(Article)
(Article) চোখে স্বপ্ন ছিল অনেক। পড়াশোনা করে চাকরি করতে চেয়েছিলেন। মাধ্যমিকের পরে নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে কাজও শুরু করেছিলেন বারুইপুরে। বাবা, বাপি দাস, পেশায় বারুইপুর কল্যাণপুর জোড়া মন্দির শ্মশানের ডোম, হঠাৎ কাজ থেকে বাড়ি ফিরে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। অতএব ছন্দপতন। পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বাড়িতে অসুস্থ মা। ১৫ বছরের বোন। ১০ বছরের ভাই। কীভাবে চলবে সংসার? বাড়ির বড় মেয়ে সমাজের অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের ইচ্ছায় এই কাজ বেছে নিয়েছিলেন। পেশায় ডোম। মহিলা ডোম! সেই থেকে এক অদম্য জীবনসংগ্রাম শুরু। (এই বিষয়ে বলে রাখা দরকার, ২০২৩ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী শ্মশানে মৃতদেহ সৎকারে যাঁরা সাহায্য করেন, তাঁদের আর ডোম বলে ডাকা হয় না। সরকারি খাতায় ডোমেদের এখন থেকে পরিচয় ‘সৎকারকর্মী’ হিসাবে। ওই নামেই তাঁদের উল্লেখ করা হয় সর্বত্র।)
(Article)

বলাই বাহুল্য, শ্মশানের পারিপার্শ্বিক দৃশ্য আদপেই মধুর হয় না। বরং, তা রীতিমতো ভয়াবহ। একের পর এক দাহের অপেক্ষায় থাকা দেহ, মৃতের পরিজনের কান্না, শোকাতুর মুখ, ডোম আর শ্মশান-পুরোহিতের দেহ সৎকারের নির্লিপ্তি- চোখের সামনে দেখা খুব একটা সহজ নয়। বিশেষ করে যাঁর প্রিয়জন দেহত্যাগ করেছেন, তাঁর পক্ষে তো বটেই! আসলে, সবাই ধরে নেন, মহিলা মাত্রেই কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী। শ্মশানের ভয়াবহতা দেখে যদি সংবেনশীল মনে আঘাত লাগে, যদি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। শ্মশানে যেতেই যেখানে ভয়ে অনেকে শিউরে ওঠেন। সেখানে মৃতদের নাম নথিভুক্ত করা থেকে শুরু করে দেহ সৎকার, চুল্লির কাজ সবই একা হাতেই সামলান এই তরুণী। তাঁর নাম টুম্পা দাস। বয়স ২৯। শ্মশানের পাশেই তাঁর বাড়ি। (Article)

গত দশ বছর ধরে বারুইপুরের পঞ্চায়েত এলাকা পুরন্দরপুর মহাশ্মশানের দায়িত্ব সামলে আসছেন।
জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। কাজের এই বিশাল বহরে না তো মেয়েদের ব্যাপক পরিমাণে চণ্ডীপাঠ করতে দেখা যায়, না জুতো সেলাই করতে। মাংস কাটার দোকানে হোক বা শ্মশানে কাজে সমান অংশগ্রহণ অলীক ভাবনামাত্র। তবে ব্যাতিক্রম মাঝে মাঝে নিয়মের অস্তিত্ব স্বীকার করে। যেমন বারুইপুরের টুম্পা। এই শ্মশানে টুম্পাই একমাত্র শ্মশানকর্মী। তাই চুল্লির তালা খোলা থেকে শবদেহের স্ট্যান্ড তোলা, চুল্লির ঢাকনা খোলা থেকে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার পরে পরিবারকে দেহাংশ দান। সবটাই একা হাতে করেন এই সাহসিনী। শ্মশানের ডোম বলতেই চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে ভয়ানক কোনও চেহারা। রগচটা মেজাজ। টুম্পার ক্ষেত্রে এসব একদমই খাটে না। মৃদু গলার স্বর। ভীরু চাউনি। মুখে হাসি। তাঁকে দেখে কস্মিনকালেও কেউ ভাববে না, তরুণী মেয়েটি শ্মশানে ডোমের কাজ করেন। (Article)





“২০১৫ সাল থেকে শ্মশানে কাঠের চিতার সমস্ত দায়িত্ব সামলেছেন৷ এক হাতে গ্লাভস আর অন্য হাতে কাঠ নিয়ে কাজে নেমে পড়তে হত, প্রথম প্রথম ভয় লাগত। দাহ কার্যের পুরোটাই সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। কটু গন্ধের ধোঁয়ায় শ্বাস নেওয়া দায়।” হাল ছাড়েনি টুম্পা। পিছিয়ে আসেনি। এরপর ২০১৯ সালে এই শ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লি বসে। কিছুটা উন্নত হয় কাজের পরিবেশ। টুম্পার কথায়, “মৃতদেহ শ্মশানে এলে নাম নথিভুক্ত করার কাজ শুরু হয়। তারপর লাশ চুল্লিতে ঢোকানো থেকে শুরু করে মেশিন চালানো, হাড়গোড় বের করে আনা সবই আমাকে করতে হয়। সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত একটানা ডিউটি। বিশ্রাম নেই।” গত ১০ বছরে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি মৃতদেহ সৎকার করেছেন তিনি। তাঁর দাবি, ভালবেসে ফেলেছেন এই কাজকে। তাই, শ্মশানই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। (Article)
টুম্পা বলেন, “শুরুতে ভয় পেয়েছিলাম। সারাদিন ধরে একের পর এক মৃতদেহ চুল্লিতে ঢোকানো দেখে। শ্মশানযাত্রীদের ভালবাসা এবং কাজের তাগিদ আমার মনকে শক্ত করেছে। পরিবারের পেটে খাবারের ব্যবস্থা করাই এই কাজের প্রতি আমার টান।” টুম্পা বলেন, “আমি কল্যাণপুর পঞ্চায়েত থেকে মাসিক ৫০০০ টাকা বেতন পাই। আজকের দিনে ৩ জনের সংসার এই টাকায় চালানো কঠিন।” শ্মশানে আসা স্বজনহারা মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন নিজের দুঃখগুলো ভুলতে চেষ্টা করেন।
শ্মশানে ডোমের দায়িত্বে বরাবরই থাকে ছেলেরা একজন মেয়ে হয়ে টুম্পা কেন এই পেশায়? টুম্পার উত্তর, “এখন ছেলে-মেয়ে বলতে আলাদা করে কিছু নেই। সবাই সমান।” (Article)





২
এই শ্মশানে একা থাকতে ভয় হয় না? “মরা মানুষের থেকে জীবিত মানুষে ভয় বেশি। প্রথম প্রথম একটু ভয় লাগত। তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। শ্মশানেই মানুষের সব শেষ। যত দম্ভ, টাকা পয়সা, এমনকি গায়ের কাপড়টুকু পর্যন্ত মানুষ চিতায় নিয়ে যেতে পারে না। তাই বাইরের জগতের থেকে এখানেই আমি অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকি।”
বিয়ে, সংসার প্রশ্ন শেষ করার আগেই, “টুম্পা জানান, এই কাজ করি শুনে অধিকাংশ মানুষ পিছিয়ে যান, এই কাজ আমি ছাড়ব না। আর এখন ইচ্ছেও নেই।” (Article)
‘বল হরি, হরি বল’। খই ছিটাতে ছিটাতে এগিয়ে আসে মৃতদেহ। মৃতদেহের কাগজপত্র তৈরি করতে টুম্পা জায়গা ছেড়ে উঠে তৈরি হতে থাকেন। মুখে মাস্ক বাঁধেন। দু’হাতে গলিয়ে নেন গ্লাভস। চুল্লি রেডি করেন। পুরোহিতের কাজ শেষ হলে। তারপর চুল্লির মধ্যে ঢুকিয়ে দেন মৃতদেহ। এরপর ৪৫মিনিট ব্যস্ততা থাকে না টুম্পার। বাকি কাজ আগুনের। এরকমভাবেই আগুনে আস্তে আস্তে পুড়ে শেষ হয় মানব শরীর। যেখানে সব কিছুর শেষ সেখান থেকেই বেঁচে থাকার রশদ জোগাড়ের জন্য জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন মহিলা “সৎকারকর্মী ”(ডোম) টুম্পা দাস। (Article)
৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসের দিনে টুম্পা সমাজকে একটা বার্তা দিলেন, জীবনে কোনও কাজই ছোট নয়, লড়াই কখনও থেমে যায় না, জীবনযুদ্ধে তাঁকে লড়াই করে জিততে হবে, সেই সাহস নিয়ে হাসি মুখে জিতে গিয়েছেন টুম্পা। টুম্পা যে কাজ করে চলেছেন আমরা তাঁকে কুর্নিশ জানাই। (Article)
নেশা ও পেশা ফটোগ্রাফি। ডকুমেন্টারি স্টোরি টেলিং, স্ট্রিট ও ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফিতে আগ্রহী।
One Response
ভালো লেখা