(Clay Dolls)
শ্রাবণের মেঘলা অপরাহ্নে পালপাড়ায় রঙ ও অলংকারণহীন বিশালাকায় দুর্গা মূর্তির পায়ের সামনে কাপড় পেতে রাখা রয়েছে, রঙিন দুই খোল ছাঁচের মাটির পুতুল। আর সেই পুতুলকে নিজের করে ঝুলন সাজানোর জন্য ভিড় জমিয়েছে কিশোর কিশোরীদের দল। প্রতি বছর ঝুলন পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে এমনই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় পূর্ব বর্ধমানের জাহান্নগর পালপাড়ায়। ভাণ্ডারটিকুরি রেল স্টেশনের কাছেই অবস্থিত এই পালপাড়া। বাংলার মাটির পুতুলের কথা উঠলেই কৃষ্ণনগরের নাম সবার আগে আসে। কিন্তু আজও এই পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক অঞ্চল রয়েছে যেখানকার মাটির পুতুলের লালিত্য শিশু ও কিশোর কিশোরীদের মনকে আকর্ষণ করতে থাকে। এদের মধ্যে অন্যতম হল জাহান্নগর পালপাড়া। (Clay Dolls)\
‘আরও পড়ুন: বাংলার পুতুলের শ্রমজীবী ধারা
মাটির শরীরের মধ্যে তুলির টানে লালিত্যকে গড়ে তোলেন এখানকার শিল্পীরা। সরল অথচ কাব্যিক ভঙ্গিমায় বাঙালিয়ানার ছোঁয়া পাওয়া যায় এখানকার পুতুলের মধ্যে। মূলত ঝুলন যাত্রা উপলক্ষ্যে এখানকার শিল্পীরা মাটির পুতুল তৈরি করে থাকেন। কাঁচা এবং পোড়ামাটির দুই ধরনের পুতুলেরই দেখা এখানে মেলে। রথযাত্রার সময় থেকেই পুতুল তৈরির কাজ শুরু হয়। মূলত গৃহবধূরা এই পুতুল নির্মাণ করে থাকেন। নারী জীবনের কথা পুতুল নির্মাণে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। নারীকে রানীর মতো করে পুতুল নির্মাণে তুলে ধরা হয়েছে। কলসী কাখে রমণী, বালতি দিয়ে টিউবওয়েল থেকে জল তোলা গৃহবধূ, ঘোমটাহীন সধবা বধূ, ফ্রক পরা কন্যা পুতুলের চরিত্র হয়ে শিশু মনকে আকৃষ্ট করেছে। এই সকল পুতুলের শাড়ির মধ্যে সোনালী রঙের রেখাপাত করা হয়েছে। (Clay Dolls)

এমনকি গলার মালা ও হাতের চুড়িগুলিকেও সোনালী রঙে রাঙিয়ে তোলা হয়েছে। শাড়ি ছাড়াও উত্তর ভারতীয় শৈলীর ঘাগড়া চলি পুতুলের বস্ত্র সজ্জায় পরিণতি পেয়েছে। পুতুলের মুখের অভিব্যক্তিতে শান্ত ভাব লক্ষণীয়। গায়ের রঙ উজ্জ্বল বর্ণ। মাথা উঁচু করে এই সকল পুতুলগুলো তাকিয়ে রয়েছে। পুতুলের কেশবিন্যাসকে শিল্পীরা গুরুত্ব সহকারে প্রস্ফুটিত করেছে। এখানকার প্রবীণ শিল্পী কাজল পালের তৈরি একটি বউ পুতুল ফেলে আসা অতীতকে মনে করিয়ে দেয়। লাল রং-এর এক প্যাচ দেওয়া শাড়ি পরিহিতা বউ পুতুলের মধ্যে গত শতাব্দীর শুরুর দিকের সময়ের ইঙ্গিত বহন করে চলে। মাথার ঘোমটা থেকে খোলা চুল বেরিয়ে এসেছে। উন্নত ললাট। কপালে লাল টিপ। ডান হাতে পলা। বাম হাত কলসী আগলে রাখার ভঙ্গিমায়। মুখে অস্ফুট হাসি। শিল্পীর সরল তুলির টানে লোকজ ভাব পুতুলের শরীরে স্পষ্ট হয়েছে। (Clay Dolls)
“কৃষক পুতুলের স্থূল শরীর। মুখে কৌতুক উদ্দীপক হাসি। মাথায় গোলাকার টুপি, কাঁধে গামছা আর শরীরে থাকা খাটো ধুতি। ঠিক একই অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায় সবজি বিক্রেতা পুতুলের মধ্যে।”
সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে কৃষক, সবজি বিক্রেতা, পুলিশ, নৌকো ও তার মাঝি, ব্যান্ড পার্টি বা বাদনদার, ঘোড়া পিঠে বসা যোদ্ধা, মিলিটারি, শবদেহবহনকারী ডোম পুতুলের দেখা এখানে মেলে। বাস্তব জীবনের ঘাম রক্ত পরিশ্রমের বদলে এখানকার সমাজধর্মী পুতুলের মধ্যে শিশুসুলভ কোমলতা ও কৌতুক অভিব্যক্তি ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়। এখানকার তৈরি কৃষক পুতুলের স্থূল শরীর। মুখে কৌতুক উদ্দীপক হাসি। মাথায় গোলাকার টুপি, কাঁধে গামছা আর শরীরে থাকা খাটো ধুতি। ঠিক একই অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায় সবজি বিক্রেতা পুতুলের মধ্যে। শুধু তার মাথায় কোনও টুপি নেই সেখানে রয়েছে বড় একটি সবজি। নৌকা ও মাঝি পুতুলের পুরোটাই মাটি দিয়ে তৈরি করা। (Clay Dolls)

পল্লী বাংলার নদীতে ভেসে চলা খড়ের আচ্ছাদন দেওয়া নৌকার অনুরূপ তৈরি করা হয়েছে এই পুতুল। মাঝি দাড় টানার ভঙ্গিমায় পাটাতনের ওপর বসে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য মৃৎশিল্পীরা পুলিশ পুতুল নির্মাণের ক্ষেত্রে সাদা ও খাকি রংয়ের ব্যবহার বেশি করে থাকেন। কিন্তু এখানকার নির্মিত পুলিশ পুতুল তার ব্যতিক্রম। রঙিন ফুলহাতা গোল গোলার জামা ও ফুল প্যান্ট। জামার রং কখনও কমলা, কখনও লাল। কপালে টিকা। মাথায় রঙিন গোলাকার টুপি। স্থূল শরীর নিয়ে স্যালুট করার ভঙ্গিমায় সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একইভাবে ব্যান্ড পার্টি বা বাদনদার পুতুলের মধ্যেও স্বতন্ত্র শৈলী বজায় রেখেছেন এখানকার শিল্পীরা। রঙিন গোল গলা পাঞ্জাবি কোমর ছাড়িয়ে গিয়েছে। সেই পাঞ্জাবির ওপর হালকা তুলির টান। মাথায় গোলাকার টুপি। কপালে টিকা। মুখের অভিব্যক্তিতে শান্ত ভাব এখানকার বাদনদার পুতুলকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। (Clay Dolls)

সবুজ উর্দি পরা মিলিটারি পুতুলের দুটি রূপ দেখা যায়। প্রথমটি বুকে ভর দিয়ে এগিয়ে চলা আর দ্বিতীয়টি হাঁটু মুড়ে মাটির কালো রঙের কামানের উপর বসে থাকার অভিব্যক্তি। ঘোড়ার পিঠে বসা যোদ্ধা পুতুল বাংলার সনাতনী ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দিয়ে যায়। মাথায় পাগড়ি। মাথার পেছনদিকে পাগড়ির কাপড় নেমে গিয়েছে। লাল রংয়ের ফতুয়ার মধ্যে থাকা কোমরবন্ধ যোদ্ধাশুলভ অভিব্যক্তিকে স্পষ্ট করে তুলেছে। কপালে লম্বা করে লাল টিকা ও মুখের ভাবনায় গভীর চিন্তার ছোঁয়া যোদ্ধা পুতুলকে অনন্য করে তুলেছে। (Clay Dolls)
“মাটির পুতুল শৈলীর মধ্যে গডজিলা, গরু, হাতি, বাঘ, হনুমান, খরগোশ, টিয়া পাখি, ঘোড়া পুতুলের দেখা পাওয়া যায়।”
এখানকার অন্যান্য পুতুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বর বউ পুতুল। নববধূকে এখানে মা লক্ষ্মীর প্রতিচ্ছবি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তাই বউ পুতুলের মাথায় সোনালি রঙের মুকুট। বসার ভঙ্গিমায় দেবী সুলভ অভিব্যক্তি। হাতের মুদ্রায়, ধ্যানস্থ ভাব। মুকুটের তলায় কেশরাজি নববধূর পিঠ পর্যন্ত স্পর্শ করেছে। চোখের দৃষ্টিতে লজ্জাহীন শান্ত ভাব। অন্যদিকে বর পুতুলের অভিব্যক্তি বাঙালি যুবকের আনন্দময়তাকে তুলে ধরেছে। এর পাশাপাশি বিশেষ উল্লেখযোগ্য পুতুলগুলি হল মীরাবাঈ, বাউল, ঘাড় নাড়া বুড়ো দাদু, নগর কীর্তনে বেরোনো বৈষ্ণব গোঁসাই, ফুটবল খেলোয়াড়। এখানকার পুতুলের সর্বোচ্চ উচ্চতা সাত ইঞ্চি। সর্বনিম্ন উচ্চতা সাড়ে চার ইঞ্চি। জাহান্নগর পালপাড়ার উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন সতী রানী পাল, কাজল পাল, কৃষ্ণা পাল এবং গৌতম পাল। শিল্পী সতী রানী পাল জানিয়েছেন যে প্রায় ২৪ বছর ধরে মাটির পুতুল তিনি তৈরি করে চলেছেন। (Clay Dolls)

প্রতি বছর ঝুলন উপলক্ষ্যে প্রায় ২৫ রকমের মাটির পুতুল তৈরি করে থাকেন তিনি। কাঠামোর প্রতিমা নির্মাণের পাশাপাশি পোড়ামাটির হাড়ি কলসি ও অন্যান্য মৃৎপাত্র তৈরি করে থাকেন। (Clay Dolls)

গডজিলার মুখের ভেতর গোলাকার হলুদ রঙের একটি পিণ্ড রয়েছে। যেটি আগুনের হল্কার প্রতীক হিসেবে শিল্পী তুলে ধরেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় শিশুদের জন্য ঘোড়া পুতুলের পাশাপাশি ছলন বা মানত-এ দেওয়ার ঘোড়া তৈরি হয়। পুতুলের পাশাপাশি ছাঁচের দেব প্রতিমার মধ্যে রাধা কৃষ্ণ এবং গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ প্রভুর প্রতিমা শিল্পীরা নির্মাণ করে থাকেন। (Clay Dolls)
আরও পড়ুন: পুতুল খেলার সেকাল একাল
নগরোন্নয়নের ফলে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালির এই হস্তশিল্পের অন্যতম প্রতীক অর্থাৎ মাটির পুতুলের শৈলী ক্রমাগত ক্ষয়ে চলেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে জাহান্নগরের মাটির পুতুল শৈলীর ধারা মাথা উঁচু করে টিকে রয়েছে। (Clay Dolls)
ছবি সৌজন্য- লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
পেশায় সাংবাদিক। কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়ের থেকে সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপনে স্নাতকোত্তর। বাংলার পুতুল শিল্পকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। লেখকের, ‘আমাদের কথা’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। সেখানে বাংলার বিভিন্ন জেলার মাটির পুতুল নিয়ে ১৫০ টি পর্বে ভিডিও করেছেন তিনি। শিল্পীদের ঘরে গিয়ে শুনেছেন তাঁদের মনের কথা। এছাড়া শিবের মুখোশ, চালচিত্র, লক্ষ্মী সরা, মনসা ঘট, মনসা চালি, ছলনের ঘোড়া নিয়েও তিনি পর্ব তৈরি করেছেন তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে। লেখক নিজে পুতুল সংগ্রাহক। এই লেখায় ব্যবহৃত ছবিগুলো লেখকের নিজের সংগ্রহে থাকা পুতুলের।