(Arunachal Pradesh) বাগানের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তাটা সোজা চলে গেছে নদীর ধারে। নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। উল্টোদিকের পাহাড়টার দিকে তাকালেই সেই গানটার কথা মনে হচ্ছে, “সবুজ পাহাড় ডাকে আয়রে ছুটে আয়”। সে গানেও তো আছে অহমিয়া সুর!

কাচের ঘরটার মধ্যে অর্কিডগুলো যত্ন করে সাজানো। নাম ধাম বংশপরিচয়ও লেখা আছে। বাগানে এক পাক ঘুরে এসেছি। সেভাবে বুনো ফুলের দেখা মেলেনি। বর্ষাতেই এদের বাড়বাড়ন্ত। এখন তো পাতা ঝরার দিন।
আরও পড়ুন: তুষার নিসর্গে মোহময়ী আউলি
টিপি অর্কিড রিসার্চ সেন্টার, দুষ্প্রাপ্য কিছু অর্কিডের সংগ্রহশালাও বলা যেতে পারে। কিন্তু আমার তাতে বিশেষ আগ্রহ ছিল না। বরং সবুজ মেশানো নীল শীর্ণকায়া কামেং নদীই বড় বেশি টানছিল। মনে হচ্ছিল, দু দণ্ড এখানে বসি। কিন্তু তার কি জো আছে? ড্রাইভার সাহেব সৈয়দ তাড়া দিচ্ছে, “জলদি! রাস্তেমে অউর বহুত কুছ দেখনা হ্যায়”। ঠিকই তো! অনেকটা পথও তো যেতে হবে! প্রায় ১৩৭ কিলোমিটার। অগত্যা, মন দরিয়ায় ডুব দেওয়ার উপায় নেই।

অরুণাচল প্রদেশের ভালুকপং থেকে রওনা দিয়েছি বেশ সকাল সকাল। ৫ কিলোমিটার দূরে এই অর্কিড সেন্টারটা দেখে আবার এগিয়ে চলা। পথের ধারে একটা ঝরনার পাশে গাড়ি থামল। রূপের তেমন বাহার না থাকলেও সেলফি পয়েন্ট হিসেবে মন্দ নয়। ছোট্ট বিরতিতে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে খাওয়ার এটাই আদর্শ জায়গা।

শ’য়ে শ’য়ে হেয়ার পিন বাঁক। সবুজ পাহাড় ঘেরা মনোরম প্রকৃতি মন কেড়ে নেয়। পথের ধারে গাছ ভর্তি কমলালেবু আর তারই কাছাকাছি বিক্রেতারা লেবুর সাজিয়ে বসে আছে খদ্দেরের অপেক্ষায়। একটা হ্যাঙ্গিং ব্রিজের কাছে এসে এমনই এক খুদে বিক্রেতার দেখা পেলাম। ব্রিজে ওঠার মুখে দুহাত ছড়িয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো। শর্ত একটাই, তার কাছ থেকে লেবু কিনতে হবে, তবেই সে পথ থেকে সরে দাঁড়াবে। দুষ্টুমি করে বলল, “প্যাহেলে পাসওয়ার্ড, বিশ রুপিয়া”।

খানিকটা চলার পর পৌঁছলাম টেঙ্গাভ্যালি। এই জনপদের অনেকটা অংশ জুড়ে সেনাবাহিনীর ছাউনি। আর্মি হসপিটাল থেকে সর্বধর্ম প্রার্থনাস্থল, বাজার, স্কুল সবই রয়েছে।
দুপুর দুপুর পৌঁছলাম বমডিলা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। এখানে এসেই সেটা প্রথমবারের জন্য অনুভব করলাম, কনকনে পাহাড়ি ঠান্ডা। একটা রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে বমডিলা মনাস্ট্রি দেখতে চললাম। একটু উপরের দিকে শহর থেকে খানিক দূরে নিরিবিলিতে মনাস্ট্রির অবস্থান। লম্বা লম্বা পাইন ঘেরা পাহাড়ি ঢালে হোস্টেল, গেস্ট হাউস, গুম্ফা মন্দির, চোর্তেন, সবকিছু নিয়ে বিশাল চত্বর। শিশু লামারা ছুটোছুটি করে খেলছে আর সদ্য কৈশোর পেরোনো’রা ক্রিকেট খেলায় মত্ত।

জুতো খুলে ঢুকে পড়লাম মনাস্ট্রির ভেতরে। সোনার পাতে মোড়া বিশাল এক বুদ্ধমূর্তি। আধো আলোয় দেওয়ালে বেশ কিছু ফ্রেস্কো পেন্টিং নজরে এলো। যেখানে মূলত জাতকের কাহিনী অলংকরণ করা হয়েছে।
সূর্য কাত হয়েছে পাহাড়ের আড়ালে। পাহাড়ে এমনিতেই ঝুপ্ করে সন্ধ্যে নামে। ভারতের পূর্ব প্রান্তে এ রাজ্য তো ‘দা ল্যান্ড অফ রাইজিং সান’। ভোরের প্রথম আলো যেমন দেখে, সন্ধ্যেও নামে সবার আগে। চারটে বাজলেই আলো ক্রমে ফিকে হয়ে যায়।

দিরাং পৌঁছতে প্রায় ঘন্টা দেড়েক সময় লাগলো। ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল সাড়ে চারটে পেরিয়েছে। সমান্তরালে বয়ে চলেছে দিরাং নদী। জমজমাট পাহাড়ি জনপদ। মূল সড়ক সোজা চলে গেছে তাওয়াং-এর দিকে। আমরা সে পথ ছেড়ে ডানদিকের সরু রাস্তাটা ধরে এগিয়ে চললাম। পিছনে রয়ে গেলো ব্যস্ত দিরাং শহর।
এতক্ষণ রাস্তা ছিল পিচপালিশ মসৃণ। এবার সর্পিল পাহাড়ি পথে ঝাঁকুনি শুরু হল। কাঁচা রাস্তা এতটাই সরু যে উল্টোদিক থেকে গাড়ি এলে আটকে যাওয়ার উপক্রম। প্রায় ৪০ মিনিট পর গ্রামের দেখা পেলাম। ছোট ছোট বাড়ির বারান্দায় ফুলের টব সাজানো। মাঝে মাঝে কিছু মুদির দোকান। সেখানে চাল ডাল তেল নুন তো আছেই, একইসঙ্গে সবজি আর শুঁটকি মাছও বিক্রি হচ্ছে। সাইনবোর্ডের ঠিকানায় লেখা আছে সাংতি ভ্যালি। আজ এখানেই আমাদের রাত্রিবাস। (Arunachal Pradesh)

এবার অগ্রিম বুকিং করা হোমস্টে খোঁজার পালা। জিপিএস অন করেছে সৈয়দ। সবেমাত্র সাড়ে পাঁচটা। দিনের আলো ফুরিয়েছে। মালিকের নাম নরবু ওয়াংদি। নেটওয়ার্ক খুবই দুর্বল। সৈয়দ ফোন নাম্বার নিয়ে বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং অনেকক্ষণ পর তাকে পাওয়া গেল। নরবুর পথ নির্দেশিকা মেনে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গাড়ি নামতে লাগলো। সাংতি নদীর ধারে নিরিবিলিতে আজকের অস্থায়ী আস্তানা। (Arunachal Pradesh)
অনেকটা ছড়ানো জায়গা নিয়ে হোমস্টের চত্বর। নদীর গা ঘেঁষে কয়েকটা কটেজ আর তাঁবু, মাঝখানে খালি উঠোন। তিনটে কটেজে আমাদের নয় জনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। খাসা বন্দোবস্ত।
অনেকগুলো ধাপ নেমে পৌঁছে গেলাম লেকের কাছে। জল কিছুটা জমাট বেঁধেছে। মনে হচ্ছে কাচের পুরু পাত বসানো। বাকি অংশটুকু টলটলে। মেঘলা আকাশ আর পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি সেই জলে। ফ্রোজেন লেকে হাঁটতে পা হড়কে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে।
ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই দেখি গৃহকর্তা উঠোনের মাঝখানে কাঠকুটো জড়ো করে ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন করছেন। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা কেউ টুরিস্ট সামলাচ্ছেন, কেউ আবার রান্নাঘরে চা পাকোড়া বানাতে ব্যস্ত। অন্ধকার ঘন হয়েছে। উষ্ণতার পারদ ক্রমে নামছে। হাত পা সেঁকতে বেশ আরাম লাগছিল। তবু দু পা গ্রামের পথে হাঁটবো ভেবে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলাম। (Arunachal Pradesh)

কালো মেঘে জ্যোৎস্না ঢাকা পড়েছে। বৃষ্টি হবে বোধহয়। সাংতিকে দেখা না গেলেও নিশ্চুপ অন্ধকারে তার উদ্দামতার শব্দ স্পষ্ট। এদিকটায় আরও কয়েকটা হোমস্টে আছে। কিন্তু কিছুটা চলার পর বুঝতে পারলাম গ্রাম অনেকটাই দূরে। প্রকৃতির অন্ধকারে কালো বিষ। আমরা চলেছি যেন ছায়ামূর্তির মতো। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা, নিঝুম সন্ধ্যাকে মনে হচ্ছে গভীর রাত। টর্চের আলোটুকুই যা সম্বল। এরকম গা ছমছমে মুহূর্তে পথের দূরত্বকে বড্ড বেশি মনে হয়। ফিরে চললাম। (Arunachal Pradesh)
নদীর একদম গা ঘেঁষে, ঘেরা জায়গায়, খোলা আকাশের নিচে ডাইনিং-এর ব্যবস্থা। কিন্তু ওখানে আলোর ব্যবস্থা নেই। তাই উঠোনেই আগুনের কাছে টেবিল পেতে বড় বড় হটপটে ভাত, রুটি, ডাল, সবজি, চিকেন কারি, স্যালাড গুছিয়ে রেখে গেছে। আগুনের আঁচও কমে এসেছে। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘরে ঢুকে কম্বলের আরাম। (Arunachal Pradesh)

সকালে উঠে ডাইনিং এরিয়াতে চা খেতে এলাম। হালকা কুয়াশা থাকলেও আকাশ ফর্সা। সাংতি নদী তীব্র বেগে ছোট বড় নানান পাথর খণ্ডের উপর দিয়ে নাচতে নাচতে চলেছে। এই নদী ১৫ কিলোমিটার দূরে দিরাং নদীর সঙ্গে মিলেছে। সূর্যের আলোয় চিক্ চিক্ করছে তার স্বচ্ছ জল। নদীর এপার ওপার জুড়ে পার্থনা পতাকা হাওয়ায় উড়ছে। (Arunachal Pradesh)
সকাল ন’টা নাগাদ সাংতি ভ্যালিকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম তাওয়াং-এর পথে। দূরত্ব প্রায় ১৪৩ কিলোমিটার। গতকাল আসার সময় অন্ধকারে গ্রামটাকে ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। এখন দিনের আলোয় মায়াঘেরা পথ ধরে চলতে চলতে মনে হচ্ছে জল রঙে আঁকা ল্যান্ডস্কেপ। বড্ড ভুল হয়ে গেল, একটা গোটা দিন রাখা উচিত ছিল সাংতি ভ্যালির জন্য। এই উপত্যকার নির্জনতাই এর বড় আকর্ষণ। বাজার এলাকায় অবশ্য কর্মব্যস্ততার ছবি। বাচ্চারা পথের ধারে খেলছে, কেউ স্কুলে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে হাত নাড়ছে। (Arunachal Pradesh)

সেই বড় রাস্তাটায় এসে পড়েছি, দিরাং টাউন। সৈয়দ আমাদের দিরাং মনাস্ট্রি দেখিয়ে তারপর তাওয়াং-এর পথে এগোবে। বেশ বড় মনাস্ট্রি। প্রবেশের মুখে সুন্দর কারুকার্য করা চোর্তেন। তিন খেপে সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছে গেলাম উপরে, মনাস্ট্রির কাছে। সুন্দর বাগান। ভেতরে বিশাল বুদ্ধমূর্তি। চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা বিস্তৃত উপত্যকার শোভা। নিচে বয়ে চলেছে দিরাং নদী। (Arunachal Pradesh)

বেলা প্রায় এগারোটা। পাকদণ্ডী পথ ধরে আবার চলা শুরু। একনাগাড়ে শুধুই চড়াই। গাছপালা ক্রমে কমছে। সবুজ উধাও। বাদামি পাহাড়ের রুক্ষতা ক্রমে প্রকট হচ্ছে। মাথাগুলো চুন ছড়ানো বরফে ঢাকা। সেনাবাহিনীর ছাউনি শুরু হয়ে গেছে। সৈয়দ জানালো, সেলা পাসের কাছাকাছি চলে এসেছি। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই দিরাং ভ্যালির ৪৯০০ ফিট থেকে একেবারে ১৩৭০০ ফিট উচ্চতায় পৌঁছলাম, সেলা টপে। (Arunachal Pradesh)

গাড়ি থেকে নামতেই ঝোড়ো হাওয়ার তীব্রতা কামড় বসাতে শুরু করল। সেলা টপে রয়েছে বিশাল এক তোরণ। সেনা ছাউনি, শিব মন্দির আর অজস্র রঙিন প্রার্থনা পতাকা। উপর থেকেই দেখা যাচ্ছে বরফের সাদা চাদরে মোড়া সেলা লেককে। পর্যটকরা জমাট বাঁধা লেকের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে। (Arunachal Pradesh)

অনেকগুলো ধাপ নেমে পৌঁছে গেলাম লেকের কাছে। জল কিছুটা জমাট বেঁধেছে। মনে হচ্ছে কাচের পুরু পাত বসানো। বাকি অংশটুকু টলটলে। মেঘলা আকাশ আর পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি সেই জলে। ফ্রোজেন লেকে হাঁটতে পা হড়কে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। সাবান জলের উপর দিয়ে হাঁটার অনুভূতি। তবে এ বড়ো আনন্দের অভিজ্ঞতা! (Arunachal Pradesh)

পাশাপাশি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এক জায়গায় বরফে ফাটল ধরেছে আর সেখান থেকে বুদবুদ উঠছে। বোঝা গেল, ওই জায়গায় বরফ গলে গেছে। এটা খুবই বিপদজনক। পর্যটকদের অনেকেই সেটা লক্ষ্য করেছেন এবং একে অপরকে সাবধান করছেন, “ওদিকটা যাবেন না”। বেশিক্ষণ এখানে হাঁটাহাঁটি না করাটাই ভালো। (Arunachal Pradesh)
নীল আকাশের গায়ে কালো মেঘের ছোপ। আধঘন্টা মতো ছিলাম লেকের কাছে। কোথা থেকে ফগ এসে ঢেকে দিচ্ছে চারপাশ। এক দু ফোঁটা গায়ে পড়ল। দম ফাটানো চড়াই। ঝোড়ো বাতাস সামলে হাঁপাতে হাঁপাতে ওঠা। বেলা প্রায় পৌনে দুটো। খুবই খিদে পেয়েছে সবার। তাছাড়া এই প্রবল শীতে একটু গরম কিছু খাওয়া দরকার। স্থানীয় ক্যান্টিনটায় ঢুকলাম।সেখানে বেশ ভিড়। খাবার বানাতে অনেক দেরি হবে। অগত্যা শুধু কফি খেয়ে বেরিয়ে এলাম। (Arunachal Pradesh)
প্রয়োজনীয় তথ্য:
অরুণাচল প্রদেশ ভ্রমণে ইনারলাইন পারমিট লাগে। অনলাইনে পারমিট পেতে ওয়েবসাইট দেখুন – https://eilp.arunachal.gov.in/
থাকা: ভালুকপং-এ থাকার জন্য অনেক হোটেল আছে। সাংতি ভ্যালিতে থাকার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন – নরবু ওয়াংদি (৮৪১৩০ ৪০৬৮৭)
যাতায়াত: ট্রেনে বা বিমানে গুয়াহাটি পৌঁছে সেখান থেকে ভাড়াগাড়িতে অরুণাচল বেড়ানো সুবিধাজনক। তেজপুর থেকেও ভ্রমণ শুরু করা যেতে পারে। গাড়ির জন্য যোগাযোগ – সৈয়দ ইসলাম (৬০২৬৫ ৭২৬০৬, ৯৯৫৭০ ৫৭৫১৬)
ছবি: লেখক
পরবর্তী পর্ব: ১৮ মার্চ, ২০২৫
দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, প্রতিদিন, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো আর ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি।