(Dinabandhu Mitra)
পুলিশের ছাড়পত্র কিছুতেই মিলছে না! কারণ? একটি নাটকের অভিনয় করবে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ কিন্তু ভারতীয় পুলিশবিভাগ নাছোড়বান্দা। এই ঘটনা ইংরেজ আমলের পরের, দেশ ততদিনে স্বাধীন। বারবার বলা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত পুলিশবিভাগ বলে বসেন দীনবন্ধু বাবুকে আসতে হবে! ততদিনে দীনবন্ধু মিত্রের মৃত্যুর ৮০ বছর অতিক্রান্ত। নাটকটির কথা আশা করি সকলেই বুঝতে পারছেন, নীলদর্পণ। অদ্ভুত মনে হলেও ঘটনাটি একেবারেই সত্যি। মৃত্যুর বহু বছর পরেও এই নাট্যকারকে মনে রাখার দায় ছিল না বাঙালির; অথচ মধুসূদন সমসাময়িক সময়ে ব্রিটিশ সরকারের ভিত নিজের সাহিত্যকীর্তির মাধ্যমে কিছুটা হলেও টলমল করে দিয়েছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চেও যেন তিনি খানিক বিস্মৃত! (Dinabandhu Mitra)
দীনবন্ধুর পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল গন্ধর্ব নারায়ণ মিত্র। এমন রাশভারী নামের কারণ হিসেবে জানা যায়, বাবা-মা ভেবেছিলেন তাঁদের সন্তান বড় হয়ে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের জন্য হয়তো কোনও অসাধ্য সাধন করবে!
দীনবন্ধু মিত্রর জন্ম ব্রিটিশ ভারতে, ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে, অবিভক্ত বাংলার উত্তর ২৪ পরগনার চৌবেড়িয়া গ্রামে। বর্তমানে এটি উত্তর ২৪ পরগনার অন্তর্ভুক্ত হলেও সেই সময়ে এটি ছিল নদিয়ার অংশবিশেষ। ছোট নদী যমুনাসহ আরও তিনটি নদী বেড় দিয়ে রেখেছিল এই গ্রামকে, সেইখান থেকেই এমনতর নাম। দীনবন্ধুর পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল গন্ধর্ব নারায়ণ মিত্র। এমন রাশভারী নামের কারণ হিসেবে জানা যায়, বাবা-মা ভেবেছিলেন তাঁদের সন্তান বড় হয়ে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের জন্য হয়তো কোনও অসাধ্য সাধন করবে! দীনবন্ধুর বাবা ছিলেন কালাচাঁদ মিত্র। ছোটোবেলায় গ্রামের পাঠশালাতেই প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হয় তাঁর। (Dinabandhu Mitra)

আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না তাঁদের পরিবারের। সামান্য পড়াশোনার পরেই দীনবন্ধুকে জমিদারি সেরেস্তার কাজ শুরু করতে হয়। এত অল্প সময়ে নিজের পড়াশোনার জীবনে ইতি টানতে চাননি তিনি। তাই উচ্চশিক্ষার টানে একরকম পালিয়ে আসেন কলকাতায়! পিতৃব্যের বাড়িতে ঠাঁই হয়, তবে কঠোর পরিশ্রম করে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যান দীনবন্ধু। রান্নাবান্না করে, বাসন মেজে ঘরের বিভিন্ন কাজকর্ম সারার পর সুযোগ মিলত লেখাপড়ার।
প্রথমে পাদ্রী জেমস লঙ্ সাহেবের অবৈতনিক স্কুলে শুরু করেন পড়াশোনা। পরিবার প্রদত্ত নামটি এই সময়েই পরিবর্তন করে নিজের নতুন নাম গ্রহণ করে হন দীনবন্ধু। (Dinabandhu Mitra)
আরও পড়ুন: প্রকাশগলির ভিতর দিয়ে
এরপর তিনি ভর্তি হন কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে। বর্তমানে এটিই কলকাতার ঐতিহ্যশালী হেয়ার স্কুল! সমস্ত কাজের চাপ সামলে পরীক্ষার ফলাফলে কিন্তু কোনও প্রভাব পড়তে দেননি দীনবন্ধু। ১৮৫০-এ জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তিলাভ থেকে হিন্দু কলেজে ভর্তি। এর পরের দু-বছরও প্রথম হয়ে বৃত্তিলাভের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৮৫৩-র জানুয়ারিতে শিক্ষকতার পরীক্ষা পাস করলেও পড়া আর সম্পূর্ণ হয়নি। ১৮৫৫-তে মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে ডাকবিভাগে চাকরি পেয়ে চলে যান পাটনায়। পাটনা থেকে তাঁর ভ্রমণজীবন শুরু। ভ্রমণকারীর মতন কাজের সুবাদে তাঁকে যেতে হয় বিভিন্ন জায়গায়; পাটনা থেকে ওড়িশা, সেখান থেকে নদিয়া, তারপর যশোর, ঢাকা হয়ে আবার ওড়িশা, কর্মজীবনে কোথাও দীর্ঘস্থায়ী আবাস গড়ে তুলতে পারেননি। ১৮৭১-এ লুসাই যুদ্ধে সরকারি ডাকের প্রয়োজনীয়তায় কাছাড়ে যেতে হয় তাঁকে। কলকাতায় ফিরে আসার পর দীনবন্ধু মিত্র হয়ে ওঠেন ‘রায়বাহাদুর’! (Dinabandhu Mitra)

নিজের কর্মজীবনটি একেবারেই স্থিতিশীল ছিল না দীনবন্ধুর। অক্লান্ত পরিশ্রম করলেও প্রাপ্য মর্যাদাটুকু পাননি কখনোই। পদন্নতির সম্ভাবনা থাকলেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তা হয়নি। বাড়েনি বেতনও। ছুটির আবেদন করলে তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই না-মঞ্জুর হয়ে যেত। এইভাবেই ক্রমাগত অস্থায়ী জীবনের ধকল এবং বারংবার বিভিন্ন স্থান বদলের কারণে অচিরেই ভেঙে যায় স্বাস্থ্য। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে অকাল স্বাস্থহানির কারণে চলে যান ইহলোকের সব বন্ধন কাটিয়ে। যে সাহিত্যিক দীনবন্ধুকে আমরা খোঁজার চেষ্টা করছি, তাঁর সন্ধান কিন্তু এই ভ্রমণপর্বেই মিলবে! ক্রমাগত বিভিন্ন স্থানে যেমন তিনি ঘুরেছেন, তেমনই সান্নিধ্য পেয়েছেন বহু মানুষের, আর সেখান থেকেই বিবিধ সাহিত্যকর্মের রসদটুকু খুঁজে নিতে অসুবিধা হয়নি। (Dinabandhu Mitra)
আরও পড়ুন: বিবাহ রন্ধন: ‘যদি কাগজে লেখো নাম’
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় কবিতা লেখার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল দীনবন্ধুর সাহিত্যচর্চা। নীলদর্পণ সেই চর্চার ভাবীকালকে বহন করে আনে। ক্ষেত্রমণি, তোরাপ, আদুরী, রাজীব, নিমচাঁদ, নদেরচাঁদ, কাঞ্চনের মতন চরিত্রগুলোর দিকে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, সমাজের কতটা গভীর পর্যন্ত অন্তর্দৃষ্টি ছিল তাঁর। ডেপুটি থেকে গ্রামের প্রজা, নেশাখোর, লম্পট, গ্রাম্য বালিকা, প্রায় সর্বস্তরের মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। কেবল ডাকবিভাগের একজন কর্মীর সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেননি, আর তাই সধবার একাদশী থেকে বিয়ে পাগলা বুড়ো-র মতন রচনা সৃষ্টি করে গেছেন সেই সময়ের নিরিখেই। (Dinabandhu Mitra)

নীলদর্পণ রচনা ও প্রকাশের পর নিজের নাম-পরিচিতি গোপন রাখেননি দীনবন্ধু মিত্র। সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত সমস্যা বাড়বে জেনেও এই সৎসাহসটুকু বজায় রাখতে পেরেছিলেন। এর পরের ইতিহাস অনেকেরই জানা। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দিয়ে এর ইংরেজি অনুবাদ করান পাদ্রী রেভারেন্ড জেমস লঙ্। নীলকর সাহেবদের ভয়াবহ রূপটি এমন নগ্ন বাস্তবে চলে আসবে, এমনটা হয়তো সাহেবরা ভাবতেও পারেননি! লঙ্ সাহেবের বিরুদ্ধে ইংলিশম্যান পত্রিকার সম্পাদক মানহানির মামলা করেন। একমাসের কারাদণ্ডসহ এক হাজার টাকা জরিমানা হয় পাদ্রী লঙ্-এর! ইতিহাস হয়ে ওঠে নীলদর্পণ। (Dinabandhu Mitra)
নিজের জীবনে যা দেখেছেন তাইই সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তুলেছেন। হয়তো সে কারণেই আজ তিনি জনপ্রিয়তার আড়ালে ব্রাত্য। কলকাতার সাহিত্য জগতে এখনও দীনবন্ধু মিত্রের নাম অখ্যাত। একেবারে শুরুতেই যে ঘটনার উল্লেখ করেছিলাম, ফিরে তাকালে বোঝা যায়, পুলিশ বিভাগ জানতেনই না দীনবন্ধু মিত্র কে! কেবল দীনবন্ধুই নন, তাঁর জন্মভিটেও কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাঁর নামে রাস্তাঘাট, স্কুল তৈরির পরে চৌবেড়িয়ার বাসভূমিটি হেরিটেজ তকমা পায়, কিন্তু বিন্দুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি সেই ভিটের। ভগ্নপ্রায় বাড়ির ইটের ভিতর থাকা অজানা ইতিহাসের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে বটের ঝুরি! পাশ দিয়ে গেলে মনে হতে পারে কোনও ভূতুড়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই বাড়ি! ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি পেয়েছিলেন দীনবন্ধু, ভাবতে পেরেছিলেন ইতিহাসে এমনভাবেই বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি হয়ে যাবেন ধীরে ধীরে? (Dinabandhu Mitra)
তথ্যসূত্র:
১/দীনবন্ধু রচনাসংগ্রহ (প্রধান সম্পাদক: গোপাল হালদার);
২/সাহিত্যসাধক চরিতমালা
৩/ আনন্দবাজার পত্রিকা
৪/ গুগল, উইকিপিডিয়া
বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।