেই। তবে হতাশ হবেন না। জানুয়ারির সাত তারিখে আমার একটা ওয়ান ডে ম্যাচ খেলার কথা আছে। তাতে ভাল কিছু করতে পারলে দু চারজন হয়ত আমার কথা শুনলেও শুনতে পারে… দেখা যাক… সেদিন আপনারা মাঠেও থাকতে পারেন। কোনও টিকিট লাগবে না। ওপেন টু অল।’
মীনা বাসন মেজে ঘর মুছে দিয়ে চলে গেছে। মীনা এ বাড়িতে কাজ করছে প্রায় পাঁচবছর। অসুখ বিসুখ না করলে কামাই করে না। সে কৌস্তভদের বাড়িতেও কাজ করে। সে হঠাৎ বলল, ‘দাদা আপনি নাকি আবার খেলবেন! খুব বড় খেলা হবে নাকি… ও বাড়ির দাদা বলছিল। আমাকে দেখতে নিয়ে যাবেন?’
কান্তমের মা আবার হাতজোড় করে বললেন, ‘অনেক ধন্যবাদ দাদা। আমরা সাতই জানুয়ারির দিকে তাকিয়ে থাকব। মাঠে যাবার প্রচণ্ড ইচ্ছা রইল। ভগবান যদি মুখ তুলে চান… আজ তালে আসি দাদা। একটু মনে রাখবেন প্লিজ…’
কান্তম বলল, ‘আসছি কাকু’
দেবু বাঁ হাত ওপরে তুলল।

ইডেন গার্ডেন পাওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত। বালিগঞ্জের একটা মাঠে খেলার আয়োজন হল। ছোট হলেও সুন্দর মাঠ। মাঠের দুদিকে গ্যালারি আছে। মাঠটা সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। মাঠে কার্পেটের মতো ছাঁটা ঘাস আছে। চারদিকে গাছপালা আছে অনেক। মনোরম পরিবেশ। পিচ ভালো করে রোল করা হয়েছে। মনে হচ্ছে আগাগোড়াই স্পোর্টিং উইকেট থাকবে। বোলার এবং ব্যাটসম্যান সমান সাহায্য পাবে। বাংলার প্রাক্তন ডাকসাইটে ক্রিকেটার অনেকেই আমন্ত্রণ রক্ষা করে উপস্থিত হয়েছেন। তারা সকলেই দেবু ব্যানার্জিকে চেনেন এবং দুএকজন সিনিক প্রকৃতির লোক ছাড়া বেশিরভাগই দেবপ্রসাদের গুণগ্রাহী। দক্ষিণদিকে উইকেটের পিছনে তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে তারা বলের নড়াচড়া দেখতে পান। প্রাক্তনীরা খুব খুশি। নিজেদের ক্রিকেটার গোষ্ঠীর মধ্যে অনেকদিন পর প্রাণ খুলে আড্ডা দিচ্ছেন। প্যাভেলিয়ন উইকেটের আড়াআড়ি। একদিকের স্টাম্পের মিড উইকেটের দিকে।
বেঙ্গল ইলেভেন টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে ছ উইকেটে দুশো বিরানব্বই রান তুলে দিল পঞ্চাশ ওভারে। দুটো সেঞ্চুরি। নবদিগন্তের সব বোলারই বেদম মার খেল। মাঠ সব দর্শকের জন্য অবারিত দ্বার। শুধু দিনের খেলা। এ মাঠে ফ্লাড লাইট নেই। তারা ধুন্ধুমার চার ছক্কা খুব উপভোগ করতে লাগল। দেবু চার ওভার অফস্পিন বোলিং করে আটত্রিশ রান দিল।
বেলা দেড়টার সময় ব্যাট করতে নামল নবদিগন্ত। কান্তম তার মাকে নিয়ে খেলা দেখতে এসেছে। একদিকে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসেছে।
ষোল রানের মধ্যে দুটো উইকেট পড়ে গেল নবদিগন্তের পাঁচ ওভারের মধ্যে। ওপেনার দুজন আশিস ঘোষ আর সিমন রায়, দুজনই এল বি ডব্লু হল মনোজ বরাটের ইনসুয়িং মিস করে।
দেবু প্যাড পরেই বসে ছিল। গ্লাভস পরতে পরতে ব্যাটটা হাতে নিয়ে মাঠে নেমে উইকেটের দিকে হাঁটতে লাগল। পু্রনো অভ্যেস মতো চোখে আলো সইয়ে নেওয়ার জন্য একবার আকাশের দিকে তাকাল। কান্তম আর তার মা উদ্বেলিত হয়ে প্রচুর হাততালি দিতে লাগল। হাততালি, মাঠে উপস্থিত আরও অনেকে দিল, সজল দাসের মতো দুচারজন নিন্দুক ছাড়া।
মাঠের উত্তর দিকের স্টাম্পে অফ স্টাম্প গার্ড নিল দেবু। উল্টোদিক থেকে জোরালো হাওয়া বইছে। প্রথম বল… মনোজ বরাটের এ ওভারের পঞ্চম বল। ডানহাতি বোলার। অফস্টাম্পের ওপর পুরো লেংথের ডেলিভারি। বলের পালিশ এবং সিম এখনও অটুট। হাওয়ার টানে মাপা নিখুঁত আউটসুয়িং হল। মনোজের ইনসুয়িং। দেবু অফস্টাম্প কভার করে খেলতে বাধ্য হল। বলটা একটুর জন্য কানায় লাগল না। উইকেট কিপার এবং তিনটে স্লিপ আকাশ ফাটানো আবেদন করল। আম্পায়ার বিভ্রান্ত হয়নি। ওভারের শেষ বল। সিমের ওপর সোজাসুজি মনোজের তর্জনির টানে এবার ইনসুয়িং হল। দেবু একদম বুঝতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে কোনওরকমে ব্যাট নামাতে না পারলে পরিষ্কার বোল্ড হত। ওভার শেষ। বাংলার এক নম্বর পেসার মনোজ বরাট সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে ডান হাতটা তুলল দাঁত বার করে হেসে। কান্তম আর তার মা শিউরে উঠল। সজল দাস টেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে পার্থর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
দেবুর মনে তার মায়ের মুখ ভেসে উঠল। মা বোধহয় ঘরের সব কাজ সেরে এবার খেতে বসবে। বেলা প্রায় দুটো বাজে। সূর্য হেলে পড়েছে এই শীতের বেলায়।
ওদিকের ব্যাটসম্যানের নাম সম্রাট। সম্রাট রায়চৌধুরী। পরের ওভারে আর এক মিডিয়াম পেসার প্রতাপ দিন্দাকে খেলার জন্য তৈরি হয়েছে। প্রথম দুটো বল ফ্রন্টফুটে ব্লক করল। তৃতীয় বলটা অফস্টাম্পের প্রায় একফুট বাইরে। আউটসুয়িং করে আরও বাইরে যাচ্ছিল। লোভ সামলাতে না পেরে এবং খুব সম্ভবতঃ চাপমুক্ত হবার জন্য ক্রিজে দাঁড়িয়ে স্কোয়্যার কাট মারল। পা মাথা অনেক দূরে। ব্যাটের বাইরের দিকের কানায় লেগে উইকেটকিপারের হাতে সহজ ক্যাচ। সাড়ে পাঁচ ওভারে ষোল রানে তিন উইকেট। এখন দেখার বিষয় একটাই। নবদিগন্ত অন্তত কুড়ি ওভার খেলতে পারে কি না। প্রতিশ্রুতিমান তরুণ কৌস্তভ মিত্র ব্যাট করতে নামল। তার বোলিং যথেষ্ট মার খেয়েছে। ব্যাটিং-এ বাড়তি কিছু করে দেখাবার তাগিদ আছে তার। ক্রিজে দুজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
প্রথম বল। কপাল ভাল। অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে রসালো হাফভলি। কৌস্তভ ডান পা বাড়িয়ে কপিবুক স্টাইলে ড্রাইভ মারল। কভার আর এক্সট্রা কভারের মধ্যে দিয়ে বল ছিটকে গেল বাউন্ডারিতে। পরের বল লেগ অ্যান্ড মিডলে। মিড উইকেটে ফ্লিক করে একটা সিঙ্গল নিল।
দেবু অফস্টাম্প গার্ড নিল। পরের বলটা এল মিডল স্টাম্পে বাউন্সার। দেবু অনায়াসে ডাক করল। পরের দুটো বল অফস্টাম্পের অনেক বাইরে। ছেড়ে দিল। পরের বলটা ফাইন লেগে ফ্লিক করে এক রান নিল। শেষ বলটা কৌস্তভ ব্যাকফুটে রক্ষণাত্মক খেলল।
হাওয়ার টানে মাপা নিখুঁত আউটসুয়িং হল। মনোজের ইনসুয়িং। দেবু অফস্টাম্প কভার করে খেলতে বাধ্য হল। বলটা একটুর জন্য কানায় লাগল না। উইকেট কিপার এবং তিনটে স্লিপ আকাশ ফাটানো আবেদন করল। আম্পায়ার বিভ্রান্ত হয়নি। ওভারের শেষ বল। সিমের ওপর সোজাসুজি মনোজের তর্জনির টানে এবার ইনসুয়িং হল। দেবু একদম বুঝতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে কোনওরকমে ব্যাট নামাতে না পারলে পরিষ্কার বোল্ড হত।
এবারে মনোজ বরাটের ওভার শুরু হবে। ব্যাটসম্যান পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক দেবপ্রসাদ ব্যানার্জি। বোলারের পিঠের দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে এক নাগাড়ে। রোদে ঝলমল করছে সারা মাঠ।

***
প্রথম দুটো বল গুড লেংথে ।আউট সুয়িং করাতে চেয়েছিল মনোজ বরাট। দেবু ডান পা বাড়িয়ে মাথা বলের ওপর নিয়ে গিয়ে ব্লক করল। বল ভাঙতে দিল না। তৃতীয় বলটা কম লেংথের। অফস্টাম্পের বাইরে থেকে ভেতরে আসছিল। দেবু ব্যাকফুটে গেল।তার ব্যাট ঝলসে উঠল দেড় দশক আগেকার ঔজ্জ্বল্যের একটা স্কোয়্যার কাটে।কভার পয়েন্ট ফিল্ডার নড়ার সুযোগ পেল না। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে কৌস্তভ ব্যাটতালি দিল।মাঠের বাইরে বসে সজল দাস বলল, ‘ খুব রিস্ক নিল দেবু। মিট করতে না পারলে শিওর বোল্ড।’
পার্থ কিছু উত্তর দিল না।মনে মনে ভাবল, ‘ সেটা হলেই বোধহয় তুমি খুশি হতে।’ তারপর ভাবল — মাঠে এরকম কত সজল দাস ঘাপটি মেরে বসে আছে !
ওভার শেষ হলে পিচের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেবু আর কৌস্তভ কথা বলে নিল। দেবু বলল, ‘এই সাদা বলের শাইন বেশিক্ষণ থাকবে না। আর ছ সাত ওভার। ততক্ষণ সিঙ্গল নিয়ে স্ট্রাইক ঘুরিয়ে যা। বরাটের বলটা দেখে খেল। কুড়ি ওভারের পর স্পিনার ওদের আনতেই হবে। তখন দেখা যাবে।’ কৌস্তভ বাধ্য ছাত্রের মতো মাথা নাড়ল।
শীতের দুপুরে বিনা টিকিটের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য থেকে থেকে লোক ঢুকতে লাগল। দেখতে দেখতে গ্যালারি ভরে গেল।
পনের ওভারের পর তিন উইকেটে চৌষট্টি।আস্কিং রেট আট-এর ওপরে। দু একটা ডট বল খেললেই নয় -এর ওপরে চলে যাচ্ছে। আর একটা উইকেট পড়ে গেলেই নবদিগন্তে সূর্য অস্ত যাবার অবস্থা হবে। তবে কুড়ি ওভার খেলে দিতে পারবে মনে হচ্ছে।
একটা বড় স্পনসর যোগাড় করতে পেরেছে প্রদ্যুৎ ঘোষেরা। আর ডোনরদের টাকা যোগ করলে মোটামুটি খারাপ টাকা উঠবে না। দেবুকে দেওয়ার পরও থাকবে কিছু।
দেবু ব্যানার্জী শুধু একটা সাদা বল দেখতে পাচ্ছে। টাকা পয়সা অভাব অভিযোগ কিছু নেই স্নায়ুজালের মনপ্রবাহে। সব শূন্য,সব অদৃশ্য। জেগে আছে শুধু বোলারের হাত এবং একটা সাদা বল। আর শূন্যে দোদুল্যমান সুদীর্ঘকালের না পাওয়ার বেদনামাখা উদাসী বেলুন।গৌরীদেবী এতক্ষণে খাওয়া সেরে একটু রোদ্দুরে গিয়ে বসলেন। শীতের বেলা। রোদ পড়ে এসেছে।গৌরীদেবী বসে বসে ভাবতে লাগলেন ….. আলোমুখে না কালোমুখে ….. কিভাবে মাঠ থেকে খেলার শেষে বাড়ি ফিরবে দেবু ।
ড্রিঙ্কস ব্রেক হল অাঠারো ওভারের পরে। রান তিন উইকেটে বাহাত্তর। বল পুরোন হয়ে গেছে অনেকটাই। তবে পিচে পড়ে বল এখনও নড়াচড়া করছে , ধীর গতিতে। মনোজ বরাটের ছ ওভার বল করা হয়ে গেছে। বদল করে আর একজন মিডিয়াম পেসার আনা হল। ইরাবান ঘটক। বাংলার ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতি। ব্যাটিংয়েও ঝড়ো চুয়ান্ন রান করেছে।
ইরাবানের প্রথম বল। বল নড়ল না। বোধহয় ইয়র্ক করাতে চেয়েছিল। নীচু ফুলটস হয়ে গেল। দেবু ছবির মতো স্ট্রেট ড্রাইভ মারল। তীরের মতো বলটা বোলারের পিছনে বাউন্ডারীতে গেল। পরের বলটা শর্ট, লেগ স্টাম্পের ওপর শরীর লক্ষ্য করে। আস্কিং রেট ক্রমশ: বেড়ে যাচ্ছে।দেবু ঠি ক করল এবার হিসেব করে ঝুঁকি নিতেই হবে। পেছনের পায়ে গিয়ে পুলশট মারল উঁচু করে। নিখুঁত টাইমিং। বল গিয়ে পড়ল স্কোয়্যার লেগের ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে। মাঠ গরম হয়ে গেল ক্রিকেট প্রেমিক দর্শকদের তুমুল চিৎকারে। নীরিহ প্রদর্শনী চ্যারিটি ম্যাচ পেশাদার টুর্নামেন্টের হাড্ডাহাড্ডি উত্তেজক মেজাজে ঢুকে পড়ল সহসা। পরের বলে দেবু ফ্রন্টফুটে অনড্রাইভ মারল। লং অন থেকে ফিল্ডার পড়ি কি মরি ছুটে গিয়ে বাউন্ডারি বাঁচাল। তিন রান হল। স্লিপ পুরো খালি করে দেওয়া হল। একজন ডিপ কভারে আর একজন ডিপ স্কোয়্যার লেগে গিয়ে দাঁড়াল। শেষ বলে চোখ কান বুজে চালাল কৌস্তভ। উঁচু ক্যাচ। লং অফ ফিল্ডার সহজ ক্যাচ ফেলে দিল। ভাগ্য বোধহয় সাহসীর সহায়ক হয়। এরপর স্পিনার আনতেই হল। দেবু ভেবে নিল, ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া এ খেলা জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। যতটা বেশি সম্ভব রান এই সময়েই তুলে নিতে হবে। একজন লেগস্পিনার বল করতে এল। বাংলা দলে নিয়মিত।
পরপর দু বলে স্টেপ আউট করে মিড অনের ওপর দিয়ে দুটো ছয় মারল। বলটা যেখানে গিয়ে পড়ল সেখানেই বসে ছিল কান্তম আর তার মা। কান্তম বলটা কুড়িয়ে মাঠে ছুঁড়ে দিল। দুহাত তুলে শিশুর মতো লাফাতে লাগল।
পঁয়ত্রিশ ওভারের মাথায় দুজনেই সত্তর পেরিয়ে গেল। রান তিন উইকেটে একশ একাত্তর। মাঠে লড়াইয়ের তাপ বেড়ে উঠেছে। ফিল্ডিং ক্যাপ্টেন
সহ-খেলোয়াড়দের সঙ্গে দীর্ঘ শলাপরামর্শে ব্যস্ত থাকতে লাগল।
কৌস্তভ আউট … চল্লিশ ওভারের শেষ বলে।অফ স্পিনার আনোয়ার আলিকে
তোলার জন্য স্টেপ আউট করল। বল বুঝতে পারেনি । স্পিন না করে সোজা টপস্পিন হয়ে গেল। পুরোপুরি লাইন মিস করল। বোল্ড ! মিডল স্টাম্প। চার উইকেটে দুশো এগারো। জিততে গেলে শেষ দশ ওভারে করতে হবে বিরাশি রান ।কৌস্তভ অমূল্য একানব্বই রান দিয়ে গেছে ।দশ রানের জন্য দুশো রানের পার্টনারশিপ হল না। এরপর নামল সৌম্য সেন। বোলিং অলরাউন্ডার। চালিয়ে খেলে।ভয়ডর কম।ময়দানি পরিভাষায় ‘তাড়ু প্লেয়ার’ । সময়বিশেষে এই তাড়ুরা খুব কাজে লেগে যায়, যদি ক্লিক করে যায়।
পঁয়তাল্লিশ বছরের একটা বুড়ো পোড় খাওয়া বহু সংগ্রামের দাগ বয়ে বেড়ানো একটা ব্যাটসম্যান সৌম্যর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেবু সৌম্যকে কোন পরামর্শ দিতে গেল না। সম্পূর্ণভাবে তার ওপরই ছেড়ে দিল তার ব্যাটিং-এর ব্যাপার।
মনোজ বরাটকে লাগিয়ে দেওয়া হল নতুন ব্যাটসম্যানকে তোলবার জন্য। প্রথম বল। সৌম্য দিগ্বিদিক ভুলে প্রায় মাঝপিচে নেমে গেল স্লগ করার জন্য। ব্যাটস্পীড এত বেশি ছিল যে, বল ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে উইকেটকিপারের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পড়ল। দেবু নিজে পঁচানব্বই রানে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবল এই সময়ে সৌম্য আউট হয়ে গেলে সে একার হাতে ম্যাচ বার করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। দেবু সৌম্যর দিকে এগিয়ে কথা বলবার জন্য। দেবু বলল, ‘ তোমাকে চালাতে বারণ করছি না। কিন্তু মনে রেখ ম্যাচটা আমাদের জিততেই হবে। সৌম্য সমঝদারের মতো মাথা নাড়ল। কিন্তু তার উচ্ছ্বলতা থামায় কে। ক্রিজে ফিরে গিয়ে আবার নতুন করে গার্ড নিল। অবাক কান্ড লেগ স্টাম্প গার্ড নিল।
মনোজ বরাটের বল। মিডল স্টাম্পের ওপর ইয়র্কার। সৌম্য চোখ কান বুজে হাঁকড়াল। ভাগ্যের জোরে বলটা ব্যাটের কানায় লাগল এবং স্লিপ যেখানে দাঁড়ায় সেখান দিয়ে ক্যাচ হয়ে বুলেটের গতিতে থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে চলে গেল। মনোজ বরাট প্রবল হতাশায় দুহাতে মাথার চুল ছেঁড়ার ভঙ্গীতে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। দেবু আবার এগিয়ে গেল ওকে কিছু বলার মতো। সৌম্য আবার বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। পরের বল স্লোয়ার, অফস্টাম্পের বাইরে। ছেড়ে দিলেই হত। কিন্তু সৌম্য ছাড়ার পাত্র নয়। লাফিয়ে উঠে হাতুড়ি চালাল। বল পয়েন্টের ওপর উঠে গিয়ে গাছ থেকে পড়া কমলালেবুর মতো নেমে আসতে লাগল। বাউন্ডারির ধারে দাঁড়ানো ফিল্ডার মরীয়া দৌড়তে লাগল ক্যাচটার নাগাল পাবার জন্য। শেষ মুহূর্তে কোন উপায় না দেখে শরীর ছুঁড়ল। বলটা হাতে প্রায় পেয়েই গিয়েছিল। কিন্তু পেল না। আঙুলে লেগে পিছলে গেল। দুটো রান হল। শেষ বল অফস্টাম্পের বাইরে সোজা বল গুড লেংথে। সৌম্য স্কোয়্যার কাট মারতে গেল। ব্যাটে লাগল না। ওভার শেষ। দেবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মাঠের বাইরে প্রদ্যুৎ ঘোষ উত্তেজনায় হাঁসফাঁস করতে লাগল। ঘনঘন সিগারেট ধরাতে লাগল।
রান আটকাবার জন্য জলি শেখকে নিয়ে আসা হল। জলি পার্টটাইম বোলার কিন্তু খুব আঁটোসাঁটো বোলিং করে। ওর বলে স্ট্রোক করা মুশ্কিল। দেবু মিড অনের পাশ দিয়ে ঠেলে দু রান নিল। ও এখন সাতানব্বই। পরের বলে জোরাল ড্রাইভ । সোজা ডিপ মিড অফের কাছে গেল। রান হল না। পরের বলে সিঙ্গল নেওয়ার সুযোগ ছিল। দেবু সৌম্যকে হাত তুলে থামিয়ে দিল। পরের বল লেগস্টাম্পের ওপর। স্কোয়্যার লেগ এগিয়ে দাঁড়িয়েছে। দেবু দেখে রেখেছিল। তার পাশ দিয়ে ফ্লিক করল। ফিল্ডার ডাইভ মারল। বলে আঙুল লাগল কিন্তু বলটা থামাতে পারল না। মাটি থেকে উঠে পড়ি মরি করে ছুটল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। দেবু একশ এক ! ! সারা মাঠ হাততালি দিতে লাগল। সজল দাশও সকলের দেখাদেখি তালি বাজাল। এখন আস্কিং রেট সাত দশমিক নয় পাঁচ ….. । মানে, প্রায় আট। শেষ বলে আটকে গেল দেবু। থার্ডম্যানে ঠেলে একটা সিঙ্গল নিতে চেয়েছিল। ব্যাটে লাগল না। কট বিহাইন্ড হতে হতে বেঁচে গেল। প্রদ্যুৎ ঘোষ শিউরে উঠল। ফের একটা সিগারেট ধরাল। কে জানত সাধারণ একটা প্রদর্শনী ম্যাচ এরকম হাড্ডাহাড্ডি উত্তেজক চেহারা নেবে। কান্তম তার মায়ের পাশে বসে দমবন্ধ করে বসে আছে।
ছেচল্লিশ ওভার চলছে। পাঁচ ওভারে বিয়াল্লিশ রান করতে হবে।
সৌমেনের স্ট্রাইক। ফিল্ডার সব দূরে ছড়ানো বাউন্ডারি আটকানোর জন্য । শুধু একটা শর্ট কভার দাঁড়িয়েছে। সেটাই কাল হল। উদভ্রান্তচিত্ত সৌমেন ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলেই সিঙ্গল নেওয়ার জন্য দৌড়তে শুরু করল। শর্ট কভার বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এসে বলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। উইকেটকিপার যখন বেল ফেলছে সৌমেন তখন মাঝ পিচে। দেবু ক্রিজের মধ্যে দাঁড়িয়ে কপাল চাপড়াল। পাঁচ উইকেটে দুশো একান্ন । এখনও বিয়াল্লিশ রান বাকি । হাতে আছে উনত্রিশ বল। পরের ব্যাটসম্যান অনিন্দ্য সোম নবদিগন্তের উইকেটকিপার। ব্যাট খুব খারাপ করে না। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে জবুথবু মেরে গেছে। দেবু ওর অবস্থাটা ভালরকম আন্দাজ করতে পারল। উইকেটে পৌঁছবার আগেই দেবু ওর দিকে এগিয়ে গেল। ওর কাঁধে হাত রেখে বুড়ো ব্যাটসম্যান দেবু ব্যানার্জী বলল, ‘ ঘাবড়াবার কিছু নেই। তুমি শুধু একটা সিঙ্গল নেওয়ার চেষ্টা কর।
তা অনিন্দ্য সাবলীলভাবেই কাজটা করতে পারল। লংঅফে পুশ করে একটা সিঙ্গল পেল।
হারজিৎ পুরোটাই এখন দেবুর হাতে। দেবু ভাবল ভীরুর মতো বেঁচে থেকে লাভ কি। ব্যাটিং ক্রিজের বাইরে স্ট্যান্স নিল। পরের বলটা এক পা এগিয়ে গিয়ে মিড অন আর মিড উইকেটের ওপর দিয়ে তুলল। বিশাল ছক্কা। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। পিকনিক করার মেজাজে খেলা দেখতে ঢুকে এমন মারকাটারি উত্তেজনার খোরাক পাবে মোটেই আশা করেননি তারা।পরের বলের ড্রাইভটা মাটিতে থাকল।কিন্তু
ঠি কমতো মিডলিং না হওয়ায় শাপে বর হল। বল ব্যাটের বাইরের দিকের অংশে লেগে দিগভ্রষ্ট হয়ে কভার আর পয়েন্টের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে গেল। মাঠ উত্তেজনায় কাঁপছে।
শেষ বলে সিঙ্গল নিতে হল অনিন্দ্যকে ঢাকা দেওয়ার জন্য।
অনিন্দ্য এখনও টিকে আছে। যে চারটে বল খেলতে হয়েছে ভালভাবেই সামলে দিয়েছে।
এখন দু ওভারে করতে হবে বাইশ।
হাতে যদিও পাঁচ উইকেট সেটা শুধু সংখ্যার হিসেবে। এরপর যারা আসবে তারা এই চাপ নিতে পারবে না।
অফ অ্যান্ড মিডলে বল রাখল মনোজ বরাট , বলের ওপর আঙুল ঘুরিয়ে স্লো বাউন্সার। দেবু যাতে ব্যাটে না পায়। দেবু পেছনের পায়ে লেগস্টাম্পের বাইরে সরে গেল। একটু লাফিয়ে উঠে টেনিস শট মারল। একদম টাইমিং হল না। কিন্তু বলটা ধনুকের গতিপথে
উঁচু হয়ে ঠিক ফাইন লেগ বাউন্ডারির বাইরে পড়ল। এই ওভারে দুটো দু রান আর শেষ বলে সিঙ্গল সমেত মোট এগারো রান হল।
ইনিংসের শেষ ওভার করবে ইরাবান ঘটক। ব্যাট করবে দেবপ্রসাদ ব্যানার্জী। জেতার জন্য দরকার এগারো রান। বাংলা একাদশের ক্যাপ্টেন বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও দিতে রাজি হল না। সব ফিল্ডার বাউন্ডারি পাহারা দিতে লাগল। শুধু একটা শর্ট মিড উইকেট রইল। মিস টাইমড শর্ট তালুবন্দী করার জন্য। দেবু প্রথম বলে রান পেল না। চালাল এবং ফস্কাল। উইকেট কিপার বল ধরে দু হাত তুলে লাফিয়ে যেতে লাগল চিৎকার করতে করতে। আম্পায়ার নির্বিকার ভঙ্গীতে কোর্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিলেন।পাঁচ বলে এগারো চাই। পরের বলটা আর ফস্কাল না দেবু। এতক্ষণ ধরে বল দেখার পর বারবার বল ফস্কায় না কেউ। একদম ব্যাটের মাঝখানে এবং এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে ছয়। প্রদ্যুৎ ঘোষ স্ট্যান্ড থেকে নেমে বাউন্ডারি লাইনের ধারে এসে দাঁড়িয়ে রইল মাঠের দিকে চেয়ে। সে পোড় খাওয়া ক্রীড়া সংগঠক । সে জানে এরপর আর দেবুকে আটকাতে পারবে না ওরা।
পারবে না আটকাতে নবদিগন্তকেও। অনেক অপমানের জবাব দেওয়া বাকি ছিল। দেবু তার হয়ে বদলাটা নিল।
চার বলে পাঁচ রান। দেবু পরের বলে অফস্টাম্পের বাইরে শাফল করে মাথা পয়েন্টের দিকে হেলিয়ে ভয়ঙ্কর স্লগ করল লং অনের ওপর দিয়ে । এখনও তিনটে বল বাকি।
স্থূলকায় প্রদ্যুৎ ঘোষ খলবল করতে করতে মাঠের মধ্যে ছুটতে আরম্ভ করল অতি দ্রুত দেবুর কাছে পৌঁছে তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার জন্য।
পিচের আড়াআড়ি দিশা থেকে কান্তমকেও দৌড়ে আসতে দেখা গেল।
প্রদ্যুৎ দেবুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দেবু রে …… তুই শুধু নিজেই জিতলি না, আমার আসল সন্তান নবদিগন্তকেও বাঁচালি।’
কান্তম ততক্ষণে সেখানে পৌঁছেছে। সে বলল, ‘ কাকু….. আমিও একদিন আপনার মতো খেলতে চাই।’
দেবু টেন্টের দিকে হাঁটতে হাঁটতে প্রদ্যুৎকে বলল, ‘ চিন্টু আমার একটা আর্জি আছে। এই ছেলেটাকে যদি নবদিগন্তে রিক্রুট করিস …. ‘
প্রদ্যুৎ ঘোষ হাঁ করে তাকিয়ে রইল দেবুর মুখের দিকে। বলল, ‘ শুধু এইটুকু …… আর কিছু বলার নেই তোর ? ‘
— ‘ ওর মা খুব দু:খী, আমার মার মতো।’
প্রদ্যুৎ বলল, ‘ তুই কোন চিন্তা করিসনি। কাল সকালেই পৌঁছব আমরা মায়েদের কাছে । আজ রাতটা পোয়াতে দে।’
হিমেল হাওয়া লুটোপুটি খাচ্ছে শীতের গোধূলিবেলায়।
ছবি সৌজন্য: Flickr, Wikimedia Commons, Free SVG, Max Pixel,
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণায় জন্ম ১৯৫৩ সালে। কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। প্রথাগত পড়াশোনা থেকে চিরকালই পলাতক। লেখালেখির সঙ্গে জড়িত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। ফিলহাল ডিজিটাল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় মনোনিবিষ্ট। চাকরি ঘুরে ফিরে বিভিন্ন জায়গায়।