(Dwarakanath Gangopadhyay)
“উনি হচ্ছেন অমুকের স্ত্রী”—বঙ্গসমাজে মহিলাদের পরিচয় প্রদানের এই রীতি খুব অস্বাভাবিক লাগছে শুনতে? ২০২৫-এও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভিতর ভিতর চোরা স্রোতের মতন এই পরিচয় প্রদানের ধারা অব্যাহত; একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই টের পাওয়া যায়! কিন্তু এমন একজন মানুষ ছিলেন উনিশ শতকে, যাঁর পরিচিতি হয়ে উঠেছিল, কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর স্বামী হিসেবে। ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনীর পরিচিতি এখন অনেকেই জানেন, আর সেইসঙ্গেই জানেন ‘তাঁর স্বামী’ হিসেবে পরিচিত দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ওরফে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। (Dwarakanath Gangopadhyay)
বিশেষ করে মহিলারা কতটা স্বাধীন হতে পারেন, এ বিষয়ে ছিল বিভিন্ন ছুঁৎমার্গ! এই দ্বিধাগ্রস্ততাকে কাটিয়ে তুলতে দ্বারকানাথ নতুন করে গঠন করলেন ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’।
স্বামীর পরিচিতিই কি স্ত্রীর পরিচিতি হয়ে উঠতে পারে? বা এর বিপরীত? এই বিতর্কের ভিতর না গিয়ে, বহু কাজের কথা চলে আসে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামের পাশে। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে পরে একসময় নানা ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংস্কার প্রবেশ করেছিল তার ভিতর। বিশেষ করে মহিলারা কতটা স্বাধীন হতে পারেন, এ বিষয়ে ছিল বিভিন্ন ছুঁৎমার্গ! এই দ্বিধাগ্রস্ততাকে কাটিয়ে তুলতে দ্বারকানাথ নতুন করে গঠন করলেন ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’। যে সদস্যরা পরবর্তীতে তৈরি করবেন ‘ভারতসভা’। দুর্ভিক্ষ থেকে কৃষক আন্দোলন, সাধারণ মানুষের পাশ থেকে সরে যাননি দ্বারকানাথ। গ্রামে গ্রামে মদ তৈরির অনৈতিক-অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন বারবার। (Dwarakanath Gangopadhyay)

দ্বারকানাথ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৪-এর ২০ এপ্রিল, জন্মস্থান অবিভক্ত বাংলার ঢাকার বিক্রমপুরে। নিজের সৎসাহস এবং প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে কোনওভাবেই হারিয়ে যেতে দেননি দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। অবলাবান্ধব, সমালোচক-এর মতন পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি নিজের হাতে ধরেছিলেন কলম। মেয়েদের সর্বস্তরে উন্নতিবিধানের চেষ্টা করার পাশাপাশি ব্রিটিশদের অমানবিক শোষণের ঘটনাকে তুলে ধরতে সক্রিয় হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে চা শ্রমিকদের উপর হওয়া অন্যায়ের বিষয়টি অবশ্যই চলে আসে! (Dwarakanath Gangopadhyay)
আরও পড়ুন: ‘রায় বাহাদুর’ মিত্রমশাই
সঞ্জীবনী পত্রিকায় রামকুমার বিদ্যারত্ন চা-কর সাহেবদের বিরুদ্ধে চলা মামলা এবং ইংরেজ বিচারপতিদের একপেশে রায়প্রদানের বিষয়টি নিয়ে লেখা শুরু করেছিলেন। ঘটনাটি দ্বারকানাথের নজরে আসে। এই সময়েই একটি ঘটনা বিশেষ আলোড়ন তৈরি করে দেয়। গর্ডন নামের এক ব্রিটিশ কর্তা প্রায় বিনা কারণে উমেশ নামের এক বালকের সারা শরীর জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দেন! যন্ত্রণায় মারা যায় ছেলেটি। বিষয়টি নিয়ে থানা-আদালত হলেও খুব সহজেই গর্ডন মুক্তি পেয়ে যায়। ঘটনাটি প্রকাশিত হয় সঞ্জীবনী পত্রিকায়। সাড়া পড়ে যায় শিক্ষিত সমাজে। (Dwarakanath Gangopadhyay)
থেমে থাকেননি দ্বারকানাথ। স্বয়ং আসাম যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁকে তো অনেকেই চেনেন, তাহলে উপায়? সাহায্য নেন ছদ্মবেশের! খড়ের গাড়ির ভিতর আত্মগোপন করে বিস্তীর্ণ এলাকায় সমীক্ষা চালাতে থাকেন। সংগ্রহে আসে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য! এই সমস্ত তথ্যভাণ্ডারের সহায়তায় ধারাবাহিক প্রবন্ধ প্রকাশ শুরু করেন সঞ্জীবনী পত্রিকায়। এখানেই শেষ হয়নি। দ্য বেঙ্গলি পত্রিকায় একাধিক ইংরেজি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছিল দ্বারকানাথের। একের পর এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ চলে আসে প্রকাশ্যে!
মাতৃত্বের ছুটি না থাকায় শিশুদের অকালমৃত্যু, মায়েদের অবাঞ্ছিত গর্ভপাত, ম্যালেরিয়ার ভয়াবহ প্রকোপে শিশুদের প্রাণ হারানো, চা বাগানের ম্যানেজারদের অকথ্য অত্যাচার এবং চাবুকের ব্যবহারের মতন বহু গোপন সত্য তুলে ধরেন দ্বারকানাথ।
মাতৃত্বের ছুটি না থাকায় শিশুদের অকালমৃত্যু, মায়েদের অবাঞ্ছিত গর্ভপাত, ম্যালেরিয়ার ভয়াবহ প্রকোপে শিশুদের প্রাণ হারানো, চা বাগানের ম্যানেজারদের অকথ্য অত্যাচার এবং চাবুকের ব্যবহারের মতন বহু গোপন সত্য তুলে ধরেন দ্বারকানাথ। তাঁর কলম জানায়, চা শ্রমিকদের উপর অত্যাচারের এক অতি প্রচলিত পদ্ধতি ছিল সংকীর্ণ ঘুপচি ঘরে বন্দি করে রাখা। তেষ্টায় এক ফোঁটা জলও পেতেন না তাঁরা! ইতিহাসে একেই বোধহয় প্রকৃত ‘অন্ধকূপ’ বলা যায়! (Dwarakanath Gangopadhyay)
এমন জীবনকে স্বেচ্ছায় নির্বাচন করেছিলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কর্মক্ষেত্রের একেবারে প্রাথমিক পর্বটি ছিল শিক্ষকতা। সময়, উনিশ শতকের শেষ পর্যায়, গ্রামের শিক্ষকতা ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’ স্থাপন ও ছাত্রী নিবাস প্রস্তুতিতে ব্রাহ্ম সমাজের একজন হিসেবে বিশেষ ভূমিকা ছিল তাঁর। কয়েক বছর পর এই বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’। এই সবকিছুর সঙ্গেই প্রকট বা প্রচ্ছন্ন হিসেবে ছিলেন দ্বারকানাথ। (Dwarakanath Gangopadhyay)
‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’ স্থাপন ও ছাত্রী নিবাস প্রস্তুতিতে ব্রাহ্ম সমাজের একজন হিসেবে বিশেষ ভূমিকা ছিল তাঁর। কয়েক বছর পর এই বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’।
এই স্কুলের সূত্রেই ছাত্রীদের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে পারা ও মহিলাদের মেডিক্যাল কলেজে প্রবেশাধিকারের মতন বিষয়গুলিতে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই স্কুলটি পরবর্তীতে বেথুন স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। তাঁর এই সমস্ত কাজে সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, দুৰ্গামোহন দাস, আনন্দমোহন বসু, অন্নদাচরণ খাস্তগীর প্রমুখরা। (Dwarakanath Gangopadhyay)
নিজের জীবনে ‘অবলাবান্ধব’ উপাধিটি পেয়েছিলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। সময়টা ১৮৭০-এর প্রথমদিক। ‘অবলাবান্ধব’ নিয়ে কলকাতায় উপস্থিত হলেন দ্বারকানাথ। পরিস্থিতি মোটেই অনুকূল ছিল না। ঢাকার বন্ধুদের সহযোগিতা যেমন পেলেন না, তেমনই কলকাতায় প্রথমদিকে পেলেন না কোনও সাহায্য। এই সময়ে পত্রিকার যাবতীয় দায়িত্ব সামলাতে হত তাঁকে একার হাতে। তবে বেশ কিছুদিনের মধ্যেই একটি ছোট দল গঠন করে ফেললেন দ্বারকানাথ। ব্রাহ্মসমাজের সেই দলটি নতুন নতুন লেখকদের সহযোগিতায় ‘অবলাবান্ধব’-কে জনপ্রিয় ও শক্তিশালী করে তুলল। এই কাজের সূত্রেই উপাধিটি প্রাপ্য হয় তাঁর। (Dwarakanath Gangopadhyay)

রাজনীতির ক্ষেত্রেও নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন দ্বারকানাথ। ভারতসভা এবং জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন তিনি। এখানেই কংগ্রেসের অধিবেশনে মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের জন্য একাধিকবার দাবি জানিয়েছেন। কার্যত দ্বারকানাথের বারংবার প্রচেষ্টায় ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ছ’জন মহিলা বোম্বাইতে জাতীয় কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে যোগদানের সুযোগ পান। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ও স্বর্ণকুমারী বসু যুগ্মভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন। (Dwarakanath Gangopadhyay)
এত এত কাজের মাঝে ছোটদের জন্য কিছু পাঠ্যপুস্তকও লিখেছিলেন। ‘প্রিন্স’ উপাধিটি তাঁর বরাতে জোটেনি, জোটার কথাও নয় যদিও! অগুনতি মানুষের ক্লান্ত মিছিলে হয়তো হারিয়ে গিয়েছেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
জীবনের শেষ পর্যায়ে দ্বারকানাথ ভুগছিলেন যকৃতের অসুখে। ১৮৯৮-এর জুন মাসে অসুখ আরও গুরুতর আকার নেয়। ২৭ জুন রাতের শেষ প্রহরে মাত্র ৫৪ বছর বয়সেই ইহলোক থেকে মুক্ত হয়ে যান দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর প্রয়াণের পর সঞ্জীবনী পত্রিকা প্রকাশ করে এক শোকপ্রস্তাব। (Dwarakanath Gangopadhyay)
এত এত কাজের মাঝে ছোটদের জন্য কিছু পাঠ্যপুস্তকও লিখেছিলেন। ‘প্রিন্স’ উপাধিটি তাঁর বরাতে জোটেনি, জোটার কথাও নয় যদিও! অগুনতি মানুষের ক্লান্ত মিছিলে হয়তো হারিয়ে গিয়েছেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কাজের সুবাদে বাংলার অঘোষিত ‘প্রিন্স’ উপাধিটি তাঁর নামের পাশে ভাবা গেলে নেহাত মন্দ হবে কি? (Dwarakanath Gangopadhyay)
তথ্যসূত্র-
আনন্দবাজার পত্রিকা
ইন্ডিয়া টাইমস্ ব্লগ
গুগল
দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও তৎকালীন ব্রাহ্ম-হিন্দু সমাজের চালচিত্র: নিখিল সুর
ইতিহাস আড্ডা
বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।