শুন শুন সর্বজন শুন দিয়া মন / চিংড়ি নামক পোকার কথা করিব বর্ণন।।
ইলিশ-চিংড়ি বিবাদ লইয়া মত্ত বাঙালি / ইতোমধ্যে দুটি আরো গোল দিয়া ফেলি।।
মোহনবাগান-ইষ্টবেঙ্গল, ঘটি-বাঙালে / চিরকালীন দ্বন্দ সমাস কয় বুঝি তাহারে।।
আহা বেশ! বেশ! বেশ!
ভাই কহিও চিংড়িপ্রেমিক / অধম এই লেখকেরও ভালোবাসা অধিক।।
আমাদের ঘটিবাড়ির লোকজনের চিংড়ি নামের এই পতঙ্গশ্রেণীর প্রোটিনের ওপর পক্ষপাত একটু যেন বেশিই। তাদের রোজকার মেনুতে মৎস্যগোত্রীয় না হয়েও সসম্মানে এবং নিজগুণে উত্তীর্ণ এই পোকাটির যেন অবারিত দ্বার (shrimp recipes)। সেই লেগ্যাসি বয়ে বেড়াতে গিয়ে বাড়ির বাজার সরকারও বুঝে যান একসময় পুঁইশাক/ ওল/ মোচা/ থোড়/ লাউ/ কাঁকুড় এসব নিলে চিংড়ি মাস্ট। তা সে লবস্টার কো বাবালোগ হোক বা দীনের তারিণী ঘুষো কিংবা কুচো। আর তাই বুঝি খাস ঘটিবাড়ির মেয়ে নবনীতা দেবসেনের ভালো-বাসার বাড়িতে আমাদের সই বৈঠকের বার্ষিক জন্মদিনে তাঁর মা রাধারাণী দেবীর প্রিয় পদ মোচা চিংড়ি বা চিংড়ি মালাইকারী কখনও বাদ পড়তে দেখিনি।
চিংড়ি মাছ নয় আর সম্পূর্ণ অন্যজাতের সজীব বলেই বুঝি ওদের এত স্বাদ। আঁশটে ব্যাপরটা নেই। আছে এক অন্য রসায়ন। সংস্কৃত শ্লোকে পর্যন্ত চিংড়ি নিয়ে ঠাট্টা পড়েছিলাম কল্যাণী দত্তের ‘থোড় বড়ি খাড়া’য়।
গলদাং বাগদাং রস্যাং নারিকেলসমণ্বিতাং।।
অলাবুলৌভনাং কৃত্বা ভক্ষিতব্যং ‘শুভেযোগে’।

রবিঠাকুরের কাদম্বরী বৌঠান তো তাঁর প্রিয় বন্ধু সেই ছোট্ট দেওরটির জন্য রোজ পান্তাভাতের পাশটিতে কুচো চিংড়ি ভাজা রাখতে ভুলতেন না। রবি কবিরও চিংড়ি-প্রীতি ছিল বলেই না এমন ছড়া লিখতে পেরেছিলেন?
গলদা চিংড়ি তিংড়িমিংড়ি,
লম্বা দাঁড়ার করতাল।
পাকড়াশিদের কাঁকড়া-ডােবায়
মাকড়সাদের হরতাল।
তা এই সন্ধিপদীদের তুমুল কনসার্টের ব্যান্ডমাস্টার যে চিংড়ি তা সবাই জানে।
রবিঠাকুরের সহজপাঠ প্রথমভাগে চিংড়ির সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ সেই অনুস্বর অধ্যায়ে। “কাংলা, তোর ঝুড়িতে কী? ঝুড়িতে আছে পালং শাক, পিড়িং শাক, ট্যাংরা মাছ, চিংড়ি মাছ।” বলাই বাহুল্য সংসারবাবুর মায়েরও কিন্তু অতি পছন্দের তা। আর চন্দ্রবিন্দু চ্যাপ্টারে?
তিমি ওঠে গাঁ গাঁ করে/চিঁ চিঁ করে চিংড়ি
অথবা
মাছ এল সব কাৎলাপাড়া, খয়রাহাটি ঝেঁটিয়ে,
মোটা মোটা চিংড়ি ওঠে পাঁকের তলা ঘেঁটিয়ে।
গল্পগুচ্ছের অন্যতম গল্প ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’র শুরুতেও রয়েছে চিংড়িমাছের ঝালচচ্চড়ির কথা।

গলদা, বাগদা তো মহার্ঘ আর ধানখেতের চাবড়া চিংড়ি, বা হরিণা চিংড়ি? সেও তো প্রোটিন আর ক্যালসিয়ামে ভরপুর সুখাদ্যের তালিকায় পড়ে। বৃন্দাবনে যেমন ‘কানু বিনে গীত নাই’, তেমনই ঘটিবাড়ির হেঁশেলে চিংড়ি বিনে আমিষপদ নাই। আলু-পেঁয়াজ দিয়ে বাটিচচ্চড়ি থেকে পিঁয়াজকলি, লাউ থেকে ওল কপি, পুঁই শাক থেকে চিচিঙ্গে সবেরই অন্যতম অনুঘটক হল এই কুচো চিংড়ি (shrimp recipes)। রান্নাঘরের অগতির গতি, ছোট ছেলেপুলের পাতের ভাত ওঠানোর যাদুকাঠি— সবই সেই চিংড়ি। সামান্য ঘাস দিয়ে রাঁধলেও বুঝি অনন্য স্বাদ হবে। কবি সরল দেও তো তাই এমন সুললিত ছড়া লিখেছেন চিংড়ি নিয়ে। কারণ তার নাম মুখে এলেই যে মুখের মধ্যে লালারস নিঃসরণে উথালপাতাল হয় রসনা।
ঘরকা চিংড়ি ঘাটকা চিংড়ি
আটকা জলে টাটকা চিংড়ি
চিংড়িমাছের গয়নাগাটি
গয়না ছাড়া হয় না খাঁটি।

শীতের উত্তুরে হাওয়ায় নাচন লাগলেই রাস্তার ধারে দেখবেন সবুজ কলাপাতায় ধবধবে সাদা চিংড়ির সবচাইতে সস্তার ভার্সন নিয়ে বসে পড়েছে গাঁয়ের মানুষজন। ঘুসো বা দুধসাদা এই ন্যানো চিংড়ির গাঁয়েঘরে নাম ফুল-চিংড়ি। কাদার মতো নরম তাই কেউ বলে কাদা চিংড়ি। সবশুদ্ধ ধুয়ে নিয়ে বড়া করতে হয়। এর পুষ্টিগুণ প্রচুর। ক্যালসিয়াম আর প্রোটিনসর্বস্ব এর মেদহীন, গয়নাগাটি ছাড়া স্লিম শরীর। বারেবারে ভালো করে ধুয়ে জল চেপে, নুন, হলুদ, লংকা গুঁড়ো দিয়ে ম্যারিনেট করে সামান্য বেসন, পোস্ত, কাঁচালংকা কুচি ছড়িয়ে আলতো হাতে চেপে নিয়ে ছাঁকা সরষের তেলে ভেজে ডালের সঙ্গে সাজিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। তবে রোজ নয়, মাঝেমধ্যে চলতেই পারে এই ডিপ ফ্রায়েড মুচমুচে সুস্বাদু বস্তুটি।
চিংড়ির কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় আমার এক রগুড়ে মামার কথা। ওঁদের সময় কত্ত বড় চিংড়ি খেয়েছিলেন তা বোঝানোর জন্য উনি একবার বলেছিলেন “এ আর কি চিংড়ি খাস তোরা? আমরা যে চিংড়ি খেয়েছি তার খোলাগুলো ডাস্টবিনে পড়ে থাকলে তার মধ্যে দিয়ে কুকুরের বাচ্ছা ঢুকতো আর বেরুত।”
আমাদের সাদামাটা বাঙালির সংসারে এসব এখন গালগল্প।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মাছভাত, পিঠেপায়েসের মতো চিংড়ি নিয়ে আদিখ্যেতাও কিন্তু শিখরে। বাঙালির এই চিংড়ি-বিলাস বহু প্রাচীন। বিজয়গুপ্তের মঙ্গলকাব্যে ও পূর্ব বাংলার মধ্যযুগীয় রান্নার চিত্রেও সেই চিংড়ির স্বাদ ।
‘ভিতরে মরিচ গুঁড়া বাহিরে জুড়ায় সুতা।
তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা’
এরে কয় বাঙালির চিংড়ি বিলাস। পদ্ম,মান, কচুপাতার মধ্যে চিংড়িমাছ, সর্ষে, পোস্ত, কাঁচালংকা আর তেল, নুন দিয়ে ভাতের মধ্যে ভাপিয়ে পাতা সহ ভাত মেখে খাওয়া আজকের রেস্তোরাঁয় মহার্ঘ ডেলিকেসি। আর মালয়েশিয়া থেকে শিখে আসা রেসিপি মহার্ঘ্য চিংড়ি মালাইকারি? আবার গোপাল ভাঁড়ের বিধবা পিসিমার বাড়ি যাবার আগে পকেটে কুচো চিংড়ি ভাজা নেওয়া আর গিয়ে পিসিমার নিরামিষ লাউয়ের তরকারির ওপর সেই চিংড়িভাজা ছড়িয়ে পিসিমার কাছ থেকে টাকা আদায় করা… সামান্য জিনিসের অসামান্য স্বাদ হলে এমনই তো হবার কথা।

বাঙালের ইলিশ আর ঘটিদের চিংড়ি নিয়ে বাকবিতণ্ডা বা আদিখ্যেতা জীবনেও মিটবে না।
মাছ না হয়েও পতঙ্গ শ্রেণীর চিংড়ির আলাদা কদর আমিষ মহলে। তার গায়ে মাছের লাল রক্ত না থাক, রাজকীয়তা কিছু কম নেই। তার শরীরে আঁশ না থাক, স্বাদে কিছু ঘাটতি নেই। ইলিশের মতো শুধু মরশুমি জলজ শস্য নয় বলে এর সম্বচ্ছরি আদরও বাঙালি রান্নাঘরে কম পড়েনি কোনওকালে। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়তার কারণেই আপামর বাঙালি তাকে একছত্র অধিকার দিয়ে আসছে বাজারের মাছের থলেতে। যার সামর্থ্য আছে সে খায় “জলের ভিতর মাছ কত রস ভরা/ দাড়ী গোঁপ জটাধারী জামাজোড়া পরা” মহার্ঘ্য গলদা, বাগদা চিংড়ি। যার নেই, সে ধানখেতের চাবড়া থেকে হরিণা চিংড়ি খায়। যে আরও দীন, সে কুচো ঘুষো যা পায় তাই ছড়িয়ে রান্না করে, শুধু দুটো ভাত উঠবে বলে।
আর তাই তো ভোজনরসিক ঈশ্বর গুপ্ত মহাশয় চিংড়ি কে “অমৃতের খনি” অভিহিত করে “আমিষের সভাপতি মীন শিরোমণি” বলে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন।
তার রূপে-গুণে মুগ্ধ কবি আরও লিখেছেন—
“গলদা চিংড়ি মাছ নাম যার মোচা / পড়েছে চরণতলে এলাইয়া কোঁচা”

সেই যে সুপাচক, সুরস্রষ্টা সলিল চৌধুরী একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন না, “Good food is an integral part of life”! তা সেই সুখাদ্যের সম্ভারে চিংড়ির কদর তো আজীবন থেকেই গেল।
চিংড়ির পুর-ভরা লাউপাতা বেসনে ডুবিয়ে ভাজা যে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর প্রিয় পদ আর বিনা পেঁয়াজে চিংড়ির পোলাও শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ফেবারিট তা জেনেছিলাম সেবার কিংবদন্তীর হেঁশেলের খোঁজ নিতে গিয়ে।
কলাপাতায় মুড়ে সর্ষে নারকোল কোরা দিয়ে চিংড়ি ভাপা খেতে খেতে নয়ত আমিষপ্রিয় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু বলেন, “সবজীর পদ হল জাপানী মাল আর মাছ-মাংস হল জার্মান মাল”!
চিংড়িপোকার এমনই মাহাত্ম্য যে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ির ভোজসভার অন্যতম মেনু এখনও চিংড়ির কাটলেট কারি, রায় পরিবারের ট্র্যাডিশন মেনে। আর জাদুকর জুনিয়র পিসি সরকার আজও না কি মিস করেন তাঁর দিদিমার হাতের অসামান্য সেই চিংড়ির একটা কেজো রান্না চিংড়িপোড়ার স্বাদ! বলেছিলেন সেবার— “চিংড়িমাছ উনুনের পিঠে রাখতেন দিদিমা। সঙ্গে রসুন কুচি। এবার সর্ষের তেলে কালোজিরে কাঁচালংকা ফোড়ন দিয়ে একসঙ্গে বেটে নেওয়া চিংড়ি আর রসুন দিয়ে শুকনো ভাত যেন স্বর্গীয় মেনু।” ফুড কলামনিস্ট ভীর সাঙ্ঘবী এ রেসিপি শুনলেই হয়ত বলতেন, “রুড ফুড অফ বেঙ্গল”।
নবনীতাদিও বলেছিলেন সেবার, চিংড়িমাছ খুব পছন্দের, কারণ কাঁটা বেছে খেতে হয় না। “ফুলচিংড়ির বড়া খেতে বড্ড ভালোবাসি রে….”
বলেছিলাম “দিদি, হান্ড্রেড পারসেন্ট এগ্রিড উইথ ইউ, আমাদের বাড়িতেও যে চল আছে এর…”

আর তাই তো প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী থেকে পূর্ণিমা ঠাকুর, বেলা দে থেকে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় সবার রেসিপি বইয়ের ডেটাবেস যেন থইথই চিংড়িমাছের রেসিপিতে। তবু তো চিনেদের গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রন অথবা চিলি গারলিক শ্রিম্প আর জাপানি প্রন টেম্পুরার কথা বলা হল না। সাউথ ইস্ট এশিয়ার রেস্তোরাঁ তো উপচে পড়ে কেবলই সামুদ্রিক চিংড়িবিলাসে। আর কন্টিনেন্টাল স্টার্টার প্রন ককটেল বা শ্রিম্প অন টোস্ট, লবস্টার থার্মিডর বা ভারতীয় দক্ষিণী মালাবারি প্রন কিংবা প্রন বালচাও? তারাই বা কীসে কম?
তবে এহেন সন্ধিপদীর প্রতি বাঙালির উথলে ওঠা আদি অকৃত্রিম রসনার সঙ্গে মোহনবাগান-ইষ্টবেঙ্গল, উত্তম-সৌমিত্র, হেমন্ত-মান্না নামক দ্বন্দ সমাসগুলির মতো ইলিশ-চিংড়িও যে দাপটের সঙ্গে পঙক্তিভোজে চিরকাল বসে পড়বে আর পাত পেড়ে খেয়ে তবেই উঠবে, তা বলাই বাহুল্য।
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।