(Football)
বর্ষা প্রগাঢ় হয়েছে আজ দিন পনেরো। শহরে হাঁটু হাঁটু জল। কাদায় মিশে তিতিবিরক্তি। ছাতায় দামড়া দামড়া ছ্যাঁদা। একটা ছ্যাঁদায় চোখ রেখেছিলাম। ঔৎসুক। দেখতে পাচ্ছি, ব্যারাকপুর স্টেডিয়াম। কলকাতা ফুটবল লিগের ম্যাচ। মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট বনাম রেলওয়ে এফসি। ৩৫ মিনিটের মাথায়, মাঝমাঠে ছিটকে পড়লেন রেলওয়ে এফসির তারক হেমব্রম। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার। তেইশ বছর। ছটফট করছেন। বাঁ পা নড়ছে না। কিন্তু স্ট্রেচার এল না কোনও। (Football)
আরও পড়ুন: শান্তি আনুক বিউটিফুল ফুটবল
রেলওয়ে এফসির টিম-ডাক্তার নেই। তৎক্ষণাৎ মোহনবাগানের মেডিক্যাল টিম একছুটে মাঠে। কটিকোস্টেরয়েড ইঞ্জেকশান। তারকের বাঁ পায়ে ব্যান্ডেজ। দু’পাশে দুটো ছাতা দিয়ে বাঁধা। লোহার পাত অথবা ব্রেসেস নেই। কোত্থাও নেই। যে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছিল আইএফএ, বলল, কলকাতা যাবে না। ওয়ার্কিং রেডিয়াসের বাইরে। (Football)

চোখটা সরিয়ে নিলাম ইচ্ছে করেই। বিতৃষ্ণা, ক্রোধ না কান্না— ঠাহর করতে পারছিলাম না। একটা ছ্যাঁদার ভেতরে জন্ম নিল এ-দৃশ্য। অতঃপর, হে পাঠক, বাংলা ফুটবলের পাশে দাঁড়ান, এ কী! আলবাত দাঁড়াবেন। তবে ছাতা মাথায়। কারণ প্রতিবাদ-মুহূর্তেও আপনার প্রয়োজন নিরাপদ আড়াল। তাই, ভারতীয় ফুটবলের আর কিসুই হবে না— আপনার মতো আমিও তাই-ই মনে করি। এটুকুই। এরপরেই আপনি বলবেন, তেমন প্লেয়ার আর কোথায় বল তো? পিকে, চুনী, মান্না… কখনও ভেবে দেখেছেন বর্তমানে এই ভয়েডনেস কেন? (Football)
শেষ কবে সংবাদপত্রের হেডলাইনে দেখেছিলেন কোনও বাঙালি স্ট্রাইকারের নাম? ফুটবল-কেন্দ্রিক যে বালখিল্যতা করে চলেছে সংস্থা, দীর্ঘদিন, তা আপনার গা সওয়া হল কীভাবে? আসুন। একটু ছানবিন করে দেখি। (Football)
ফুটবল আমাদের আইডেন্টিটি। ধর্ম বললেও অত্যুক্তি হয় না। আইডেন্টিটির ছবিগুলো কেমন? ১৯৫৬ সাল। সমর ব্যানার্জি ক্যাপ্টেন। ভারতীয় ফুটবল দল মেলবোর্ন অলিম্পিকের সেমিফাইনালে।
ফুটবল আমাদের আইডেন্টিটি। ধর্ম বললেও অত্যুক্তি হয় না। আইডেন্টিটির ছবিগুলো কেমন? ১৯৫৬ সাল। সমর ব্যানার্জি ক্যাপ্টেন। ভারতীয় ফুটবল দল মেলবোর্ন অলিম্পিকের সেমিফাইনালে। ১৯৭০। এশিয়ান কাপ। ব্রোঞ্জ মেডেল। ফিফার প্রেসিডেন্ট মঞ্চে উঠে বললেন, এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ডিফেন্ডার সুধীর কর্মকার! কাট টু ২০২৫। তারক হেমব্রমের ছাতা দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, বাঁ পা। সোনাঝরা নস্টালজিয়া মূলধন করে যে ফুটবল চলে না, একটা বৃহৎ আয়নার সম্মুখে তা উলঙ্গ। লজ্জা নিবারণের চেতনাটুকু হারিয়ে গেছে। (Football)
উইকিপিডিয়া বলছে, কলকাতা ফুটবল লিগ— এশিয়ার প্রাচীনতম। আয়োজক, পশ্চিমবঙ্গের ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশান(আইএফএ)। ১৩২ বছর আগে জন্মেছিল যে সংস্থা! অর্থ হয়, ভারতীয় ফুটবলকে সেই সংস্থা ঢের বেশি চিনেছে। জন্মলগ্ন থেকে চিনেছে। অল ইন্ডিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশানের(এআইএফএফ) চেয়েও বেশি চিনেছে। তেমনটাই উচিৎ! অথচ আইএফএ সভাপতি অজিত ব্যানার্জি একটি সাক্ষাৎকারে বললেন, হাসপাতাল কখনও তোমার কাছে আসবে না। তোমায় হাসপাতালে যেতে হবে। টিম-ডাক্তার ছিল না, কিন্তু ফিজিও ছিল। ব্যস! দায়মুক্ত হওয়া গেল চমৎকার। (Football)
“আইএসএলের মোড়কটি খুব আকর্ষণীয়। রবার্তো কার্লোস, দিয়েগো ফোরলান, মার্কো মাতেরাজ্জির মতো বিদেশি তারকা খেলোয়াড়। পাশাপাশি, ক্লাবগুলোর মালিক একেকজন সেলিব্রিটি। প্রভূত ব্র্যান্ডিং। প্রভূত বিজ্ঞাপন। তারপর? শেষ দশ বছরে ভারতীয় ফুটবলের চালচিত্র কতখানি বদলেছে?”
নিজেদের আরও দায়মুক্ত করেছেন আইএফএ সচিব অনির্বাণ দত্ত। তিনি বলছেন, এইটা কি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ? চ্যাম্পিয়ান্স লিগ? আইএসএল? নয় তো! কাজেই আইএফএ-র সাধ্যমতো চেষ্টায় এই লিগ অর্গানাইজ করা হয়। অ্যাম্বুলেন্স আছে। প্লেয়ারদের ইনসিওরেন্স আছে। দু-লক্ষ টাকা। আসলে বলতে চাইলেন, যতটুকু পেয়েছ, ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট হও। আবিশ্বের ফুটবলে কী ঘটছে, সেসবের খোঁজ করতে যেও না। (Football)
মনে করুন, ইউয়েফা একটি ফুটবল লিগ অর্গানাইজ করছে। ম্যাচ সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব হোমটিমের। এ-কথা কতখানি বাস্তবসম্মত বলতে পারেন? একটু ঘেঁটে দেখুন। চ্যাম্পিয়ান্স লিগের প্রত্যেক ম্যাচেই, ইউয়েফার যে মেডিক্যাল টিম মাঠে উপস্থিত থাকে, সেই টিম এলিট ফুটবল-ডাক্তারে সমৃদ্ধ। শুধুমাত্র হোমটিমের ওপর নির্ভর করে ইউয়েফা একটা লিগ আয়োজন করেনি। আপনি চাইলেই বলতে পারেন, চ্যাম্পিয়ান্স লিগে অংশগ্রহণের খরচ বিপুল। আইএসএলেও প্রায় ছ’কোটি টাকা। আইলিগে, সাত লক্ষ। অতিরিক্ত দশ লক্ষ টাকা সম্প্রচার খাতে। কলকাতা ফুটবল লিগের সেই খরচ কত? এক হাজার টাকা। শুরুতেই বলেছি, আইএফএ কত পুরনো একটা সংস্থা! কী এমন দুর্দিন এল যে, মাত্র এক হাজার টাকা পার্টিসিপেশান ফি রাখতে হচ্ছে? এইভাবে সংস্থার অন্দরের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক কারচুপি ঢেকে রাখা ছাড়া আর কিছু হয় না। বুক ফুলিয়ে বলা যায়, কলকাতা লিগ! বাওয়া! (Football)

অথচ গতবছর কোন দল চ্যাম্পিয়ান হয়েছে? এখনও পর্যন্ত ঘোষণা করতে পারেনি আইএফএ! লেখা আছে, নট ডিসাইডেড টিল ডেট। পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক ফুটবল উন্নত হচ্ছে? নট ডিসাইডেড টিল ডেট! তারক হেমব্রমের ফেসবুক প্রোফাইল স্ক্রল করলে দেখতে পাওয়া যায়, খেপুড়ে তারক। ছেলেটা খুব খেপ খেলে বেড়ায় কী না! কতশত মানুষের তীব্র ধমক। ব্রাইট কেরিয়ার এইভাবে নষ্ট করছে ছেলেটা! তবু, খিদে তো পায় মশাই! এটুকু তো ডিসাইড করা গেছে। (Football)
ব্যারাকপুর। নৈহাটি। কল্যাণী। মূলত এই তিনটে স্টেডিয়ামেই কলকাতা লিগের অধিকাংশ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এইবার, আইএফএ ছাড়পত্র দিয়েছে বলেই সেইসমস্ত মাঠগুলোয় খেলা হচ্ছে। অথচ আপনি একবার চেয়ে দেখুন। প্রতিটাই খেলার অযোগ্য। জীর্ণ। এবং চোটপ্রবণ। তাহলে কোন ভরসায় এতগুলো টিম একটা টুর্ণামেন্ট খেলছে? আসলে খেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ থেকে প্রাক্তন ফুটবলার, সকলেই বলছেন, এখন ফুটবলে বিশ্বমানের কত প্রযুক্তি! তবু বলুন তো, সেগুলোর অ্যাপ্লিকেশান কোথায়? ছাতার মাথায়! (Football)
ফুটবলের নিম্ন স্তরে, পুঁজি যেমন সমস্যা, বিনিয়োগ যেমন সমস্যা, তেমনই সমস্যা ফুটবল ফেডারেশানের পরিকল্পনায়। অভিপ্রায়ে।
ফুটবলের নিম্ন স্তরে, পুঁজি যেমন সমস্যা, বিনিয়োগ যেমন সমস্যা, তেমনই সমস্যা ফুটবল ফেডারেশানের পরিকল্পনায়। অভিপ্রায়ে। আইএসএলের মোড়কটি খুব আকর্ষণীয়। রবার্তো কার্লোস, দিয়েগো ফোরলান, মার্কো মাতেরাজ্জির মতো বিদেশি তারকা খেলোয়াড়। পাশাপাশি, ক্লাবগুলোর মালিক একেকজন সেলিব্রিটি। প্রভূত ব্র্যান্ডিং। প্রভূত বিজ্ঞাপন। তারপর? শেষ দশ বছরে ভারতীয় ফুটবলের চালচিত্র কতখানি বদলেছে? উন্নতির যাবতীয় সম্ভাবনার কথা নাই-বা তুললাম। (Football)
কারণ আইএসএলের নৌকাও ডুবুডুবু। এই ফুটবল সিজনে, আইএসএল অনুষ্ঠিত হওয়ার আশা আপাতত ‘অন হোল্ড’! আবার, ভারতীয় ফুটবলে কোচিং এবিলিটি ও দর্শন সংক্রান্ত আস্ত একখানা লেখা হয়ে যাবে। বলছি, আন্তর্জাতিক স্তরের কথা। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনের সেই স্বপ্নের কথা। বিশ্ব র্যাঙ্কিং, ১৩৩। শেষ ন’বছরে সর্বনিম্ন। অথচ উজবেকিস্তান, আমাদেরই মতো তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ। পোড়া দেশ। তবু আগামি বিশ্বকাপের মঞ্চে জ্যোতিষ্ক হয়ে জ্বলবে। ফুটবল খেলবে। ঐতিহাসিক! ঐতিহাসিক! আমরা চিৎকার করব। সংবাদপত্রে দু’পাতা গদ্য লিখব। কিন্তু প্রশ্ন তুলব না, আমরা কেন অপারগ? (Football)
“শুধুমাত্র ইমোশানের সাহায্যে কি পরিকাঠামো বদলে ফেলা যায়? লক্ষ্য করে দেখবেন, ভারতীয় ফুটবল, বিশেষ করে বাংলার ফুটবল শ্রেণি-বিচ্ছিন্ন হয়েছে অনেকদিন হল।”
রাষ্ট্রের হত্তাকত্তার মতো, এআইএফএফ-এর কর্তারাও বুঝেছেন, একবেলা ভাত না জুটলেও, ফুটবল ইমোশানের কোনও কমতি নেই। কলকাতা মহলে তো আরও নেই। যে উদ্যমে, যে নিষ্কলুষ আবেগে ইস্টবেঙ্গলের জন্য, মোহনবাগানের জন্য, মহামেডানের জন্য, এক এবং একমাত্র ফুটবলের জন্য রাতদিন হেদিয়ে মরছে বাঙালি সন্তান-সন্ততি, আর কোনও জাতি সেই সাহস রাখে? বাংলা ফুটবলের পাশে দাঁড়াতে সদা প্রস্তুত। ঠিক সেই কারণেই, একটা বিপক্ষ দলের মেডিক্যাল টিম মাঠে প্রবেশ করেছিল সেদিন। যুদ্ধরীতি লঙ্ঘন করেই। ধর্ম নিয়ে, জাত নিয়ে, চামড়ার রং নিয়ে নিরন্তর লড়ে যাওয়া একটা সময়ে, এ-দৃশ্য বিরল। (Football)

এই যে হাজারও দুর্দশার মাঝে একফালি সুখকর আশার দৃশ্য খুঁজে নিলাম! এ-জন্যেই বোধহয় ভারতীয় ফুটবলের ছাতায় এত এত ছ্যাঁদা। শুধুমাত্র ইমোশানের সাহায্যে কি পরিকাঠামো বদলে ফেলা যায়? লক্ষ্য করে দেখবেন, ভারতীয় ফুটবল, বিশেষ করে বাংলার ফুটবল শ্রেণি-বিচ্ছিন্ন হয়েছে অনেকদিন হল। তারক হেমব্রম, অথবা ইউনাইটেড স্পোর্টস ক্লাবের উঠতি সুপারস্টার সাহিল হরিজন— আপনার চোখে ‘অপর’। তথাকথিত ঘরের ছেলে নয়। (Football)
আরও পড়ুন: এশীয় যুব ফুটবল : সোনা জেতার সুবর্ণ জয়ন্তী
তাই বোধহয় আত্মীয়তা কম। তাই পা ভাঙলেও, ফার্স্ট এডের উপযুক্ত সামগ্রী আছে না ছাতার মাথা আছে, সে নিয়ে বড়ই উদাসীন। (Football)
তারক হেমব্রম কেমন আছেন? সুস্থ হচ্ছেন। দেড় মাস পরে মাঠে ফিরবেন। চিকিৎসার শুরু থেকে তারকের মাথায় আক্ষরিক অর্থেই ছাতা ধরে দাঁড়িয়েছিলেন নবাব ভট্টাচার্য। ইউনাইটেড স্পোর্টস ক্লাবের চেয়ারম্যান। কারণ আইএফএ সচিব প্রথমেই জানিয়েছেন, আমাদের আর্থিক সামর্থের কথা ভেবেছেন কখনও? যতটুকু চিকিৎসা করা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি এক্সপেক্ট করবেন না। কাজেই, শেষ করি মোক্ষম একটি প্রশ্নে। আইএফএ স্ব-দায়িত্বে যদি কোনও ম্যাচ অর্গানাইজ করে, সেখানে কি উৎকৃষ্ট মানের কোনও মাঠ অথবা মেডিক্যাল টিমের জোগাদ দিতে সর্বতভাবে সক্ষম? উত্তর, সেই ছাতার মাথাতেই… (Football)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
রোদ্দুর এমন একটা বই যার ফ্রণ্ট কাভারে সিনেমা আর ব্যাক কাভারে ঘুম। মধ্যে অনেকগুলো পাতা। লেখা ও না-লেখা। সসম্মানে অঙ্কে তৃতীয় বর্ষের পড়াশোনা শেষ করে স্নাতকোত্তরে প্রবেশ করলেও, হিসেবনিকেশ গুলিয়ে দেওয়াই রোদ্দুরের প্রধান কাজ।