ভারতীয় লঘু সংগীতের জগতে সহজাত প্রতিভার অন্যতম দুই সেরা দৃষ্টান্ত হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukhopadhyay) ও কিশোরকুমার (Kishorkumar)। দুজনের কারুরই সেই অর্থে প্রথাগত সংগীত শিক্ষার বনিয়াদ সেভাবে শক্তপোক্ত ছিল না। কিন্তু সমুদ্রপ্রায় সাংগীতিক প্রতিভা ও পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল থেকে অনায়াসে আহরণ করার ক্ষমতা দুজনকে নিয়ে গিয়েছিল খ্যাতির শীর্ষস্থানে। এঁদের মধ্যে একজন কলকাত্তাইয়া বাঙালি। অপরজন প্রবাসের। এই দুই মহান সংগীতশিল্পীর সুর-সংযোগে রচিত হয়েছে বেশকিছু চিরসবুজ গান। উজ্জ্বলতায় যা আজও ভাস্বর। এই বিষয় নিয়ে দু’চার কথা বলাই যায়।
সুরের আকাশে শুকতারা: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উঠে এসেছিলেন দক্ষিণ কলকাতার এক ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। অপূর্ব সুরে ভরা কণ্ঠ ও হৃদয়ে সংগীতের তাড়না নিয়ে জন্মেছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে পুরোপুরি গানে এলেন। এরপর, ক্রমশ তাঁর সুরপ্রতিভা ডানা মেলতে লাগল। এভাবেই শিল্পী হিসেবে প্রথমে কলকাতায় নিজেকে মোটামুটি ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে, পাড়ি দিলেন মুম্বাই। সময়টা ১৯৫১।

অন্যদিকে, ঐ সময়েরই আগে-পরে, কিশোরকুমারও তাঁর ‘দাদামণি’, চিত্রতারকা অশোককুমারের হাত ধরে মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডোয়া থেকে মুম্বাই এসে প্রতিষ্ঠার জমি খুঁজতে শুরু করেছেন। শুরু করলেন নায়ক-গায়ক হিসেবে। তারপরে চলে এলেন শুধুমাত্র গানের জগতে। প্রসঙ্গত, কিশোরকুমার বললে, আমাদের প্রথমেই মনে আসে এক ধরনের উচ্ছ্বাসে ভরা ঝলমলে গানের কথা। কিন্তু এও আমরা জানি, বিষাদময় রোমান্টিক মেলডিও এই শিল্পীর গলায় কী মাধুর্যতা পেয়েছে। গানের ধরন যেমনই হোক, যা মনে হয়, কিশোরকুমারের সাংগীতিক দর্শনের মূল কথাটা ছিল, “দুখী মন মেরে/শুন মেরা কহেনা…”। তাঁর বিভিন্ন ধরনের গান শুনলে বোঝা যায়, আসলে তিনি নরম অন্তর-কাড়া স্নিগ্ধ গানেরই কাঙাল ছিলেন। আর এই ধরনের গানের অন্যতম নৃপতি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোঁয়ায় যে বেশকিছু কিশোর-সংগীত জন্ম নেবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
১৯৫১ সালে মুম্বাই গিয়ে, “ফিল্মিস্তান”-এ সংগীত পরিচালকের চাকরি নিয়েছিলেন হেমন্ত। হিন্দি জগতে পদবী বাদ দিয়ে হলেন ‘হেমন্তকুমার’। সংস্থার মালিক শশধর মুখার্জি ছিলেন অশোক-কিশোরের আপন ভগ্নিপতি। তখন মুম্বাইয়ের ছবির জগতে চলছে বাঙালিদের রমরমা, যার মধ্যে সংগীত ছিল অন্যতম প্রধান। শিল্প-প্রতিভার বিনিময় ও প্রকাশের এক অনবদ্য ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল সেইসময়ের বলিউডে। ফলে, সবদিক থেকে এরকম অনুকূল আবহাওয়ায় হেমন্ত-কিশোর সাংগীতিক সংযোগ ঘটতে বেশি সময় লাগল না।
১৯৫৭ সালে সত্যেন বসু পরিচালিত “বন্দী” ছবিতে প্রথমবার সংযোগ ঘটল দুজনের। এতে হেমন্তকুমারের সংগীত পরিচালনায় ছবির নায়ক কিশোরকুমারের একক কণ্ঠে ছিল দুটি গান― “চুপ হো যা আমিরোঁ…” এবং “এক রোজ হমারি ভি…”। প্রথম গানটি ঘুমপাড়ানি গানের ধরনের হলেও, প্রচলিত ধাঁচ থেকে একটু আলাদা। মিষ্টি ছন্দে গড়া গানটির সঙ্গে কিশোরের গায়কী মিশে গেছে সুন্দর ভাবে। অন্য গানটি, পরিচিত কিশোর-ঢঙের কমেডি অভিনয়সহযোগে গাওয়া। হেমন্তকুমারের সুররচনা নায়ক-গায়কের ধরনের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে গেছে। এছাড়াও এই ছবিতে গীতা দত্তের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে কিশোর গেয়েছিলেন, “ঘর কি রৌনক হ্যায় ঘরওয়ালি…”। একই বছরে কিশোর-অভিনীত “মিস্ মেরী” ছবিতে হেমন্তকুমারের সুরে নায়ক গাইলেন মজাদার গান, “গানা না আয়া…”। এবার বাংলা ছবি।
কণ্ঠে নিলেম গান: নামে হেমন্ত, কণ্ঠে চিরবসন্ত: পর্ব ২ : স্বপন সোম
১৯৫৮ সালে কিশোরকুমার প্রযোজিত বাংলা ছবি “লুকোচুরি” মুক্তি পেল। বলাই বাহুল্য, প্রযোজকই নায়ক। নায়িকা দুজন― অনীতা গুহ ও মালা সিনহা। সংগীত পরিচালনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাংলা গানে এই প্রথম ঘটল দুজনের যুগলবন্দি, যা শুরুতেই বাজিমাৎ করল। ছবিতে কিশোরের ডাবল রোল। যমজ ভাই। দুজনের স্বভাব দুই মেরুতে। একজন শান্ত নম্র। ভাল গান করেন। সুর করাতেও দক্ষ এবং সেটাই পেশা। তাঁর শান্ত স্বভাবজাত সুরগুলি স্বাভাবিক ভাবেই হয় মেলডিনির্ভর। অন্যদিকে, আরেক ভাই চঞ্চল, উচ্ছ্বাসে ভরা এবং সহজাত প্রতিভাধর। গান সেও ভালোই গাইতে পারে। কিন্তু তার ধরনে থাকে একটা উচ্ছল, প্রাণখোলা ভাব। এই দুরকম চরিত্রের কিশোর-কণ্ঠ অনুযায়ী যেভাবে গানগুলো গড়ে তুলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তার জন্যে কোনও বিশেষণই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে কিশোরকুমার ও রুমা দেবীর গাওয়া “এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায়…” গানটি যে স্বপ্নময় প্রেমের আবেশ ছড়িয়ে সুরপথে এগিয়ে চলে, সেই ভালোবাসার গান চিরকালের জন্যে গেঁথে যায় বাঙালিমনে। এছাড়াও ঐ শান্ত ভাইয়ের গলাতেই আছে একটি রবীন্দ্রসংগীত, “মায়াবনবিহারিণী হরিণী…”(সহশিল্পী― রুমা দেবী)। অসাধারণ গেয়েছিলেন কিশোরকুমার। এটাই তাঁর গাওয়া প্রথম রবীন্দ্রসংগীত। প্রসঙ্গত, “লুকোচুরি”-তে যেহেতু এই একটিই রবীন্দ্রনাথের গান ছিল, তাই এর রেকর্ড বেরোনো নিয়ে একটা সমস্যা হয়। কারণ, অন্য পিঠের গানটা তো দরকার। ছবিতে তো আর কোনও রবীন্দ্রসংগীত নেই। রেকর্ড কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ডে অন্য গান থাকতে পারবে না। এইজন্যে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও রুমা দেবী দ্বৈত কণ্ঠে গাইলেন “তোমার গীতি জাগাল স্মৃতি…”, যেটি রইল “মায়াবনবিহারিণী…” গানের উলটো পিঠে। রেকর্ড বেরিয়ে গেল। শুধুমাত্র এই কারণেই গানটি গেয়েছিলেন হেমন্ত-রুমা। ছবির সঙ্গে এ গানের কোনও সম্পর্ক ছিল না। এর পাশাপাশি সেই চঞ্চল, ছটফটে ভাইয়ের গানের মধ্যে ছিল কিশোর-স্পেশাল ইয়ডলিং সহযোগে “এক পলকের একটু দেখা…”, গীতা দত্তের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে “শুধু একটুখানি চাওয়া…” এবং এক ও অদ্বিতীয় “শিং নেই তবু নাম তার সিংহ…”। প্রত্যেকটি গান জনপ্রিয় হলেও, শেষের গানটি সবকিছু ছাড়িয়ে ‘উঁকি মারে আকাশে’। এই ধরনের গানে তো কিশোরকুমার বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারী।
এই গানটি নিয়ে কিছু মহল থেকে বলা হয়েছিল (এখনও শোনা যায়) যে, ১৯৫১ সালে, হলিউডের বিখ্যাত শিল্পী ড্যানি কে-র গাওয়া Oh By Zingo গানের অনুসরণে, বাংলা গানটি তৈরি করেছিলেন কিশোরকুমার। এ নির্মাণের কৃতিত্ব পুরোপুরি ভাবে তাঁরই প্রাপ্য, “লুকোচুরি”-র সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এ ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা নেই। সঙ্গে এরকমও বলা হয়, হেমন্তবাবু নাকি, এটা স্বীকার করেন না। কিন্তু, কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। কারণ, ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে Silhouette Magazine-এর পীযূষ শর্মাকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের এক জায়গায় গানটি সম্পর্কে হেমন্ত বলেছিলেন, এটা সম্পূর্ণভাবে কিশোরের মস্তিষ্কপ্রসূত, এ ক্ষেত্রে তাঁর বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই। শুধু তাই নয়। হেমন্ত আরও বলেছিলেন, তাঁর সুরারোপিত “গার্ল ফ্রেন্ড”(১৯৬০) ছবিতে থাকা কিশোরকুমারের গাওয়া “তুম ঠিক হি কহতি হো ম্যাডাম/ ম্যায় পাগল হুঁ… ও ম্যাডাম কাম কাম কাম…” গানটির কম্পোজিশনও ছিল পুরোপুরি ভাবে গায়কেরই, যা শুনলেই বোঝা যাবে। আবার এই ছবিরই অপূর্ব মেলডিতে ভরা “আজ রোনা পড়া তো সমঝে…” গানে বেরিয়ে আসে অতুলনীয় হেমন্ত-ঘরানা। জবরদস্ত গেয়েছেনও কিশোরকুমার। গঠনপ্রণালী ও গায়কীর দিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা গানদুটি শুনলেই স্পষ্ট হয় কিশোরের গায়নভঙ্গির অতলান্তিক বৈচিত্র্যের দিকটি। প্রসঙ্গত, “আজ রোনা পড়া…”-র সুরেই আমরা এর দু’বছর আগে(১৯৫৮) লতা মঙ্গেশকরের গলায় শুনেছিলাম, “প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে…”। এছাড়া, “গার্ল ফ্রেন্ড” ছবিতে কিশোরের গাওয়া বাকি গানগুলোও ছিল বৈচিত্র্যে ভরপুর।
এরপর, হেমন্তকুমারের সংগীত পরিচালনায় “দো দুনি চার”(১৯৬৮), “রাহগীর”(১৯৬৯), “খামোশী”(১৯৬৯), “বিশ সাল পহেলে”(১৯৭২) ছবিগুলিতেও কিশোরকুমারের নানা বর্ণের গান শোনা গেছে, যার প্রায় সবগুলোই কমবেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পীযূষ শর্মাকে হেমন্ত বলেছিলেন, তিনি সুর করে দেওয়ার পর, কিছু কিছু গান, কিশোরকুমার তাঁর মতো করে অল্পবিস্তর বদলে নিতেন। অবশ্য, হাতেগোনা কয়েকটি গানের ক্ষেত্রে এরকম হয়েছে। এ ব্যাপারে হেমন্ত কখনওই আপত্তি করেননি। কারণ, এতে ভাল ছাড়া খারাপ হয়নি। যেমন, “দো দুনি চার” ছবিতে গুলজারের লেখা “হাওয়ায়োঁ পে লিখ দো…” গানটি হেমন্তর কাছ থেকে শুনে, তাকে কিছুটা নিজের মতো গড়ে নিয়ে গেয়েছিলেন কিশোরকুমার। গানটি শুনলেই বোঝা যায়, হেমন্তর সুরের প্রলেপে তৈরি গানটি কিশোরের গায়কীর নিজস্ব ঢঙকে সঙ্গী করে কী সুন্দর মূর্ছনায় ছড়িয়ে পড়েছে ছবির প্রকৃতিময় দৃশ্যে। এটাই তো হওয়া উচিৎ। যাঁরা জাতের শিল্পী হন, তাঁদের প্রত্যেকেরই একটা নিজস্বতা থাকে। যা তাঁদের বিশিষ্ট করে তোলে। সংগীত পরিচালক হেমন্ত ও গায়ক কিশোরকুমারের এই বিশিষ্টতা যখন দুজনের কাছেই মান্যতা পায়, তখনই গান হয়ে ওঠে সার্থক। হেমন্ত এও বলেছেন, তাঁর সুরারোপিত অধিকাংশ গানই একটুও না বদলে গেয়েছেন কিশোরকুমার। তার মধ্যে কিছু গান নিয়ে ভেবেছেন গভীরভাবে। যেমন, “খামোশী” ছবিতে হেমন্ত-র সংগীত জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কম্পোজিশন, “উও শাম্ কুছ আজীব থি…” গানটি সুরকারের কাছ থেকে শুনে টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দু-তিনদিন ধরে শুনেছিলেন কিশোর। মন দিয়ে ভেবেছিলেন গানটা নিয়ে। তারপর, হেমন্তকে বলেছিলেন, “এটা কাকা-র (রাজেশ খান্না) লিপের গান। আমি একেবারে সেই মুডে গানটা গাইব। কোনও চিন্তা করবেন না।” বাকিটা ইতিহাস। নিজের গাওয়া সেরা পছন্দের দশটি গানের মধ্যে এই গানটিকে রেখেছিলেন কিশোরকুমার। প্রসঙ্গত, বাংলা হিন্দি মিলিয়ে যেকটি ছবিতে হেমন্ত-র সুরে কিশোরের গান আছে, তার অধিকাংশতেই কিশোরকুমার অভিনয় করে গেয়েছেন। শুধুমাত্র কয়েকটি বাদে। যেমন, হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে, “রাহগীর”, “খামোশী” ও “বিশ সাল পহেলে”। শেষের ছবিটির প্রযোজকও ছিলেন হেমন্তকুমার। এতে অন্যতম নায়ক চরিত্রে ছিলেন হেমন্ত-পুত্র জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়। যিনি ছবিতে নাম নিয়েছিলেন ‘রীতেশকুমার’। তাঁরই ঠোঁটে কিশোরের গাওয়া দুটি গান ছিল― “হ্যায় জমানা মেরে দিল…” ও “আভি তো দুয়া দেকে…”(আশা ভোঁসলের সঙ্গে)।

“লুকোচুরি” ছাড়া কিশোরকুমার অভিনীত আরও তিনটি ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়― “মধ্য রাতের তারা”(১৯৬১), “একটুকু ছোঁয়া লাগে”(১৯৬৫) ও “দুষ্টু প্রজাপতি”(১৯৬৭)। শেষের ছবিটিতে কমেডি ভঙ্গিতে কিশোরের গাওয়া “গুটেন মরগেন…” ও “ইউরেকা ইউরেকা..” গানদুটি উন্মাদনা ছড়ায়। পাশাপাশি আছে লোকসুরের মিষ্টি ছন্দে “ছলকি ছলকি মন…”। ঐ ছবিতে কীর্তনাঙ্গের “সুখ নামে শুক পাখি…” গানে একটি অভিনব ব্যাপার আছে। এটি কিশোরের লিপে গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। “মধ্য রাতের তারা”-য় “জন্মদিন” বলে কিশোরের একটিই গান আছে। যা তেমনকিছু উল্লেখযোগ্য নয়। “একটুকু ছোঁয়া লাগে” ছবিতে হেমন্ত আবারও কিশোরকে দিয়ে গাইয়েছেন একটি রবীন্দ্রসংগীত, “একটুকু ছোঁয়া লাগে/একটুকু কথা শুনি…”। এছাড়া আছে “সরস্বতীর সেবা করি…” এবং হেমন্ত-র সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে “দুস্তর পারাবার পেরিয়ে…”।
নিজের অভিনয়ের বাইরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে দুটো বাংলা ছবিতে প্লেব্যাক করেছিলেন কিশোরকুমার। তার মধ্যে ১৯৭২ সালের “অনিন্দিতা” ছবিটির শুধু প্রযোজক ও সংগীত পরিচালকই ছিলেন না হেমন্ত, ছবির পরিচালনাও ছিল তাঁরই। এ ছবিতে কিশোরের গাওয়া “ও গো নিরূপমা/করিও ক্ষমা…” আজও সুপার হিট। অন্য ছবি “প্রক্সি”-তে (১৯৭৭) যে গানটি কিশোরকে দিয়ে গাইয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তা অন্য কারুর পক্ষে গাওয়া সম্ভব ছিল না। ছবিতে ডাবল রোলের অন্যতম নায়ক রঞ্জিত মল্লিক, যিনি গান জানেন না, তাঁকে পরিস্থিতির চাপে পড়ে গানটি গাইতে হচ্ছে― “কী করে বোঝাই তোকে/গানেরই গ জানি না/ ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি/ বেসুরো সুর মানি না…”। গানটি যেমন অসাধারণ লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, তেমনি এলোমেলো ভঙ্গিতে সুর করেছেন হেমন্ত। আর কিশোরকুমার যেভাবে তাকে গানে প্রকাশ করেছেন, তা নিয়ে কিছু বলারই দরকার পড়ে না। এ গানটির ক্ষেত্রেও বোঝা যায়, সুরকার হেমন্তবাবু হলেও, এর অনেক কারিকুরি গায়কজাত।
হেমন্তেরই মাধুরী উৎসবে : অরিজিৎ মৈত্র
সিনেমায় বেশ কয়েকবার হেমন্তর সুরে কিশোরকুমার গাইলেও, নন-ফিল্ম বেসিক গানে একবারের বেশি এ ঘটনা ঘটেনি। ১৯৮০ সালের পুজোর রেকর্ডে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ও মুকুল দত্ত-র কথায় কিশোরকুমারের গাওয়া সেই চারটি আধুনিক বাংলা গান আজও জীবন্ত এবং থাকবেও চিরকাল― “আমার পূজার ফুল…”, “সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে…”, “কেন রে তুই চড়লি ওরে বাবুদের জুড়িগাড়িতে…” এবং “চোখের জলের হয় না কোনও রঙ…”। তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অসুস্থ। তবু তারই মধ্যে চারটি গানে কিশোরের কথা মাথায় রেখে যে সুরবৈচিত্র্য ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি, তাতে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। আর কিশোরকুমারও গানগুলোকে আপন করে নিয়ে গেয়েছিলেন।
শুধুমাত্র হেমন্ত-র সুরেই কিশোরকুমার গাননি, উলটো ঘটনাটাও ঘটেছিল দুটি হিন্দি ছবিতে। অর্থাৎ, তাতে ছিল কিশোরকুমারের সুরে হেমন্তকুমারের গান। দুটি ছবিতেই কাহিনিকার, পরিচালক, প্রযোজক ও সংগীত পরিচালক ছিলেন কিশোরকুমার― “দূর গগন কি ছাঁও মে”(১৯৬৪) এবং “দূর কা রাহী”(১৯৭১)। প্রথমটিতে টাইটেল সঙ হিসেবে ব্যবহৃত “রাহি তু মত্ রুক যানা…” গানটি ছবির আবেদনকে স্পষ্ট করে দেয় শুরুতেই। যাতে আদর্শ হয়ে ওঠে হেমন্ত-র দেব-কণ্ঠ। দ্বিতীয় ছবিতে একটি বিষাদময় নাটকীয় মুহূর্তে সমবেত কণ্ঠের হামিং সহযোগে হেমন্তকুমারের স্বর্ণখচিত গলায় কিশোর-সুরে ধ্বনিত হল― “চলতি চলি যায়ে জিন্দেগী কি ডগর… দূর কা রাহী…”। ছবির দৃশ্যকে যা আরও অর্থবহ করে তুলল।
স্মৃতির আকাশ থেকে: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন হেমন্ত দাদু : অরিজিৎ মৈত্র
পীযূষ শর্মাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের একটা জায়গায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “যেকোনও সংগীত পরিচালকের কাছে কিশোর ছিল একটা সম্পদ।” পাশাপাশি কিশোরকুমারও নানা জায়গায় হেমন্ত সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এরকম দুই দিকপালের এই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন থেকেই যে কালজয়ী সৃষ্টির উন্মেষ ঘটে, তা এতক্ষণের আলোচনায় হয়তো কিছুটা পরিষ্কার।
তথ্যঋণ :
১) আনন্দধারা/ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়(সম্পাদনা : অভীক চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন)
২) জীবনপুরের পথিক হেমন্ত( সম্পাদনা : ধীরাজ সাহা)
৩) একদিন পাখি উড়ে যাবে/ মুকুল দত্ত
৪) বিভিন্ন সিনেমার বুকলেট
জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।