(Sisir Kumar Das)
সাহিত্যে তিনি যেন কেমন দূরের প্রতিবেশী। দূরে থেকেও কাছের মনে হওয়ার দক্ষতা সহজলভ্য নয় একেবারেই। কিছু মানুষ সেই ক্ষমতার অধিকারী অনায়াসেই। কখনও মনে হতে পারে, এ বুঝি সহজাত প্রতিভাসুলভ কিছু! কিন্তু বিষয় তা নয় আদৌ। (Sisir Kumar Das)

এমন একটি বই লেখা হল, যার পাতা উলটে অংশত মনে হবে কবিতাই। এমনকি কবিতার তিনটি লাইন তথা চরণ দেখতে পাবেন স্পষ্ট; কেবল অনুপস্থিত চার নাম্বার চরণ। বিশ শতকের প্রেক্ষাপটে বাংলায় এমন কবিতা আর দ্বিতীয় লেখা হয়েছিল কী না জানা নেই। তবে এই গ্রন্থ কেবল মানুষটিকে সাহিত্য পরিসরে চিরস্থায়ী করে তোলেনি, বুঝিয়ে দিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে এমন এক ব্রাত্য অথচ দীর্ঘস্থায়ী সাহিত্যিক রয়েছেন। দূরের হয়েও তিনি ঠিক ধ্রুবতারারই মতন। আর সেই তিন চরণের কবিতা বইটির নাম অবলুপ্ত চতুর্থ চরণ। (Sisir Kumar Das)
আরও পড়ুন: ‘রায় বাহাদুর’ মিত্রমশাই
প্রায় সকলেই বুঝতে পেরেছেন, শিশির কুমার দাশের প্রসঙ্গে কথা বলছি। এমন গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, কবি, অনুবাদক, পণ্ডিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যেও বিরল প্রতিভা। ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস লেখা সহজ ছিল না, আর সেই অতি দুরূহ কাজটি যেন অনায়াসেই করেছিলেন শিশির কুমার। তিন খণ্ডে প্রকাশ পেয়েছিল A History of Indian Literature. এই বইয়ে বিস্তারিতভাবে ধরা হয়েছে ৮০০–১৩৯৯, ১৮০০–১৯১০, ১৯১১–১৯৫৬ পর্যন্ত সময়পর্বকে। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি লেখার সম্পাদনাতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন শিশির কুমার, অথচ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পাননি। তৎকালীন সময়ে এমন সুপণ্ডিত ব্রাত্যজনের কথা খুব একটা আলোচিত নয়। (Sisir Kumar Das)

ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন শিশির কুমার দাশ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে। বাবা মুকুন্দ চন্দ্র দাশ, মা সরলা দেবী। শৈশবজীবন কলকাতাতেই কেটেছিল তাঁর। সময়টা ১৯৫১, ভারত সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে। সাউথ সাবার্বান স্কুল (মেন) থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন তিনি। এরপর নিজের ইচ্ছেতেই তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাম্মানিক স্নাতক হন। ঠিক এর একবছর পরেই প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতার বই জন্মলগ্ন। ১৯৫৭-তে সেই সময়ে রেকর্ড নাম্বার নিয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন স্নাতকোত্তর। তাঁর শিক্ষকরা সেই দিনই বুঝেছিলেন, ছেলেটি এক বিস্ময়বালক। যতদূর জানা যায়, শিশির কুমারের এই নাম্বারের রেকর্ড এখনও পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রয়েছে! ১৯৬৩, একসঙ্গে যুগপৎ ডক্টরল ডিগ্রি শিশির কুমারকে বিশেষভাবে সম্মানিত করে। একটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের, অন্যটি লন্ডনের। অবশ্য ১৯৬০–৬৩ পর্যন্ত সময়পর্বটি তাঁর কেটেছে লন্ডনের ‘স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এ শিক্ষকতা করার সূত্রে। (Sisir Kumar Das)
এই ১৯৬৩-তেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মডার্ন ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেরি স্টাডি’ বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন শিশির কুমার। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত এখানেই অধ্যাপনা করে গেছেন বরাবরের প্রচারবিমুখ মানুষটি। ১৯৮০–২০০১, এই সময়পর্ব তাঁর জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। এই সময়ে তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপকের পদটি অর্জন করেছিলেন! ভারতীয় তুলনামূলক সাহিত্য সংস্থার (CLAI) সভাপতিও ছিলেন ওই সময়পর্বেই। শিশির কুমার নিজে প্রায় মাতৃভাষার মতো জানতেন গ্রিক ভাষা। বেশকিছু গ্রিক নাটক অনুবাদ করার পাশাপাশি তাঁর অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ, অ্যারিস্টটলের Poetics বইটির বাংলা অনুবাদ, মূল গ্রিক থেকে। একদিকে ভাষাতত্ত্ব, অন্যদিকে নিজের সাহিত্য-ভাবনা, এই দুইয়ে মিলিয়ে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক করার কাজটি সকলের আড়ালে পরম যত্নে করে গেছেন শিশির কুমার। সংসদ বাংলা সাহিত্য সঙ্গী-র মতন কাজ কেবল বাংলা কেন, সমগ্র ভারত বা বিশ্বেও খুব বেশি হয়নি। (Sisir Kumar Das)

ধরুন পৃথিবীর দুই শ্রেষ্ঠ চিন্তক মুখোমুখি। একজন খ্রিস্টের জন্মের প্রায় সমসাময়িক আর অন্যজন একেবারে হালফিলের। বাস্তবে এমন অসম্ভব। যেমন রবীন্দ্রনাথ আর অ্যারিস্টটল, তাঁরা কি কোনওদিন মুখোমুখি হতে পারেন? কিন্তু যিনি স্রষ্টা এবং মৌলিক ভাবনার অধিকারী, তিনি এমনকিছু অসাধ্য সাধন করতেই পারেন তাঁর লেখনীতে! কালিদাস, অ্যারিস্টটল, পরশুরাম একই সময়পর্বে একটি ডাইমেনশনে উপস্থিত থাকলে কী বলতেন? কেমন হত তাঁদের কথোপকথন? বিষয়টি যতটা আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে লেখা কিন্তু ততটাই কঠিন, আর এই আপাত অসাধ্য সাধন করেছিলেন শিশির কুমার দাশ। সৃষ্টি হয়েছিল এক অবিশ্বাস্য কথোপকথন, অলৌকিক সংলাপ। বাংলা ভাষায় এমন বই আর দ্বিতীয় একটি হয়নি। অথচ এই বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বকে কতটা মনে রাখতে পেরেছি আমরা? Comparative Literature Association of India-র (CLAI) উদ্যোগে প্রতি দু-বছরে একবার করে আয়োজিত হয় শিশির কুমার দাশ-এর উপর স্মারক বক্তৃতা। কেবল এটুকুই, এর বাইরে তিনি যে আপাত ব্রাত্য, বলা যায় স্বেচ্ছা নির্বাসিত! (Sisir Kumar Das)
নিজের জীবনে সাহিত্যকর্ম ও কীর্তির জন্য বহু সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন শিশির কুমার, সেই প্রসঙ্গে বলতেই হয় কিছু কথা। ১৯৭০-এ তিনি পান পশ্চিম জার্মানির নেহরু পুরস্কার, এর বছরচারেক বাদে ফিলিপিনসের জাতীয় ভাষার পুরস্কার। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল রবীন্দ্র পুরস্কারে, The Shadow of the Cross-Christianity and Hinduism in Colonial Situation এবং The Artist in Chains গ্রন্থের জন্য। (Sisir Kumar Das)

এছাড়া করুণাময়ী স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুধাময়ী স্মৃতি পদক, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রদত্ত রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্যের মতন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন শিশির কুমার দাশ। ভাষা জিজ্ঞাসা, ভারত সাহিত্যকথা, মধুসূদনের কবিমানস, তারায় তারায়-এর মতন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ গ্রন্থের জন্ম দিয়েছে তাঁর কলম। ইংরেজিতে তাঁর লেখা The Mad Lover অগণিত পাঠককে গভীর বিশ্লেষণের ভিতর নিয়ে যায়। কেউ কেউ হয়তো তাঁকে চেনেন পরীক্ষিত সেন নামে, শিশির কুমার দাশের ছদ্মনাম; তবে সমস্ত কিছুর ভিতরেও তিনি যেন সামান্য ফিকে। যে ৭ মে তিনি চলে গিয়েছিলেন, সেই মানুষটি কি তবে ব্রাত্যজনের সখা হয়েই থেকে যাবেন আজও এই প্রচারসর্বস্ব সাহিত্য জগতে? উত্তরটা বরং সময়ের হাতেই তোলা থাক। (Sisir Kumar Das)
তথ্যসূত্র:
১/ অবলুপ্ত চতুর্থ চরণ
২/ অলৌকিক সংলাপ
৩/ গহন শিশির কুমার দাশ সংখ্যা
৪/ গুগল
বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।