(Rabindranath Tagore)
ভূমিকা
কৈশোরের এক রেডিও অনুষ্ঠানে ঘোষক বললেন, “এবারের শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।” তখন “রবীন্দ্রনাথ” মানে নোবেল প্রাইজ পাওয়া, সুদর্শন, ঋষিতুল্য এক মহাপুরুষ। যাঁর ছবি বসার ঘরের দেওয়ালে শোভা পায়। বসার ঘরের কাচের শো’কেসে তাঁর মাটির মূর্তি, কৃষ্ণনগরের শিল্পীর কাজ। তাঁর লেখা কিছু বই শোভা পায় আলমারিতে। মায়ের হারমোনিয়ামের ওপরে কয়েক-খণ্ড গীতবিতান। রেডিওতে ভেসে এল, হেমন্তর অপার্থিব কণ্ঠে, “দিনের শেষে ঘুমের দেশে”। মানে কিছু বুঝিনি, কিন্তু সেই কণ্ঠ আর গানের রেশে স্তব্ধ হয়ে গেল চরাচর। সেই বোঝা না বোঝার ঊষালগ্নে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাল লেগে গেল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ ভাল লেগে গেল। এই ভাল লাগা কোনও আরোপিত বিষয় নয়। ওই বিজ্ঞাপনের কথার মতো, “এমনি এমনি”। জানি না, ওই গান সেদিন অন্য কারও কণ্ঠে শুনলে ইনস্ট্যান্ট ভাল লাগার ব্যাপারটা হয়ে উঠত কী না। (Rabindranath Tagore)
রেডিওতে ভেসে এল, হেমন্তর অপার্থিব কণ্ঠে, “দিনের শেষে ঘুমের দেশে”। মানে কিছু বুঝিনি, কিন্তু সেই কণ্ঠ আর গানের রেশে স্তব্ধ হয়ে গেল চরাচর।
সময়ের শতাব্দী পার করে, আজও বাঙালি মননে এবং চেতনায়, রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি দেখা যায়। ইদানিংকালে তথ্যপ্রযুক্তি, তাঁর ব্যাপ্তি এবং জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বসন্তউৎসবের দিনে কিংবা পঁচিশে বৈশাখে, ভোরবেলা থেকে, সাইড টেবিলে রাখা এন্ড্রয়েডে/অ্যাপলে টোকা দিয়ে মেসেজের প্রবাহ শুরু হয়। নানান লেখা, তথ্য, কবিতার কোটেশন ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুল, পাখি, সূর্য বা সমুদ্রের ছবি। অডিও ফাইল আসে দু’কলি গান বা একপ্যারা কবিতাপাঠ নিয়ে। অপরিমেয় কন্টেন্টে “www” ভরে ওঠে। টেকনোলজি সবাইকে শিল্পী করে দিয়েছে। প্রত্যেকে রবীন্দ্রনাথকে “share” করতে চায়। ফোনের মেমোরি থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডিলিট করতে হয় ফাইলস। (Rabindranath Tagore)
বসন্তউৎসবের দিনে কিংবা পঁচিশে বৈশাখে, ভোরবেলা থেকে, সাইড টেবিলে রাখা এন্ড্রয়েডে/অ্যাপলে টোকা দিয়ে মেসেজের প্রবাহ শুরু হয়।
পৃথিবীতে “দাগ” রেখে যাওয়া অতীব দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে প্রধানত দুটো কারণে। প্রথম কারণ অবশ্যই কিছু কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসাধারণ জনপ্রিয়তা। একশো বছর ধরে বাঙালি তার মনের ভাব রবীন্দ্রনাথের গানে খুঁজে পায়। সমষ্টিগতভাবে বাঙালির রবীন্দ্রনাথকে আজও মনে রাখার অন্য কারণ রবীন্দ্র-পুজো। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির আরাধ্য দেব-দেবীর পুজোর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত পপুলার সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছেন।
বিষয় দুটি নিয়ে ব্যক্তিগত মত এবং কিছু রেফারেন্স দেওয়ার চেষ্টা করা যাক। (Rabindranath Tagore)

রবীন্দ্রসঙ্গীত আজও জনপ্রিয়:
“তোমার গান যে কত শুনিয়েছিলে মোরে
সেই কথাটি তুমি ভুলবে কেমন করে?”
রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা আজ থেকে একশো বছর আগে ছিল না। শান্তিনিকেতনের এলিটিস্ট আবহাওয়ার সে গান জনসাধারনের কাছে পৌঁছতে অসমর্থ হয়। নানারকম নিয়ম কানুনের মধ্যে দিয়ে গানের শুদ্ধ রূপের একটি টেমপ্লেট চালু করার চেষ্টা হয়েছিল।
দেবব্রত বিশ্বাস “ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত(পৃষ্ঠা ৪৩-৪৪)” এ লেখেন: “১৯৩১ সন আরম্ভ করে বেশ কয়েক বৎসর শান্তিনিকেতনে গিয়ে যেসব গান(আধ্যাত্মিক নয়) ওখানকার ছেলে-মেয়েদের মুখে আর গলায় শুনতাম, সেই গানগুলির সুর এবং গাইবার ধরন-ধারণ আমার মনকে একেবারেই আকৃষ্ট করত না। এর কারণ দু’রকমের হতে পারে। এক নম্বর কারণ হতে পারে যে, ওই গান গুলির রস গ্রহণ বা উপভোগ করার ব্যাপারে আমার নিজের অক্ষমতা। কিংবা দু’নম্বর কারণ হতে পারে এই যে, যাঁদের মুখে ও গলায় ওইসব গান শুনতাম, গানের মধ্যে রস সঞ্চারনে তাঁদের অক্ষমতা। আবার এই কথাটিও সত্যি যে তখনকার দিনে সংগীত রসিকরা এবং সাধারণ শ্রোতারাও রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গান এবং ঋতু সংগীত গুলিকে যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন না। এই সব গানগুলির প্রতি তাঁদের রীতিমতো অশ্রদ্ধাই ছিল।” (Rabindranath Tagore)
আরও পড়ুন: নীরবে নিতান্ত অবনত বসন্তের সর্ব-সমর্পণ।
কয়েকজন মানুষ রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বাতন্ত্র বজায় রেখে, পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের কাছে। দেবব্রত বিশ্বাস সে তালিকায় অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি না থাকলে আজকের এই ব্যাপ্তি সম্ভব ছিল না। তাঁর গায়কী, উপলব্ধির উত্তরণ ঘটায় অমৃতলোকে। বলিষ্ঠ কণ্ঠে, বাচনভঙ্গিতে তিনি অনন্য। রবীন্দ্রনাথের বাণী হৃদয়ে স্থান পায়। পিতৃদেবের মুখে শোনা ইউনিভার্সিটি হলে জর্জদার প্রোগ্রামে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। শ্রোতাদের তুরীয় আনন্দ। তিল ধারণের জায়গা নেই। তিনিই একমাত্র রবীন্দ্র সংগীতের “রকস্টার”। অথচ তাঁকে গান করতে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
দেবব্রত বিশ্বাস “ব্রাত্য জনের রুদ্ধ সংগীত” এ লেখেন যে, “আমি আরো জানিয়েছিলাম যে আমার কারবার ওই সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে যারা রবীন্দ্রনাথের ধারও ধারে না– অথচ আমার অজানা কোনো কারণে অসম্ভব রবীন্দ্র সংগীত বিলাসী। তাদের মন ভোলাবার আশায় অর্থাৎ সোজা কথায় তাদের emotion এবং intellectকে গভীর ভাবে নাড়া দেবার চেষ্টায় আমি রবি ঠাকুরের গানগুলির গায়ে নানান রঙ-চং লাগিয়ে পরিবেশন করি (পৃষ্ঠা ১৩৭)।”
পিতৃদেবের মুখে শোনা ইউনিভার্সিটি হলে জর্জদার প্রোগ্রামে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। শ্রোতাদের তুরীয় আনন্দ। তিল ধারণের জায়গা নেই।
গানকে জনপ্রিয় করেন সেযুগের গায়ক যুগল, যাঁকে স্বয়ং দেবব্রত “রবীন্দ্র সংগীতের হিরো আর হিরোইন” বলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সুচিত্রা মিত্র। আছেন পঙ্কজ মল্লিক। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। আছেন কনক দাস। আছেন রাজেশ্বরী দত্ত। আছেন আরও অনেক শিল্পী। যাঁদের গানের মধ্যে দিয়ে আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ভালবেসেছি। (Rabindranath Tagore)
আমরা যাঁরা ষাটের দশকে বা সত্তরের দশকে জন্মেছি, তাঁদের স্মৃতিতে আছে যে মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে বিশেষত মেয়েরা ক্লাস ফাইভ সিক্স থেকে রীতিমতো গানের ক্লাস করত। একদিকে ভাতখণ্ডে বা অন্য কোনও ঘরানায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং প্যারাললি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখা হত। সকালে রেডিওতে খবরের পর আধঘণ্টা রবীন্দ্রনাথের গানের প্রোগ্রাম হত। নামি শিল্পীদের গানে অজান্তে রবীন্দ্রনাথ “institutionalised” হয়ে যেতেন। ছেলেরা গান বা তবলায় বসে যেত। পাড়ায় পাড়ায় গান, কবিতা আবৃত্তির কম্পিটিশন হত। রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত আর নজরুল। বাড়িতে বাবা ক্লাস এইটে পড়ার সময় জীবনানন্দের রূপসী বাংলা কিনে দিয়েছিল। কিন্তু তখন জীবনানন্দ-র কবিতা আমি অন্তত কাউকে কম্পিটিশনে বলতে শুনিনি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করতেন শম্ভু মিত্র। পার্থ ঘোষ। গৌরী ঘোষ। আরও অনেকে। রেডিওতে নৃতনাট্য “চিত্রাঙ্গদা”, “শ্যামা” ইত্যাদি শোনা যেত। তারপর আশির দশকে টিভিতে রবীন্দ্রনাথের গান আর নৃত্যনাট্য দেখা শুরু। বেশ মনে পড়ে কলেজে পড়ার সময় আজকের মহানায়িকা ঋতুপর্ণার “চন্ডালিকা” দেখে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম। (Rabindranath Tagore)
ছেলেরা গান বা তবলায় বসে যেত। পাড়ায় পাড়ায় গান, কবিতা আবৃত্তির কম্পিটিশন হত। রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত আর নজরুল।
ওহ, আর একটা জরুরি প্রসঙ্গ-র উল্লেখ করতেই হবে, আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে রবীন্দ্রনাথের গানের বিস্তার প্রসঙ্গে। তখন বোধহয় ক্লাস নাইনে পড়ি। সম্পর্কিত দিদির বিয়েতে বাসররাত্রিতে দিদি গাইল, “জানি জানি তুমি এসেছ এ পথে মনের ভুলে”। তখন বিয়েতে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার রেওয়াজ ছিল। পিসির কাছে খবর পেলাম যে মা গেয়েছিল, “আমি রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি”। এক বৌদি গেয়েছিল, “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে”। এখন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সবাই জানে যে জীবনানন্দ শুনতে চেয়েছিলেন, “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে”। এসব তাঁর গানের “institutionalisation”. তিনি এক্কেবারে ঘরের মানুষ।
দেবব্রত উল্লিখিত emotion এবং intellect কে নাড়া দেওয়ার এক নিজস্ব অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাক। অনেক অনেক দশক আগে কৈশোরে, শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায়, শোনা গেল শান্তিদেব ঘোষের কণ্ঠে, “ওই আসনতলের মাটির পরে লুটিয়ে রব তোমার চরণধূলায় ধূলায় ধূসর হব।” ওই বয়েসে কোনও ওপিনিয়ন থাকে না। কিন্তু মনে হয়েছিল গানটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন শুধুমাত্র শান্তিদেব গাইবেন বলে। তিনি গেয়ে চলেছেন, খানিকটা যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে। “তোমার চরণধূলায় ধূলায় ধূসর হব”, লাইনটা বেশ কয়েকবার এসেছে গানে। “ধূসর হব” এর উচ্চারণ “ধূসরোও হবোও।” অসম্ভব ক্রন্দনময় আকূতি। প্রার্থনা ঝরে পড়ছে কণ্ঠে। সমর্থারতির আত্মনিবেদন। পূজা, প্রেম, অহং সবকিছুর শেষ ওই আসনতলে। অনুরণনে শ্রোতার মন যেন সেই ধূলায় লুটিয়ে পড়ে। বীরভূমের তান্ত্রিক লালমাটিতে মানুষের মন ক্ষণকালের জন্য হলেও হয়ে ওঠে বৈরাগ্যে গৈরিক। এইভাবেই সকালে রেডিও থেকে সুচিত্রা মিত্রের “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু”, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “দিনান্ত বেলায়”, অন্তরে প্রবেশ করে। (Rabindranath Tagore)
অনেক অনেক দশক আগে কৈশোরে, শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায়, শোনা গেল শান্তিদেব ঘোষের কণ্ঠে, “ওই আসনতলের মাটির পরে লুটিয়ে রব তোমার চরণধূলায় ধূলায় ধূসর হব।”
রবীন্দ্রসঙ্গীত অন্যান্য বাংলা গান থেকে স্বতন্ত্র। নিজস্ব এক বাউন্ডারি আছে। কথা আর সুরের সামঞ্জস্য আছে। শুধু সুরের জ্ঞান থাকলেই এ গান গাওয়া যায় না। অনেক নামী শিল্পী ব্যর্থ হয়েছেন যথার্থভাবে গাইতে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ফান্ডামেন্টাল গুলো না জেনে শুধু সুরে লাগালে গানের স্পিরিটটা ঠিক মতো ধরা পড়ে না। আজকাল নানারকম যন্ত্র সহযোগে এক্সপেরিমেন্ট চলছে। শত কণ্ঠে, সহস্র কণ্ঠে গান হয়ে চলেছে। ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ছে। অডিওর চেয়ে ভিজুয়ালে জোর দেওয়া হচ্ছে। ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি গায়িকার বন্ধ চোখ, খোলা চুলের টাইট ক্লোজ আপ নিচ্ছেন, এক্কেবারে যেন সিনেমার সুফি সাধিকার রোলে।
তবুও কিছু ছেলেমেয়ে দেখি এসরাজ বা খালি গলায় শুদ্ধ উচ্চারণে রেনডিশন করতে পারে, এটাই আশার কথা। (Rabindranath Tagore)

পুজো আর সংস্কৃতি:
“তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি।।”
কৌম চেতনায় পৌত্তলিকতা হাজার বছর ধরে বহমান। অরূপকে ধরা হয় রূপের কাঠামোয়। বাঙ্ময় মূর্তিতে। পাথরের টুকরো হয়ে ওঠে দেবতা। হয়তো আজ বাংলাদেশে যে বিদ্বেষ দেখা যাচ্ছে সেটা ওই পুজোর বিরুদ্ধে। আব্রাহামিক ভাবনায় এক ঈশ্বর। রবীন্দ্রনাথের গানে পুজো আর প্রেম এক হয়ে যায় অন্য কোনও ঈশ্বর চেতনায়।
রবীন্দ্রনাথকে শ্রীচৈতন্য বা নানকদেবের মতো ধর্ম প্রবর্তক নিশ্চই বলা যায় না। তবুও, ছোটবেলার স্মৃতিতে দেখি দিদার ঠাকুরঘরে অনেক দেব, দেবীর পাশে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি। কৃষ্ণনগরের মাটির শিল্পীর হাতে গড়া। রীতিমতো সামনে ছোট্ট থালায় ফুল বাতাসা দিয়ে অন্য সব ঠাকুরের মতোই পুজো করছেন দিদা। প্রশ্ন করলে বলেন, “উনি ঈশ্বর সমতুল”। সেখানে কোনও দ্বিধা নেই। (Rabindranath Tagore)
নমস্কার করে খুলে দেখালেন একগুচ্ছ চুল যা সংগ্রহ করা হয় কবির মরদেহের শরীর থেকে।
রবীন্দ্রপুজোর আরেক উদাহরণ মনে পড়ে। বন্ধুর ঠাকুমা কথাপ্রসঙ্গে গর্বের সাথে ব্যক্ত করলেন স্বামীর মহান কীর্তির কথা। পুজোর আসনে রুপোর কৌটো। নমস্কার করে খুলে দেখালেন একগুচ্ছ চুল যা সংগ্রহ করা হয় কবির মরদেহের শরীর থেকে। এইভাবেই বহুযুগ আগে মহানাস্তিক বুদ্ধের নখের ওপর, চুলের ওপর স্তূপ নির্মাণ করে পৌত্তলিক পুজোর আবেগে।
পৌত্তলিক অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখা যায় পুজোর ঘরে। যেমন আছেন পাঁচশো বছর আগের শ্রীচৈতন্য। ন্যায় শাস্ত্রের মহা তার্কিক, পরবর্তীকালে ভক্তিবাদের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র আজ অবতার রূপে পূজিত হন। আছেন রামকৃষ্ণদেব। এক কাকিমার ঠাকুরঘরে সামরিক বেশে নেতাজির ছবি দেখি। অবিশ্বাস্য শোনালেও এক ঠাকুর ঘরে জ্যোতিবাবুর ছবি দেখেছিলাম। সামনে ফুল, বেলপাতা, নকুল দানা। (Rabindranath Tagore)
যেমন বছরে একবার আসেন মা দুগ্গা, মা সরস্বতী, তেমনই আসেন রবি ঠাকুর, বছরে দু’বার– পঁচিশে বৈশাখে আর বসন্ত উৎসবে। শান্তিনিকেতনের, জোড়াসাঁকোর সীমানা ছাড়িয়ে, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি হয়ে ব্যাঙ্গালুরু, মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, ঢাকা হয়ে বিলেত, আমেরিকায় যেখানে দুই বাংলার লোকেরা থাকে– সেখানেই হয়ে চলে গান আর নাচ: “ওরে গৃহবাসী।” রঙিন ধুতি পাঞ্জাবি– ছেলেদের, বাটিকের শাড়ি, জুটের গয়না, বড় টিপ, ইস্তিরি করা খোলাচুল– মেয়েদের। বাঙালির সংস্কৃতি বয়ে চলে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে। এখানে পুজো আর সংস্কৃতি অনন্যভাবে যুক্ত। বাঙালির নিজস্ব, যা অন্যদের বোঝা একটু কঠিন। বোঝানোর চেষ্টা করা অর্থহীন। (Rabindranath Tagore)
রবীন্দ্রনাথের লেখার ব্যাপ্তি মহাসাগরের মতো বিশাল ক্ষেত্র জুড়ে। আবার গভীরতা হিমালয় পর্বতের মতো অতীব উচ্চ।
রবীন্দ্রনাথের লেখার ব্যাপ্তি মহাসাগরের মতো বিশাল ক্ষেত্র জুড়ে। আবার গভীরতা হিমালয় পর্বতের মতো অতীব উচ্চ। এই গভীরে অবগাহন করেছেন মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধির অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। ইতিহাসে এরকম অনেকেই ছিলেন যাঁরা নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু একমাত্র রবীন্দ্রনাথ পুজোর জায়গায় অবস্থান করছেন। খানিকটা ঈশ্বরের মতো, অথবা ধর্ম প্রবর্তকদের মতো।

পঁচিশে বৈশাখ বা বসন্ত উৎসবে পুজো হয়ে চলে সর্বত্র। আর সে পুজোর বিষয় হল গোটা তিরিশেক গান, গোটা দশেক কবিতা, আর নৃত্যনাট্য যেমন শ্যামা, নটির পূজা, চিত্রাঙ্গদা। ইন্টেলেকচুয়াল গোছের মানুষেরা একটু এগিয়ে ড্রইং-রুমে বা আলোচনা সভায় ‘রক্ত করবী’ বা ‘সভ্যতার সংকট’ নিয়ে কথা বলেন। অথচ শতাব্দীর অন্যতম সেরা চিন্তাশীল মানুষটি দীর্ঘ জীবনে লিখে গেছেন ভলিউমের পর ভলিউম। মানুষটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ইনস্টিটিউশন। চেষ্টা করেছেন গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি সাধনের তথা কৃষির আধুনিকীকরণের। মেজরিটির বিরুদ্ধে, একলা মানুষটি প্রতিবাদ করেছেন গান্ধীজির বিদেশী সামগ্রী বর্জন আন্দোলনের। লিখেছেন ভারতীয় ইতিহাস চেতনা। নারী মুক্তির কথা বলেছেন। লিখে গেছেন যে, ডেভেলপমেন্টের নাম করে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম আসলে ধ্বংসকে আমন্ত্রণ করা। বলেন প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে টিকে থাকার কথা। প্রথম পরিবেশবিদ তিনি। যুদ্ধের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ এক প্রতিবাদী কণ্ঠ। ভবিষ্যত দ্রষ্টার মতো দেখেছিলেন পাশ্চাত্যের উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে যে সভ্যতার(civilization) সৃষ্টি হয়েছে তার সংকট। সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন বার বার। (Rabindranath Tagore)
পঁচিশে বৈশাখ বা বসন্ত উৎসবে পুজো হয়ে চলে সর্বত্র। আর সে পুজোর বিষয় হল গোটা তিরিশেক গান, গোটা দশেক কবিতা, আর নৃত্যনাট্য যেমন শ্যামা, নটির পূজা, চিত্রাঙ্গদা।
সেই মানুষটি আজ সীমাবদ্ধ হয়ে গেলেন গোটা কয়েক গান, কবিতা আর নাটকের মধ্যে। সেও ভালো, কারণ আরও অনেকে হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে। পৃথিবীতে “দাগ” রেখে যাওয়া বড় শক্ত।
উচ্চবিত্ত বন্ধুদের মুখে শোনা তাঁদের শান্তিনিকেতনের বাড়ির কথা। প্রতি বছর নিয়ম করে নিষ্ঠার সঙ্গে এক-দু’দিনের জন্য সেখানে যাওয়া এবং ছাতিমতলা ইত্যাদি ঘুরে দেখা। একটু রবীন্দ্রসঙ্গীত, সঙ্গে আরেকটু বাউল গান এবং গুছিয়ে খাওয়া দাওয়া; তারপর তুমুল যানজট কাটিয়ে শক্তিগড়ে ল্যাংচা খেয়ে কলকাতা ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। আপওয়ার্ডলি মোবাইল মধ্যবিত্ত বাঙালির স্ট্যাটাস সিম্বল– ‘রবীন্দ্রনাথ’। অনেকে বাউল গান নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠেন, অনেকে মেতে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের খাওয়া দাওয়া নিয়ে, আবার অনেকে সুনীলের বা রঞ্জনের লেখা পড়ে মেতে ওঠেন আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে। সঙ্গে একাধিক নারীর প্রসঙ্গ। কেচ্ছা খুব মনোহরণ। কলকাতার ইদানিং তৈরি হওয়া হাইরাইজের কুড়ি তলার অ্যাপার্টমেন্টের লিভিং আর ডাইনিং এরিয়ার মাঝে দেওয়ালে শোভা পায়– একতারা; আর রবীন্দ্রনাথের বিমূর্ত ছবি, রামকিঙ্কর বেইজ। (Rabindranath Tagore)
উচ্চবিত্ত বন্ধুদের মুখে শোনা তাঁদের শান্তিনিকেতনের বাড়ির কথা। প্রতি বছর নিয়ম করে নিষ্ঠার সঙ্গে এক-দু’দিনের জন্য সেখানে যাওয়া এবং ছাতিমতলা ইত্যাদি ঘুরে দেখা।
গভীরে তিনি নেই। আছেন গর্বের জায়গা হয়ে। পৌত্তলিক পূজা হয়ে। তাঁকে নিয়ে দেখি কিছু মানুষের অসহিষ্ণুতা। এক বন্ধু কবিগুরুর কিছু লাইন মজা করে চেঞ্জ করে পোস্ট করেছেন। আরেক বন্ধু দেখি আজকের ভাষায় “ঘেঁটে ঘ।” এসব করার সাহস আসে কোত্থেকে। তাঁকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করা গেল। শোনা গেল যে তিনি সম্প্রতি রীতিমতো ইস্কুলের ক্লাস করে “রবীন্দ্রনাথ” শিখেছেন। সেখানে খাপ না খোলাই ভালো। অথচ আশির দশকের মাঝামাঝি কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মনে পড়ে, নানারকম পড়াশোনার রেওয়াজ ছিল না, কিন্তু সেনস অফ হিউমার ছিল। কথায় কথায় এত মত্ততা, এত অসহিষ্ণুতা ছিল না। ক্যান্টিনে রীতিমতো টেবিল বাজিয়ে গানের প্যারোডি করা হত এবং মজা নিতে বিরত হত না কেউ– কংগ্রেসপন্থী, বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, অতিবাম এবং সাধারণ ছাত্ররা। আজকের দিনে সেসব প্যারোডি করা শরীরের পক্ষে হানিকারক। যুগ পাল্টে গেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আছেন। (Rabindranath Tagore)
ঋকবেদের প্রথম মন্ত্র অগ্নির। “অগ্নিমীলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজম্। হোতারং রত্নধাতমম্।”
উপসংহার:
ঋকবেদের প্রথম মন্ত্র অগ্নির। “অগ্নিমীলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজম্। হোতারং রত্নধাতমম্।” এই মন্ত্রের রচয়িতা থেকে শুরু করে, উপনিষদের ঋষিদের হয়ে, আদি কবিকে স্পর্শ করে, লুইপা, কাহ্নপার দোঁহা হয়ে, কালিদাসকে ছুঁয়ে, পদাবলীর গীতিকারদের পথ ধরে ভারত সাধনার প্রবাহিত ধারা রবীন্দ্রনাথে এসে সম্মিলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এককভাবে ভারত সাধনার হাজার বছরের প্রতিরূপ। ভারতবর্ষের ইতিহাস চেতনার প্রতীক। মহাদেবের জটা থেকে নির্গত গঙ্গা যেমন বয়ে চলেন সাগরের দিকে, পথে মিলে মিশে এক হয়ে যায় বহু স্রোতস্বিনী, তেমনই প্রবাহিত রবীন্দ্রনাথে মিলে এক হয়ে যায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ভাবনা, বাউলের মরমিয়া তত্ত্ব, এবং রেনেসাঁ ভারতের নবজাগরিত চেতনা। একক মানুষের বিস্ময়কর প্রতিভা তিনি। তাঁকে আমাদের প্রণাম করতে হয় না কারণ তিনি আমাদের প্রণত করান।
আজও “বসন্তের মাতাল সমীরণে” রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে, “আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে” রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে, “হিমের রাতে” রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে, “শারদপ্রাতে” রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে, “হেমন্তে কোন বসন্তে” রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে, “দারুণ অগ্নিবাণে” রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে। (Rabindranath Tagore)
অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কাজের ক্ষেত্র তথ্যপ্রযুক্তি। কিছুদিন স্মার্ট সিটিতে কাজ করেছেন। আড্ডাবাজ মানুষ। বইপড়া আর সিনেমা দেখা নেশা। কাজের সুত্রে সলিউশন ব্লুপ্রিন্ট, স্পেক্স, প্রপোজাল ইত্যাদি অনেক লিখেছেন। ইদানিং বাংলায় প্রবন্ধ, গল্প, ফিল্ম রিভিউ লেখার একটা চেষ্টা চলছে।