Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

আলোকঝর্ণার পথে যাত্রী

জয়া মিত্র

নভেম্বর ৩০, ২০২০

Light
ছবি সৌজন্য - wikipedia.com
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

মাছ কোথায় পাওয়া যায়, দুধ কোথায় পাওয়া যায়— এরকম সব সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নের উত্তরে ছোটরা যখন বলত— কোর্টের বাজারে, সেটা বড়দের নির্দোষ কৌতুকের কারণ হত। কোনওদিন আকাশের তারা দেখেনি এরকম বাচ্চার সঙ্গেও আলাপ হয়েছে যে জানে আকাশে দেখা যায় প্রধানত অন্য ‘সোলার সিস্টেমের স্যাটেলাইট’ যারা পৃথিবীকে আক্রমণ করতে আসে। বছর দুই আগে শোনা গেল শহরের এক অতিবিখ্যাত স্কুলের ক্লাস এইটের সবক’টি ছাত্রছাত্রী ভাবে যে হিমালয় পাহাড় মাথার ওপর আর বঙ্গোপসাগর হল মাটির তলায়, তার দক্ষিণে আর অস্ট্রেলিয়া নামে কোনও কিছু থাকতেই পারে না, তখন বিষয়টা আর ঠিক কৌতুক রইল না। মাথা ঘামিয়ে জানা গেল তারা ভূগোল ক্লাসে ম্যাপপয়েন্টিং করতে পারে চমৎকার। কিন্তু ম্যাপের উত্তরদক্ষিণ আর ঘরের বাইরের উত্তরদক্ষিণ যে আলাদা, একথা তাদের শেখা হয়নি।

[the_ad id=”266918″]

স্বাভাবিক। ওটা শেখান হত কোলে করে জানলার বাইরে কিংবা ছাদ কি উঠোন থেকে সূর্য দেখিয়ে, ‘ওই যে সূর্য উঠছে ওইটে হল পুবদিক’ বলে। প্লে স্কুল অনেক কিছু শেখায়, কিন্তু অনেককিছু শেখায়ও তো না। বস্তুত, কোন কোন জিনিস যে প্রাথমিকভাবে অবশ্য শিক্ষণীয় আর কোনটা পরে শিখে নিলেও চলবে— সেই ভাগটা শিক্ষার ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হয়েছে কিনা— একথা কেউই বলতে পারলেন না। অথচ সেটা স্থির না হলে চলে কী করে! মনুষ্যশিশু তো মাটি শুঁকে, মায়ের গা শুঁকে, উঁচু থেকে নিজদায়িত্বে পড়ে গিয়ে, এই পৃথিবীতে নিজের বেঁচে থাকার কৌশলগুলি আয়ত্ত করতে পারে না। তাকে জীবনযাপন শিক্ষা নিতে হয়। তার বেঁচে থাকার অর্থ আর প্রকৌশল অনেক বেশি জটিল, অনেক বেশি বিমূর্ত এবং একই সঙ্গে ঐতিহ্যময়।

[the_ad id=”266919″]

গত কয়েকমাসে লকডাউনের সময়ে যে সব বিচিত্র ও মূল্যবান অভিজ্ঞতা লাভ হল আমাদের মতো লোকেদের, তা থেকে বোঝা গেছে এই বিশ্বে বেঁচে থাকা আর বাঁচিয়ে রাখবার জন্য এমন কিছু কিছু বিষয় জানা জরুরি যা প্রায়ই সিলেবাসের বাইরে। বিদ্যার্জনের প্রথম, কখনও কখনও একমাত্র স্থান, ইস্কুলবাড়িটিকে রবি ঠাকুর থেকে চমস্কি – অনেকেই বর্ণনা করেছেন ‘রঙিন জেলখানা’ বলে। কেবল ‘তোতাকাহিনি’র খাঁচাটির মতো নয়, এমনকী ‘ডাকঘর’-এ অমলের আধ-জানলা ঘরটির মতোই সেই বিদ্যাভবন থেকে বাইরে থাকে সমস্ত জীবন্ত পৃথিবী, তার বিশাল, অপরূপ প্রকৃতির সৌন্দর্য আর রহস্যের অনন্ত সম্ভার নিয়ে। সেই প্রকৃতিময় পৃথিবীই তো মানুষের প্রথম শিক্ষাক্ষেত্র আর শিক্ষাদাত্রীও। জীবনের প্রথম আর বুনিয়াদি শিক্ষাটি ঠিকভাবে শুরু না হলে কেবল হিমালয়, বঙ্গোপসাগর নয়, জীবনের আরও বহু দিকদিশা গুলিয়ে যাবে নিশ্চিত। 

Education
শিক্ষা যে কোনও বস্তু নয়, জীবন ও পৃথিবীর সম্পর্ককে বুঝবার পথটির আলো। ছবি সৌজন্য – amazon.com

ফল কী হতে পারে তার? যেই ভূখণ্ডে, যে সংস্কৃতির শিকড়ে লগ্ন হয়ে মানুষ সুস্থ মানসিকতায় বড় হতে পারে, নিজে বাঁচতে ও অন্যকে বাঁচায় সাহায্য করতে পারে, তার সঙ্গে কোনও প্রত্যক্ষ পরিচয় গড়ে ওঠে না। ওই আত্মীয়তার, আত্মপরিচয়ের বোধ, আত্মবিশ্বাস ছাড়া শিক্ষা আর কী দেবে, কী দিতে পারে একটি নবীন মানুষকে, যে জীবনপথে যাত্রা শুরু করতে চলেছে?

মাঝে মাঝে ভয় হয়, শিক্ষা যে কোনও বস্তু নয়, জীবন ও পৃথিবীর সম্পর্ককে বুঝবার পথটির আলো— এ কথা বোধহয় আমাদের শিক্ষাবোধের একেবারে বাইরে চলে যাচ্ছে। ‘শিক্ষিত করা’র নামে দু’বছরের শিশুরও দিন চলে যাচ্ছে রঙিন ছবি আঁকা দেওয়ালের কন্দরে, ছয় বর্গফুট সাজানো বাগানের সাজিয়ে দেওয়া খেলনার নির্দিষ্টতায়। মানুষের জীবনের সবচেয়ে প্রথম শিক্ষা যে সৌন্দর্যবোধ আর আনন্দ, সেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে, স্বজনের আত্মীয়তা, স্নেহ, পরিবেশ প্রতিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে আসা সহজ জ্ঞান আর অনুভূতির বদলে তাকে শিখতে হয় প্রতিযোগিতা, অসন্তুষ্টি, সাফল্য- অসাফল্যের আততি। অভ্যস্ত হতে হয় প্রশ্ন-না-করায়। সেই মানুষকুঁড়িদের বাকি জীবনের ছক কাটা হয়ে যায় সেখানেই।

[the_ad id=”270084″]

শিক্ষা শব্দে একটি সামগ্রিকতার ভাব থাকে। শুধুমাত্র বিদ্যার চেয়ে তার ব্যাপ্তি আর গভীরতা অনেক বেশি। আমাদের এই দেশে শিক্ষাব্যবস্থা সমাজে অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল স্কুলবাড়ি-পূর্ব কালেও, সেকথা জানার জন্য অ্যাডাম সাহেবের চিত্ত-চমৎকারী রিপোর্ট পড়ার দরকার হয় না, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তার অসংখ্য চিহ্ন ছড়ানো। যদি শিক্ষিত মানুষের অভাব থাকত, তাহলে উপনিবেশ-পূর্ব যুগে, বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে এদেশের কৃষি, অন্য নানা বৃত্তি, গৃহস্থালীগুলি, চলত কী করে? কী করে স্বল্প আয়োজনে অনেক বেশি মানুষ সন্তুষ্টির জীবন নির্বাহ করত অন্য আরও অনেককে নিয়ে? আজ যার নাম হয়েছে ‘সুস্থায়ী জীবনযাপন’, কী করে সেই প্রকরণ আয়ত্ত ছিল তাঁদের, যাঁরা অনেকেই নাম সইও করতে জানতেন না? 

Education
উন্মুক্ত পৃথিবীর সঙ্গে উপযুক্ত শিক্ষা নিত্য আলোর মতো এসে শিশুকুঁড়িকে ফুটিয়ে তুলবে। ছবি সৌজন্য – wikipedia.com

নামসই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এতে কারও কোনও সংশয় নেই। কিন্তু একইরকম গুরুত্বপূর্ণ হল জীবনের প্রথম শিক্ষায় ভালবাসা আর নৈতিকতা শেখা। শিশুর জন্য বড়দের প্রথম দান হবার কথা ছিল সহজ প্রসন্নতা আর মূল্যবোধ। শিশু নিজে কিন্তু অসুখী হয় না, যদি না তাকে অসুখী করা হয়। পাথর খাদানের নরকেও বাচ্চাদের বেলচায় বসে ‘গাড়ি গাড়ি’ খেলতে দেখেছি। চায়ের দোকানের নীচে বাস করা বাচ্চাকে দেখেছি কুকুরছানাকে জড়িয়ে ঘুমোতে। তাকে যেন ওইভাবে থাকতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করা বড়দের দায়িত্ব। তাঁদেরই একাংশ যে আজ ওই অবস্থাটির কারণ ঘটাতে অন্যায় কিংবা অস্বস্তিও বোধ করেন না, তারও একটা বড় কারণ হয়তো তাঁদের নিজেদের বড় হয়ে ওঠার মধ্যে কোথাও নিহিত। সেখানে সমাজকে, প্রতিবেশীকে ভালোবাসার নীতিবোধ ছাড়িয়ে উঠেছিল এক অলীক ‘উন্নতি’র প্রতিযোগিতা। জীবনবিচ্ছিন্ন সাফল্যের বোধ। 

[the_ad id=”270086″]

ওই বোধ যে ব্যক্তিমানুষকে কোনও সার্থকতায় পৌঁছে দেয় না, শেষ পর্যন্ত সমাজকেও দুশ্চিকিৎস্য ব্যধিগ্রস্ত করে তোলে তা আজকে আমাদের চারিপাশে প্রকট হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে তার জন্য যাত্রা তো শুরু করতেই হবে। শিশু-মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, মানবশিশু তার জীবনের প্রথম পাঁচ বছরে যেসব মানসিক অভ্যাস অর্জন করে, সেটাই তার বাকি জীবনের বুনিয়াদি চলনের নির্ধারক। প্রথাগত বিদ্যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই নতুন করে ভাবতে হবে কীভাবে সেই বিদ্যা আরও অর্থপূর্ণ হয়, কীভাবে আরও বেশি মানবশিশুকে সেই সত্যিকারের প্রয়োজনীয় বিদ্যার আয়ত্তে নিয়ে আসা যায়। তার জন্য একান্ত দরকার শিশুদের মনকে খর্ব না করা, পঙ্গু, আগ্রহহীন করে না দেওয়া। তাকে মুক্ত, উন্মুখ রাখা। অমৃতও যদি লভ্য হয়, উপযুক্ত পাত্রবিহনে তা রাখব কোথায়? উন্মুক্ত পৃথিবীর সঙ্গে উপযুক্ত শিক্ষা নিত্য আলোর মতো এসে শিশুকুঁড়িকে ফুটিয়ে তুলবে। ‘সাফল্যে’র চেয়েও বড় কোনও মানবিকতায়।          

জয়া মিত্র বাংলা ভাষার এক জনপ্রিয় কবি ও গদ্যকার। সত্তরের দশকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং রাজনৈতিক বন্দীদশাও কাটিয়েছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, এই সমস্ত মাধ্যমেই তাঁর অনায়াস যাতায়াত। লেখালেখি করেন ছোটবড় একাধিক সংবাদমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায়।জল, প্রকৃতি, পরিবেশ, নারী ও শিশু বিষয়ে ওঁর কাজ উল্লেখযোগ্য। 'হন্যমান', 'জলের নাম ভালোবাসা', 'রূপুলি বেতের ঝাঁপি', 'মাটি ও শিকড়বাকড়' জয়া মিত্রর কিছু জনপ্রিয় ও সমাদৃত বই।

Picture of জয়া মিত্র

জয়া মিত্র

জয়া মিত্র বাংলা ভাষার এক জনপ্রিয় কবি ও গদ্যকার। সত্তরের দশকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং রাজনৈতিক বন্দীদশাও কাটিয়েছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, এই সমস্ত মাধ্যমেই তাঁর অনায়াস যাতায়াত। লেখালেখি করেন ছোটবড় একাধিক সংবাদমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায়।জল, প্রকৃতি, পরিবেশ, নারী ও শিশু বিষয়ে ওঁর কাজ উল্লেখযোগ্য। 'হন্যমান', 'জলের নাম ভালোবাসা', 'রূপুলি বেতের ঝাঁপি', 'মাটি ও শিকড়বাকড়' জয়া মিত্রর কিছু জনপ্রিয় ও সমাদৃত বই।
Picture of জয়া মিত্র

জয়া মিত্র

জয়া মিত্র বাংলা ভাষার এক জনপ্রিয় কবি ও গদ্যকার। সত্তরের দশকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং রাজনৈতিক বন্দীদশাও কাটিয়েছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, এই সমস্ত মাধ্যমেই তাঁর অনায়াস যাতায়াত। লেখালেখি করেন ছোটবড় একাধিক সংবাদমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায়।জল, প্রকৃতি, পরিবেশ, নারী ও শিশু বিষয়ে ওঁর কাজ উল্লেখযোগ্য। 'হন্যমান', 'জলের নাম ভালোবাসা', 'রূপুলি বেতের ঝাঁপি', 'মাটি ও শিকড়বাকড়' জয়া মিত্রর কিছু জনপ্রিয় ও সমাদৃত বই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস