বাংলা কার্টুন জগতের অন্যতম প্রাণপুরুষ চণ্ডী লাহিড়ীর লেখা এই নিবন্ধটি প্রকাশ পেয়েছিল কিঞ্জল পত্রিকার রজতজয়ন্তী বর্ষের ‘অমল চক্রবর্তী’ বিশেষ সংখ্যায় (Amal Chakrabarty)। পত্রিকার অনুমতিক্রমে নিবন্ধটি বাংলালাইভের পাতায় পুনঃপ্রকাশিত হল।
বিশেষ ধন্যবাদ কিঞ্জল পত্রিকার সম্পাদক, লেখক, বাংলালাইভের দীর্ঘদিনের শুভানুধ্যায়ী চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়…
চণ্ডী লাহিড়ী
অমলকে আমি শুধু যে চিনি তাই নয়, তার উত্থান, পতন, পুনরুত্থানের অনেক খবর রাখি। অমলের জীবনের সব চেয়ে বড় মানসিক সংকট দেখা দিয়েছিল যখন রেলের পাকা চাকরি ছেড়ে প্রবল ঝুঁকি নিয়ে সে কার্টুনিস্ট হওয়ার স্বপ্ন সহ পথে নেমেছিল। অবশ্য তখন ওর বাবা বেঁচে, বিয়ে করেনি। তবু ঝুঁকি নেওয়া সেদিনও খুব ঝুঁকি ছিল। কারণ অপ্রিয় হলেও স্বীকার করা ভালো, এই পশ্চিমবঙ্গে কোনও সংবাদপত্র মালিকই কার্টুনিস্টকে পাকা চাকরি দিতে রাজি নয় এখন। সেদিন কিন্তু পাকা চাকরি পাওয়া যেত। অন্তত অমলকে পাকা চাকরিতে নেবার জন্য সাধা হয়েছিল।
অমল এক সময়ে অমৃতবাজারে কার্টুন করার সঙ্গে সঙ্গে স্টেটস্ম্যানের জন্যও ছবি করতে শুরু করে। এর জন্যই সুকোমলকান্তি ঘোষ (পত্রিকার অন্যতম ডিরেক্টর) রোটারি ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে কথাপ্রসঙ্গে আমায় বলে বসলেন— একজন ভাল কার্টুনিস্ট দিতে পারেন? আমি তখন আনন্দবাজারে, এবং অবশ্যই কিছু দাম্ভিক। আমার কার্যকালে দেখেছি, আনন্দবাজারের কর্মীদের (একটু উঁচু পদে যারা ছিলাম) স্পষ্ট কথা বলার বদভ্যাস ছিল। সুকোমলবাবুকে স্পষ্টই বললাম, অমলকেই পাকা চাকরি দিন। তার চেয়ে ভালো যোগ্যতার এই সময়ে আর কাউকে দেখি না। সুকোমলবাবুর সে কথা ভালো লাগেনি। এর দুদিন পরেই যুগান্তরে বিজ্ঞাপন দিয়ে তরুণ, অনভিজ্ঞ বহু কার্টুনিস্টের ছবি ছাপা হতে শুরু করল।
কিছুদিন পরে প্রেস ক্লাবে সুকোমলবাবুর সঙ্গে আবার দেখা হল। বললেন— আমায় কার্টুনিস্ট দেবার কী হল?
বললাম— হ্যাঁ, মুখের ওপরই বললাম— আপনি ঠিকে ঝি খুঁজছেন। হোলটাইমার রাখুন। ভালো কার্টুন অমলই দেবে। আমায় আনন্দবাজার হোলটাইমার রেখেছে। বইপত্র কেনার জন্য কয়েক হাজার টাকা দেয়। ভা্লো টাকা দেয়, ভালো কাজ পায়। অমলকে দিন, অমলও দেবে।
সুকোমলবাবু ও তাঁদের পত্রিকাদি সবই এখন পরলোকে। কিন্তু এখনও আমার দৃঢ় বিশ্বাস He is the last of the Mohicans.
এখন যাঁরা কাজ করছেন সবাই সংবাদের ইলাসট্রেশন করছেন। রঙিন ছবি আঁকার সুযোগ পেয়েও রঙের ব্যবহার জানেন না। অন্য দেশের কাগজ প্রায় কেউই পড়েন না। অমল ব্যতিক্রম। দেশবিদেশের খবর সে রাখে। প্রাসঙ্গিক পড়াশোনাও বজায় রেখেছে।
যে সব তরুণ কার্টুনিস্ট হবার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের একটি কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিই— কার্টুন নিরন্তর চর্চার ফসল। আদৌ শৌখিন শিল্প নয়। দুটো চোখে দেখার বাইরে আরও একটি তৃতীয় নয়ন প্রয়োজন, যেটা এই চর্চার ফলে মনের গভীরে গড়ে ওঠে, কপালের নীচে নয়।

ব্যক্তিগত জীবনে অমলের প্রধান গুণ, প্রচুর খ্যাতি সত্ত্বেও সে অসম্ভব বিনয়ী। সাধারণত গুণীরা অহংকারী হয়। অমলের এই বিনয়ী ও সর্বত ভদ্র স্বভাবের জন্য তার সহকর্মীরা প্রায়ই ভাবে— ছেলেটির কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমরা তার কার্টুন ছেপে তাকে ধন্য করছি। পঞ্চাশ বছরের কিছু বেশি মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। নতুন কালের সাংবাদিকদের সবাই না হলেও, অধিকাংশের মধ্যে গভীরতার বড়ই অভাব। কার্টুন বোদ্ধার সংখ্যা আরও কম। এর চেয়েও বড় সমস্যা হল দিল্লি, বোম্বাই-এর সব কার্টুনিস্ট খুব উঁচু মাপের, কলকাতার কার্টুনিস্টরা অচ্ছুৎ। কিস্যু পারে না— পত্রিকা সম্পাদকদের এই বদ্ধমূল ধারণার ফলে, পিসিয়েলকে বসিয়ে দিয়ে শংকরকে দিয়ে কার্টুন করাতো অমৃতবাজার। এক সময় আমাকেও রাজনৈতিক কার্টুন বন্ধ করে কেবল পকেট কার্টুনের ছোট গণ্ডিতে সাঁতার কাটতে বাধ্য করা হয়েছিল।
হাসবেন না। পেঙ্গুইন প্রকাশিত ভারতীয় কার্টুনের যে সংকলন বের হয়েছে তাতে আনন্দবাজারের এক সাব-এডিটরের শৌখিন কার্টুন ছাপা হয়েছে। আমি আনন্দবাজারের স্টাফ কার্টুনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও আমার ছবি ছাপা হয়নি। “কলকাতায় কোনও কার্টুনিস্ট নেই”— এই মিথ্যা বার্তাটি পেঙ্গুইনের মতো আন্তর্জাতিক প্রকাশনার মারফৎ ছড়িয়ে পত্রিকার মালিকরা নিজেদেরই যে লোকচক্ষে হেয় করে তুললেন, এই বোধটাও তাঁদের নেই। মনে রাখা দরকার, আমি এবং অমল কার্টুনে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছি। দিল্লি বা বোম্বের কার্টুনিস্টরা এখনও পর্যন্ত পায়নি।
অমলের সৌভাগ্য, এখনও সম্মানের সঙ্গে কাজ করে চলেছে। তাকে বসিয়ে দিয়ে, দিল্লি থেকে কোনও কার্টুনিস্টের ছবি ছাপা শুরু করেনি তার নতুন প্রতিষ্ঠান। অমলকে নিয়ে সামান্য হলেও ‘কিঞ্জল’ যে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করছে, তাতে আমি আন্তরিকভাবে খুশি। গেঁয়ো যোগীকে ভিক্ষা দেওয়া দরকার। ভিন গাঁয়ের যোগীরা যে ভণ্ড নয় তার প্রমাণ কী?
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।
One Response
চন্ডীদার (লাহিড়ি) সাথে সম্পর্কটা ছিল পারিবারিক। সেই সূত্রে জানি স্পষ্ট বক্তা ছিলেন।, স্বভাব আমুদে ছিলেন।
কেদারনাথ রাবার পথে, রাস্তার পাশ থেকে বরফের চাঙড় তুলে মাথায় রেখে বললেন “ছবি তোল।”
শেষ জীবনে অসুস্থতার মধ্যএও সেই রসবোধ যআয়নই।