(Rabindranath Tagore)
২৩ বৈশাখ ১৩৩৮, তাঁর সত্তরতম জন্মদিনের প্রাক্কালে শান্তিনিকেতনে বসে ‘জন্মদিন’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন—
বিশ্বের প্রাঙ্গণে আজ ছুটি হোক মোর,/ ছিন্ন করে দাও কর্মডোর। শেষে আরও লিখলেন— এ জন্মের গোধূলির ধূসর প্রহরে/ বিশ্বরসসরোবরে/ শেষবার ভরিব হৃদয় মন দেহ/ দূর করি সব কর্ম, সব তর্ক, সকল সন্দেহ,/ সব খ্যাতি, সকল দুরাশা—/ বলে যাব, ‘আমি যাই, রেখে যাই, মোর ভালোবাসা।’ (Rabindranath Tagore)
আরও পড়ুন: ম্যাথিউ ব্লেক এর উপন্যাস ‘অ্যানা ও’: ভাষান্তর- মোহনা মজুমদার
কিন্তু সত্তর অতিক্রান্ত কবি, যিনি ইতিমধ্যেই তিরিশের বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন, ১৯৩২-এর এপ্রিলে বিদেশ থেকে আসা একটি আমন্ত্রণের সম্মুখীন হয়ে এড়িয়ে যেতে পারলেন না। “দেশ থেকে বেরবার বয়স গেছে এইটেই স্থির করে বসেছিলুম। এমন সময় পারস্যরাজের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ এল। মনে হল এ নিমন্ত্রণ অস্বীকার করা অকর্তব্য হবে। তবু সত্তর বছরের ক্লান্ত শরীরের পক্ষ থেকে দ্বিধা ঘোচেনি।” সাত বছর আগে ১৯২৫ সালে তরুণ আহমদ শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ইরানে শাসনক্ষমতায় এসেছিলেন রেজা শাহ পাহলভি। তাঁর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের সাড়া দেওয়ার পিছনে অবশ্য ছিল কবির দীর্ঘকালের পারস্যপ্রেম। “একদিন দূর থেকে পারস্যও আমার কাছে পৌঁছেছিল। (Rabindranath Tagore)

তখন আমি বালক। সে পারস্য ভাবরসের পারস্য, কবির পারস্য।… আজ পারস্যের রাজা আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন, সেই সঙ্গে সেই কবিদের আমন্ত্রণও মিলিত।” রুমি, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, সানায়ি, হাফেজ, সাদী, সাত্তার প্রমুখ অসংখ্য ফার্সি কবির কাব্যভুবন এবং ব্যাবিলেনীয়, আকামেনীয়, সাসানীয় সভ্যতার ধারক ও বাহক পারস্যের মুসলমান সমাজ সভ্যতা, বাহাই, জরথুস্ত্রু সম্প্রদায় ও তাদের ইতিহাস, যাযাবরদের জীবনযাত্রা এবং পারস্যের অতীত ইতিহাস কবিকে দীর্ঘদিন পারস্যমুগ্ধ করে রেখেছিল। (Rabindranath Tagore)
সমুদ্রপথে বিদেশ যাত্রার ধকল আর সইবে না মনে করে কবি সিদ্ধান্ত নিলেন আকাশপথে ভ্রমণের। এর আগে কবির একবারই আকাশপথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
সমুদ্রপথে বিদেশ যাত্রার ধকল আর সইবে না মনে করে কবি সিদ্ধান্ত নিলেন আকাশপথে ভ্রমণের। এর আগে কবির একবারই আকাশপথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বিমানে চড়ে লন্ডন থেকে প্যারিস গিয়েছিলেন সম্ভবত ১৯২১ সালের ১৭ এপ্রিল। এগারো বছর পরের আবার এক এপ্রিল। ১৯৩২ সালের ১১ এপ্রিল দমদম থেকে কবি চড়ে বসলেন বায়ুতরীতে, সঙ্গে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এবং সচিব অমিয় চক্রবর্তী। এলাহাবাদ, যোধপুর ও করাচী। পরের দিন ১২ এপ্রিল সমুদ্র তীরবর্তী ছোট গ্রাম জাস্ক-এ যাত্রাবিরতি ও রাত্রিযাপন। তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘পারস্যে’ কবি জানাচ্ছেন— পরদিন তিনটে- রাত্রে উঠতে হল, চারটের সময় যাত্রা, ১৩ই এপ্রিল তারিখে সকাল সাড়ে-আটটার সময় বুশেয়ারে পৌঁছনো গেল। (Rabindranath Tagore)
কবির এই পারস্যে আগমন নিয়ে ইরানের মানুষের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। পত্রপত্রিকাতেও তাঁকে নিয়ে নানাবিধ সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছিল। ১৬ এপ্রিল সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ কতদিন পারস্যে থাকবেন তা নির্দিষ্ট না হলেও মনে করা হচ্ছে তিনি সপ্তাহ দু’য়েক সেখানে কাটাবেন। বাস্তবে অবশ্য অসুস্থ শরীর নিয়েও কবি মাসাধিককাল পারস্যে কাটিয়েছিলেন। (Rabindranath Tagore)

এই মাসাধিককাল সময়ে তিনি পারস্যকে চিনেছেন নিজের মতো করে— পথে পথে ঘুরে, শহরে গ্রামে প্রাসাদে সময়যাপন করে, বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে এসে, প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে। পারস্যের এই প্রকৃত রূপ চিনে নেওয়ার কাজে অবশ্য সঙ্গত করেছে তাঁর ইতিহাসের পাঠ। কবি মানবিক অসাম্প্রদায়িক সমাজের স্বপ্ন দেখলেও কখনও ধর্মকে অস্বীকার করেননি। পারস্যের পরিবেশের মধ্যে বিশেষত সুফি মতাদর্শের বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি সেই মানবিক অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় পরিসর লক্ষ করেছেন। (Rabindranath Tagore)
সুফি কবি হাফেজ, চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের আমন্ত্রণে বাংলায় এসেছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন হাফেজের অনুরাগী ভক্ত। সেই হাফেজের সমাধি দেখতে যাওয়া প্রসঙ্গে কবি বলেছেন— বেরলুম, পিতার তীর্থস্থানে আমার মানস-অর্ঘ্য নিবেদন করতে। সমাধিতে বসে চোখ বন্ধ করে কবি উচ্চারণ করেছিলেন সুফি চারণ কবি হাফেজেরই একাধিক কবিতা এবং ভেবেছিলেন— এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল… মনে হল আমরা দু’জন একই পান্থশালার মানুষ, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভর্তি করেছি।… নিশ্চিত মনে হল, আজ কত-শত বৎসর পরে জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক। (Rabindranath Tagore)
সেখানে বাংলা থেকে আগত কবির জন্য জনতার এমন ঢল নামে যে ইরানি কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সেনা মোতায়েন করতে একপ্রকার বাধ্য হন। নানা বর্ণের ফুলে ঢাকা অনুষ্ঠানস্থলে, তার মধ্যে আবার প্রাধান্য ছিল গোলাপের, সরকারের তরফে কবিকে পদক ও ফরমান দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
পারস্যরাজ রেজা শাহর সঙ্গে কবির সাক্ষাৎ হয় ২ মে। আর ৫ মে ধর্ম ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া হয় সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি। পরের দিন ৬ মে ছিল ২৫ বৈশাখ— কবির জন্মদিন, যা এই প্রথম বিদেশে সাড়ম্বরে পালিত হল। মধ্যযুগের জনপ্রিয় ফার্সি কবি শেখ সাদীর সিরাজে অবস্থিত সমাধিস্থলে আয়োজিত হয় রবীন্দ্র-জন্মানুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে ইরানের তৎকালীন ক্যাবিনেট সচিব আব্দুল হোসেন তিমুরতাস-সহ অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সেখানে বাংলা থেকে আগত কবির জন্য জনতার এমন ঢল নামে যে ইরানি কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সেনা মোতায়েন করতে একপ্রকার বাধ্য হন। নানা বর্ণের ফুলে ঢাকা অনুষ্ঠানস্থলে, তার মধ্যে আবার প্রাধান্য ছিল গোলাপের, সরকারের তরফে কবিকে পদক ও ফরমান দিয়ে সম্মানিত করা হয়। অগণিত মানুষ হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে কবিকে অভিনন্দিত করেন এবং নানা উপহার প্রদান করেন। আবেগঘন পরিবেশে আপ্লুত কবি অভিবাদনের প্রত্যুত্তরে তাঁর সদ্য রচিত কবিতা ‘পারস্যে জন্মদিনে’র ইংরেজি তরজমা পারস্যবাসীকে শোনান। (Rabindranath Tagore)
২৫ বৈশাখ ১৩৩৯-এ লেখা এই কবিতাটিতে, ইরানে জন্মদিন পালনকে নিজের দ্বিতীয় জন্ম হিসাবে দেখা আবেগতাড়িত কবি, দিনটির আবেগকে ধরে রেখে লিখেছেন— ইরান, তোমার মত বুলবুল/ তোমার কাননে যত আছে ফুল/ বিদেশি কবির জন্মদিনেরে মানি/ শুনালো তাহারে অভিনন্দনবাণী।… ইরান, তোমার সম্মানমালে/ নব গৌরব বহি নিজ ভালে/ সার্থক হল কবির জন্মদিন।/ চিরকাল তারই স্বীকার করিয়া ঋণ/ তোমার ললাটে পরানু এ মোর শ্লোক—/ ইরানের জয় হোক।

কিন্তু জন্মদিনের আয়োজন এখানেই শেষ হল না। বিকেলে ইরানের শিক্ষা বিভাগের মন্ত্রীর বাসভবনে কবিকে নিমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত হতে হল। সেখানে দেশের প্রধান ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বৈদেশিক রাষ্ট্রপ্রতিনিধিরাও।(Rabindranath Tagore)
পারস্যে জন্মদিন কাটিয়ে ফেরার সময় কবি কৃতজ্ঞচিত্তে বিনম্র উচ্চারণে জানালেন— আজ শেষ পর্যন্ত তোমাদের কাছে বিদায় নেওয়ার সময় এসেছে। কৃতজ্ঞতায় ভরা আমার এই হৃদয়খানি তোমাদের দেশে রেখে গেলাম।… আমার জীবনের মহৎ সৌভাগ্য আজ তোমাদের কাছে এলাম। জয় হোক ইরানের। (Rabindranath Tagore)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি সৌজন্য- আন্তর্জাল
পেশায় শিক্ষক দিলীপকুমার ঘোষের জন্ম হাওড়ার ডোমজুড় ব্লকের দফরপুর গ্রামে। নরসিংহ দত্ত কলেজের স্নাতক, রবীন্দ্রভারতী থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। নেশা ক্রিকেট, সিনেমা, ক্যুইজ, রাজনীতি। নিমগ্ন পাঠক, সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত সৈনিক। কয়েকটি ছোটবড় পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে অণুগল্প, ছোটগল্প এবং রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে 'সুখপাঠ' এবং 'উদ্ভাস' পত্রিকায় রম্যরচনা এবং দ্বিভাষীয় আন্তর্জালিক 'থার্ড লেন'-এ ছোটগল্প প্রকাশ পেয়েছে।