(Chicken Pox) তখন আর জি কর থেকে সদ্য ডাক্তারি পাশ করে পিডিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগে হাউসজবশিপ করছি। মনে বেশ একটা ফুরফুরে সবজান্তা সবজান্তা ভাব। এক ফাল্গুনের রাতে ইমার্জেন্সি ডিউটিতে একটি বছর সাতেকের বাচ্চা ভর্তি হলো। ভয়ঙ্কর জ্বর আর কাঁপুনি, সঙ্গে সর্দি, কাশি। পরদিন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি জ্বর তো আছেই সঙ্গে গায়ে ছোট ছোট লাল ডুমো ডুমো র্যাশ আর ভীষণ চুলকানি। সময় গড়াতে ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ছে বুকে, পিঠে, মুখে। আর র্যাশগুলোও কেমন যেন ছোট ছোট জলফোস্কায় পরিণত হচ্ছে। এমন পেশেন্ট আগে দেখিনি। বুঝেই উঠতে পারছি না কি করবো! (Chicken Pox)

দুপুরবেলা আউটডোর সেরে আমার স্যার যখন রাউন্ডে এলেন ততক্ষণে রোগীর জলফোস্কা র্যাশ গলা, চোখের পাতা এবং যৌনাঙ্গেও ছড়িয়ে পড়েছে। দেখেই স্যার জিজ্ঞেস করলেন- ডায়াগনোসিস বল। আমি চুপ।
মাথা নেড়ে স্যার বললেন, ‘তোরা চিকেন পক্সের পেসেন্ট দেখিস নি?’ এ তো একেবারে ক্লাসিক কেস! র্যাশগুলো ভালো করে দেখে চিনে রাখ। কোনোদিন যেন ভুল না হয়।’
‘আচ্ছা কেস না হয় দেখিস নি। থিওরিটা তো পড়েছিস নাকি?’
‘বল তো পক্সের causative agent কি?’
‘Varicella Virus। ভীষণ ছোঁয়াচে।’ চটজলদি জবাব দিই।
‘কি করে ছড়ায় বলতো?’
‘Air droplet, অর্থাৎ পক্সরোগীর সান্নিধ্য, হাঁচি, কাশি এমনকি কথা বলা থেকেও ছড়ায়।’ (Chicken Pox)
‘কে বলেছে তোমাদের এসব কথা? তেল, সাবান গায়ে না মাখলেও পরিষ্কার জলে অবশ্যই স্নান করাতে পারবে। আর খাওয়ার মানামানি? কিস্যু নেই। বরং মাছ, মাংস, ডিম, সোয়াবিনের মতো পুষ্টিকর, প্রোটিনজাতীয় খাবার খাওয়ালে বাচ্চা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে, দুর্বলতাও কাটবে।’
‘পক্স হওয়ার সম্ভাবনা কাদের বেশি?’
‘সত্যি বলতে যার আগে পক্স হয়নি, সে যদি পক্সরোগীর সান্নিধ্যে আসে তারই হতে পারে। তবে শিশু, বৃদ্ধ, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী বা যার কেমোথেরাপি চলছে অথবা এমন রোগে ভুগছে যেখানে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় (যেমন এইডস) তাদেরই হতে পারে।’
‘বেশ বেশ! তা বলতো পক্স-এর ভাইরাস কখন মানবশরীরে সংক্রামিত হয়? র্যাশ বেরোনোর আগে না পরে?’
‘স্যার, পক্সের ভাইরাস রোগীর র্যাশ বেরোনোর দু’একদিন আগে থেকে তার সান্নিধ্যে আসা মানুষের শরীরে সংক্রামিত হয়।’
‘জানিস তো! সাধারণত পক্স বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিজের থেকেই সেরে যায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা যে দেখা যায় না তা নয়। যেমন দেখ বাচ্চাটা কাশছে। তোকে দেখতে হবে লাংসে নিউমোনিয়া হলো কিনা। নজর রাখতে হবে র্যাশগুলোয় যেন কোনোভাবেই ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন না হয়। Group A Streptococcal Infection হলে কিন্তু মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। খুব নগণ্য হলেও কিছু ক্ষেত্রে Glomerulonephritis বা Encephalitis কিংবা Toxic Shock Syndrome এর মতো মারণ রোগও হতে পারে। আর গর্ভাবস্থার প্রথমদিকে মায়ের পক্স হলে বাচ্চার কম ওজন বা Limb-এর সমস্যা হতে পারে।’ (Chicken Pox)

‘পক্স সারতে কতদিন সময় লাগে স্যার?’ এতক্ষণ আমাদের কথোপকথন মন দিয়ে শুনছিলেন বাচ্চার মা। এবার তিনি সরাসরি প্রশ্ন করেন স্যারকে।
স্যার জবাব দেন, ‘সাধারণভাবে পক্স সারতে সময় লাগে দশ থেকে একুশ দিন। তা তোমার বাচ্চাটাকে পক্সের টীকা দাও নি কেন? তাহলে তো এতোটা বাড়াবাড়ি হতো না। টীকা সংক্রমণ সম্পূর্ণ রুখতে না পারলেও অল্পের ওপর দিয়ে যেত।’
‘আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কেউ বলে না দিলে আর জানবো কোত্থেকে?’ মায়ের সরল স্বীকারোক্তি।
‘ডাক্তারবাবু,একটা কথা ছিল। আমরা গাঁয়ের লোকেরা এই রোগকে বলি বসন্ত রোগ বা মায়ের দয়া। আপনি কালকেই ছুটি করে দিন। বিস্তর পালন করতে হবে। স্নান করা বারণ, আমিষজাতীয় খাবার মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া বারণ। ঘি দিয়ে সেদ্ধ খাবার খেতে হবে। আলাদা ঘরে মশারির ভেতর থাকতে হবে। মাথায় তেল, সাবান মাখা যাবে না। আরও কতো কী’। (Chicken Pox)
আরও পড়ুন: বেড়াতে বেরিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে কী করবেন?
এতক্ষণ আমাদের স্যার শান্তভাবে শুনছিলেন পেসেন্টের মায়ের কথা। এবার রাগে ফেটে পড়লেন।
‘কে বলেছে তোমাদের এসব কথা? তেল, সাবান গায়ে না মাখলেও পরিষ্কার জলে অবশ্যই স্নান করাতে পারবে। আর খাওয়ার মানামানি? কিস্যু নেই। বরং মাছ, মাংস, ডিম, সোয়াবিনের মতো পুষ্টিকর, প্রোটিনজাতীয় খাবার খাওয়ালে বাচ্চা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে, দুর্বলতাও কাটবে।’
‘বলেন কি?’ মায়ের মুখে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছি।’ স্যারের সংক্ষিপ্ত জবাব। (Chicken Pox)

‘এর Prevention এর কোনো উপায় নেই?’ অনেকক্ষণ থেকেই প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরছিল।
‘না, সেভাবে নেই। যেহেতু র্যাশ বেরোনোর আগে রোগটা ধরার তেমন উপায় নেই, তাই সতর্ক হওয়ারও কোনো উপায় নেই। রোগ হলে তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করতে হবে। পক্স সারানোর ভালো ওষুধ তো আছেই। তবে কারুর বাড়িতে পক্স হয়েছে জানলে সেখানটা এড়িয়ে যাওয়া ভালো। এছাড়া রাস্তাঘাটে, পাবলিক প্লেসে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। একটা জিনিস মনে রাখিস অর্পণ, পক্স কিন্তু জীবনে একবারই হয়। তোর হয়েছে আগে?’
ঘাড় নাড়ি – ‘না!’
‘এই রে! ক’দিন বাদে দেখ কি হয়!’ একথা বলে চিন্তিত মুখে স্যার চলে গেলেন।
আর স্যারের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত করে তার দিন কয়েকের মধ্যেই আমিও চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলাম। (Chicken Pox)
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Wikimedia Commons, Flickr, Flickr
পেশায় পালমোনোলজিস্ট ডা: অর্পণ রায় চৌধুরীর মূল নেশা বেড়ানো ও ছবি তোলা। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখালিখি করতে ভালোবাসেন। ইতিমধ্যে তাঁর প্রকাশিত ভ্রমণ বইয়ের সংখ্যা ছয়। ট্রাভেল রাইটার্স ফোরামের সদস্য।
One Response
ভালো লাগলো একটা হালকা চালে অনেক তথ্য সমৃদ্ধ লেখা পড়ে , অনেক দিন পর অর্পণ দার লেখা পড়লাম। ভালো থাকবেন। রামরিক হাসপাতালে অনেক বড় দেখা ।